#এক_শহর_প্রেম?,04,05
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
অডিটোরিয়ামের ভেতর ঢুকবে কি ঢুকবে না, তাই ভাবছে আদিরা। অস্বস্থি ও ভয় হচ্ছে তার। নাচের সময় মারসাদের করা বাধ্যগত স্পর্শগুলোও তার স্নায়ুতন্ত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এখনও ভাবলে তার শুভ্র কায়া কেঁপে উঠে। প্রায় পাঁচ মিনিট হলো আদিরা অডিটোরিয়ামের বাহিরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি করছে। হঠাৎ একজোড়া হাত তার কাঁধ স্পর্শ করে বার দুয়েক ডাক দিলো। আদিরা হকচকিয়ে গিয়ে পেছোনে ফিরে ভূ’ত দেখার মতো চমকে গেলো। পেছোনে মারসাদ হাস্যজ্বল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মারসাদ নিজেও অডিটোরিয়ামের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে বলল,
–আমাকে দেখা যাচ্ছে না কেনো? কতো চেষ্টা করছো দেখতে যে আমার মতো ব’দ লোকটা ভেতরে আছে কী-না? কিন্তু আফসোস! ব’দ লোকটা একটু চোখ-মুখ ধুতে গিয়েছিল। কী করবে এখন?
আদিরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। লোকটা নিজের মতো করে প্রলাপ বকে যাচ্ছে। ওর মনের কথাগুলোও বলে দিচ্ছে। আদিরা মনে মনে ভাবে,
“সে জানলো কী করে যে আমি কী করছিলাম?”
মারসাদ হাই তুলতে তুলতে বলে,
–তুমি বড্ড জোরে জোরে চিন্তা করো মিস পার্পল কুইন। উপস রেড কুইন! অসাধারণ কিছু চিন্তা করোই না যা আমি ধরতে পারবো না। যাইহোক। চলো। প্রতিটা স্টেপ কয়েকবার করে মেমোরাইজ করবে। তোমার মার্কশিট দেখলাম। কোয়াইট ব্রিলিয়ান্ট তুমি। ডান্স স্টেপ গুলো তো আর অতো কঠিন না তোমার ফেভারিট সাবজেক্ট বায়োলজির ঘাসফড়িং, রুইমাছ ও শ্বশনের চাপ্টারের মতো। আয়ত্তে চলে আসবে। লেটস গো।
আদিরা মারসাদের দেওয়া অদ্ভুত উদাহারণটা ঠিক মেলাতে পারলো না। সে তাও কিছু বলল না। মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভেতরে ঢুকে পিছু পিছু আদিরাও ঢুকে। মৌমিরা নাচের স্টেপ আবারও দুয়েকবার দেখিয়ে দিয়ে ওরা প্র্যাকটিস করে।
________
ঝড়ো হাওয়ায় দুলছে প্রকৃতি। সন্ধ্যা নামতেই ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির ছাঁট। আদিরা মেসের জানালার গ্রিল ধরে একটা কপাট খোলা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ তো সেই কখন চলে গেছে। অন্ধকারে সে বৃষ্টি দেখছে। খুব করে মন চাচ্ছে বাহিরে গিয়ে এই বর্ষণে নিজেকে বিলীন করতে। আদিরার গ্রামের কথা মনে পরছে। জৈষ্ঠ মাসের শুরু। এখন ঝড়বৃষ্টিতে ঘরের চালে টুপটুপ করে কাঁচা-পাকা আমি পরতো বৃষ্টির সাথে সাথে। টিনের চালে বৃষ্টির অনবরত টুপটুপ করে পরা এক ছন্দ তৈরি করে সাথে হঠাৎ হঠাৎ আম পরলে সেই ছন্দে ভিন্নতা আনতো। আদিরা ও তার ভাই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে বাড়ির পেছোনের আম গাছ দুটোর কাছে চলে যেতো। উঠোনে পানি জমে ছলাৎছলাৎ দৃশ্য। দুই ভাই-বোনের দুষ্টুমি আর মায়ের বারণ করা চিৎকার চেঁচামেচি খুব খুব মিস করছে সে।
আদিরার এক রুমমেটের চিৎকার তার কানে আসলো,
–এই মেয়ে জানালা বন্ধ করো। কতক্ষণ ধরে বলছি সে তো শুনছেই না। বৃষ্টির পানিতে পুরো রুম ভিজে যাচ্ছে আর সে জানালা দিয়ে বৃষ্টিবিলাশ করছে। এই মেয়ে দেখতে পারছো না? এটা পশ্চিমা বৃষ্টি আর জানালাটাও পশ্চিম দিকে। বন্ধ করো এখুনি।
আদিরা মলিন হেসে জানালার কপাট লাগিয়ে দিলো। নিজের জন্য বরাদ্ধ করা খাটে বসে। প্রকৃতির রুদ্ররূপ এখন বন্ধ জানালা দিয়ে অবলোকন করছে আদিরা। আদিরা মনে মনে আওড়ায়,
“এই শহর যান্ত্রিক। প্রকৃতির হাসি কান্না কিছুই তাদের হৃদয় ছোঁয় না। প্রেম তো হারিয়েই গেছে। ব্যাস্ত যার যার জীবন নিয়ে। এই শহর কী আমায় আপনা করবে?”
_________
ভার্সিটিতে স্টেজ সাঁজানো হচ্ছে। গতকালের বৃষ্টিতে মাটি কিছুটা কর্দমাক্ত। এখন হালকা বালি দিয়ে দিয়ে কাঁদামাটি শুকানোর চেষ্টা চলছে। আদিরা গেট দিয়ে ঢোকার পর কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে শয়ে শয়ে ভেজা কৃষ্ণচূড়া বৃষ্টিতে সিক্ত রাস্তায় বিছিয়ে থাকতে দেখেছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল তুলে নিয়েছিল এখন গেছে বড়ো কড়ই গাছটার কাছে। কড়ই গাছটার নিচে চাদরের মতো ভেজা ফুল ছড়িয়ে আছে। আস্ত ফুল পাওয়াই মুশকিল। কড়ই গাছটার কাছে মাটিও কর্দমাক্ত। পা টিপে টিপে গিয়ে দুই-তিনটা ফুল তুলে নিলো আদিরা। এখন ব্যাগ থেকে সুতা বের করে বেঁধে নিলো। আদিরা বাম পাশে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে কাঠের তৈরি ছবি আঁকতে সাহায্য করে এমন কিছুতে কাগজ সেঁটে কিছু আঁকছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আদিরার কৌতুহল হলো। সে একটু এগিয়ে গিয়ে মাহিকে দেখতে পেলো। আদিরা মাহির পেছোনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে মাহি কী আঁকছে।
আচমকা মাহি ক্যানভাসে রঙ তুলির সামাঞ্জস্য করতে করতে বলে উঠলো,
–কী দেখছিস আদু?
অবাক হয় আদিরা। তারপর বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–তুমি বুঝলে কি করে?
মাহি মুচকি হাসে। ধ্যান তার চিত্র আঁকাতে। হেয়ালি করে বলে,
–কড়ই ফুলের সমারোহে এক পার্পল ফেইরি! সুন্দর না?
আদিরা ক্যানভাসে চিত্রটা দেখে অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,
–তুমি এতো সুন্দর করে কী করে আঁকলে? চিত্রটা অসম্ভব সুন্দর।
মাহি আঁকতে আঁকতে বলে,
–তুমি আমার ক্যানভাসে এসে এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছো। আমি তো সিক্ত কড়ই গাছটার নিচে ফুলের সমারোহ চিত্রে ফুটিয়ে তুলছিলাম মাত্র। তখনি এক বেগুনী পরীর আবির্ভাব। এই যান্ত্রিক শহরে গোলাপ, বেলির মতো কিছুটা কৃষ্ণচূড়াকেও প্রাধান্য দেওয়া হয় কিন্তু কড়ই ফুলের সৌন্দর্য সবাই বুঝতে পারে না। কড়ই ফুলও যে মুগ্ধতা ছড়াতে পারে তা সবাই বুঝে না। অবশ্য গোলাপ ছাড়া অন্য ফুলের প্রাধান্যও কম দেখা যায়।
আদিরা চিত্রর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহি আদিরার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে বলে,
–আমি তো চিত্রটা দেখে দেখে আঁকলাম। তবে দাভাই এটা না দেখেও শুধু ফিল করে আঁকতে পারবে। চেহারা আঁকতে ছবি দেখতে হয় কিন্তু প্রকৃতি আঁকতেও আমার সেটাকে সামনে রেখে আঁকতে হয় নয়তো খুঁতখুঁত লাগে। দাভাই এটা আঁকলে কল্পনা করে বা মাত্র এক-দুইবার দেখে এঁকে ফেলতে পারতো।
আদিরা উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
–তুমিও দারুন আঁকো। চিত্রটা দেখে আমি অনেক অবাক হয়ে গিয়েছি। এতো সুন্দর হচ্ছে বলার মতো না। তোমরা কী ছবি আঁকা শিখেছো?
মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–নাহ! আমি দাভাইকে দেখে শিখেছি। আমার বাবাও খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। কিন্তু তার রঙ হারিয়ে গেছে। তার ক্যানভাস শূণ্য থাকে এখন। দাভাই ছোট বেলায় অনেক আঁকতো। আর বড় হয়েও তার আঁকা অনেক চিত্র দেখেছি। দাভাই এখন ছবি আঁকে খুব কম। সে নিরালায় ছবি আঁকে। যাইহোক। আমার আর একটু বাকি আছে। ফুলগুলোতে আরেকটু রঙ দিবো।
আদিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাকিটুকু আঁকা দেখে। ছবি আঁকা হলে মাহি ও আদিরা ডিপার্টমেন্টের একটা রুমে ছবিটা শুকাতে রেখে আসে। তারপর ওরা স্টেজ যেখানে সাঁজাচ্ছে সেখানে যায়। ওরা ঘুরে ঘুরে দেখছিল তখনি সেখানে মৌমি এসে হড়বড়িয়ে বলে,
–তোমাকে আমি কতো খুঁজলাম জুলোজি ডিপার্টমেন্টে আদিরা! কই ছিলে? জলদি চলো। তোমাকে লাস্ট টাইম প্র্যাকটিস করতে হবে তো। কোনো ব্লান্ডার করা যাবে না।
মাহি মৌমিকে হুট করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আপিইইই! ইশ তোমাকে ব্লু শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে গো। আমিই তো ক্রাশ খেয়ে গেলাম তাহলে জিজু কী পরিমান ফিদা হবে ভাবতো?
মৌমি মাহিকে জড়িয়ে বলে,
–থাংকু মাহি বাচ্চাটা। তোমাকে তো পুতুলের মতো লাগছে। শাড়ি পড়লে না কেনো?
মাহি মুখ লটকিয়ে বলে,
–শাড়ি! কে পড়িয়ে দিবে বলোতো? আমার মা! বাদ দেও। আদু কী ডান্স করবে নাকি?
মৌমি হাস্যজ্বল প্রতিউত্তর করে,
–হ্যাঁ। তোমার ভাইয়ের সাথে।
মাহি উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
–ওয়াও গ্রেট।
আদিরা তো হতভম্ব।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,
#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
মারসাদ মাহির ভাই এটা জানতে পেরে আদিরা তাজ্জব বনে যায়। আদিরা হতভম্ব হয়ে বলে,
–উনি তোমার ভাই? কিন্তু….
মাহি ভ্রুঁ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–কিন্তু কী?
আদিরা মুখ ছোট করে বলে,
–কিছু না। যাই আমি হ্যাঁ। নাচ তো বাধ্যতামূলক করতেই হবে। কিছু করার নেই। থাকো তুমি। মৌমি আপু চলো।
আদিরা মৌমির সাথে চলে গেলে মাহি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্টেজে লাগানো ফুলের কম্বিনেশন দেখছে।
–এই মেয়ে তুমি আজও শার্ট-প্যান্ট পড়েছ?
আকস্মিক পুরুষালী কন্ঠস্বরের ধ’মকে ঘুরে তাকালো মাহি। তীক্ষ্ম নয়নজোড়া কন্ঠস্বরের অধিকারী পুরুষটিকে দেখছে। মাহি ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
–তো!
পুরুষটি তার সোচ্চার করা কন্ঠস্বরে বলে,
–আজ একটা অনুষ্ঠান আর তুমি এসব পড়েছ? শাড়ি পড়লেও পারতে। আর শাড়ি না থাকলে বলতে আমায়।
রাগে কটমট করে উঠে মাহি। বলে কীনা শাড়ি নেই তার কাছে। মাহি খলবলিয়ে বলে,
–ও মিস্টার! শাড়ি কিনতে চাইলে আমি যত ইচ্ছা কিনতে পারি। আপনারটা নিতে যাবো কেন? আপনার কেনা শাড়ি আপনি আপনার বউকে পড়াইয়েন। আপনার ভবিষ্যৎ বউকে সারাদিন শাড়ি পড়িয়ে নিজের সামনে সং সাঁজায়ে রাখবেন। তাও আমাকে বলতে আসবেন না। যান ফু’টেন এখান থেকে।
আলতো হাসলো পুরুষটি। পরক্ষনেই বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে,
–তুমিই হবে এই আহনাফ ইকবালের বউ। তখন সারাদিন চব্বিশঘণ্টা শাড়ি পড়িয়ে বসিয়ে রাখবো মেয়ে!
মাহি কান খাড়া করে আহনাফের বিড়বিড় করা বুলি শুনতে চাইলো কিন্তু মাঝের দূরত্ব কয়েক হাত হওয়ায় তা সম্ভপর হলো না। মাহি তীক্ষ্ম নজরে আহনাফকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–এই আপনি বিড়বিড় করে কী বলছেন? আপনি মানুষটা এতো বিড়বিড় করেন কেনো বলেন তো?
আহনাফ হেসে পকেটে হাত গুঁজে বলে,
–তুমি কৌতুহল দেখাও তাই। সেসব বাদ দেও। আমি সুমিকে বলছি তোমার জন্য শাড়ি ও শাড়ি পড়ানোর ব্যাবস্থা করতে।
মাহি ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
–নাআআ। এই কাঁদা বৃষ্টির মধ্যে আমা শাড়ি কখনোই পড়বো না। আমার এমনিতেও শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই। এই এই আপনি চট্টগ্রাম থেকে এখানে কেনো এলেন? আমাকে জ্বালাতে? আমার ভাইটাও যে কেনো আপনি বলতে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এলো! আপনারা দুটোই হচ্ছেন মা’থামোটা। এসেছেন যখন তখন আমাকেই বা এখানেই কেনও চান্স পেতে হলো! আ’জব কিসমত আমার।
মাহির হাহুতাশ শুনে আহনাফ উচ্চস্বরে হেসে দিলো। আহনাফের হাসি দেখে মাহি নাক ফুলিয়ে ফুঁসছে। আহনাফ সামনে এগিয়ে মাহির নাকে টোকা দেয় যার বৌদলতে মাহি একটু সরে গিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে চাইল। আহনাফ বলে,
–আমি মারসাদের জন্য চবি ছেড়েছি আর মারসাদ ঢাবি ছেড়েছে। এক বছর লস হলেও আমরা দুই বন্ধু একসাথে আছি এখন এবং নিজেদের পছন্দের সাবজেক্টে। তাই আমাদের কোনে আফসোস নেই।
মাহি কিছু বলল না। তার ফোন বেজে উঠলে সে কথা বলতে বলতে আশেপাশে দেখে সামনে আরেক বান্ধুবীকে দেখে আহনাফকে হাতের ইশারায় বিদায় জানিয়ে চলে যায়। আহনাফ মুচকি হেসে স্বগোতক্তি করে,
“তোমার নীড় আমাতে হবে মাহিপাখি!”
__________________
প্র্যাকটিস শেষ করে আদিরা চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এর আগে সে কখনও স্টেজে নাচ করেনি। স্কুলে একবার স্টেজে কবিতা আবৃতি করে দ্বিতীয় হয়েছিল। তার চিন্তায় জোর খিদে পাচ্ছে। পাশে রাখা পানির বোতল থেকে বারবার পানি পান করছে। মারসাদ দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করে নিরবে হাসছে। স্টেজ পারফর্মেন্স আরও দুই ঘন্টা পরে। এর আগে আরেকবার লাস্ট ফিনিশিং দেখানো হবে। আদিরাকে স্বস্থি দিতে সেখানে মাহি আসে। মাহি এসে মারসাদকে জড়িয়ে ধরে। মারসাদও ছোটোবোনকে আলতোভাবে নিজের সাথে আগলে নেয়। মাহি মারসাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে,
–দাভাই তুমি পঁচা। কাল বাসায় গেলে কিন্তু আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলে। আমি জানতে পেরে খুব রাগ করেছি তোমার উপর।
মারসাদ মাহির চুল হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে আদুরে সুরে বলে,
–তুই তো ঘুমোচ্ছিলিস পাখি। দাদী বলল মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়েছিস। তাই আর জাগাই নি।
মারসাদের জবাবে মাহি মুখ ভাড় করে বলে,
–রাতে থেকে আসতে পারতে। আমি তো অতো জলদিও ঘুমাই নি। তুমি গিয়েছিলেই রাত করে। রাতে তো থেমে থেমে বৃষ্টিও হয়েছে। থেকে আসতে রাতটা।
মারসাদ মলিন কন্ঠে বলে,
–না রে। আমার সাধ্য থাকলে আমি বহুদূরে চলে যেতাম। তোর আর দাদীর জন্য পারি না। তিন বছর আগে সেখান থেকে শূণ্য হাতে অনেক কিছু ছেড়ে চলে এসেছিলাম। জানি না কখনও ফিরবো কিনা। বাবা তো বাবাই। সে তার নিজের দুনিয়াতে ব্যাস্ত।
মাহি প্রতিউত্তরে কিছু বলবে তার আগেই মারসাদ থামিয়ে দিয়ে বলে,
–তোর বান্ধুবীর কাছে যা। বেচারি নার্ভাস হয়ে বারবার পানি খাচ্ছে। দেখ গিয়ে। সেন্স টেন্স হারালে প্রবলেম হয়ে যাবে কিন্তু।
মারসাদ সেখান থেকে চলে যায়। মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিরার কাছে যায়। আদিরা মাহিকে দেখে হড়বড়িয়ে বলে,
–মাহি আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে। হাত পা ঘেমে যাচ্ছে, বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আর খিদেও পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি পারর্ফম করতে পারবো না। খুব ভয় হচ্ছে।
মাহি আদিরার মন ডাইভার্ট করতে উচ্ছাসিত হয়ে বলল,
–সেসব পরে দেখা যাবে। আর আমার ভাই সামলে নিবে। আগে তুই বল, তুই পারর্ফমেন্সে কী ড্রেস পড়বি? গানের সাথে মিলিয়ে পড়িস।
আদিরা পাশ থেকে একটা ড্রেস বের করে মাহিকে দেখিয়ে বলে,
–এটা তোমার ভাইয়া দিয়ে বলল নাচের জন্য পড়তে।
মাহি ড্রেসটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদা রঙের জর্জেটের লং ঘেরালো কুর্তি সাথে পাজামা ও ওড়না। সব শুভ্রতায় রাঙানো। মাহি চোখের কোনে জমে উঠা জলের বিন্দু আঙুল দিয়ে মুছে ফেলে। তারপর ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে মলিন কন্ঠে বলে,
–ড্রেসটা খুব সুন্দর। তোকে খুব সুন্দর লাগবে। একদম এক পরীর মতো।
মাহি ড্রেসটা আদিরার হাতে দিয়ে চলে যায়। আদিরা মাহির চোখের কোনে জমে উঠা অশ্রকণা দেখেছিল। হুট করে হাসিখুশি মেয়েটার মনে আষাঢ় ঘিরে এলো কেনো তা তার বোধগম্য হলো না।
……..
শেষ সময়ের প্রস্তুতির সময় মারসাদ আদিরাকে বলে,
–শোনো, তুমি স্টেপ ভুলে গেলেও টেনশন করবে না। আমি যেই ফ্লোতে যাবো তুমিও সেই ফ্লোতে যাবে। না পারলে আমি আস্তে করে বলে বলে দিবো। বুঝেছো?
আদিরা মাথা নিচু করে ঘার নাড়ায়। মারসাদ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে স্টেজের পেছোন দিকে গান সেট করার ডিরেকশন দিতে চলে যায়। তখন সেখানে সামিরার আগমন ঘটে। সামিরা এসে আদিরার চারপাশে একবার ঘুরে এসে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
–কা’ককে পেখম লাগালে কা’কই লাগে। আমিও দেখব কী ডান্স করো স্টেজে। পুরো অডিয়েন্সের হাসির পাত্র হবে তুমি।
আদিরার নার্ভাসনেস যেনো আরও বেড়ে গেলো। মাহি তখন আদিরার থেকে কিছুটা দূরে ছিল। মাহি এসে সামিরাকে হাসিমুখে সুন্দর করে বলে,
–আহ! সামিরা আপু। বাদ দেও না। আদুর পারর্ফমেন্সে নিয়ে তোমাকে ভাবতেও হবে না। তুমি নিজের পারর্ফমেন্সে ধ্যান দেও তো বেটার হবে। আদুরটা দাভাই সামলে নিবে রিল্যাক্স।
সামিরা রাগে কটমট করে বলে,
–তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে? তুমি যে আমাকে একটুও পছন্দ করো না তা আমার জানা আছে। বাট আই ডোন্টকেয়ার এবাউট ইউ।
মাহি মুচকি হেসে বলে,
–বাট আই কেয়ার এবাউট ইউ মাই ডিয়ার সামিরা আপু। দেখো দেখো অধিক চিন্তার কারণে তোমার চেহারায় রিংকেলস পরে যাচ্ছে। দিন দিন বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হচ্ছো!
অপমানে দগ্ধ সামিরা তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করে। মাহি দাঁত কেলিয়ে হাসে। আদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–চিল আদু। একদম রিল্যাক্সে থাক। সব পারফেক্ট হবে।
আদিরা প্রতিউত্তরে মলিন হাসলো।
……
স্টেজে কয়েকটা পারর্ফমেন্সের পর নাচের জন্য স্টেজে মারসাদ ও আদিরা। দুজনের পড়নেই সাদা আউটফিট। সাউন্ড বক্সে জুবিন নিটুয়ালের গান বাজছে।
“Rim jhim ye saawan phir barsaatein le Aaya hai.
Mausam mohabbaton ka khud chalke aaya hai.
sare shehar mein sirf humko bheegaya hai,
Rim jhim ye saawan phir barsaatein le Aaya hai.
Pehli Mohabbat hai aur pehli ye baarish hai
Bharlo bahon mein aasmaan ki nabajish hai.
Kitna kush hai dekho na ye aasmaan.
Hai khushnaseebi meri sari zamaane mein,
Jo hamsafar tune mujhko banaya hai,
Rim jhim ye saawan phir barsaatein le Aaya hai.”
(বেশি বড় গানের লাইন লেখার জন্য সরি। বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)
নাচের স্টেপগুলো নিজেদের বানানো। নাচের মাঝে যখন আদিরা মারসাদের হাত ধরে ঘুরছিল তখন পায়ের কাছে থাকা একটা তার কেউ হেঁচকা টান দেয়। যার ফলশ্রুতিতে আদিরা ঘুরা অবস্থায় একদম পরে যেতে ধরলে স্টেজের ফ্লোরের কয়েক ইঞ্চি উঁচু থেকে মারসাদ আদিরার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। তারপর সেখান থেকে মারসাদ নাচের অন্য স্টেপ তুলে। আদিরা পরে যাওয়ার ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে নিয়েছিল কিন্তু কোমড়ে কারও স্পর্শে সম্বিত ফিরে পেলে সে আর নাচের কোনো স্টেপ নিজ থেকে দিতেই পারছে না। মারসাদ যেমন ভাবে বলে দিচ্ছে ও ঘুরাচ্ছে তেমনভাবেই করছে। অবশেষে পারফর্মেন্স শেষ হলে সবাই করতালির মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করে।
ব্যাক স্টেজে সামিরা ক্রুদ্ধ হয়ে সাউন্ডবক্সে লা’থি দিয়ে এখন নিজেই এখন পা ধরে লাফাচ্ছে। এই দৃশ্য রবিন, মৃদুল ও রাফিন দেখে হেসে গড়াগড়ি অবস্থা। সামিরা রাগে কটমট চাহনি নিক্ষেপ করছে ওদের দিকে কিন্তু ওদের এতে কোনো হেলদোল নেই। আদিরা ও মারসাদ স্টেজ থেকে নেমে এলে মাহি গিয়ে আদিরাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর উৎফুল্লতা নিয়ে বলে,
–মাঝের ওই স্টেপটা ওয়াও ছিল জাস্ট। আদু পড়ে যাচ্ছিলো আর দাভাই এন্ড মোমেন্টে ধরে তারপর কী সুন্দর করে টেনে তুলে আবারও ঘুরালো এরপর টেনে আনলো। আর প্রথম দিকেও দারুণ ছিল। শেষটা মাইন্ড ব্লোয়িং।
আদিরা বিনিময়ে মুচকি হাসলো। মারসাদ ঘরি ঠিক করতে করতে বললো,
–অনেক স্টেপ প্র্যাকটিসের বাহিরে দিতে হয়েছে। সে তখন পরে যাওয়ার ভান ধরে নি! সে পড়েই যাচ্ছিলো কারও হিংসার বদৌলতে।
মারসাদ আঁড় চোখে পায়ে হাত দিয়ে বসে থাকা সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল। মাহি ও আহনাফ সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝে গেলো ব্যাপারটা। মারসাদ আবার বলে,
–তার ওড়না আমার ঘরির সাথে বারবার বেজে যাচ্ছিলো ওই সিনটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। সে আবার স্টেপ ভুলেও গিয়েছিল। যাই হোক, সবটা ঠিক ভাবে মিটে গেছে।
মারসাদ বাঁকা হেসে আহনাফকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আদিরা লাজুক হাসলো। ওদের আরেক বান্ধুবী এসে আদিরাকে নিয়ে নাচ নিয়ে কথা বলছে। মাহি ওই মেয়েটার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–এই সাবিহা, আমার ও আদুর একটা ছবি তুলে দেও তো। এই ড্রেসটাতে আদুকে ঠিক একজনের মতো লাগছে। যে আমার ও দাভাইয়ের হৃদয়ের খুব কাছের। একটা ছবি তুলে দেও পরে আমি সেটা দেখে দেখে একটা চিত্র আঁকবো। আমি ওর নাচের সময় কয়েকটা ছবিও তুলে নিয়েছি পরে আঁকবো বলে।
সাবিহা মেয়েটা মাহি ও আদিরার ছবি তুলে দিলো।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,