এখানে বেলি ফুলের মালা-১১,১২

0
313

এখানে বেলি ফুলের মালা-১১,১২

১১
—————————

আজাদ সাহেবকে কপালে হাত রেখে চোখ বুঁজে হাসতে দেখে বিনী ভরকে গেল। কিছুটা ভয়ে ভয়ে ‘ আব্বা ‘ বলে দ্বিতীয়বার ডাকলো। তাদের বিয়ের পর থেকে আজাদ সাহেবের সঙ্গে তার তেমন কোনো কথা হয়নি। এমনকী সে তার সামনেও কম এসেছে। কেন সেটা সেও জানেনা কিন্তু আজাদ সাহেবকে তার খানিকটা ভয় করে। আজাদ সাহেব গম্ভীর ধরনের মানুষ। তার একমাত্র আলোচনার বিষয় হলো রাজনীতি যার আগামাথা কিছুই বুঝে না বিনী।

আজাদ সাহেব এবার সোজা হয়ে বসল। বিনীর দিকে মুখ তুলে চাইলেন। সুন্দর করে হাসলেন ঠিক যেমনটা তেতাল্লিশ বছর পূর্বে প্রথম দিন মৃন্ময়ীকে ভয়ে কাঁপতে দেখে হেসে দিয়েছিলেন। বিনীর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বিনীকে সামনের সোফায় বসতে ইশারা করলেন। বিনী আজাদ সাহেবের ইশারা মতো সামনের সোফায় বসলো।

‘ মাস্টার্সে ভর্তি হচ্ছো কখন ? ‘

আজাদ সাহেবের মুখে ভার্সিটির কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো বিনী। সে ধারণা করেনি আজাদ সাহেব এই পরিস্থিতিতে তার পড়াশোনার কথা তুলবেন। তবে বিনীকে চুপ থাকতে দেখে আজাদ সাহেব আলতো হেসে আবারও একই প্রশ্ন করলেন। এবার বিনীর খানিকটা সাহস হলো। সে তার বহু দিনের জমানো কথা খুলে বললো।

‘ মাস্টার্সে ভর্তি হবো না আব্বা। ‘

বিনীর কথায় আজাদ সাহেব বিস্ময়ের চূড়ান্ত রেশ ঘটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘ কেন ? ‘
‘ এমনিতেই আব্বা। এতকাল তো পড়াশোনা করলাম। এখন নাহয় একটু ঘরের কাজকর্ম করে আম্মাকে সাহায্য করি। আম্মারও সুবিধা হবে। ‘

বিনীর কথায় হাসলেন আজাদ সাহেব। চা খেতে খেতে বিনীকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো বিনী। আজাদ সাহেব সেদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আরাম কেদারার গায়ে শরীর এলিয়ে দিলেন। বয়সের ভারে শরীরটা কেমন দূর্বল লাগছে।

—-

রান্নাঘরে এক প্রকার জোর করেই পিড়িতে বসেছে বিনী। শাহিদা খাতুন কিছুতেই ওকে কাজ করতে দিতে রাজি নন। উনার ভাষ্য মতে বিনী এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছে কাজেই আজ আর কাজে হাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনটা শুধু বিনীর ক্ষেত্রেই নয়। আফিফা যখন তার বাবার বাড়ি কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যায় তখন ফিরে এসে তাকেও কোনো কাজে হাত দিতে দেননা শাহিদা খাতুন। উনার বরাবরের কথা হলো বাড়ির বউরা উনাদের বাড়ির মেয়ের মতো। তারা ঝি চাকর নন যে কামলার মতো খাটতে হবে।

বিনী চেয়েছিল কিছু কাজকর্ম করবে কিন্তু শাহিদা খাতুন ওকে কাজেই হাত দিতে দিচ্ছেন না। কাজেই বাধ্য হয়ে ও একটু আধটু সাহায্য করছে, শাহিদা খাতুনকে রান্নায় জিনিস এগিয়ে দিচ্ছে। শাহিদা খাতুন যদিও উপর দিয়ে উপর দিয়ে কপট রাগ দেখাচ্ছেন কিন্তু উনার এই রাগের তীব্রতা নেই। উনি শুধু মুখেই বিরক্তিকর শব্দ করছেন এই যা।

‘ বাপের বাড়ি কয়দিনের লেইগা গেলা ঘুরতে অথচ দুই দিন থাইকাই আইয়া পড়লো। কারণডা কি হুনি ? ‘

শাহিদা খাতুন খুন্তি নাড়তে নাড়তেই কথাটা বললেন। বিনী ভেবে পেলো না কি বলবে। তার মা যে তার শশুর বাড়ির লোকদের বিশেষ করে শাহিদা খাতুনকে পছন্দ করেন না এই কথাটা তো আর বলা যায় না। তাই সে বললো ‘ এমনিতেই আম্মা। ওই বাড়িতে মন টিকছিল না। আপনাদের কথা মনে পড়ছিল তাই চলে এসেছি। ‘

কথাটা যে একেবারেই মিথ্যে তা না। বিনীর আসলেই শাহিদা খাতুনদের কথা মনে পড়ছিল। তার এই বাড়িতে বিয়ে করে আসার দিন ক্ষণ সবে মাত্র এক সপ্তাহ অথচ এই এক সপ্তাহেই এই বাড়ির লোকেদের সে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। তাদের ছাড়া তার মনটা আনচান করে। কোথাও যেন টিকতে চায় না। অথচ সে চঞ্চলা নয়।

জাহানারা হাসলেন বিনীর কথায়। বড় জা শাহিদা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘ বউ দেখি এখনই আমাদের পাগল আপা। পরে আবার বেয়াইন না বলেন আমরা বউমাকে কালো জাদু করেছি। ‘
জাহানারার কথায় শাহিদা খাতুন কিছু বললেন না। তিনি তরকারি নাড়া দিতে দিতে বিনীকে বললেন ‘ ফ্রিজে আমের গলা আচার আছে। ইচ্ছা করলে বড় বউরে নিয়া খাইতে পারো। ‘

শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী আর আফিফার চোখ চকচক করে উঠলো। আফিফা হাতের কাজ রেখে ছুটে গেলো আচারের বোয়ম নামাতে। মিনিটের মধ্যে একটা বড় আচারের বোয়ম আর দুটো বাটি নিয়ে সে হাজিরও হয়ে গেলো। দুই বাটিতে আচার নিয়ে একটা নিজের জন্য আর আরেকটা বিনীর দিকে এগিয়ে দিল। বিনী নিঃশব্দে বাটিটা হাতে নিয়ে আচার মুখে দিলো।

আচার মুখে দিতেই বিনীর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। এ যেন সে অমৃত খাচ্ছে। কোনো আচার এত সুস্বাদু হতে পারে সেটা তার জানা ছিল না। সে খেতে খেতে শাহিদা খাতুনকে বললো ‘ আম্মা একটা কথা বলার ছিল। ‘

‘ তো বলবাই না। কেউ কি তোমারে কসম দিসে যে কথা কইবার পারবা না ? ‘

শাহিদা খাতুনের আঁকাবাঁকা কথা বিনী গায়ে মাখলো না। সে বলল ‘ বলছিলাম আমাকে আচার বানানো শিখিয়ে দিবেন ? আমিও শিখতে চাই। ‘
‘ কোন আচারখান ? সবগুলা না শুধু তোমার হাতের টা ? ‘ শাহিদা খাতুনের তির্যক প্রশ্ন।

‘ সবগুলাই শিখি। তাহলে ভালোভাবে শিখতে পারবো। ‘

‘ তাইলে আগে অন্য ডি শিখান লাগবো। আমের মৌসুম অহন প্রায় শেষের দিকা। এখনকার আম দিয়া এই আচার হইবো না। আমেরটি তোমার সামনের বছর শিখা লাগবো। এহন তাইলে অন্য ডি শিখো ? ‘

শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী সায় দিয়ে বললো ‘ আচ্ছা। ‘
তারপর বিনী আর আফিফা দুজনেই আচার খেতে খেতে জাহানারা আর শাহিদা খাতুনের সঙ্গে কথাবার্তা চালালো। আচার খাওয়া শেষে আর উপায় না পেয়ে বিনী ঘরে চলে এলো। শাহিদা খাতুন তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসা নিয়ে বেশি করছেন। তাদের বাড়ি থেকে বিনীদের বাড়ি অতও দূরে নয় যে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। তবুও তিনি মনের শান্তির জন্যই এই কাজ করছেন।

ঘরে ফিরে বিনী দেখলো আবির ঘুমিয়ে আছে। আবিরকে ঘুমন্ত দেখে সে ভাবলো রোজনামচা লেখা যায়। সেই ভেবেই সে নিজের আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। তার তালা দেওয়া ড্রয়ার থেকে তার গুপ্ত দিনপঞ্জি নামিয়ে আনলো। পঞ্জিখানা আবিরের টেবিলের উপর রেখে নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসলো। তার প্রিয় ফাউন্টেন কলম খুলে রোজ নামচা লেখায় মনস্থির করলো।

এই ফাউন্টেন কলমটা বিনীর খুব প্রিয়। এই কলমটা তাকে দিয়েছিলেন জহির সাহেব তার পনেরো তম জন্মদিনে। তখনকার সময়ে এর দাম ছিল প্রায় একশো টাকা যা আজ থেকে প্রায় নয় বছর পূর্বে। বেশ পুরনো সময়ের বলে কলমের গায়ে বেশ নজরকাড়া কারুকার্য করা। কিছু কিছু জায়গায় রঙিন পাথর বসানো।

বিনী কলম টেনে পঞ্জির হলদে পাতায় লিখতে আরম্ভ করলো,

পাতা ৫৫…

২২ আষাঢ়,১৯৯০

আজ বিয়ের সপ্তম দিন। বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি আর আবির। সেখানে তাকে দেখেছি এক মেয়ের সঙ্গে। চিনিনা ওকে আমি ?হয়তো ওর স্ত্রী হবে। প্রেমিকা নিয়ে ঘোরার হলে এতদিন আমার অপেক্ষায় প্রহর গুনত না। ওকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখে কি আমার খারাপ লেগেছে ? বুকের ভিতরটা চিনচিনে ব্যাথা দুমড়ে মুচড়ে গেছে ? ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখা কি এতই সহজ ?

মা ভাবে আমি আবির আর তার পরিবারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, ওদের অনেক ভালোবাসি। কথাখানা আংশিক সঠিক। আমি আসলেই আবিরের পরিবারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। যেই ভয়ে কোনওদিন যৌথ পরিবারে বিয়ে করতে চাইনি সেই ভয় আমার কেটে গেছে। ওদের আমি ভালোবাসি এটাও ঠিক। যেই অদেখা পরিবার কোনওদিন আমারও হবে এই স্বপ্ন মনে নিয়ে বেড়ে উঠেছি সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছে।

কিন্তু!! কিন্তু…কিন্তু, কিন্তু আমি আবিরের প্রেমে পড়িনি। আমি শুধুই তাতে মুগ্ধ হয়েছি। প্রেমের প্রথম শর্ত মুগ্ধ হওয়া। আমি ওর প্রেমে পড়ার দিকে এক ধাপ এগিয়েছি। ওর আমার প্রতি যত্ন,আমার ইচ্ছের মূল্যায়ন করা আর আমার জন্য চিন্তা করা আমায় মুগ্ধ করেছে। কিন্তু ওকে আমি ভালোবাসিনি। ভালো আমি একজনকেই বেসেছি যে রোজ আমার জন্য বেলি ফুলের মালা হাতে রাস্তার পাশে এক ধ্যানে দাড়িয়ে থাকতো।

তার মতো করে আবিরও বেলি ফুলের মালা আনে। কিন্তু তার আর আবিরের মাঝে যে বিস্তর ফারাক। সে কোনওদিন আমার লম্বা বেণীতে বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দেওয়ার অধিকার পায়নি অথচ কি অবলীলায় মাত্র তিনটে শব্দের দাপটে আবিরের সঙ্গে এখন আমি একই বিছানায় শুই। আমাদের মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও হয়, সে আমায় তার উত্তাল ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমনকী বেলি ফুলের মালাও চুলে জড়িয়ে দেয় কিন্তু তবুও যেন আফসোস থেকেই যায়। ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে একবার অন্তত চুলে বেলি ফুলের মালা জড়াতে না পারার আফসোস। আমাদের প্রেমটা আর কাব্যিক হলো না। তার আনা বেলি ফুলের মালা আর জড়ানো হলো না চুলে। আফসোস,আফসোস আর আফসোস। এই জীবন মনে হয় আফসোসের সুরেই কেটে যাবে।

লেখা শেষে দিনপঞ্জির যেই পাতায় সে নতুন লিখেছে সেই পাতায় এক টাটকা গোলাপ গুঁজে পঞ্জিটা নিয়ে আলমারিতে তার রাখা শাড়ির ভাঁজে রেখে দিল। আলমারি আটকে দিয়ে চাবির গোছা নিয়ে বালিশের পাশে রাখল। তারপর নিঃশব্দে আবিরের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। আবিরের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে। বিনীর হয়তো পুরো জীবন কাটবে আফসোসে আফসোসেই। সরাবকে নিজের করে না পাওয়ার আফসোস, আবিরকে বিয়ে করেও তাতে শুধুই মুগ্ধ হওয়ার আফসোস, আবিরের সম্পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাকে ভালোবাসতে না পারার আফসোস।

—-

রোজকার মতোই রান্নাঘরে কাজ করছেন শাহিদা খাতুনসহ বাড়ির বাকি বউরা। তবে আজ শাহিদা খাতুনের উপর নতুন এক দায়িত্ব পড়েছে। যুহারিন বিশেষ করে আবদার করেছে আজ যেন দুপুরের খাবারে তার জন্য নিজ হাতে পোলাও রাধেন শাহিদা খাতুন। শাহিদা খাতুন বাহিরে দিয়ে যতই নিজেকে শক্ত পোক্ত দেখান না কেন আদতে তিনি খুবই কোমল। একমাত্র নাতনির কোনো আবদার পূরণ না করার সাধ্য তার অন্তত নেই। তাই তিনি পোলাও রাধার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চালগুলো ধুয়ে ঝুড়িতে ঝরতে দিয়েছেন।

বিনী মাংসে মশলা মাখাচ্ছে। যুহারিন যখন চেয়েছে তখন পোলাওয়ের সঙ্গে সঙ্গে কষা গরু মাংসও রাধা হবে। তার জন্যই মূলত মাংসে মশলা মাখানোর কাজ চলছে। আফিফা কালকের জন্য রুটি বানিয়ে রাখছে আর জাহানারা চুলায় চিংড়ির মালাইকারি বসিয়েছেন।

জাবিয়ার আজ কলেজ বন্ধ তাই সে বাড়িতেই আছে। যেহেতু কলেজ বন্ধ সেহেতু পড়াগুলো এগিয়ে রাখছেন। এতক্ষণ ঘরে একলা সময় নিয়ে পড়েছে সে। কিন্তু এখন আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তখনই ক্রিং ক্রিং শব্দে বসার ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো। জাবিয়া নিজে দেখছে জানিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

‘ আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন ? ‘

‘ জাবিয়া আমি আবির। তোর ভাবি কোথায় ? ‘

ফোনের ওপারে আবিরের গলা পেয়ে আর বিনীর নাম শুনে মৃদু হেসে উঠলো জাবিয়া। কৌতুক গলায় বললো ‘ কেন ? কোনো বিশেষ প্রয়োজন বুঝি ? ‘
জাবিয়ার মজা আবিরের ঠিক সইলো না। সে কঠোর গলায় ঝাড়ি দিয়ে বললো ‘ বড় ভাইয়ের সঙ্গে এসব কি ধরনের কথা বলছিস ? লাজ শরম কি সব ভুলে খেয়েছিস ? যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর না দিয়ে উনি এসেছেন উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে। দ্রুত বল তোর ভাবি কোথায় ‘

আবিরের ঝাড়ি খেয়ে জাবিয়া আর কথা এগোলো না। স্রেফ বললো ‘ ভাবি রান্নাঘরে কাজ করছে। ‘

‘ ওকে ডেকে দে, বল জরুরি কথা আছে। ‘

বিনী অধীর আগ্রহে তার কাজ করছে। তার মনযোগ আর কোনদিকে নেই। সে ব্যস্ত সবজি কাটতে। মাংসের মশলা মাখিয়ে রেখে দিয়েছে। জাবিয়া চাইনিজ সবজি খাবে আবদার করেছে। এই সবজির নাম আগে শুনেনি বিনী, এই প্রথম শুনলো সে। তাই রান্নার নিয়মকানুনও জানা নেই তার। কিন্তু তার এই মুশকিল আসান করে দিয়েছে জাবিয়া। কোথা থেকে রান্নার বই এনে হাজির করেছে। এখন সেটা থেকেই দেখে জিনিস জড়ো করছে বিনী।

‘ ভাবি আবির ভাই ফোন দিয়েছেন। আপনাকে ডাকছে,বলেছে জরুরি কথা আছে। ‘

বিনী যখন সবজি কাটতে ব্যস্ত তখনই জাবিয়া এসে আবিরের ফোন দেওয়ার ব্যাপারটা জানালো। আবির ফোন করেছে শুনে বিনী শাহিদা খাতুনের দিকে অনুমতির আশায় মুখ তুলে তাকালো। শাহিদা খাতুন ওর দৃষ্টি দেখে বললেন ‘ অহন আমার দিকে তাকাও কেন ? তোমার জামাই কি ফোন করবার আগে আমার থেইকা অনুমতি নিয়া ফোন করছিলো যে এহন তার সাথে কথা বলবার লেইগা তোমার আমার অনুমতি নেইবার প্রয়োজন আছে ? যাইয়া তাড়াতাড়ি কথা কও, আমার ছেলে তোমারে খাইয়া ফালাইবো না। ‘

শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী সবজি রেখে উঠে দাড়ালো। ফর্সা, নিটোল হাতখানা পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে মুছে বসার ঘরে গেলো। টেলিফোনটা কানে দিয়ে বললো ‘ বিনী বলছি। ‘
বিনীর গলা পেয়ে আবির সুধালো ‘ কি করছিলে ? ‘
বিনী এক রোখা হয়ে জবাব দিল ‘ সবজি কাটছিলাম। ‘

‘ তাহলে এক কাজ করো। তুমি গিয়ে বাড়ির সদর দরজাটা খুলো আর কি দেখলে সেটা এসে জানাও আমাকে। ‘
আবিরের কথায় বিনী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘ কেন ? ‘
কিন্তু আবির সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো ‘ আহা যাও না, গেলেই দেখতে পাবে। ‘

অগত্যা উপায় না পেয়ে বিনী টেলিফোন হোল্ডে রেখে সদর দরজা গিয়ে খুললো। দরজা খুলতেই সে দেখলো পাড়ার মন্টু মিয়া এক মাঝারি বাক্স হাতে দেরি আছে। বিনীকে দেখা মাত্র মন্টু মিয়া বাক্স ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। বিনী কিয়ৎক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলো বাক্সের ভিতর কি আছে। কিন্তু বুঝতে না পেরে একসময় খুলেই ফেললো বাক্সের মোড়ক।

বাক্স খুলতেই উন্মোচিত হলো এক ডজন রঙিন চুড়ির গোছা। এত চুড়ি আগে কখনও একসাথে পায়নি বিনী। আনন্দে তার চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করলো। বিনী চুড়ির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে একটা ছোট চিরকুট পেলো। চিরকুটটা খুলে সে দেখলো ক্রিম কালারের কাগজের গায়ে কালো অক্ষরে লেখা ‘ শুধুই আমার বিনীর জন্য ‘

~চলবে ইনশাআল্লাহ্…

এখানে বেলি ফুলের মালা-১২
—————————

এতগুলো রং বেরংয়ের চুড়ি দেখে বিনী আনন্দে খিলখিল করে উঠলো। তার অনেক দিনের ইচ্ছা, সুতি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে চুড়ি পড়বে, পায়ে সরু নূপুর পড়াবে আর চুলে বেলি ফুলের মালা। ব্যাপারটাই যেন অন্যরকম। তবে এটা ঠিক সে চেয়েছিল এসব তার জন্য সরাব করবে। কিন্তু মানুষটা তার ভাগ্যে থাকলে তো।

বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষকে না পেয়ে বেদনায় নীল হওয়ার মতো বোকা বিনী নয়। সে আগেও এমন অনেক কিছু চেয়েছে যা কখনও পায়নি। জহির সাহেবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল বিধায় যেকোনো জিনিস চাইলেই সহজে পেয়ে যেত। কিন্তু এসব বিলাসিতার বদলে তার খুবই কাছের মানুষজন তার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে।

বিনীর তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। সে শুধু চেয়েছিল তার শৈশবের দিনগুলোতে জহির সাহেব আর সালমা ইসলাম তাকে সময় দিবেন। ছুটির দিনগুলোতে তাদের দুই বোনকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি। সালমা ইসলাম বরাবরই তার চাকরি নিয়ে আর জহির সাহেব তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের ফিরে তাকানোর মতো সময় তাদের ছিল না।

বাবারা তো কাজ করে তাই তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু মা!! তাদের সমস্ত সময় বরাবরই সন্তানদের জন্য বরাদ্দ। তাহলে তারা কেন সন্তান ফেলে শুধু নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাবে ? চাকরি যখন করছে তখন সেইভাবে সংসারও সামলানো উচিত।

তবে বিনী এখন আর ওসব নিয়ে মন খারাপ করে না। এসব তার সয়ে গেছে। এমনকী আসফিয়াও এসব মেনে নিয়েছে। তার মতো করে কোনওদিন সে অভিযোগ জানায়নি। সে ব্যস্ত তার পড়াশোনা নিয়ে। মা বাবাকে নিয়ে মাতামাতি করা তার জন্য বিলাসিতা। পড়াশুনা আর উপন্যাসের রাজ্যই তার জন্য যথেষ্ট।
সালমা ইসলাম তো এখনও চাকরি করে চলেছেন। বেসরকারি এক কলেজে প্রফেসর তিনি।

বিনীর এত বছরের জীবনে তার বিয়ের সময় ছাড়া সে কখনো সালমা ইসলামকে এত লম্বা ছুটিতে দেখেনি। এত বছরে উনি কেবল মেয়ের বিয়েতেই ছুটি নিয়েছেন। এছাড়া কোনওদিন ছুটি নেওয়ার কিংবা স্বামী,সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি তার। বিনী যখন ছোট্টটি ছিল তখন প্রায়শই ঘুরতে যাওয়ার আবদার করতো। কিন্তু যতই ও ক্রমশ বড় হতে শুরু করলো ততই ওর আবদার আর অভিযোগের ঝুলি কমে যেতে শুরু করল।

বিনী আনন্দ চিত্তে বাক্সখানা হাতে নিয়ে বসার ঘরে এলো। টেলিফোন কানে ধরে লাজুক কণ্ঠে বললো ‘ ধন্যবাদ আমার ইচ্ছের ঝুলি থেকে একটা ইচ্ছে পূরণ করার জন্য। ‘
আবির হাসলো বিনিময়ে। তাদের মাঝে আরও কিছু কথা হলো যা আমাদের না শুনলেই হয়। কথা শেষে বিনী টেলিফোন রেখে ওর উপহারের বাক্স ঘরে রেখে এসে আবারও কাজে বসলো।

শাহিদা খাতুন বিনীকে ফিরতে দেখলেন কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। স্বামী, স্ত্রীর কথার মাঝে ঢুকে উনিই বা কি করবেন। অনেক শাশুড়ি আছেন যারা ছেলের বউয়ের সঙ্গে ছেলের ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেন না। ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার মাঝে পড়ে নিজের হাত, পা, নাক, কান সব গলিয়ে দেন। শাহিদা খাতুনের মনে হয় এসব ব্যক্তিত্বহীন মানুষেরই কাজ। ছেলেকে তো বিয়েই দেওয়া হয়েছে আরেক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বংশ বৃদ্ধি করার জন্য। তাহলে ঘনিষ্ঠ হলে যদি এত আপত্তি থাকে তাহলে বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। ছেলেকে ননীর পুতুল সাজিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখুক।

—-

রোজকার মতো আজও কলেজ শেষে নিয়ম করে বান্ধবীদের নিয়ে পথ চলা আরম্ভ করেছে আসফিয়া। সে ভেবেছিল কালকের ঘটনার পর আজ আর হয়তো জাদিদ আসবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে আজও জাদিদ কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আসফিয়া এতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো তবে সেই দিকে মাথা না ঘামিয়ে সে পথ চলতে শুরু করল। কুসুম আর রানীও জাদিদকে লক্ষ্য করেছে। আগের তুলনায় জাদিদকে নিয়ে তাদের মনের ভয়টা কমেছে।

আসফিয়া তার বান্ধবীদের সঙ্গে নীরবে হাঁটতে হাঁটতেই এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সামনে জাদিদের দেখা পেয়ে তিন বান্ধবীই থেমে গেলো। আসফিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আর কুসুম এবং রানী খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। জাদিদ তাদের থেকে বয়সে অনেক বড় তার উপর শরীরে স্বাস্থ্য ভালো বলে একটু বেশিই লম্বা মনে হয়। এমনিতেও তারা ভাইয়েরা উচ্চতায় অনেকটা লম্বা। এখন এহেন ইয়া লম্বা একটা ছেলেকে দেখে কুসুম আর রানীর মতো ভীতু মানুষের দল ভয় না পেয়ে যায় কোথায়।

‘ আমাদের কি একটু একলা ছাড়া যায় আপুরা ? ‘

জাদিদ কথাটা কুসুম আর রানীর দিকে তাকিয়েই বললো। ওর কথা শুনে কুসুম আর রানী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো তারপর আলতো মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জাদিদ আর আসফিয়াকে ফেলে একলা হাঁটতে শুরু করলো দুজনে। ওদের এভাবে এগিয়ে যেতে দেখে হতবাক আসফিয়া ‘ এই তোরা আমায় ফেলে কোথায় যাচ্ছিস ? ‘ বলে এগোতে চাইলো কিন্তু বিধি বাম।

জাদিদ তার লম্বা বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে আসফিয়াকে জাপটে ধরেছে বাহুতে। আসফিয়া শত চেষ্টায়ও সেই বন্ধন উপেক্ষা করতে পারছে না। চেহারায় মেকি বিরক্তিকর ভাব এনে বললো ‘ আটকে ধরেছেন কেন এভাবে ? বলিনি কাল মা কখনোই আপনাকে মেনে নিবে না ? হাতটা ছাড়ুন আশেপাশে সবাই দেখবে। ‘

আসফিয়ার কথা শুনে জাদিদ ওর হাত ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়ে আসফিয়া সস্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলো। তবে জাদিদ তার পিছু ছাড়লো না। সে আসফিয়ার পিছন পিছন এগিয়ে গেলো। খানিকটা দ্রুত হেঁটে নিজেদের পথের তাল মিলিয়ে নিলো। আসফিয়া ওকে এভাবে ওর পাশে পাশে হাঁটতে দেখে অবাক হলো। বিস্মিত গলায় বলল ‘ আমি আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আপনি আমাদের এলাকায় দাড়িয়ে এখনও আমার পাশে হাঁটবার মতো সাহস করছেন। ‘

আসফিয়ার কথায় ভাবান্তর দেখা দিল না জাদিদের মাঝে। তবে সে মৃদু হাসলো। হেসে আসফিয়ার এক হাত নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে পথ এগোতে এগোতে বললো ‘ সাহসের কথা বলছো ? সাহস না থাকলে প্রেমে পড়ার মতো দুঃসাহসিক কাজ করতাম না। আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের বর্তমান নষ্ট করার মতোই অবিবেচক আমি নই। বুদ্ধিমানরা কখনও ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের বর্তমান নষ্ট করে না। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয় ভাগ্যের উপর। ‘

আসফিয়া জাদিদের কথার জবাবে কিছু বললো না। সে নীরবে সময়টা জাদিদের সঙ্গে উপভোগ করছে। আপাতত সালমা ইসলামের কথা ভেবে নিজের সুখ, শান্তি নষ্ট করার ইচ্ছে বা শক্তি তার নেই। তবে চিন্তা করতে ইচ্ছা করছে না বললেও চিন্তা ঠিকই রয়ে যাচ্ছে। তাদের এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি ? আদৌ কি তাদের অদৃষ্ট এক বন্ধনে বাধা পড়বে ?

—-

বিনী আবারও একই ভুল করেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে সে খানিক বিশ্রাম করবার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো। ক্লান্তি সমস্ত শরীরে ভার করায় বিছানা গা লাগানো মাত্র অতল নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ধরফরিয়ে উঠে বসে সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা সাতটা অথচ আজাদ সাহেব, সাজ্জাদ সাহেব বিকালে চা খান। বাড়ির সকলে বিকালেই চা, নাস্তার পাট চুকিয়ে রাখেন।

বিনী অপরাধী মুখে দ্রুত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। মাথার আঁচল টেনে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো নগ্ন পায়ে। বিনীত সুরে গলা খাদে নামিয়ে বললো ‘ ক্ষমা করবেন আম্মা। বিছানায় শুয়েই চোখ লেগে গেছিল তাই ঘুমের মধ্যে টের পাইনি। দয়া করে রাগ করবেন না। আমি বুঝতে পারিনি এত দেরী হয়ে যাবে। ‘

শাহিদা খাতুনের মুখ থমথমে। উনি জোরে জোরে রান্নাঘরের কল পাড়ে বাসন মাজছেন। মুখে রা নেই তার। তাকে চুপ দেখে বিনীর এবার কান্না পেলো। সে না পারছে তার পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলতে আর না পারছে কাদতে। সে তার কান্না সামলে আফিফাকে ধরলো। অসহায় গলায় বললো ‘ ভাবি আম্মাকে বলেন না এই ভুল আর হবে না। আমি এরপর থেকে আর দুপুরে কাজের পর ঘুমাবো না, ঘরেও ঢুকবো না। তাও যেন আম্মা রাগ কইরা না থাকে। ‘

বিনীর কথা শুনে আরও রেগে গেলেন শাহিদা খাতুন। তিনি ফোঁস করে হাতে থাকা বাসন বিকট শব্দে মেঝেতে রাখলেন। থালা বাসনের ঝনঝন শব্দে জাহানারা কেপে উঠলেন। আফিফা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে। আসল কথা শাহিদা খাতুন রেগেছেন কি কারণে সেটাই বুঝতে পারছে না ও। রাগার মতো কি হয়েছে ?

‘ খবরদার মুখ সামলাইয়া কথা কও বউ। তুমি অনার্স পাস মাইয়া মানুষ এমনে কথা কইলে আমরা মূর্খ মহিলা মানুষ কেমনে কথা কমু ? খবরদার এই ভাষায় আর ভবিষ্যতে কইবা না। আর দেরি কইরা উঠছো তো কি হইসে ? মহাভারত অশুদ্ধ হইসে নাকি ? দেরি হইয়া গেছে ভালো কথা। মানুষ মাত্রই ভুল, ঘুম আইবারই পারে এতে এত ক্ষমা চাইবার কি আছে ?তুমি ঘুমাইসো তাতে আমি রাগ করমু কেন ? মনে হয় আমি ঘুমাই নাই ? ‘

শাহিদা খাতুনের আচমকা বিরূপ আচরণে বিনী কান্না ভুলে থতমত খেয়ে গেল। সে আশা করেছিলো শাহিদা খাতুন এখন আরও তার অসময়ে ঘুমিয়ে পড়াতে রাগারাগি করবেন, বকাঝকা দিবেন এবং শেষে হয়তো কয়েকটা কড়া কথাও শোনাবেন। অথচ পরিস্থিতি পুরোই উল্টো। উনি নাকি বিনী ক্ষমা চাওয়াতে রেগে গেছেন ?

আফিফা এবার না পারতে হেসে উঠলো। সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি শাহিদা খাতুন রেগেছেন কেন। এখন তার মস্তিষ্কে ধরা দিয়েছে শাহিদা খাতুন প্রয়োজন বিনা অতিরিক্ত কথা পছন্দ করেন না অথচ বিনী ক্ষমা করে দিন বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। এদের দুই জনের কাহিনী দেখলে তার হাসি পায়। তার বিয়ের পরপর সেও শাহিদা খাতুনকে ভয় পেত কিন্তু সেই ভয়ের মাত্রা দুই দিনের বেশি ছড়ায় নী। অথচ বিনীর বিয়ের সাত দিন কিন্তু বিনী এখনও শাহিদা খাতুনকে জমের মতো ভয় পায়।

‘ এত হাসবার কি আছে ? মাইয়া মানুষ গো হাসতে নাই জানোনা বউ ? চুপচাপ কাম করো। হাজারবার কইছি কামের সময় এত কথা কইবার না কিন্তু হেগো যত কথা কামের সময়ই মনে পড়ে। অসহ্য…অসহ্য। ‘

শাহিদা খাতুন রাগে গজগজ করতে করতে আবারও থালা বাসন মাজতে বসলেন। উনার মাথা গরম আপাতত। বারবার ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা উনার মোটেই পছন্দ নয়। এতে নিজেকে ছোটলোক মনে হয়। তার মতে কেউ কোনো অপরাধ করলে তাতে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে পারে এবং দুঃখ প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু বারবার ক্ষমা চেয়ে অপর পাশের মানুষটাকে নিজের নজরে বড় করে দেয় ঠিকই কিন্তু মানুষটা নিজের নজরে ছোট হয়ে যায় সেটা আর কেউ বুঝে না।

শাহিদা খাতুনের এহেন রাম ধমক খেয়ে বিনী আর কিছু বলবার সাহস পেলো না। সে নীরবে, নিঃশব্দে কাজে বসলো। রাতের তরকারি করতে হবে। আজ সকলে রাতের খাবারে রুটি খাবে তাই বিনী ঠিক করলো রুটিটা করে ফেলা যায়। সেই মতেই সে আফিফাকে কানে কানে সুধালো আটা কতটুকু দিবে।
আফিফা মানুষ ভেবে পরিমাণ জানালো।

আফিফা আর বিনীর ফুসুর ফুসুর দেখে আবারও রেগে গেলেন শাহিদা খাতুন। কটমট দৃষ্টিতে বললেন ‘ এত ফুসুর ফুসুর কিসের ? আমারে কওন যায় না ? ‘
বিনী শাহিদা খাতুনের ধমক শুনে বলে উঠলো ‘ আম্মা আপনিই তো বললেন কথা না বলতেন। ‘
‘ খামোশ… আমি বলিনি প্রয়োজনেও কথা না বলতে। ‘

এরপর আর কথা বাড়ালো না বিনী। সে আটা সিদ্ধ করতে দিয়েছে চুলায়। কাজের মাঝেই সবার কানে এলো টেলিফোনের শব্দ। জাবিয়া তখন বসার ঘরেই বই নিয়ে বসে সাজ্জাদ সাহেবের কাছে হায়ার ম্যাথ করছিলো। সে ছুটে গেলো ফোন ধরতে। টেলিফোনের শব্দ বন্ধ হয়ে যেতেই আর কেউ উঠে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। যে যার যার কাজে মন দিলেন।

কথা বলে রান্নাঘরে এসে দাড়ালো জাবিয়া। সে জানালো জাহানারার বড় ভাই আজমল সাহেব ফোন করেছেন, জরুরি এক বিষয়ে কথা আছে। জাহানারা তা শুনতে পেয়ে হাত পা ধুয়ে মুছে এগিয়ে গেলেন বসার ঘরে। বড়রা কথা বলবে বিধায় জাবিয়া আর বসার ঘরে বসলো না। সে বই খাতা নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

দীর্ঘ এক আলাপ সেরে খাবার ঘরে এসে দাড়ালেন জাহানারা। তার চোখে মুখে আনন্দের রেশ। উনি হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠস্বরে শাহিদা খাতুনকে বললেন ‘ একটা সুখবর আছে আপা। ‘
সুখবরের কথা শুনে শাহিদা খাতুন মুখ তুলে চাইলেন। কাজ করতে করতে বললেন ‘ কি সুখবর ?’

‘ আমার বড় ভাইয়ের ছেলে শাহরিয়া আছে না ? ও কিছুদিন আগে বিলেত থেকে ফিরেছে। একবারে দশ বছর পর পড়াশোনা শেষে ফিরেছে। এই দেশেই নাকি একবারে ব্যবসা পাতি করবে। ভাইজান ঠিক করেছেন শাহরিয়ার বিয়ে দিবেন। তাই আমাদের জাবিয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ‘

জাহানারার কথায় সকলে চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু বিনী যেন খুশি হয়েও খুশি হতে পারল না। আসফিয়ার কাছে বিয়ের আগে শুনেছিল জাবিয়ার প্রেমিক আছে, নাম তুষার। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক কতটুকু গভীর সে জানেনা। তবে যদি সত্যি সত্যি তারা একে অপরকে ভালোবেসে থাকে তাহলে তো এই বিয়ে করে সুখী হতে পারবে না জাবিয়া। ভালোবাসাহীন সম্পর্কে আদৌ কি সে সুখী থাকবে ?

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

( জাবিয়ার বিয়ের খবর পেলেন তো ? কার কি অনুভূতি শুনতে চাই ?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here