এখানে বেলি ফুলের মালা-১৫,১৬

0
300

এখানে বেলি ফুলের মালা-১৫,১৬

১৫
—————————

দখিনা হাওয়া বইছে। জাবিয়ার কপালের দিকে রেশমি ছোট ছোট চুলগুলো আকাশে উড়ছে। জাবিয়া ছাদের কিনার ঘেসে দাড়িয়ে আছে। তাদের ছাদে বড় করে বাউন্ডারি দেওয়া হয়নি। যতটুকু দেওয়া হয়েছে ততটুকুই জাবিয়ার কোমর অব্দি পড়ে। তবে জাবিয়া পোক্ত সেই ইটের তৈরি দেওয়ালের উপর হাত রেখেই দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে সে আকাশে কবুতরদের দল বেঁধে উড়া দেখছে।

জাবিয়ার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে শাহরিয়াও আকাশ দেখতে ব্যস্ত ছিল। আকাশ পানে চেয়েই সে বললো ‘ বিয়েতে কি তুমি আদৌ রাজি ? নাকি ফুপিজান জোর করে আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিচ্ছে ? ‘

শাহরিয়ারের কথায় জাবিয়ার হাসি পেলো। নাহ্ তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সে আপন মনেই বিয়ে করতে বাধ্য। আজ শাহরিয়াকে সে বিয়ে করতে আপত্তি করে তুষারের হাত ধরে চলে গেলে তার বাবা মা আর কখনও তার মুখ দেখবে না। সাজ্জাদ সাহেব কিংবা জাহানারা কোনোদিনই এই প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেবেন না। প্রেমের সম্পর্কে তাদের এক ধরনের বিতৃষ্ণা আছে যেটা সে টের পেয়েছে যখন কয়েক মাস পূর্বে তার খালাতো বোন লামিয়ার প্রেম সম্পর্কের ব্যাপারটা খোলাসা হয়।

লামিয়ার প্রেমের কথা জানতে পেরে জাহানারা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। লামিয়া রাজিও হয়েছিল। সেই দেখে নিজ দায়িত্বে পাত্রও ঠিক করেন জাহানারা। কিন্তু বিয়ের দিন লামিয়ার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা উনাকে পুরোপুরি রুপে নাড়িয়ে দেয়। উনি প্রতিজ্ঞা করেন বেচেঁ থাকতে আর ভাগ্নি লামিয়ার মুখ দেখবেন না। সেই থেকেই প্রেমের প্রতি উনার এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। উনার ধারণা প্রেম করে বিয়ে করলে সংসার কখনও সুখের হয়না।

জাহানারার ধারণা আসলেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে করেও সুখে নেই লামিয়া। তার বর রোজ রাতে নেশা করে এসে তাকে মারধর করে অথচ তাদের তিন বছরের প্রেম ছিল। মেয়ের উপর রাগ করে মেয়ের মুখ দেখবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন জাহানারার বোন আর বোন জামাই। প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার পর আর কোন মুখেই বা ফিরে আসবে লামিয়া ? তাই সে নিরবে সবকিছু সহ্য করছে।

লামিয়ার এমন রোজ রোজ মার খাওয়ার কথা শোনার পর জাহানারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন জাবিয়া যেন ভুলক্রমেও প্রেম পিরিতি করার চিন্তা না করে। কিন্তু এই একই কথা যদি জাহানারা আরও কয়েক মাস আগে বলতেন তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। তুষার নামক সেই স্বপ্ন পুরুষকেও বিরহের মতো কঠিন যন্ত্রণার ভাগীদার হতে হতো না।

জাবিয়ার পুরনো অতীতের কথা ভেবে মলিন হাসলো। বললো ‘ তোমার কেন মনে হলো আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে ? ‘
‘ না মানে বিয়ে নিয়ে তোমার কোনো হেলদোল নেই। এসে থেকে আমার সঙ্গে কথাও বলো না। অথচ আগে সারাদিন আমার পিছন পিছন ঘুরতে। ‘ রয়ে সয়ে বললো শাহরিয়া।

‘ বিয়ের কনে হয়ে নিজেই নিজের বিয়েতে নাচানাচি করবো আশা করছো ? আমার ছোট ভাবীকে দেখেছো তো ? উনি খুবই ঠোঁটকাটা। আমাকে নাচতে দেখলে আরও বাড়িয়ে চাড়িয়ে কাজিন গুষ্টিতে ছড়িয়ে দিবেন এই কথা। ‘ ঠোঁটে দাত চেপেই অসম্ভব এই মিথ্যে কথাটা বলে ফেললো জাবিয়া।

উপযুক্ত কারণ নেই জাবিয়ার কাছে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই সব দোষ ফেলে দিল বিনীর ঘাড়ে। এতে শাহরিয়া অন্তত আর কোনো প্রশ্ন করবে না। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে শাহরিয়া বিস্মিত গলায় সুধালো ‘ সেকি উনি এরকম ? দেখে তো উনাকে একদম শান্তশিষ্ট, ঠান্ডা মেজাজের মানুষ মনে হয়। ‘

শাহরিয়ার কথায় হাসলো জাবিয়া। হালকা হেসে বললো ‘ কার ভিতরটা কেমন সেটা কি আর বাহির থেকে বোঝা যায় ? এই যেমন আমিও তো মামাকে দেখে বুঝিনি আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করবে। মামা তোমার বাবা। তুমি নিজে বুঝেছিলে কি মামার ভিতর ভিতর কি চলছে ? ‘

‘ কথা ঠিক। কার ভিতর কি চলে সে তো একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই জানে না। ‘
কথাটা বলে আকাশ পানে স্থির দৃষ্টি তাক করলো শাহরিয়া। তার ভাবনায় চলছে নবনী কি করছে এখন ? সেও কি এখন আকাশ পানে চেয়ে তাদের দুজনের স্মৃতি চারণ করছে। শাহরিয়ার মনে পড়লো তাদের দুজনের একসঙ্গে কাটানো সোনালী দিন আর রূপালী রাত্তিরের কথা।

—-

প্রস্থানের পূর্বে আঙিনায় দাড়িয়ে জাবিয়াকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো শাহরিয়া। জাবিয়া দাড়িয়ে আছে তার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায়। শাহরিয়ার চলে যাওয়ার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জাবিয়া। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই জাবিয়ার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। প্রকৃতিতে অভিমানী মেঘ তার টুপুর টাপুর বর্ষণ ঝরাচ্ছে।

জাবিয়া এক মনে বৃষ্টি দেখছে। জাহানারা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জাবিয়া সেটা বুঝতে পেরেও কিছু বললো না। জাহানারা বললেন ‘ বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো যায় না জানিস তো। তুই আমার মেয়ে, আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে হয়ে তুই কোনো ভুল করবি না। তোর বয়সটা আবেগের তাই হয়তো ওই ছেলের মায়ায় পড়ে গেছিস। ওসব মায়া মোহ দুই দিনে কেটে যাবে। তখন বোঝা নিয়ে বেড়াতে হবে।

বাবা মা কখনও সন্তানের খারাপ চায়না জানিস তো। শাহরিয়া ভালো ছেলে তার উপরে আমাদের পূর্ব পরিচিত। আমার বিশ্বাস তুই ওর সাথে সুখী হবি। ‘

গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললেন জাহানারা। লামিয়ার পরিণতি দেখে উনার মনে জাবিয়ারও একই ভুল করার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন এসেছিল। উনার সেই আশঙ্কাই সত্য হলো যখন জাবিয়ার কলেজ ব্যাগে তুষারকে লেখা পত্র পেলেন। তবে একটা কথা ভেবে সস্তির নিশ্বাস ফেললেন যে জাবিয়া উনাদের কথা ভেবে তুষারের সঙ্গে বিচ্ছেদের চিন্তা ভাবনা করছে যেটা সেই চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।

জাবিয়া এক মনে জাহানারার বক্তব্য শুনলো কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মেয়েকে নীরব দেখে জাহানারা বললেন ‘ সময় আছে তোর কাছে। নীরবে ভাব আর উপলব্ধি কর আমি আর তোর বাবা তোর খারাপ চাই না। বিয়ে নিয়ে তোকে জোর করবো না। তোর ইচ্ছে হলে করবি নাহলে করবি না। কিন্তু কয়েক বছর পরে হলেও তোকে আমার পছন্দেই বিয়ে করতে হবে কারণ ওই ছেলেকে আমি মেনে নিবো না। ‘

শেষের কথাগুলো রুক্ষ স্বরে বলে বেরিয়ে গেলেন জাহানারা। জাবিয়া নিরুত্তর। ভালোবাসা বুঝি অপরাধ ? তাহলে এই অপরাধ করার পরই কেন সকলে ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি নিয়ে হাজির হয় ? আগে সাবধান করলে কি আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো ? আসলে কাছের মানুষগুলো বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর মতোই। কাউকে ভালোবাসার পর ন্যায় বিচারের শালিসী নিয়ে হাজির হয়। অথচ যখন সময় ছিল তখন তাদের নাগালও পাওয়া যায় না।

—-

হারিকেন জ্বালিয়ে বই খাতা নিয়ে বসেছে রুনা। কোমর ছাড়ানো লম্বা চুলগুলো যত্নের অভাবে উস্কখুস্ক হয়ে ছড়িয়ে আছে পিঠ বেয়ে। নূরজাহান ওর থেকে খানিকটা দূরে আরাম কেদারায় বসে উলের সোয়েটার বুনছেন। সামনে শীতকাল আসতে চলেছে। হয়তো আর কয়েক মাস পরেই কনকনে শীত দাপট দেখিয়ে হাজির হবে। তাই তিনি আগেভাগেই শীতের জামা কাপড় বুনতে বসেছেন।

ঘুম থেকে উঠে রুনা খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন নূরজাহান। সরাবের খবরও নিয়েছিলেন। রুনা শুকনো মুখে মিথ্যে বললো যে দুজন একসঙ্গেই খেয়েছে। এছাড়া যে উপায় নেই। স্বামী স্ত্রীর কলহের মাঝে নূরজাহানকে টানা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। তাই সে আর এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।

‘ তোর মনে হয়না আমাদের ঘরে আরেকটা সদস্য প্রয়োজন ? ‘

নূরজাহানের কথার মানে ধরতে পারলো না রুনা। ও স্তব্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন ‘ আরে বেকুব মেয়ে বুঝলি না ? বললাম যে আমিও তো বুড়ো হচ্ছি নাকি ? নাতি নাতনী নিয়ে খেলতে তো আমারও ইচ্ছে করে। নাতি নাতনীর মুখ আদৌ দেখবো তো মরার আগে ? ‘

এতক্ষণে রুনা বুঝতে পারলো নূরজাহান কি বলছেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার দোহারা চেহারায় লালিমার আভা দেখা গেলো। সে তার নত মুখ আরও নত করে নিলো। নূরজাহান তাকে আর সরাবকে নিয়ে আরও অনেক কিছুই বললো কিন্তু রুনা লজ্জাবতী লতার মতোই যেন নুয়ে পড়েছে। সে নিরবে স্রেফ জীব বিজ্ঞান পড়ছে। এসব কথায় কান দেওয়ার সুযোগ নেই তার। সরাব তো তার কাছে আসতেই কার্পণ্য করে সেখানে বাচ্চার কথা অনেক দূরে।

সরাবের ইদানিং এক বাজে অভ্যাস তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যা হলেই বাড়ি ফেরার জন্য মনটা আকুপাকু করে। কিন্তু কেন ? কি এমন আছে ঘরে যে তার রোজই বাড়ি ফেরার এমন তাড়া থাকে ? কথাটা বললে ভুল হবে, কি নয় কে। কে আছে যে কাজ পাগল সরাবও বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া লাগিয়ে দেয় ?

উত্তর খুঁজে ফিরে সরাব তবে তার সন্ধান আর মেলে না। বাধ্য হয়েই উত্তর খোঁজার কাজে ইস্তফা দিয়ে লাকড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। আকাশেতে জ্বলজ্বল করছে লক্ষ লক্ষ তারা আর এক রূপালী পূর্ণিমার চাঁদ। নিস্তব্ধ,একলা পথে ফিরতে ফিরতেই সরাব উপলব্ধি করলো দুপুরে রুনার সঙ্গে রাগারাগি করে তারও মনটা ভালো নেই।

রুনার সঙ্গে ছোট থেকেই উঠাবসা তার যেহেতু ওদের বাবা চাচাদের বাড়ি কাছাকাছি। সেই সুবাদে একসঙ্গে প্রায়ই থাকা পড়তো। কিন্তু রুনার উপর রাগারাগি সে কখনও করেনি। বয়সে ছোট বলেই যে রাগারাগি করতে হবে এই জিনিসটা সে মানতে পারে না। ছোট বলেই কথাবার্তায় আধিপত্য বিস্তার করা তার ঠিক আসে না। তাই কখনও ধমকাধমকী করার প্রয়োজন মনে করেনি।

অথচ এই প্রথম ওর উপর রাগারাগি করে তারই মনটা খারাপ হয়ে গেছে। সেখানে রাগটা তো দেখিয়েছেই রুনার উপর। কে জানে অভিমান করেছে কিনা ? মেয়েরা তো স্বভাবতই একটু অভিমানী হয় যেটা সে নূরজাহানকে দেখে বুঝেছে। সে যখন ছোট তখন তার বাবা মায়ের উপর রাগারাগি করলে মা অভিমানে খেতেন না, কথা বলতেন না এমনকি সরাবের সঙ্গেও কথাবার্তা বন্ধ রাখতেন।

হারিকেনের আলো যখন নিভু নিভু তখন হারিকেন নিয়ে উঠে দাড়ালো রুনা। হারিকেনে তেল দেওয়া প্রয়োজন। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কোথায় তেলের ড্রাম। রুনা কোনোমতে আন্দাজে খুঁজে বের করলো। আন্দাজে তীর ছুঁড়ে সে ড্রাম থেকে তেলও ঢাললো কিন্তু হারিকেন জ্বালিয়ে উঠে দাঁড়াতেই পিছনে সরাবকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো।

রুনাকে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সরাব বললো ‘ কিরে ? এভাবে লাফিয়ে উঠলি যে ? ‘
সরাবের কথা শুনে রুনা নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। অন্ধকারের সেই অবয়ব যে সরাব সেটা ভেবেই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। বললো ‘ যেভাবে হাজির হলে তাতে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করিনি এই বেশী। ‘ কথাটা বলে বুকে হাত রেখে থু থু করলো রুনা। আরেকটুর জন্য সে মরতে মরতে বেচেঁ গেছে।

অন্ধকারে সরাবের অবয়ব যেন দানবীয় এক ব্যক্তির সত্তা। রুনা সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিল তবে রুনার ভয়ে কেপে উঠা মুখ দেখে সরাবের মনে হলো ভীত সন্ত্রস্ত এই নারীর ভয়টাও তাকে ঘিরেই। কেন যেন এক আলাদা ধরনের ভালো লাগা ঘিরে ধরে। সেই ভালো লাগা থেকেই অসম্ভব এক কাজ করে বসে সে। আকস্মিক রুনার ললাটে নিজের রুক্ষ ঠোঁটের আদর ছুঁয়ে দেয়।

সরাবের এই কাজে প্রথমে রুনা চমকে উঠলেও পরক্ষণেই লজ্জায় কুকড়ে যায়। ইতিউতি করে লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠেই সরাবের কাছ থেকে লাকড়িগুলো হাতে তুলে নিয়ে বলে ‘ দুপুরে ওভাবে রেগে বেরিয়ে গেলে। সারাদিন নিশ্চই পেটে কিছু পড়েনি। মুড়ি ভাজা খেতে পারো। আমি ততক্ষনে ভাত বসাচ্ছি। ‘

কথা শেষে লাকড়িগুলো রান্নাঘরে নিয়ে খড়ের পাশে রাখলো রুনা। কিছু লাকড়ি উনুনের ভিতর রেখে আগুন জ্বালালো। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখায় রান্নাঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। অগ্নির সেই হলদে আলোয় রুনা দেখলো সরাব রান্নাঘরের দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। তার এই মন ভোলানো হাসি দেখে যেন রুনা আরও কুকড়ে গেলো। দ্রুত অন্য দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

এখানে বেলি ফুলের মালা-১৬
—————————

সরাবকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অসস্তি হচ্ছে রুনার। ও ভাতের চাল ধুতে ধুতে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো ‘ এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ? মুড়ি না খাবে ? ‘
রুনার কথায় উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এলো সরাব। রুনাকে হাত ধরে টেনে তুলে নিজে পিড়িতে বসে চাল ধুতে শুরু করলো। রুনা ওকে চাল ধুতে দেখে অবাক হয়ে বললো ‘ একি তুমি ধুচ্ছ কেন ? আমি তো ধুচ্ছিলামই। ‘

‘ তোর না কাল পরীক্ষা ? আম্মাকে হারিকেন দিয়ে আয় আর তুই কুপি জ্বালিয়ে হেশেলের কাছে পড়তে বস। জোরে জোরে শব্দ করে পড়বি, দেখি কি পড়িস। ‘

অগত্যা রুনা আর বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না। নূরজাহানকে আরেকটা হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে এসে নিজে কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসলো। কুপির আলোয় বইয়ের পাতায় প্রত্যেকটা অক্ষর যেন অন্যরকম লাগছে। গোটা গোটা অক্ষরগুলোয় অমানিশার হালকা ছাপ। আলোহীন সন্ধ্যায় কুপির আলোতে পড়াশোনা করার মজা আলাদা। তাই নিরবচ্ছিন্ন এই বিদ্যুৎহীন এলাকায় ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে রুনার পড়াটা বেশ ভালই হয়।

সরাবের বাবা মারা গেছে বেশ ক বছর আগেই। সেই সুবাদেই সরাব এবং তার ছোট বোন দুজনেরই নিজ হাতে রেধে খাওয়ার অভ্যাস আছে। সরাবের ছোট বোন সিরাতের অবর্তমানে সরাবকেই এতদিন রেধে বেড়ে খেতে হয়েছে। যার কারণে মোটামুটি রকমের তরী তরকারি রাধা সেও জানে। অন্তত কারোর সাহায্য পাওয়ার আশায় বসে থাকতে হয়নি।

সরাব একে একে ভাত, পাট শাক ভাজি আর ডাল করলো। রান্না শেষে নূরজাহানকে সে পূর্বেই খেতে দিয়ে দিলো যেহেতু উনার দ্রুত খেয়ে রাতের ওষুধ খেয়ে সময় মতো ঘুমোতে যাওয়া প্রয়োজন। নূরজাহান অবশ্য তাকে আর রুনাকে খেতে বলেছিলেন কিন্তু রুনা জানিয়েছে তার খেতে দেরি আছে, পরীক্ষার পড়া করছে সে। অতঃপর আর কি ? নূরজাহান নিজের মতো খেয়ে শুয়ে পড়লেন।

২৫ আষাঢ়, রাত ১১:০০ ঘটিকা

বাহিরে বাতাবরণের তুমুল আড্ডা চলছে। চারিদিক তমসায় আচ্ছন্ন তবুও হাওয়া বইছে নিজের নিঃসঙ্গ মনের তৃপ্তি মেটাতে। ছোট তিন রুমের ঘরটায় দেখা যাচ্ছে কুপির আলো। রুনা মেঝেতে কুপির স্বল্প আলোয় জীব বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মনে করছে আর ওর মুখে একে একে লোকমা তুলে দিচ্ছে সরাব। ব্যাপারটা খুবই মিষ্টি তাইনা ?

আসলেই মিষ্টি কিন্তু এই মিষ্টি মুহূর্ত গভীর ভাবে অবলোকন করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই রুনার কাছে। কাল পরীক্ষা আর রুনা এখনও রিভিশন দেওয়া নিয়েই পড়ে আছে। রুমা খালার দাগিয়ে দেওয়া পড়ার অর্ধেক মাত্র শেষ করতে পেরেছে অথচ পরীক্ষায় তার ভালো নম্বর পেতেই হবে নাহলে সরাবের কথার মান যে রাখা হবে না। রুনার পক্ষে আদো জীবনে সম্ভব না সরাবের কোনো কথার অবমাননা করা।

রুনার খাবার শেষে সরাব এবার নিজের খাবার নিয়ে বসলো। রুনা বেশ মনযোগ দিয়ে পড়ছে। বুঝাই যাচ্ছে পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কিসের জন্য এই চেষ্টা ? আগে তো কখনও এত মন দিয়ে পড়েনি। তবে কি সরাবের বলা কথার মূল্য তার কাছে অধিক ?সরাবের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি ফুটলো যে অন্তত কেউ তো আছে যে তার কথার মূল্য রাখতে পারে, তাকে ভালোবাসতে জানে।

সরাব সন্তান হিসেবে কোনোদিনই নূরজাহানের কাছ থেকে ভালোবাসা পায়নি। এমনকী ওর ছোট বোন সিরাতকেও নূরজাহান কখনও ভালোবাসা দেখাননি। উনি চিরকাল ব্যস্ত ছিলেন নিজের সংসার নিয়ে। সংসারে কোনটা লাগবে, কি লাগবে না, ছেলে মেয়েদের কি কিনে দেওয়া উচিত এই নিয়েই উনার ভাবনা ছিল। অথচ কোনওদিন ভাবেননি শুধু প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাগুলো মেটালেই হয়না, সন্তানদের ভালোবাসাও দেওয়া প্রয়োজন।

বিনী সরাবের কলেজ জীবনের ভালোবাসা। দুজনে সরকারি কলেজে, একই ক্লাসে পড়তো। সেই থেকেই বিনীর প্রতি ভালো লাগার শুরু। রোজ সকালে বিনীদের বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে থাকা তার নিত্য দিনের নিয়ম ছিল। বিনী তাকে লক্ষ্য করতো কিন্তু কোনওদিন কিছু বলেনি। ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো মনোভাবই প্রকাশ করেনি।

তারপর!! তারপরই সরাবের বাবা মারা গেলেন। সরাব পড়ে গেলো সংসারের গ্যাড়াকলে। তবুও সংসার, বাবার ব্যবসা সামলে ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছিলো এবং পড়ালেখায় তুখোড় হওয়ায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাসও করে কিন্তু এরপর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারেনি। সংসার, বোনের কলেজ ফি, মায়ের ওষুধ এবং দিনশেষে ব্যবসা সামলে সে আর পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেনি।

অন্যদিকে বিনী ঠিকই এগিয়ে গিয়েছে। ভালো বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। মাঝারি ধরনের ছাত্রী সে। তবুও অনার্স অব্দি পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। আসলে বাবা মার টাকা পয়সা থাকলে পড়াশোনা কখনও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় না। সরাবের বাবা ছিলেন না, সংসার তাকেই দেখতে হয়েছে তাই পড়াশোনা তার করা হয়নি।

সরাব নূরজাহানকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু নূরজাহান কখনও একজন মা হিসেবে তার সন্তানদের কাছে টেনে নেননি, ভালোবাসেননি। কিংবা ভালোবেসেছেন কিন্তু প্রকাশ করেননি। একই কাজ বিনীও করেছে। সরাবের ভালো লাগা, ভালোবাসায় কোনওদিন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শুধু দূর হতে চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কোনওদিন বলেনি সরাবের প্রতি তার অনুভূতি কি। আর বোকা সরাব!! সে তো বিনীর এই নিরবতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে নিজের ভালবাসার পরিমাণ দিনে দিনে বাড়িয়ে গেছে।

কিন্তু কথায় আছে সবকিছুরই একটা শেষ আছে। তেমনই সরাবের সুন্দর স্মৃতিগুলোরও সময় শেষ হয়ে এসেছে। বিনীর যে তার প্রতি কোনো অনুভূতি নেই সেটা সে বিনীর বিয়ের দিন বিয়ের কার্ড দেখেই বুঝতে পেরেছে। সেই তখন থেকেই নিজেকে কঠিন করে সামলে নিতে শিখেছে সরাব। জেনেছে ভালোবেসে দূর্বল হতে নেই। কিন্তু রুনার তার প্রতি এমন ভালবাসার বহিঃ প্রকাশ তাকে আবারও দূর্বল করছে। সরাব কিছুতেই চায় না পুনরায় দূর্বল হতে।

কিন্তু এই তৃষ্ণার্ত মনও মাঝে মাঝে এক চিলতে ভালবাসার জন্য উচাটন হয়ে উঠে। মনে হয় এত আয়োজন করে নিজেকে সামলে রেখে কি হবে ? সেই তো রুপ ঝলসানো সুন্দরীর পর আবার এক দোহারা সুন্দরীর প্রেমেই পড়তে হবে। পড়লে কি কোনো ক্ষতি আছে ? নিজের স্ত্রীর প্রেমে পড়লে কোনো ক্ষতি আছে এটা অন্তত শুনেনি সরাব।

—-

আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।

এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।

হিম ধরানো বাতাবরণের মাঝে উষ্ণ গলায় বারান্দায় দাড়িয়ে আপন মনে রবীন্দ্র ঠাকুরের প্রেমের কবিতা আউড়াচ্ছে বিনী। তার প্রিয় কবি এবং লেখকদের একজন হলেন রবীন্দ্র ঠাকুর। সেঁজুতি হলো রবীন্দ্রনাথ লিখিত বিনীর প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্র লিখিত নৌকাডুবি তার প্রিয় এক উপন্যাস। উপন্যাসটির প্রতিটি লাইন তার মন ছুঁয়ে যায়।

এক প্রকৃত রবীন্দ্র প্রেমী হওয়ায় নৌকাডুবি নিয়ে বিনীর কোনো অভিযোগ নেই। তবে হঠাৎ হঠাৎ তার মনে হয় রমেশ ও হেমনলিনীদের বুঝি কোনওদিন মিল হতে নেই ? যেমনটা তার আর সরাবের হয়নি। সরাবও তো রমেশের মতোই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে। পার্থক্য শুধু একটাই বিয়েটা তারও হয়েছে এবং সে সরাবকে ভুলে একলা বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

শীতল বাতাবরণে ঘাড়ের ওপর কারোর উষ্ণ নিশ্বাস টের পেলো বিনী। পিছনে দাঁড়িয়ে একজন তার চুল নিয়ে খেলছে। কাছে কোথাও থেকে ভেসে আসছে বেলি ফুলের গন্ধ। বিনী জানে সেই কেউ একজন হলো আবির আর সে বেলি ফুলের মালা জড়াচ্ছে তার হেমনলিনীর চুলে। আবিরকে দেখলে বিনীর মনে হয়, না সব রমেশ আর হেমনলিনীর বিচ্ছেদ হয়না। কেউ কেউ পেয়ে যায় তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে খুব গভীর ভাবে।

‘ তুমি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারো ? ‘

‘ একটু আধটু ‘

‘ তাহলে শোনাও ‘

আবিরের কথায় আপত্তি করছিলো বিনী কিন্তু আবিরের আকুল আবেদনের কাছে তার আপত্তি টিকেনি। প্রিয় মানুষটার মন রাখতেই সে ধরলো তার প্রিয় এক রবীন্দ্র সঙ্গীত…

আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী,
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে
ওগো বিদেশিনী,
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী।

তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি
হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী…

মৃদু শীতল হাওয়ায় মধুর এক রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে প্রিয়তমাকে নিয়ে হারিয়ে হয়েছে গানের দুনিয়ায়। পুরোটা সময় কেটেছে ঘোরের মাঝে। গান যখন শেষ হলো আবির তখনও ঘোরে। বিনীর ডাকে তার সম্বিত ফিরলো। ঘোরে আচ্ছন্ন গলায় বললো ‘ তোমার গলা ঠিক যেন মহুয়া। এত মিষ্টি গলা অথচ সাধারণ এক পরিচয় তোমার। চাইলেই কিন্তু নিজেকে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে পার। ‘

আবিরের কথায় হাসলো বিনী। বললো ‘ ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সেগুলোকে বুড়ি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছি। বিয়ে হয়েছে, সংসার করছি। মেয়েদের না বিয়ের পর অত শখ থাকতে নেই। ‘
‘ ইচ্ছে নেই সেটা বলো। শুধু শুধু বিয়ের নামে দোষ দিও না। আম্মা শুনলে তোমাকে না ধুয়ে দিবেন। বলবেন আর কাম পাও না না ? শুধু শুধু বিয়ার নামে দোষ দাও কিল্লেগা ? ‘

আবিরের কথায় হো হো করে হেসে দিল বিনী। হাসতে হাসতেই কোনক্রমে বলিল ‘ শুধু শুধু আমার শাশুড়ি মায়ের নামে দোষ দিও নাতো। তোমরা সকলে তো আছই আম্মাকে হিটলার রূপে দেখানোর জন্য। কেন যে এমন করো কে জানে। আম্মা খুবই ভালো। ‘
আবির বললো ‘ বাহ্ তোমরা শাশুড়ি বউ দেখি একজন আরেকজনের পাগল। মাঝখান দিয়ে আমি গ্যাড়াকলে পড়লাম। কেউ দেখি আমায় পাত্তাই দেয় না। ‘

‘ অত পাত্তা পাওয়ার প্রয়োজন নেই বুঝলে। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমোতে এসো। ‘

—-

বাহিরে অবলীলায় মেঘরাজের তান্ডব চলছে। আজ দিন কয়েক যাবৎ সন্ধ্যা নেমে এলেই মেঘরাজ তার কেরামতি দেখাতে শুরু করেন। সারারাত অবিরাম বৃষ্টি ঝরিয়ে পরের দিন ঠিক যেন ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে যান। তারপর আবার দেখা মিলে সন্ধ্যায়। এ কিসের লক্ষ ? শিউলি ফোঁটানো শরৎ রাজের আগমন বার্তা নাকি ?

হয়তো তাই। আজ মেঘরাজের সঙ্গে সঙ্গে যেন তুষারের চোখেও বর্ষণ নেমেছে। মলিন চোখে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকটায়। সেখানে পড়ে আছে হলদে খামটা। তার চোখের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, পরনের কাপড় এলোমেলো আর মাথার চুলগুলো অগোছালো। মুখে মলিনতার ছাপ। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে সবটা শেষ হয়ে গেলো। যেই মানুষটা কিছু দিন আগে পর্যন্ত তার সঙ্গে ছোট্ট একটা সংসার করার স্বপ্ন দেখছিল তারই আজ বাদে কাল বিয়ে। কালকের পর মানুষটা আর থাকবে না, তাকে নিয়ে ভাবনায় মশগুল হওয়া কিংবা নিজেদের সংসার সাজানোর চিন্তা নিয়ে বসাও আর হবে না।

দূর্বল হাতে খামটা আবারও হাতে নিল তুষার। আসলেই কি তার প্রেয়সী তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নাকি এসব নিছকই এক মজা তা বোঝার জন্যই সে আবারও চিঠিটা খুলল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট ছোট হিজিবিজি অক্ষরে জাবিয়ার লেখা বিরহ ভাসিত চিঠিখানা…

প্রিয় তুষার,

তোমার নামটা কেমন অদ্ভুত তাইনা ? প্রথম যখন শুনেছিলাম চমকে গিয়েছিলাম। ছোটকালে বাবার কাছে শুনেছিলাম শীতের দেশে শীতকালে সাদা সাদা বরফের কুচির মতো বৃষ্টি হয় যাকে বলে তুষার। ইতালির ভাষায় লা নেভে আর জাপানে বলে ইউকি। ভেবেছিলাম এ আবার কেমন নাম। মানুষের নামও বুঝি তুষার হয় ?

তোমার নামের কারণেই তোমার প্রতি আমার কৌতুহল ছিল। সেই কৌতুহল থেকেই মনে তুমি জায়গা করে নিলে। গড়ে উঠলো এক নতুন প্রেমের কাহিনী। তবে সেই প্রেম আর গড়িয়ে বিয়ে অব্দি গেলো না। কেন জানো ? আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে বিলেত থেকে এসেছে। সম্পর্কে সে আমার মামাতো ভাই।

ভাবিনি কোনওদিন মামাতো ভাইকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু আমি ভবিতব্য মেনে নিয়েছি। কেন জানো ? আমি তোমায় ভালোবেসে হারাতে চাইনা। জানি না আর কখনও দেখা হবে কিনা। হয়তো কোনো একদিন শিউলি তলায় আবারও দেখা হবে যখন চামড়ায় ভাঁজ পড়বে, চুলগুলোয় পাক ধরবে আর সমাজকে মেনে চলার মতো সমস্ত শক্তি দেহ ছেড়ে নির্বাসন নিবে।

ইতি,
তোমার প্রণয়িনী

খুবই ছোট এই এক পাতার চিঠিটা পড়ে নিজের চোখের অশ্রুদের আর ধরে রাখতে পারল না তুষার। চিঠিখানা আকড়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো। গলার কাছে নিঃশ্বাসটা তার ভারী হয়ে এলো। দম বন্ধ হতে শুরু করলো। কেন এমন হলো তার সঙ্গে ? কেন ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েও পাওয়া হলো না ? কেন তাকে ভালোবেসেও ভালোবাসা হলো না ? কেন মনে থাকা ভয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়ালো ?

এত এত কেনর উত্তর পাওয়া হলো না তুষারের। চার দেওয়ালের মাঝেই তার কান্নাগুলো, আত্ম চিৎকারগুলো বন্দী হয়ে রয়ে গেলো। কারোর আর জন্য হলো না নতুন এক বিরহের গল্প। কেউ আর বলতে পারলো না আমায় তুমি তোমার মাঝেই রেখো চিরকাল। সব আর্তনাদেরা এসে ভিড় করলো সেই চার দেয়ালে যেখানে হত্যা হয়েছে এক অসহায় প্রেমিকের নরম হৃদয়খানা, রচিত হয়েছে নতুন এক বিরহের গল্প। জানা হলো না, আর কারো জানা হলো না দুই হৃদয়ে দাফন হওয়া সেই মৃত্যুর গল্প।

~চলবে ইনশাল্লাহ্…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here