এখানে বেলি ফুলের মালা-১৮
———————
কিংবা মৃত্যু দুটোই বিধাতার ইচ্ছা। জন্ম যেমন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে হয় মৃত্যুও তেমনই তার ইচ্ছেতে হয়। স্রষ্টার সৃষ্ট সকল জীবকেই এই মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। হোক সে স্থল ভাগের পিপড়ে কিংবা সাগরের তিমির। মৃত্যুর স্বাদ পাওয়া যে সকল জীবের জন্য অনিবার্য। এই চিরন্তন সত্য জানার পরও আমরা তৃষ্ণার্ত পথিকের মতোই অন্যের মায়ায় জড়িয়ে যাই। ভালোবেসে নিজের আপন সত্তাকে হারাই।
আজাদ সাহেব তার মৃন্ময়ীকে হারিয়ে তবুও এতকাল মনের জোরে বেচেঁ ছিলেন। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বুঝ দিতেন মৃন্ময়ী না থাকলেও তার সন্তানরা আছে। মনের জোরে অপেক্ষার ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া শরীরটা টেনে হিচরে সামলে রেখেছেন। কিন্তু সবকিছুরই এক নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময়ের বাহিরে স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই সম্ভব না।
এতকাল মনের বলে টিকে থাকা আজাদ সাহেবের প্রয়াতে বাড়ির সকলে যেন নীরব দর্শকে পরিণত হলেন। খাটিয়ার উপর আজাদ সাহেবের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে শাহিদা খাতুন স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তার চোখে নেই কোনো অশ্রু,মুখে নেই কোনো হাসি। বিনী তার পাশে তার হাত জড়িয়ে বসে আছে। শাহিদা খাতুনকে এতটা নীরব সে কখনো দেখেনি। শাহিদা খাতুন গম্ভীর ধরনের মানুষ। আজাদ সাহেবের মতো হাসাহাসি করার ক্ষমতা তার নেই।
তবে শাহিদা খাতুন যে একেবারেই হাসেন না তানা। শাহিদা খাতুনকে প্রথমবার তো কালই হাসতে দেখেছিল বিনী। হাসলে মানুষটাকে কি অমায়িক লাগে। চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। অথচ সেই মানুষটাই আজ রক্ত মাংসে গড়া শুধুই মাত্র এক পাথরের মূর্তি।
আজাদ সাহেবের মৃত্যুতে আবির আর আনিস নিজেদের বদ্ধ অনুভূতির প্রকাশ করতে পারেনি। দিনশেষে তারা পুরুষ আর সামাজিক শিক্ষা বলে পুরুষ মানুষদের কাদতে নেই। আজাদ সাহেবের জানাজা পড়ানো হয়েছে। উনার জানাজায় এলাকার সব বুজুর্গ, সম্মানিত ব্যক্তিরা ও দুজন এলাকারই আলেম এসেছিলেন।
খবর পেয়ে জহির সাহেব ছুটে এসেছেন। সামাজিক ভদ্রতা রক্ষার্থে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে সালমা ইসলামও হাজির হয়েছেন অথচ আবিরদের বাড়ি আসার প্রতি তার বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ ছিল না। সবটাই আসলে আউট অফ কার্টেসি। নাহলে যেই ছেলের পরিবারকে তিনি দুই চোখে সহ্য করতে পারেননা তার বাবার জানাজায় তিনি আসবেন কথাটা নেহাতই সময়ের বিলাসিতা।
সামাজিক ভদ্রতা রক্ষার্থে এলেও সালমা ইসলামের এই প্রথম শাহিদা খাতুনের মুখ চেয়ে খারাপ লাগলো। ভিতরটা অনুতাপে পুড়তে লাগলো। মনে হলো এই মানুষটাকে কিনা তিনি একেবারেই দেখতে পারেন না অথচ আজ তার অসহায়, নীরব মুখখানা দেখে তার হৃদয়ে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা উঠেছে।
জাবিয়া ছুটে এসেছে শেষবারের মতো তার বড় কাকাকে দেখতে। আজাদ সাহেবকে খাটিয়ার উপর শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখে শাহরিয়ারকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে সে। এই মানুষটাই কিনা তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে অথচ আজকের পর আর তাকে দেখা হবে না।
জুহারিন আজাদ সাহেবকে শুয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বারবার তার চোখে মুখে হাত রেখে বলছে ‘ দাদ্দু… ও দাদু উঠো তুমি। বেরু বেরু যাবে না। ‘
মেয়ের কথায় খানিক পরপর কেঁদে উঠছে আফিফা। কোনওদিন ভাবেনি যেই মানুষটা তাকে মা মা ডেকে মেয়ের মতো আদর করতেন তাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে হবে। আজাদ সাহেবের বলা একটা কথা আজ অনেক মনে পড়ছে।
‘ আমার বহুকালের আক্ষেপ ছিল আমার একটা মেয়ে হলো না। অথচ আমার একটা মেয়ের আক্ষেপে আল্লাহ আমায় দুটো মেয়ে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিনী, আফিফা আমার ছেলের বউ নয়, ওরা আমার মেয়ে। আমাদের বাড়ির সম্মান ওরা। ‘
আজাদ সাহেবের দাফন কার্য সম্পন্ন হয়েছে। জহির সাহেব, শাহরিয়া, আনিস আর আবির নিজে খাটিয়া তুলেছে। সাজ্জাদ সাহেবও আবিরদের সঙ্গে হেঁটে পারিবারিক কবরস্থানের দিকে গেছেন। তাদের পারিবারিক কবরস্থান বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে।
জানালা দিয়ে আবিরদের কবর যাত্রা দেখছেন শাহিদা খাতুন। যেই মানুষটার সঙ্গে এতকাল সংসার করলেন আজ থেকে সেই মানুষটাই নাকি ওই একলা নির্জন জায়গায় সাড়ে টিন হাত মাটির নিচে শুয়ে থাকবেন। যেই মানুষটাকে বিয়ের পর থেকে আজ অব্দি কোনওদিন একলা ছাড়েননি তাকে ছাড়াই আজ থেকে একলা থাকতে হবে।
জাদিদ আজাদ সাহেবকে দাফন করতে যায়নি। তার জীবনে সাজ্জাদ সাহেব ঠিক যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, আজাদ সাহেবও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আজাদ সাহেব সাজ্জাদ সাহেবকেও ছাড়িয়ে যান।ছোটবেলায় পরীক্ষার খাতায় নাম্বার খারাপ আসলে সাজ্জাদ সাহেবের নাম করে আজাদ সাহেবের বাবা হয়ে হাজির হওয়ার কথাটা মনে পড়লে আজও বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আজও মানুষটা কেন তার সঙ্গে রয়ে গেলো ?
জাদিদের কাছে আজাদ সাহেব বাবার মতো একজন মানুষ। সন্তান হয়ে বাবার লাশ কাধে তুলে নেওয়ার মতো অমানসিক যন্ত্রণা এই নির্দয় পৃথিবীর বুকে আর একটাও নেই। মানুষটা যে তার বাবা। বাবাকে কি করে একলা ওই নির্জন জায়গায় নির্দয়ের মতো ফেলে আসে ? এমনটা করার মত পাষাণ হৃদয়ের মানুষ সে যে এখনও হতে পারেনি।
মৃত ব্যক্তির বাড়িতে তিনদিন চুলা জ্বলতে নেই এমনটাই শুনে এসেছে সকলে। তাই আফিফা আর জাহানারা রান্নার চিন্তা করেননি। শাহিদা খাতুন চিরকাল গাম্ভীর্য বজায় রেখে মুখের উপর সত্য কথা বলায় বিশ্বাসী। তাই তার এই স্বভাবের জন্য আশেপাশের প্রতিবেশী কোনওদিনই তাকে পছন্দ করতেন না। তবে স্বামী হারা শাহিদা খাতুনের প্রতি এতটা নির্দয় হওয়ার মতো পাষাণ হয়তো তারা নয়। সেই কারণেই কয়েকজন এগিয়ে এসেছেন আগামী তিনদিনের খাবার তাদের ঘর থেকে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে।
কিন্তু শাহিদা খাতুন এই ব্যাপারে নম্র কথায় আপত্তি জানিয়েছেন। সরাসরি বলেছেন ‘ আমাগো খাবারের যোগান আমরাই করবার পারি। আর কেউ না রাধলেও আমি রাধমু। এই বয়সেও বিশজন মাইনসের খাবার রান্ধনের শক্তি আমার শরীলে আছে। আমার হাতের খাওন কারো খাইতে সমস্যা হইলে না খাইয়া থাকবো তবুও এই বাড়িতে বাইরের খাবার ঢুকবো না। এসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করিনা। ‘
অতঃপর প্রতিবেশী বিবিরা আর কি করবেন। শাহিদা খাতুনের নম্রভাবে করা অপমানে তারা অপমানিত বোধ উপলব্ধি করিয়া আর জীবনে এ বাড়ি মুখো হবেন না কইয়া প্রস্থান করিলেন। জীবনে অনেক মানুষ দেখেছেন তারা। কিন্তু স্বামী হারানোর পরও শাহিদা খাতুনের মতো শক্ত ধাচের মানুষ দেখেননি তারা। একি আদৌ মানুষ না রক্তে মাংসে গড়া পাথরের প্রতিমা ?
রান্নাঘরে দাউ নিয়ে সবজি কাটছেন শাহিদা। তার সঙ্গে আছে বিনী। জাহানারা আর আফিফাকে রান্নাঘরে আসতে বরণ করেছেন শাহিদা। তেনারা এখনও শোকে কাতর কাজেই রান্না তাদের না করাই উচিত। উনি আবেগী নন। উনার সঙ্গে সঙ্গে উনার ছোট ছেলের বউ বিনীও শক্ত ধাচের। কাজেই নিজেদের সামলে নিতে জানেন তারা।
বিনীকে রান্নার কাজ দিয়েছেন শাহিদা আর নিজে সবজি কাটছেন। কুটকুট আওয়াজে সবজি কাটছেন তিনি। আজকের রাতটা বিনীর বাবা মা এখানেই থেকে যাবেন যেহেতু অনেক রাত হয়ে এসেছে। তাই সবার জন্য নিজেই রান্না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বিনী আপাতত রাধছে, তরকারি কাটা শেষ হলে তিনিও রান্নায় নামবেন।
বিনী অবাক হয়ে দেখছে শাহিদা খাতুনকে। এতটা শক্ত মনের মানুষ আগে দেখেনি সে। তার বিয়ের ছয়মাস হতে চলেছে। এতদিনে সে শাহিদা খাতুনের আচার আচরণ ও ব্যবহারে টের পেয়েছে আজাদ সাহেবকে খুব ভালোবাসেন তিনি। অথচ তার প্রয়াতে তিনি কাদেননি। শাহিদা খাতুন এতটা শক্ত নাহলেও পারতেন। তাকে কাদতে না দেখে এলাকার অনেকেই বাজে গুজব ছড়িয়েছে। শাহিদা খাতুন নাকি স্বামীর মৃত্যুতে একেবারে শোকাহত নন।
বাড়ির পুরুষদের কাদতে দেখেনি বিনী। সে জানে সমাজ পুরুষদের কাদতে নেই বলে যেই প্রবাদ চালু করেছে তারই ফল এটা। একজন মেয়ে মানুষ নিজের কষ্ট যত সহজে মেলে ধরতে পারে, ছেলে মানুষ তত সহজে নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু শাহিদা খাতুনের পাষাণ মন বাকিদেরও ছাড়িয়ে গেছে। বাবার মৃত্যুতে আনিস, আবির অব্দি নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছে। সাজ্জাদ সাহেব লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ঘরে কেঁদেছেন।
অথচ শাহিদা খাতুন কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত বিনীর সামনেই আছেন। বিনী একবারও দেখেনি তাকে কাদতে। মানুষটা কি তাহলে অসহনীয় কষ্টের যন্ত্রণায় পাথর হয়ে গেলেন ? তবে আজাদ সাহেবের মৃত্যুতে শাহিদা খাতুনের মুখের জৌলুস যেন হারিয়ে গেছে। একদিনেই চেহারার ধারালো সেই সৌন্দর্য্য কমে এসেছে।
বয়স হওয়ার পরও শাহিদা খাতুন এখনও ফর্সা, সুন্দর, মায়াবতী মুখশ্রীর অধিকারী। চোখের নিচে তার সর্বদা অদৃশ্য এক কাজল পড়ানো। গোলগাল মুখটা মায়াবী। নিজের এত দিনের চেনাজানায় এমন ধরনের মহিলা বিনী কম দেখেছে। মনে যন্ত্রনা নিয়েও সবার সামনে স্বাভাবিক মুখে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়।
শাহিদা খাতুন চিচিঙ্গা কাটছেন। কাটতে কাটতেই তিনি আনমনে নিঃশব্দে হাসলেন। মনে মনে বললেন ‘ তুমি চলে গেছো আমার ছেড়ে তোমার মৃন্ময়ীর কাছে!! অথচ এটা ভাবলে না এত বছর তোমার সঙ্গে সংসার করে তোমায় ভালো না বেসে আমি থাকতে পারিনি। ‘
বিনী ব্যস্ত রান্নায়। তার মন, মস্তিষ্কে আজাদ সাহেব ঘাট বেধে বসেছেন। মানুষটার সঙ্গে তার আহামরি কোনো স্মৃতি নেই তবুও যেন মানুষটা এই বাড়ির সবটা জুড়ে ছিল। তার কথা মনে পড়ছে বিনীর প্রতিক্ষণে। জহির সাহেবের পর তো আজাদ সাহেবই তার কাছে বাবার মত একজন।
শাহিদা খাতুন সবজি কাটতে কাটতে হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন। বিনী চুলার পার থেকে দৌড়ে আসলো। শাহিদা খাতুনের আঙ্গুল কেটে রক্ত বের হচ্ছে। বিনী দ্রুত শাহিদা খাতুনের হাত ধরে কাটা আঙ্গুল কল পাড়ে কলের নিচে ধরলো। বহিত রক্তের স্রোত বন্ধ করা দরকার। কিন্তু রক্ত কিছুতেই বন্ধ হতে চাইছে না।
‘ আম্মা হাতে এন্টিসেপটিক দিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে হবে ‘ বলে বিনী মুখ ফিরিয়ে এবার শাহিদা খাতুনের দিকে চাইলো। তবে লক্ষ্য করলো শাহিদা খাতুনের শরীর মৃদু কাপছে। কিন্তু কেন ? তার চোখ শুষ্ক ও নরম। জলে চোখ ভেসে আছে কিন্তু অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে না চোখ থেকে।
শাহিদা খাতুনের থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর জড়িয়ে ধরলো বিনী। তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শাহিদা খাতুন এমন একজন মানুষ যিনি চাইলেও শব্দ করে কাদতে পারেন না। চিরকাল মনের ভাব লুকিয়ে রাখা যার স্বভাব তাকে হাউমাউ করে কাদতে দেখার সৌভাগ্য হবে বলে আশা করা যায়না।
‘ তাকে আমি খুব ভালোবেসেছিলাম রে। ‘
বেশ খানিকক্ষণ নীরবে কান্নাকাটি শেষে শান্ত হলেন শাহিদা খাতুন। নিজেকে ধীর হাতে ছাড়িয়ে নিলেন বিনীর হাত থেকে। বিনী বললো ‘ আম্মা আপনি একটু ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি রান্নার দিকটা দেখে নিবো। ‘
শাহিদা খাতুন মানলেন না। দৃঢ় কন্ঠে বললেন ‘ দরকার নাই। আমি করমু, তোমার দরকার পড়লে তুমি যাইয়া রেষ্ট করো। ‘
বিনীর রাগ হলো। শাহিদা খাতুন বরাবর নিজের মনমতো চলেছেন। কোনওদিন কারোর কথা শুনেনওনি এবং কেউ কখনো তার উপর কথা বলার সাহসও পায়নি। তাই বলে সবসময় নিজের মনমতো চললে তো হয়না। মাঝে মাঝে অন্যদের মতকেও সম্মান করতে হয়।
বিনী অসন্তোষ গলায় বললো ‘ আমি জানি আপনি করতে পারবেন কিন্তু আপনি জেদী হলেই তো আর আমিও জেদী হতে পারছি না। আপনি নিজের শরীরের কথা না ভাবলেও আমাদের চিন্তা আছে আপনাকে নিয়ে। শুধু আপনিই তো আর আমাদের নিয়ে চিন্তা করেন না। আমরাও আপনাকে নিয়ে চিন্তা করি। মেয়ে হয়ে মায়ের ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তা না করার মতো পাষাণ এখনও হয়ে উঠতে পারিনি। ‘
বিনীর কথায় দমে গেলেন শাহিদা খাতুন। বিনীর কথার জবাবে আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। দূর্বল শরীর নিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাড়ালেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন ‘ তোমাদের আব্বার অনুপস্থিতিতে তোমরা এখন আমার লগে এমন শক্ত ব্যবহার করবার পারছো। সেই মানুষটা থাকলে তোমাগো এই সাহস হইতো না। আমি সব বুঝি, তোমরা বদলায় যাইতাছ। ‘
শাহিদা খাতুনের প্রস্থানের পথ চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিনী। শাহিদা খাতুন এতটা ভেঙে পড়বেন সেই আশা সে করেনি। শক্ত পোক্ত নারী শাহিদা খাতুনকে এতদিন অন্যরূপে দেখে এখন আচমকা এত দূর্বল ভাবে দেখতে তার ভালো লাগছে না। শাহিদা খাতুন শেষ কথাগুলো বড্ড লাগছে। আজ আজাদ সাহেব থাকলে পরিস্থিতিটাই অন্যরকম হতো। তাদের এক পরিপূর্ণ এক পরিবার হতো।
—-
রোজকার মতোই সরাবের ফিরে আসার পর বইখাতা রেখে রান্নাঘরে তরকারি গরম করতে ঢুকেছে রুনা। আজকাল শরীরটা ভালো লাগে না তার। দূর্বল লাগে কেমন। তবে রুনা শরীরের জোরে নয় মনের জোরে কাজ করে। তাই শত দূর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সে কাজ ফেলে রাখতে পারেনা। বলা যায় আদ্যপান্ত সে এক সংসারী মেয়ে।
সরাব জামা কাপড় বদলে এসে হিসাবের খাতা নিয়ে মেঝেতে বসেছে। রুনা আগেই পাটি বিছিয়ে রেখেছিল। সরাব তখন হিসাব মিলাতে ব্যস্ত কিন্তু রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা বিকট এক চিৎকারে খাতা রেখেই ছুটে গেলো সে। গিয়ে দেখলো রুনা কলপাড়ে দাড়িয়ে বমি করছে। সরাব গিয়ে ওর চুলগুলো সামনে থেকে পেঁচিয়ে এনে পিছনে রেখে আরেক হাত দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।
রুনার মনে হচ্ছে বমির সঙ্গে সঙ্গে তার নাড়িভুঁড়ি অব্দি বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। হঠাৎ করে কি যে হলো। মনে হলো মাছের গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি এসব সম্ভব ? সবে তো একদিন হলো খবরটা পেলো। তাহলে ?
রুনাকে রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসে মেঝেতে পাটির উপর বসালো সরাব। রুনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল ‘ তোর আবার কি হলো ? একটু আগে তো ঠিকই দেখলাম। এই কিছুক্ষণের মধ্যে শরীর খারাপ হলো কি করে ? বেশি খারাপ লাগছে ? ‘
রুনা থিতু হয়ে বসলো। পেট থেকে সব উগড়ে দিয়ে এখন শান্তি লাগছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে সে বললো ‘ জানিনা কি হয়েছে। মাছের গন্ধ খারাপ লাগছে। কেমন বমি পাচ্ছে। ‘
‘ তাহলে তোর এখন কিছু করার দরকার নাই। আমি কাল তোকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবো আর যথা সম্ভব কাজ কম করার চেষ্টা করবি। বাড়ি ফিরলে এসব আমিই করবো নী। তুই এখন এখানে বস, আমি তরকারি গরম করে আনছি। ‘
সরাব উঠে যেতে ধরলে রুনা বললো ‘ দরকার নেই, আমি উঠছি। তুমি সারাদিন পর বাহির থেকে ফিরেছ। একটু রেস্ট করো। ‘
‘ এত কথা না বলে চুপচাপ ওই পিড়িতে বস। আমি কাজ করছি তুই বসে বসে দেখ। কতদিন কথা হয়না তোর সঙ্গে। একটু কথা বলি। ‘
সরাবের কথায় রুনার মনটা ভালো হয়ে গেলো। এরকম একজনকে ভালোবাসতে পেরে সে আসলেই খুশি। মানুষটা সারাদিন শেষে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে তবুও তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এমন একজনের স্ত্রী হওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। রুনা নিশ্চই কপাল গুনে ভাগ্যবতী।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….