এখানে বেলি ফুলের মালা-১৯

0
209

এখানে বেলি ফুলের মালা-১৯
———————

হারিকেনের মৃদু আলোয় হাঁটুতে মাথা রেখে এক নাগাড়ে সরাবকে দেখে চলেছে রুনা। সরাব ব্যস্ত হাতে তরকারিগুলো গরম করছে। মাটির চুলার তাপে ঘরময় ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। সেই ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশে সরাবের মুখশ্রী মায়াবী হয়ে উঠেছে। এই মায়াবী মুখখানার দিকে তাকালে রুনার মনে হয় এই মানুষটা এখন তার। যাকে এতকাল নিজের করে পাবার তীব্র বাসনা মন জুড়ে হাহাকার বসিয়েছিল আজ সে তার হয়েছে।

কাজ করতে করতে কয়েকবার চোরা চোখে সরাব রুনাকে দেখলো। রুনা এক দৃষ্টে তাকে দেখেই যাচ্ছে। তার চোখে মুখের সরাবের প্রতি মুগ্ধতা আর অন্তরে এক আকাশ সমান ভালোবাসা। বিনীর মতো নীরব, আত্মকেন্দ্রিক এক মেয়েকে ভালোবাসার পর আবারও কাউকে ভালোবাসতে পারবে এই কথা সরাবের মনেতেও আসেনি কোনওদিন।

আসলে কোনওদিন আসেনি বলে ভুল হবে। সরাব মনে আনতে চায়নি দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসার কথা। কারণ, কারণ সে চায়নি বিনী ছাড়া দ্বিতীয় কেউ তার অনিদ্রিত রাতের রানী হোক। বিনী ছাড়া অন্য কাউকে সে ভালোবাসার চোখে দেখুক। কিন্তু ভাগ্যের উপর কারোর মাইর নেই। তাই হয়তো বিনীকে এতটা ভালোবাসার পরও তাকে পাওয়া হলো না।

সরাবের এখন মনে হয় যা হয় তা হয়তো ভালোর জন্যই হয়। বিনীরা সামাজিক মর্যাদা বলো কিংবা অর্থ বিত্তের দিক থেকে, দুই দিক দিয়েই ওরা প্রভাবশালী। সেখানে বিয়ের পর বিনী ওর সঙ্গে, ওর মায়ের সঙ্গে এবং ওদের এই যৎসামান্য কুড়ে ঘরে হয়তো মানিয়ে নিতে পারতো না। সেদিক থেকে রুনা আর সে একই পর্যায়ের মানুষ। রুনা হয়তো আরেকটু নিম্নে। তাই তারা দুজনে মানিয়ে নিতে পেরেছে।

ভালোবাসলে সামাজিক মর্যাদা, অর্থ বিত্ত সবই নিছক ছেলেমানুষী কথাটা পুরোপুরি ভুল। বিয়ের মতো একটা সম্পর্কে শুধু ভালোবাসা থাকলেই হয়না। মানিয়ে নেওয়ার এবং মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হয়। যেটা হয়তো বিনীর নাও থাকতে পারতো। তাই সরাব এখন অন্তত রুনাকে বিয়ে করে আফসোস করছে না। এখন কেন, সে যখন বিয়ে করেছিল, যখন তার মনে রুনার প্রতি কোনো অনুভূতি ছিল না তখনও সে আফসোস করেনি।

নিজের অনুভূতি, নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সরাব বরাবর পরিষ্কার। সে যা করে ভেবে চিন্তে করে। একটা প্রবাদ আছে করিয়া ভাবিও না, ভাবিয়া করিও। এই প্রবাদখানা সে বড্ড ভাবে মানে। তাই রুনাকে বিয়ে যখন করেছিল তখনও তার কোনো আফসোস ছিল না এবং এখন তাকে ভালবাসার পরও কোনো আফসোস নেই।

সরাবের জীবনসঙ্গী হিসেবে রুনা যোগ্য। সে হয়তো পুরুষ মানুষ কিন্তু রুনা যে সেই অনেক পূর্বকাল হতেই তাকে নিজের করে পাওয়ার আশায় দিন গুনছে সেটা সেও বুঝতে পেরেছে। তাই বুঝতে পেরেই তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে হয়তো তার ভালোবাসার মানুষটিকে পায়নি কিন্তু অন্যদের পেতে আপত্তি কোথায়।

‘ এভাবে কি দেখছিস ? ‘

সরাব কাজ করতে করতে আড়চোখে রুনাকে দেখে বললো। রুনা ওকে এক দৃষ্টে দেখছিল। ওর কথা শুনে সে নড়েচড়ে তো বসলো কিন্তু সরাবের উপর থেকে নিজের দৃষ্টি সরালো না। মুগ্ধ, বিমোহিত নয়নে সরাবের মুখ পানে চেয়ে বললো ‘ তোমাকে ‘

‘ আমাকে দেখার মতো নতুন কিছু কি আছে ? রোজই তো দেখিস। ‘

সরাবের কথায় রুনা হাসলো। বললো ‘ এই দেখা আর ওই দেখার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। মনে নেই শেষ কখন তোমায় এভাবে মন দিয়ে দেখেছিলাম। তোমায় দেখার সৌভাগ্য ইদানিং আমার খুবই কম হয়। বাড়ি ফিরছ তুমি দেরি করে। তারপর খেয়েদেয়ে নিজের মতো শুয়ে পড়ো। একবারও মন দিয়ে তাকিয়ে আমায় দেখো না কিংবা আমাকেও তোমাকে দেখতে দাও না। আচ্ছা আমায় তুমি ভালোবাসো না তাইনা ? সেই ভালোবাসতে না পারার শাস্তিই বুঝি দিচ্ছ তুমি ? কিন্তু এই শাস্তি কি আদৌ আমার প্রাপ্য ? ‘

শেষের কথাগুলো বলার সময় সরাব রুনার গলায় থাকা কম্পন টের পেলো। ও চকিতে তরকারির পাতিল নামিয়ে রুনার দিকে ফিরে তাকালো। রুনার চোখে জল আর ঠোঁটে হাসি। কিসের হাসি এটা ? তীব্র বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া হাসি ? কিন্তু সরাব তো ভালোবাসে রুনাকে। কতটা ভালোবাসে সেটা সে জানেনা। তার ভালোবাসা কোনো পরিমাপক যন্ত্রে তুলে পরিমাপ করার বস্তু নয় যে মেপে দেখবে। এ তো স্রেফ অনুভব করার জন্য।

কিন্তু রুনা তার উপর অভিমান করেছে!! তার ইদানিং দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে অভিযোগ করছে ? সে বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়ে তা নিয়ে অভিযোগ করছে ? অথচ সে জানেই না রোজ রাতে তার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তার অগোচরেই সরাব তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখে সময়টা পার করে। শুধু রুনাকে খুশি রাখবে,রুনার সব ইচ্ছে পূরণ করবে বলেই রোজ রাতে দেরি করে দোকান বন্ধ করে যাতে আরেকটু বেশি টাকা কামাই করতে পারে।

অথচ ছোট্ট এই মেয়েটা কিছু না জেনেই তার নামে মিথ্যা অভিযোগ করছে। যেই মেয়েটা কোনওদিন তার মুখ তুলে তাকানোর আগে শতবার চিন্তা করেছে সে আজ তার নামে অভিযোগ করছে। নারী বুঝি এমনই পাষাণ মনের। প্রিয় মানুষটার কাছে অভিযোগ করার আগে বুঝি তার বুকটা কাপে না ? মনে হয় না অপর দিকের মানুষটা কি ভাববে।

তবে সরাব বিচক্ষণ। সে তার মাকে দেখে বুঝেছে নারী জাতি অভিমানী। তাই এই অভিমানী প্রেয়সীর অভিমান সে নিজেই ভাঙাবে। ভালোবেসেছে যখন তখন ভালোবাসার মানুষটার রাগ ভাঙ্গানোও তার দায়িত্ব। নিজের দায়িত্বে কার্পণ্য করার মতো মানুষ সে নয়।

‘ তুই আমার দেরি করে ফেরাটা দেখলি অথচ এটা দেখলি না তোকে একটু আরামে রাখার জন্য রুমা খালাকে নিজে এসে পড়িয়ে যেতে বলেছি। আমি অন্য সবার মতো নই। নিজের ভালো লাগা,খারাপ লাগা, ভালোবাসা মুখে মুখে প্রকাশ করতে পারিনা। এসব তোকেই বুঝে নিতে হবে। তোকে নিজের ভালো লাগা বুঝাতে না পারা যদি আমার ব্যর্থতা হয় তাহলে হয়তো সত্যিই আমি ব্যর্থ। কিন্তু তুই যে অভিযোগগুলো করলি সেগুলো কি আদৌ সত্য ? আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসিনি ? ‘ সরাব এগিয়ে গিয়ে রুনার গালে হাত রেখে ওর অশ্রুগুলো মুছে দিয়ে বললো।

রুনা থমকালো, সরাব শুধুমাত্র তার আরামের জন্য রুমা খালাকে নিজে এসে পড়িয়ে যেতে বলেছে তার জানা ছিল না। সরাব তার জন্য এত ভাবে সে বুঝতে পারেনি। সরাবের মনে তবে সত্যিই সে আছে। রুনাকে চুপ করে যেতে দেখে অস্থির হলো সরাব। রুনার গালে নিজের হাতটা আরও চেপে ধরলো। আগ্রাসী কণ্ঠে বলল ‘ উত্তর দে রুনা। আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা কি তুই আসলেই দেখতে পাস না ? তোকে ভালো না বাসলে,তোর প্রতি ভালো লাগা না থাকলে কোনওদিন তোর অতটা কাছে যেতাম না যতটা গেলে লোকে কাছে আসা বলে। ‘

রুনা কি বলবে স্থির করতে পারলো না। শুধু অপলক চেয়ে রইলো। এইদিকে তার নীরবতা সরাবকে পাগল করছে। সে হয়ে উঠছে আরও অস্থির। ভালবাসার,ভালো লাগার মানুষটা যদি ভুল বুঝে তাহলে সেই কষ্ট সহ্য করা যায়না। হৃদয়টা নীল বেদনায় মুষড়ে পড়ে।

খানিক চুপ থেকে রুনা বললো ‘ তুমি যেভাবে বুঝেছ আমি সেভাবে বলিনি। ওটা বলার ভুল ছিল। আমার শুধু তোমার উপর রাগ আছে। তুমি আমাকে সময় দাও না। আমি বলছিনা তুমি আমার জন্য দোকানের কাজ ছেড়ে দাও। আমি শুধু চাই তুমি আমায় একটু সময় দাও, আমায় ভালোবাসো। আমি কখনো তোমার ভালোবাসায় প্রশ্ন তুলিনি কিন্তু আমি চাই তুমি তোমার ভালোবাসা প্রকা…. ‘

রুনা তার কথার সমাপ্তি দিতে পারলো না। তার আগেই সরাব ওকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুজে বললো ‘ আমায় ভুল বুঝিস না বুড়ি… আমি জানিনা আমি তোকে ভালবাসি কিনা। কিন্তু তুই আমায় ভুল বুঝলে আমার খুব কষ্ট হয়। বুকের বা পাশটা চিনচিনে ব্যাথা দুমড়ে মুচড়ে যায়। দয়া করে ভুল বুঝিস না। ‘

রুনা চমকিত, থমকিত এবং পরমুহূর্তে লজ্জা পেলো। সরাব তাকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের মনের গোপন কথাও জানিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে তার কি বলা উচিত। রুনা ভেবে পেলো না। শুধু নিজেকে সরাবের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শ্যাম দেহী সরাবের মুখটা হারিকেনের হলদে আলোয় দেখলো। তারপর সরাবের ললাটে চুমু খেয়ে বললো ‘ আমি তোমায় কখনও ভুল বুঝিনি। আমি জানিনা তুমি আমায় কত ভালোবাসো কিন্তু আমার নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস আছে। আমার ভালবাসা তোমায় কখনও আমাকে ভুলতে দিবে না। আমি তোমায় অর্ধ যুগ আগ হতে ভালোবাসি। যেদিন বুঝতে পেরেছি আমি তোমায় ভালোবাসি সেদিনের পর থেকে তোমায় আর সজ্ঞানে ভাইয়া বলে সম্বোধন করে ডাকিনি। কেন জানো ? ‘

সরাব মাথা নেড়ে না বললো। রুনা বললো ‘ কারণ ভালোবাসার মানুষটাকে কোনো নামে সম্বোধন করার ক্ষমতা আমার তখনও হয়নি। এখনও আমি তোমাকে কোনো নামে সম্বোধন করিনা। কেন করিনা জানিনা, শুধু কিছু না ডেকেই ডাকতে ভালো লাগে। ‘

সরাব হাসলো। আলগোছে জড়িয়ে ধরলো তার প্রেয়সীকে। শুধু জড়িয়েই ধরে রইলো। তার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। রুনার সঙ্গে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে মন চাইছে। যাকে ভালোবেসেছে তাকে ভালোবেসে আবারও কাছে পেতে মন চাইছে। চাওয়াটা কি বেশি কিছু ? কে জানে।

—-

ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। চারদিকে এখনও কোলাহল জমে উঠেনি। শুধু শোনা যাচ্ছে পাখির কিচির মিচির। পূর্বাকাশে সূর্যের কমলাভা। হয়তো খানিক বাদেই পুরোপুরি দেখা মিলবে সূর্যের। জাদিদ দাড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে। তাদের বাড়ির সামনে যেই বাড়ি তার পিছনে পরপর দুটো বাড়ি আছে। সেই দুটো বাড়ির পরেই এক খোলা মাঠ। ওই খোলা মাথা ছোটবেলায় সে আবির আর আনিসকে সঙ্গে করে আজাদ সাহেব এবং সাজ্জাদ সাহেবের সঙ্গে ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলত।

আজাদ সাহেবের সঙ্গে জাদিদের তেমন স্মৃতি নেই। যা ছিল ওই ছোটবেলা অব্দিই সীমাবদ্ধ। তারপর তো সে বড় হয়ে গেলো আর আজাদ সাহেব দিনেদিনে অসুস্থ হয়ে দূর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলেন কিংবা বুড়ো বয়সে একটু আরামে কাটানোর জন্য কাজে মনযোগী হয়ে পড়লেন।
তবুও আজাদ সাহেবকে নিজের বাবার থেকেও বড় এক জায়গা দিয়েছিলো জাদিদ। কিন্তু মানুষটা এখন আর নেই।

সন্তান বেচেঁ থাকতে মাথার উপর থেকে বাবা নামক ছত্রছায়া হারিয়ে গেলে কেমন লাগে তা এখন ধারণা করতে পারছে জাদিদ। আজাদ সাহেব তো তার বাবার মতই একজন ছিলেন। তারই এমন অবস্থা হলে আবির, আনিসের কেমন অবস্থা কে জানে।

জাদিদ যখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে পুরনো স্মৃতি চারণ করতে ব্যস্ত তখন ওর পাশে এসে দাঁড়ালো আসফিয়া। জাদিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে বিশালাকার সেই মাঠের দিকে তাকিয়ে বললো ‘ আমরা মাঝে মাঝেই আবেগে পড়ে নিজেদের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলি। যেই মানুষটাকে ভালোবাসি তার অনুপস্থিতি আমাদের কষ্ট দেয় বলে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে নিজেকে আরও কষ্ট দেই। কিন্তু এটা ভাবিনা এতে আমাদের কাছের মানুষটা আরও কষ্ট পাচ্ছেন। ‘

জাদিদ হেসে দিল আসফিয়ার কথায়। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। আসফিয়ার দিকে ফিরে বললো ‘ বুঝতে পেরেছি। ‘
‘ কি বুঝলে ? ‘ আসফিয়া জাদিদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো।

‘ এটাই যে যেই মেয়েকে বাচ্চা মেয়ে ভেবেছিলাম সে আসলে এক বুড়ি। আর এই বুড়িই এখন বুড়োকে জ্ঞান দিচ্ছে। ‘

‘ হুম বলেছে তোমাকে। আমি কোনো বুড়ি নই। ‘ আসফিয়া মুখ ভেংচিয়ে বললো।
‘ তাহলে কি ? ‘ জাদিদ ঠোঁট কামড়ে বললো।
‘ সেতো আমার থেকে ভালো যে প্রশ্নটা করেছে সেই জানে। সে বলুক আমি কি, আমি কার। সাহস আছে কি ? আমার মনে হয়না আছে। ‘

আসফিয়ার কথায় জাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো ‘ আমার সাহস নেই বলছো ? ‘
‘ বলছি বৈকি ‘
‘ আমার সাহস নেই ভাবলে আপনি ভুল ভাবছেন ম্যাডাম। এই জাদিদ হাসানের সাহস নেই এমনটা হতেই পারে না। সাহস আমাদের বংশের রক্তে আছে। ‘

‘ আমার বিশ্বাস হয় না। ‘

‘ তাই ? ‘

‘ হুম ‘

‘ তাহলে বিশ্বাস করাচ্ছি ‘ বলে জাদিদ আসফিয়ার দিকে এগোতে লাগলো। জাদিদের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য যেই না পিছন ফিরলো ওমনি চোখ পড়ল সালমা ইসলামের উপর। সালমা ইসলামকে দেখে থমকে গেছে জাদিদ আর আসফিয়া দুজনেই। সালমা ইসলাম কখন এসেছেন দুজনের কেউই টের পায়নি।

সালমা ইসলামের মুখখানা থমথমে। কাল আজাদ সাহেবের জানাজা পড়ানোর সময় শাহিদা খাতুনের অসহায় মুখ দেখে তার মায়া হয়েছিল তাই তিনি এই বাড়িতে দুদিন থেকে জিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন জাদিদ আর আসফিয়াকে একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি মস্ত বড় ভুল করেছেন। রাগে তার শিরা উপশিরা কাপছে। তিনি থমথমে মুখে তাকিয়ে আছেন জাদিদ আর আসফিয়ার দিকে।

—-

খাবার টেবিলে সকলে একসঙ্গে সকালের নাস্তা খেতে বসেছেন। সালমা ইসলাম,জহির সাহেব এবং আসফিয়াও আছে। সালমা ইসলাম জানিয়েছেন জরুরি এক কাজে তাকে আজকেই ফিরতে হবে বাকিদের নিয়ে। যদিও জাহানারা উনাকে দুই একবার অনুরোধ করেছিলেন যদি কাজ সামলে থেকে যেতে পারেন। তবে তিনি জানিয়েছেন অফিসের কাজ ফেলে থেকে যাওয়া যাচ্ছে না। উনার এই একরোখা জবাবের পর তো আর কিছু বোকা যায়না। তাই কেউ আর তেমন অনুরোধ করেনি।

বেয়াইন হিসেবে শাহিদা খাতুনের সালমা ইসলামের সঙ্গে তেমন খাতির কখনোই ছিল না। কেন ছিল না কেউ জানেনা। তবে হয়তো দুই পক্ষ থেকে কেউই এগিয়ে আসেনি বলেই ছিল না। সেরকম আন্তরিক সম্পর্ক না থাকার দরুনই শাহিদা খাতুনও ছোট জাকে বলা সালমা ইসলামের কথা শুনে আর কিছু বলেননি।

কালকের থেকে আজকে সকলের চোখ,মুখের খানিকটা উন্নতি ঘটেছে। যদিও এখনও কেউ তেমনভাবে শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু কালকের মত ভয়াবহ পরিস্থিতি এখন আর নেই। খাওয়ার টেবিলে সকলে একসঙ্গে বসেই খাচ্ছেন। সবাইকে নাস্তা আফিফা আর জাহানারা দিচ্ছেন। রান্নাঘরে শাহিদা খাতুন রুটি ভাজছেন আর বিনী বসার ঘরে সোফায় বসে জুহারিনকে খাইয়ে দিচ্ছে।

জাদিদ খেতে আসেনি। তাকে ডাকা হয়েছিল কিন্তু সে পরে খাবে জানিয়েছে। এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না তাই কেউ আর এই ব্যাপারে জোরাজুরি করেনি। কিন্তু আসল কারণ কেউ জানে না। যদিও সালমা ইসলাম এবং আসফিয়া খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছেন কিন্তু কারোর মুখে রা নেই। সালমা ইসলাম খেতে খেতে মেয়েকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখছেন।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন জহির সাহেবরা। আবির নিজে বাড়ির গেট অব্দি এগিয়ে দিয়েছিলো। রওনা দেওয়ার পূর্বে জহির সাহেব আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘ জীবনে চলতে গেলে আমাদের সবাইকে আপনজনদের হারাতে হয়। তারমানে এই নয় কাছের মানুষদের অনুপস্থিতিতে আমাদের সবকিছু থেমে যাবে। জীবন গতিশীল, জীবনকে জীবনের মতো চলতে দাও আর নিজেকে সামলাও। আমি জানি তুমি বুঝদার, তোমাকে বলে দিতে হবে না তোমার করণীয় কি। নিজের খেয়াল রেখো আর আমার বিনী মাকে আগলে রেখো। আমি কি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি আবির ? ‘

উত্তরে আবির মলিন হেসে মাথা নেড়ে বলেছিল ‘ জি আব্বা, আমি জানি আমার কি করা উচিৎ। চিন্তা করবেন না, আমি নিজেকে খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে আগের জীবনে ফিরবো। ‘
আবিরের কথায় সস্তির নিশ্বাস ফেলে জহির সাহেব তার যক্ষের ধন,তার বড় মেয়ে বিনীকে সযত্নে আবিরের কাছে গচ্ছিত রেখে স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছিলেন।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here