এখানে বেলি ফুলের মালা-২১
———————
রুনার অনুরোধে সরাব আজ তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরছে। রুনা বলে দিয়েছে আজ দ্রুত না ফিরলে তার খবর আছে। ইদানিং মেয়েটার মন মেজাজ ভালো থাকে না। কিছু হলেই মেজাজের বারোটা বেজে থাকে। এই কারণেই সরাব কিছুদিন আগে তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো।
ডাক্তার জানিয়েছেন রুনার গর্ভাবস্থার তিন মাস চলমান। অথচ সরাব আর রুনা দুজনেই ভেবেছিল রুনার সবে কদিন আগে হয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমান করে রুনার এখন তিন মাস চলমান। ডাক্তার সাহেব জানিয়েছেন গর্ভাবস্থায় একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম ঘটে। রুনার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো একটু দেরীতে ধরা দিয়েছে।
সরাব হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলো রাস্তার ধারে এক বয়স্ক মানুষ বসে আছেন বালতিতে ফুল নিয়ে। সরাব এগিয়ে গেলো সেদিকে। বালতিতে সাজানো বেলি ফুলের মালা। সরাব সুধালো ‘ কাকা, বেলি ফুলের মালা কত করে ? ‘
‘ আব্বাজান, দশ টাকা কইরা। আপনি নেবেন ? প্যাকেট কইরা দিমুনি ? ‘
লোকটার কথায় মাথা নেড়ে হাসলো সরাব। লোকটা প্যাকেট মালা ঢুকিয়ে সরাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ আম্মাজান তো মেলা ভাগ্যবতী। আজকাল কেডাও আর ফুলের মালা লয় নাগো। এসবের আর মূল্য কই। যুগ আগাইসে… অহন সবাই লাব লেটার দেয়। ফুলের আর যুগ কই ? আম্মাজান তো বড্ড খুশি হইবো। কারোর প্রত্তম(প্রথম) পেরেম হতে পারা ভাগ্যের ব্যপার। ‘
লোকটার কথায় সরাব থমকালো। অসস্তি নিয়ে মেকি হেসে মালাটা হাতে নিলো। তারপর টাকা মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। লোকটা কি বললো ? কারোর প্রথম প্রেম হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার ? তবে রুনা কেন তার প্রথম প্রেম হতে পারলো না ? কেন বিনীকেই তার ভালোবাসতে হলো ?
জগৎটা অদ্ভুত মায়ায় ঘেরা। যাকে আমরা চাই তাকেই পাইনা আর যাকে পেয়ে যাই সে আমাদের হয়ে রয়ে যায় চিরকাল। কিন্তু মানুষটাকে কি ঠকানো হচ্ছে না ? সেই তো দিনশেষে সরাবের প্রথম প্রেমে এখনও তার মনের এক কোণে খাপটি মেরে বসে আছে। যাকে সে পারেনি ভুলতে।
বিনী বড্ড ফুল প্রেমী ছিল। রোজ ফুল কুমারী সেজে ক্লাসে আসা যেন বরাদ্দ ছিল। সরাবের ধারণা বিনীর সবথেকে প্রিয় ফুল ছিল বেলি ফুল, যার মালা সে প্রায়ই বেণীতে জড়াতো। এই কারণেই সরাবও ওর জন্য প্রায়ই বেলি ফুলের মালা কিনে সেই মালা হাতে রাস্তার ধারে বিনীদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতো।
তারপর!! তারপর যখন বিনী তার দেখা পেত তখন সেই মালা বিনীদের লেটার বক্সে রেখে চলে যেত সে। এরপর বিনী সেই মালা জড়ানো বেণী দুলাতে দুলাতে সালমা ইসলামের হাজার নিষেধ অমান্য করে বাহিরে বেরিয়ে পড়তো পাড়া বেড়াতে। এর জন্য অবশ্য বিনীকে নিয়ে এলাকায় কম চর্চা হয়নি। কিন্তু বিনী ছিল বড়লোক বাবার বড় মেয়ে। তাই কাজেই কোনওদিন ওকে সরাসরি কেউ কিছু বলবার সাহস পায়নি।
অথচ যেই বিনীর জন্য একসময় সে বেলি ফুলের মালা আনতো আজ তার পরিবর্তে মালা নিচ্ছে তার স্ত্রীয়ের জন্য। আসলে সময় কতকিছুই না বলে। একদিন যেই মানুষটাকে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছিলো আজ তার জায়গা নিয়ে নিচ্ছে সপ্তদশী এক কিশোরী। কোথায় পঁচিশ বছর বয়সী বিনী আর কোথায় সপ্তদশী রুনা।
রুনার জন্য এই মালা নিলে যে ওর সঙ্গে অন্যায় করা হবে কারণ সরাবের নেওয়া সব বেলি ফুলের মালা যে বহু পূর্বেই বিনীর নামে উৎসর্গ করেছে সরাব। তাহলে যেচে এই ভুল কি করে করে সরাব ? আনমনে হাসলো সরাব। হাসতে হাসতেই সে এগোলো বাড়ির দিকে। তবে পথে ফেলে গেলো নিজ হাতে কেনা সেই বেলি ফুলের মালা।
বাড়িতে ঢুকেই সরাব দেখলো পাটি বিছিয়ে ভীষন আয়োজন করে কাদতে বসেছে রুনা। সরাব এবার ওকে কাদতে দেখে হাসলো। এসব নতুন কিছু নয়। বিগত তিন চারদিন যাবত এসবই চলছে। তার আসতে একটু দেরী হলেই রুনা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
সরাবের আসার কথা ছিল সাড়ে নয়টায়। কিন্তু সে একটু দেরী করে পনে দশটায় এসেছে। এই পনেরো মিনিট দেরি কেন হলো তার ? রুনা এই কারণেই কাদতে বসেছে। তার ধারণা সরাবের দোকানের নতুন যেই মেয়ে ঋতু, অর্থের অভাবে নিতান্তই বাধ্য হয়ে কাজ নিয়েছে সরাব কাজ ফেলে তাকেই দেখতে থাকে।
অবশ্য রুনাকে দোষও দেওয়া যায় না। দোষটা সরাবের নিজের। সে নিজেই অতি আবেগে আপ্লুত হয়ে তার দোকানে কাজ নেওয়া ঋতুর কথা বলেছে। এবং তারপরই টের পেয়েছে আর যাই হোক আবেগে আপ্লুত হয়ে স্ত্রীকে কোনো সহকর্মীর কথা বলা যাবে না। বউকে আরেক মেয়ের কথা বলা আর যেচে কুকুরের লেজ পা দেওয়া একই কথা কারণ বাঙালি মেয়েরা আর যাই হোক স্বামী বা প্রেমিকের ভাগ কাউকে দিতে চায়না।
রুনার গর্ভাবস্থায় একটু সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সিরাত এসেছে। সিরাত আর রুনার মধ্যে তিন বছরের পার্থক্য মানে সিরাত রুনার তিন বছরের বড়। তবে বয়সে রুনা তার ছোট হলেও দুজনের মধ্যে মিলমিশটা ভালই। এমনকী রুনা যখন কেঁদেকেটে সরাবের নামে অভিযোগ তুলে তখন নূরজাহান আর সিরাত মিলে তাকে একলাই ধুয়ে দেয়।
সরাবকে ঢুকতে দেখে রুনা কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। এদিকে সিরাত অভিযোগ তুললো সে দেরি কেন করেছে। তখন সরাব হেসে বললো ‘ মাত্র পনেরো মিনিটই তো দেরি হয়েছে। ‘ রুনা তখন কেঁদে বললো তার পনেরো মিনিটই বা কেন দেরি হবে। ওর কথায় সরাব না পারতে হেসে দিল। তাতে রুনা আরও রেগে গেলো। সে ধুপধাপ পা ফেলে বাড়ির পিছন দিকে তক্তায় গিয়ে বসে পড়লো।
সরাবও আলতো হেসে সেই দিকে পা বাড়ালো। তার আফসোস নেই বিনীকে না পেয়ে। তার বদলে সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছে মিষ্টি এক অভিমানী মেয়ে যার অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতেই সরাবের পুরো জীবনটাই কেটে যাবে। প্রেয়সী যদি এত সহজ সরল মনের মিষ্টি একটা মেয়ে হয় তাহলে তার অন্তত কোনো আপত্তি নেই।
—-
বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের হিমেল হাওয়া উপভোগ করছে জাদিদ। তার দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, চুল উস্কখুস্ক আর পরনের কাপড় এলোমেলো। হাতে আধ খাওয়া সিগারেট। যেই জাদিদ কোনওদিন হাতে নেশা জাতীয় কিছু তুলেনি সে আজ প্রেম বিরহ ভুলতে হাতে তুলে নিয়েছে বিষাক্ত এক নেশা।
জাদিদ একদৃষ্টে সিগারেটখানা দেখছে। অবাক লাগছে, সিগারেটের নেশাও আসফিয়ার প্রতি তার ভালোবাসাকে ভুলাতে পারছে না। অথচ বন্ধু রায়হান তো বলেছিল সিগারেট সব দুঃখ,কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। তাহলে ধরা যায় আসফিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা অবিস্মরণীয়। এক মন ভোলানো ভালোবাসা, যার প্রেমের টানে জাদিদ শুধু ভেসেই যাচ্ছে কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে আর সাঁতরে প্রেমের সাগর পার করতে পারছে না।
সন্ধ্যায় নাস্তার টেবিলে জাদিদকে হাজার ডেকেও যখন পেলেন মা তখন নিজেই নাস্তা প্লেটে সাজিয়ে ছেলের ঘরে আসলেন জাহানারা। এসে দেখলেন ঘরের অবস্থা বেহাল। মেঝেতে জামা কাপড় ছড়ানো, বিছানার চাদর প্রায় ভূলুণ্ঠিত। বইগুলো টেবিলে এলোমেলো ছড়ানো,ড্রেসিং টেবিলে পারফিউমের বোতল পড়ে আছে।
ঘরের এত বাজে অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহানারা। জাদিদ কখনোই এতটা অগোছালো ছিল না। হয়তো অত গুছিয়ে রাখে না সে তবে এতটা খারাপ অবস্থা তো তার ঘরের কোনোদিনই হয়না। তবে এখন কি হলো ছেলের কে জানে ? ঘর ছেড়ে তাকে বের হতেও দেখা যায় না। শুধু কোনোমতে ভার্সিটি গিয়ে ক্লাসটা করে এই যা।
নাস্তার প্লেট বিছানায় রেখে বারান্দার দিকে তাকালেন জাহানারা। বারান্দার দরজা খোলা। বারান্দার দরজায় লাগানো সফেদ পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। জাহানারা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। বারান্দায় ঢুকে ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন জাদিদ তাকে দেখেও হাতের সিগারেট ফেলেনি। খানিকটা ক্ষিপ্ত হলেন তিনি।
জাহানারা ক্ষিপ্র গলায় বললেন ‘ নিজের কি অবস্থা করেছো তুমি ? বাড়িতে তুমি সিগারেট খাচ্ছ, ঘর ছেড়ে বের হচ্ছো না। বাবা মা আদৌ বেচেঁ আছে না করে গেছে তার খেয়াল রাখছো না ব্যাপার কি ? তোমার হয়েছে টা কি ? ‘
জাহানারার কথায় শ্লেষের হাসি হাসলো জাদিদ। মাথা ঝেড়ে বললো ‘ আমি তোমার খবর রাখছি না বলছো ? তুমি অভিযোগ করছো মা ? ‘
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন ‘ কেন আমি কি অভিযোগ করতে পারিনা ? ‘
জাদিদ মাথা নাড়িয়ে বললো ‘ পারবে না কেন ? অবশ্যই পারবে। তুমি আমার মা, তুমি তো অবশ্যই পারবে আমাকে অভিযোগ করতে। কিন্তু যেই মহিলা নিজ হাতে নিজের মেয়ের জীবন নষ্ট করেন তার সো কল্ড মেন্টালিটির জন্য সে কি আদৌ অভিযোগ করার অধিকার রাখে ? আসলেই কি তার কোনো অধিকার আছে অভিযোগ করার ? ‘
জাদিদের কথায় জাহানারা বিস্মিত নয়নে ওর দিকে তাকালেন। তিনি পিছিয়ে গেছেন দু কদম। স্রেফ হতবিহ্বল কণ্ঠে বললেন ‘ এসব কি বলছো তুমি ? আমি কার জীবন নষ্ট করেছি ? জাবিয়ার জীবন নষ্ট করেছি আমি ? ‘
জাদিদ মাথা নেড়ে সায় দিল জাহানারার কথায়। উনি চমকালেন এবং অবাক গলায় বললেন ‘ তোমার কেন মনে হলো আমি জাবিয়ার জীবন নষ্ট করেছি ? কি নেই ওর ? একক পরিবার আছে যেখানে কোনো ননদ, ননাসের ঝামেলা নেই। শাহরিয়ার টাকা আছে, আমার ভাইয়ের মতো শশুর আছে। আর কিসের কমতি তবে তার ? নাকি তোমার ভাষ্য মতে কোনো কিছুর কমতি আছে ? ‘
জাদিদ হাসলো। তার মায়ের চিন্তা ভাবনাও দেখি আসফিয়ার মায়ের মতো। সংসারে ননদ, ননাস থাকাও বুঝি ঝামেলা ? কে জানে, জাদিদ তো এসব কখনও শুনেনি। সে বলল ‘ আছে, কমতি আছে ওর। মানসিক শান্তির আর ভালোবাসার। তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু জানিনা ? আমি জানি আমার ছোট বোনটা তুষার নামের এক ছেলেকে ভালোবাসতো। কিন্তু তুমি চেয়েছিলে ওকে নিজের মন মতো বিয়ে দিতে যেখানে ছেলের টাকা পয়সা আছে আর কোনো ননদ, ননাস নেই।
আচ্ছা মা তুমি যে চাও তোমার মেয়ে যেন ননদ, ননাসের ঝামেলা না পোহায় তা আমার বেলায় কি চাইবে ? আমার সঙ্গে কি কোনো মা চাইবেন তার নাড়ি ছেড়া ধনকে বিয়ে দিতে যেখানে আমার বোন আছে। আমার বোনও তো আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রীয়ের ননদ হবে। তাহলে ? তোমার মত মায়েদের এই চিন্তা ধারার জন্যই আজ আমরা আপনজন থেকেও প্রিয়হারা। এরপরও তুমি বলছো তুমি কি করে জাবিয়ার জীবন নষ্ট করলে ?
তুমি তো নষ্ট করেছোই ওর জীবন ওর আনন্দ কেড়ে নিয়ে। এখন তোমার মতই এক মহিলা আমার জীবন, আমার প্রিয় মানুষটার জীবন নষ্ট করছেন আমাদের আলাদা করে দিয়ে। এরপরও তুমি আশা করো আমি তোমার খোঁজ নেবো ? তোমার কৃত কর্মের চেয়ে তোমার এক্সপেক্টেশন বেশি হয়ে গেলো না ? তুমি কি এত ভালোবাসা ডিজার্ভ করো যেখানে তুমি অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নাও ? ‘
ছেলের কথায় বাক্য হারা জাহানারা। কিছু বলার ভাষা খুজে পেলেন। মা ভক্ত ছেলে যে এরকম বিষ বাক্য উগড়ে দিবে সেটা তার জানা ছিল না। অথচ এই ছেলেই নাকি বলতো তার জন্য লাল টুকটুকে বউ আনবে। কোথায় গেলো সেসব ভালোবাসা ? কোথায় গেলো মাকে দেওয়া সেসব প্রতিজ্ঞা ?
জাহানারা জানেন জাদিদের বলা প্রত্যেকটা কথা সত্য। তিনি আসলেই মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন। মেয়েকে নিজের পছন্দ মত বিয়ে দিয়ে, তার ইচ্ছার অবমূল্যায়ন করে তিনি তৈরি করেছেন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে যে ছেলেকেও হারাবেন জানা ছিল না। জাহানারা কেন পরিষ্কার দেখতে পারছেন তার ছেলে মেয়েরা হারিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে।
মেয়ের এই কদিনের ব্যবহারে পূর্বেই অনুতপ্ত ছিলেন জাহানারা। আজ ছেলের ব্যবহারে যেন অনুতাপের আগুনে পুড়তে শুরু করলেন। ছেলে মেয়েদের হারিয়ে ফেলার ভয় জেকে বসলো তার মনে। শুকনো ঢোক গিলে আরেকবার পর্যবেক্ষণ করলেন ছেলেকে। ছেলে রাখা এস্ট্রেতে অবশিষ্ট সিগারেট ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরালো।
—-
বারান্দায় একলা দাড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে বিনী। ঘরে আবির শুয়ে আছে। সে এসেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। দুদিন হলো সে আবারও হাসপাতাল যাওয়া শুরু করেছে। এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশিদিন চাকরি ছেড়ে ঘরে বসেও তো থাকা যাচ্ছে না। সেই ঘটনার তো আজ প্রায় পাঁচ দিন। আর সে হাসপাতালে যাচ্ছে বিগত দুই দিন থেকে।
আজাদ সাহেবের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। তবুও যেন আগের মতোই শোকের শহরে ডুবে আছে বিনী। হয়তো আজাদ সাহেবের সঙ্গে সে সবথেকে কম সময় কাটিয়েছে। তবুও আজাদ সাহেব ছিলেন তার মনে জহির সাহেবেরই আরেক প্রতিচ্ছবি। বাবার মতো সেই মানুষটাকে যে কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। মানুষটার সঙ্গে কাটানো সব মুহূর্ত প্রতি নিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।
আকাশ সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে আবির আর বিনীর মাঝে যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য দূরত্বটা নিজের ঠিক অজান্তে বিনীই তৈরি করেছে। সে নিজেও জানে না সে কখন আবিরের কাছ হতে দূরে সরে গেছে। এখন তার প্রায়শ সময় কাটে শাহিদা খাতুন সঙ্গে গল্প করে, বসার ঘরে আজাদ সাহেবের চেয়ারের কাছে সোফায় বসে বিকেলে গল্পের বই পড়ে আর সময় সুযোগ পেলে বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে।
শাহিদা খাতুনকে প্রাণ ক্রমে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে বিনী। সে চায়না শাহিদা খাতুন কোনো একটা মুহূর্তও নিজেকে একলা মনে করেন। তার মতোই আফিফা আর জাহানারাও শাহিদা খাতুনকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখেন। তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন শাহিদা খাতুনকে একা ছাড়া মানেই তাকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দেয়া।
বারান্দায় একলা রাত্তির উপভোগ করতে ব্যস্ত বিনী টের পেলো এক জোড়া উষ্ণ হাত তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। বিনী ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিল মানুষটার বুকে। তার হাত দুটো আগলে ধরে বললো ‘ এমন কেন হয় আবির ? আমরা যাকে ভালোবাসি সেই হারিয়ে যায় ? আম্মার মুখ দেখেছো ? সারাদিন কেমন উদভ্রান্তের মতো থাকেন। তাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না আমার। আমি আমার পুরোনো আম্মাকে ফেরত চাই। কোথায় সেই আম্মা যে আমায় পারলেই ধমকে দিত। আজকাল সে আর আমার চুলে তেলও দিয়ে দেয় না। কোথায় গেলে ফিরে পাবো তাকে ? তাকে যে আমার বড্ড দরকার। ‘
বিনীর কথা শুনে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো আবির। বিনীর কথার বিপরীতে যুতসই উত্তর দিলো না। বরং বিনীকে আগলে ধরে বললো ‘ ঘরে চলো, রাত করে জাগা উচিত নয়। তুমি অসুস্থ হলে আম্মাকে দেখবে কে ? তোমাকে অসুস্থ দেখলে আম্মা আরও কষ্ট পাবে। ‘
বিনী জবাবে কিছু বলল না। সে জায়গা হতে নড়লোও না। বাধ্য হয়ে আবির তাকে আগলে ধরেই দাড়িয়ে রইলো। নিস্তব্ধ এই রজনী উপভোগ করছে তারা। তারা খচিত আকাশে আজাদ সাহেবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বিনী। ছোটবেলায় দাদির মুখে শুনেছিল সে মানুষ মারা গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়।
তবে কোথায় আজাদ সাহেব ? কোথায় তার কথায় কথায় আম্মা ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলা মানুষটা ? কেন মানুষটা তাদের একলা করে চলে গেলো ? বিনীর মনে যে অনেক প্রশ্ন। সেগুলোর উত্তর দিবে কে ? রোজ রোজ নতুন বই বের করে তাকে সঙ্গে নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে পড়বে কে ?
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
( এডিট ছাড়া পর্ব…. আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটবে। একটাই কথা বলবো শুধু ধৈর্য্য ধরুন আর হ্যাঁ মন্তব্য কিন্তু চাই। )