এখানে বেলি ফুলের মালা-২৩ শেষ

0
506

এখানে বেলি ফুলের মালা-২৩
———————

[অন্তিম পাতা]

প্রিয় মা,

সন্তানের কাছে মা ঠিক কতটা আপন জানো ? ঠিক যতটা আপন হলে সাহস থাকার পরও মুখ ফুটে মায়ের অভিযোগগুলো ধরিয়ে দেয় না শুধুমাত্র মায়ের মনে কষ্ট হবে বলে। আমিও এতদিন এমনটাই করে এসেছি। তুমি সবসময় আমাকে নিজের মনমতো চালাতে চেয়েছ। আমার তাতে খারাপ লাগতো কারণ তুমি আমাকে খেলতে দিতে না, বাহিরেও যেতে দিতে না। কিন্তু তবুও আমি মেনে নিয়েছিলাম কারণ আমি তোমাকে ভালবাসতাম।

কিন্তু এখন আমার পক্ষে আর সম্ভব না তোমার এই অন্যায় আবদারটুকু মেনে নেওয়া। জাদিদ আমার ভালো লাগার, ভালোবাসার মানুষ। তাকে ভালোবেসে আমার পক্ষে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। তোমাকে ভালোবেসে আমার আরেক ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে আমার পক্ষে অন্যায় করাও সম্ভব না। আমি তোমাকে যেমন ভালোবাসি তাকেও তো ভালোবাসি। তাই আমি চলে যাচ্ছি। আবারও ক্ষমা চাচ্ছি তোমার সম্মান নিয়ে খেলার জন্য। কিন্তু আমার যে কিছুই করার নেই। আমার যে তাকে সবকিছুর বিনিময়ে চাই।

ইতি,
তোমার অবাধ্য মেয়ে

চিঠি হাতে ধপ করে বসে পড়লেন সালমা ইসলাম। হলদে চিঠিখানা ভূ-লুণ্ঠিত হলো ততক্ষণে। সালমা ইসলাম তার কপাল চেপে ধরেছেন। হাত দুটো অসম্ভব কাপছে, মাথা যন্ত্রণা করছে। মেহমানদের উনি এখন কি জবাব দিবেন ? বাড়ি ভর্তি মেহমান। আর সায়লা!! তাকে কি জানাবেন ? বলবেন যে মেয়ে তার পালিয়ে গেছে ?

গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে আসফিয়া। বাহিরের স্তব্ধ প্রকৃতি এখন গতিশীল। শা শা গতিতে সব পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তার গাড়ি। লম্বা লম্বা গাছগুলো দেখতে দেখতে আসফিয়ার অধর জুড়ে প্রশস্ত হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আসফিয়া হেসে সেই গাড়ির সিটে শরীর এলিয়ে দিল।

আসফিয়াকে বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেরোতে আর গাড়িতে তুলে দিতে জহির সাহেবই সাহায্য করেছেন। তিনি চাননা তার স্ত্রীয়ের এই পাগলামোতে তার মেয়ে বলির পাঠা হোক। এতে যদি স্ত্রীয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয় তো করবেন। তবুও মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দিবেন না।
বাবা হয়ে সন্তানের কষ্টের কারণ হওয়া হয়তো জগতের মধ্যে সবথেকে ঘৃণিত কাজ। কারোর দেওয়া অভিশাপও এর চেয়ে শ্রেয়।

আসফিয়া চোখ বুজতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো জাদিদের টোল পড়া ডাটিয়াল হাসি খানা। ছেলেটা ঠিক কত সুন্দর করেই হাসে তাইনা ? আসফিয়া জানেনা এই কটাদিন তার কতটা দুর্বিষহ ভাবে কেটেছে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত গড়িয়েছে অজানা ভয়ে।

এখন থেকে জাদিদের সেই মন মাতানো হাসি আসফিয়া রোজ দেখতে পারবে। আর সেই হাসি হারানোর ভয় থাকবে না। আফসোস হবে না এই ভেবে যে আর দেখা হবে না সেই হাসি। ভাবতে ভাবতেই আসফিয়ার মনে পড়লো জহির সাহেব জাদিদকে ফোন করে তার বাড়ি থেকে পালিয়ে জাদিদের কাছে যাওয়ার কথাটা জানিয়েছেন। আচ্ছা এই কথা শুনে জাদিদের অভিব্যক্তি কি ছিল ? সে কি হেসেছিল নাকি প্রথমবার হবু শশুড়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভয়ে তার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছিলো।

আচ্ছা সে যাচ্ছে শুনে কি জাদিদ তাকে নিতে আসবে ? কোথায় এসে দাড়াবে সে ? আসফিয়ার আফসোস হলো এক খানা মুঠো ফোন কেন এখনও আবিষ্কার হলো না। বাংলাদেশ তো কত উন্নত হচ্ছে আস্তে আস্তে। তবে এখনও একটা মুঠো ফোন কেন আবিষ্কার করতে পারল না এই দেশের বিজ্ঞানীরা ? এমন বিজ্ঞানী থেকে লাভ কি যদি দেশের কাজেই না লাগতে পারে। এখন কি জাদিদের সঙ্গে বার্তালাপ চালানোর জন্য ওই পেট মোটা টেলিফোন তার শুদ্ধ বয়ে বেড়াতে হবে আসফিয়ার ?

জাদিদের সঙ্গে কল্পনায় লাল, নীল সংসার সাজাতে সাজাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল আসফিয়া। ঘুম ভাঙলো রাশেদ আলীর ডাকে। আসফিয়া উঠে বসলে রাশেদ আলী বললেন ‘ আইয়া পড়ছি আম্মা। নামবেন নী আপনি অহন ? ‘

রাশেদ আলীর কথা শুনে আসফিয়া গাড়ির জানালা দিয়ে আশেপাশে তাকালো। বললো ‘ গাড়ি কোথায় দাড় করিয়েছ কাকা ? ‘
‘ ওই সের(স্যার) যেখানে কইছিলেন হেহানেই। বড় আম্মার শশুর বাড়ির গলির মোড়ের কাছেই। ‘
রাশেদ আলীর কথায় আসফিয়া গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো ‘ তাহলে এখন ফিরে যাও তুমি। বাবাকে জানিও আমি ঠিকঠাক পৌঁছে গেছি। সময় সুযোগ হলে টেলিফোন করবো। ‘

রাশেদ আলী আসফিয়ার কথার উত্তরে মাথা নেড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরতি পথে রওনা দিলেন। আসফিয়া কয়েক পলক দাড়িয়ে দেখলো ধুলোমলিন পথে রাশেদ আলীর গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। তারপর চোখে মুখে চিরচেনা হাসি টেনে এগোতে শুরু করলো।

আজ আসফিয়ার পরনে সালমা ইসলামের দেওয়া সবুজ রংয়ের শাড়িটা। সালমা ইসলাম এই শাড়িটা মূলত আসফিয়ার মেহেদীর অনুষ্ঠান করার জন্য কিনেছিলেন। কিন্তু বান্ধবী সায়লা জানালেন এত সব উৎসব করার সুযোগ নেই। বিয়ে উপলক্ষে হাজার কাজ পড়ে আছে। তাই ভদ্র মহিলা এক প্রকার বাধ্য হয়েই মেয়ের মেহেদীর অনুষ্ঠান করার ইচ্ছাটা বাদ দিলেন। তার অনেক শখ ছিল মেয়ে এই শাড়ি পড়বে। আসফিয়া ঠিকই পূরণ করেছে তার শখ কিন্তু সালমা ইসলাম আর এই শাড়ি জড়ানো আসফিয়াকে দেখেননি।

বিনীদের বাড়ির গলির মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে আসফিয়া অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু জাদিদ এখনও আসছে না। আসফিয়া বারবার হাতের ঘড়ির ডায়ালে সময় দেখছে। এদিকে রিকশা ওয়ালা মামাও তাকে তাড়া দিচ্ছেন। রিকশা ওয়ালা মামাকে আসফিয়াই ঠিক করেছে। জাদিদ এলে এখান থেকে ওরা সোজা কাজী অফিসে যাবে। তারপর বিয়ে করে তবেই ফিরবে।

‘ আর কতক্ষন লাগবো আপা ? আপনি যার লেইগা অপেক্ষা করতাছেন হে কি আদৌ আইবো ? ‘

রিকশা ওয়ালা মামার কথায় আসফিয়ার মাঝে অভিব্যক্তি দেখা গেলো না। সে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে জাদিদের জন্য। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে জাদিদ এলে ওকে শুনিয়ে দিবে দু চার কথা। বিয়ের আগেই টাইমিং নিয়ে এত কাহিনী করছে। বিয়ের পর নিশ্চই ওকে জালিয়ে মারবে। না এর জন্য তো ছেড়ে দিলে হয় না। কথা তো শুনতেই হবে মশাইকে।

কিন্তু আসফিয়ার এত এত পরিকল্পনা অচিরেই খেই হারালো যখন আসফিয়া দূর থেকে উস্কখুস্ক চুলে এগিয়ে আসা জাদিদকে দেখলো। জাদিদের পরনে অফ হোয়াইট শার্ট আর ব্লু জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো আর দৃষ্টি মলিন। যেই দৃষ্টিতে কিছু মাস আগেও আসফিয়া সৌন্দর্যের প্রখরতা দেখেছিল সেই দৃষ্টিই আজ মলিন।

জাদিদের দেখা পেলে কতকিছু বলবে ভেবে মনে মনে গুছিয়ে রেখেছিল আসফিয়া। তবে কিছুই আর বলা হলো না। সৌন্দর্যের প্রতীক জাদিদ হাসানকে মলিন রুপে দেখেও তার অবাধ্য মনটা যেন আবারও সেই জাদিদের প্রেমেই পড়েছে। বাধ্য ঠোঁট জোড়া আজ অবাধ্য হচ্ছে। চোখগুলো বেহায়া হয়ে উঠছে। আসফিয়া স্রেফ অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

এতদিন পর ভালোবাসার মানুষটাকে দেখে কিয়ৎপল আঁখি জুড়িয়ে দেখে নিলো জাদিদও। তারপর আসফিয়াকে এহেন নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকতে দেখে হেসে বললো ‘ যাবে না ? ‘
জাদিদের কথায় হুশ হলো আসফিয়ার। নিজেকে নিজের এই নির্বুদ্ধিতার জন্য অদৃশ্য এক চপেটাঘাত করে হড়বড় করে বলল ‘ হ্যাঁ যাবো তো। ‘

তারপর!! তারপর তারা দুজনে চেপে বসলো আসফিয়ার ঠিক করা রিকশায়। কাছাকাছি, ঘেঁষাঘেঁষি করে। এতটাই কাছাকাছি যে দুজনে নিজেদের নিশ্বাস গুনতে পারছে। জাদিদ খানিকটা আরও এগিয়ে এলো। পিছন থেকে আসফিয়ার ব্লাউজের খোলা অংশের জায়গাটা শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দিয়ে ঢেকে দিল। তারপর আসফিয়াকে এক হাতে আগলে নিয়ে আসফিয়ার হাতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো ‘ আমার আফি ‘

—-

কাজের চাপে আজ দুপুরে বাড়ি খেতে আসতে পারেনি সরাব। দোকানের বিক্রি ভালো নাহলেও ইচ্ছা করেই সে বেশিক্ষন দোকানে বসেছে যাতে বিক্রিটা একটু বাড়ে। নিস্তব্ধ দুপুরে যখন সব দোকান পাট বন্ধ তখন একমাত্র তার দোকান খোলা থাকলে দুপুরের ক্রেতারা তার থেকেই মালামাল নিবে। তাই দোকানটা সে তখন আর বন্ধ করেনি। বরং সাথের ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই বসেছিল দোকানে। এতে অবশ্য লাভই হয়েছে। খানিকটা বিক্রি হয়েছে।

আকাশে মেঘ করছে। মনে হয় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। আকাশের তাহলে মন খারাপ। কিন্তু
বিক্রি হওয়ার খুশিতে সরাব এখন সব কাজ মিটিয়ে একবারে ফিরছে। আকাশের মন খারাপ কিন্তু তার তো মন ভালো। আজ আর সে দোকানে বসবে না। সবটা সিরাজকে দিয়ে সামলে নিবে। বাড়ি ফিরে সময় দিবে রুনাকে। রুনার অভিমানও তো ভাঙানো প্রয়োজন। তাই অভিমানী প্রিয়ার জন্যই বাড়ি ফিরতে পথে সে বকুল ফুলের মালা কিনে নিলো। বেলি ফুলের মালা নাহয় নিতে পারবে না কিন্তু বকুল ফুলের মালা তো আর নিতে বারণ নেই।

সরাব বাড়ি ফেরার পর সিরাত এসে দরজা খুলে দিল। আজ সিরাতকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হলো সরাব। মেয়েটা বুঝি এতটাই অভিমান করেছে যে নিজে এসে দরজাখানাও খুলল না। প্রিয়তমার রাগের পারদ আন্দাজ করতে পেরে সিরাতকে সুধালো সরাব ‘ রুনা কি করছে রে ? ‘

সিরাত বলল ‘ এখন জিজ্ঞেস করছো ? যাও ঘরে গিয়ে দেখো। তোমার বউ এখনও তোমার উপর রাগ করে আছে। দুপুরে খেয়ে বলেছিল তুমি আসলেও যেন ওকে ডাক না দেই। ভেবে দেখো কত রেগে আছে তোমার উপর। ‘

‘ আমার বউ রেগেছে!! রাগটা আমিই ভাঙাবো। তুই ভাত বাড়। দেখে আসি ওকে। ‘ বলে হাসতে হাসতে নিজের ঘরে ঢুকলো সরাব।

ঘরে ঢুকে সরাব দেখলো রুনা অন্য পাশ ফিরে শুয়ে আছে। যাহ বাবা, মেয়েটার এত রাগ যে তার দিকে ফিরলোও না। এই রাগ তো ভাঙ্গানো লাগে। সরাব হাতে ফুলের মালাটা নিয়ে খাটের অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা জানালা দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর ঘরে উকিঝুকি মারছে। এতক্ষণ এই রোদের আলো রুনার চোখে মুখে পড়ছিল। ওর সামনে দাঁড়ানোতে সরাবের গায়ে পড়ছে এবার।

সরাব দেখলো রুনা বালিশে মাথা রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তার সুন্দর কাজল চোখ দুটো দিয়ে। সেই চাহনী বড্ড নিরীহ আর শান্ত। সরাব হাসলো ওকে দেখে। বললো ‘ এখনও রেগে আছিস ? কাছেও আসতে দিবি না আমাকে ? আমার বাচ্চাটাকেও দেখতে দিবি না ? ‘

সরাব ভেবেছিল রুনা বলবে ‘ হ্যাঁ ও শুধু তোমারই বাচ্চা তাইনা ? আমার কিছু না। ও আসার আগেই আমার ভাগের ভালোবাসা সব ওকে দিয়ে দিচ্ছ। ও আসলে তো মনে হয় আমাকে দেখবেও না। ‘

কিন্তু সরাবকে অবাক করে দিয়ে রুনা কিছুই বললো না। তখনও শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে। সরাব ভাবলো হয়তো কাল রাতে ওভাবে রাগারাগি করাতে একটু বেশিই রেগে আছে। তাই রাগ ভাঙাতে ও এগিয়ে গিয়ে রুনার কাছে বসলো। রুনা তখনও খাটের অন্য প্রান্তে তার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। সরাব ওর হাতে হাত রাখলো।

রুনার হাতে হাত রাখতেই ছিটকে দূরে সরে গেলো সরাব। তার ধরা রুনার হাতটা বিছানায় ঢলে পড়েছে। সরাবের মনে হলো সে যেন নিথর কোনো এক দেহকে মাত্র ছুঁয়ে দিয়েছে। রুনার পুরো শরীর ঠাণ্ডা। চাহনি নির্জীব আর চোখের কার্নিশে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু। সেই অশ্রু চোখে নিয়েই সে নির্জীব হয়ে তাকিয়ে আছে সরাবের দিকে। বড্ড শান্ত সেই চাহনী। রুনার এই শান্ত চোখের চাহনি সরাবের সহ্য হচ্ছে না। বুকে কাঁটার মত বিধছে যেন।

রুনাকে ওভাবে নির্জীব চোখে শুয়ে থাকতে দেখে সহ্য করতে পারছে না সরাব। সিরাতকে চেঁচিয়ে ডেকে ছুটে গেছে রুনার কাছে। রুনাকে নিজের বুকে নিয়ে অনবরত ওর গালে চাপড়ে ডাকতে লাগলো কিন্তু আফসোস রুনার আজ কোনো কথা নেই। সে পাষাণী এক নারী। সরাবের ডাকে সিরাত এবং নূরজাহান ছুটে এলেন। নূরজাহান ঘুমোচ্ছিলেন কিন্তু সরাব এমন ভাবে আর্তনাদ করে ডেকেছে যে উনি আর ঘুমিয়ে থাকতে পারেননি।

সরাব তখনও হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে রুনাকে আকড়ে ধরে। সিরাত আর নূরজাহান সরাবের ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন। ঢুকে রুনাকে সরাবের কোলে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে দু কদম পিছিয়ে গেলেন তিনি আতঙ্কে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন রুনা বলে। রুনার নিথর দেহ দেখে কষ্টে পাথর সিরাত। আজ সকাল অব্দিও ওরা দুজনে বলাবলি করছিলো ছেলে হলে কি নাম রাখবে আর মেয়ে হলে কি রাখবে। অথচ এই কয় ঘণ্টার তফাতে আস্ত মানুষটাই নাই হয়ে গেলো।

সরাব প্রিয়তমার পুরো মুখে অগণিত চুমু খেতে খেতে বললো ‘ এমন করিস না রুনা। আমায় ছেড়ে যাস না। আমার উপর তোর এত রাগ ? রাগ করে থাকিস না জান। আমি প্রমিজ করছি আর কখনো তোকে বকবো না। দয়া করে আমাকে এভাবে একলা করে যাসনা। আমার কাছ থেকে নিজেকে আর আমার সন্তানকে কেড়ে নিস না। তুই না থাকলে আমি মরে যাবো রুনা…. ‘

কিন্তু সরাবের সেই আর্তনাদ আজ আর রুনার কানে গেলো না। সে পাথুরে মূর্তির মতো নির্জীব হয়ে তাকিয়ে রইল তার প্রিয়তমর দিকে। কে বলবে এই মানুষটাকেই সে তার সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে। এর সঙ্গেই সে হাজার পাগলামি করেছে। এর জন্যই হাজার কেঁদেছে। অথচ আজ মানুষটার এক ফোঁটা আর্তনাদও তার মনের ঘরে তৈরি হওয়া শক্ত দেওয়ালে ফাটল ধরাতে পারছে না। মানুষটা তার জন্য কাদছে, তার কাছে মিনতি করছে কিন্তু পাষাণ সে সেই মিনতি গ্রাহ্য করছে না। নারী মন বুঝি এমনই পাষাণ হয়। তারা বুঝি পারে এভাবেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে।

একসময় সরাব শান্ত হয়ে এলো। থেমে গেলো তার আর্তনাদ। সে শান্ত হয়ে রুনার পানে চেয়ে রইলো। রুনা এখন খাটিয়ার উপর শুয়ে নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বুজেছে। তার গা দিয়ে আসছে সুগন্ধির আতরের সুঘ্রাণ। সরাব বাতাসের গায়ে নিশ্বাস টেনে শেষবারের মতো প্রিয়তমার কপালে চুমু খেল। ভাবলো প্রকৃতি তার প্রতিশোধটা কি দারুন ভাবেই না নিলো। ওর কাছ থেকে আবারও কেড়ে নিলো ভালোবাসার মানুষটাকে। আচ্ছা ভালোবাসা বুঝি এতটাই খারাপ ? কারোর সবটা কেড়ে নেয় তো কাউকে সুদ সমেত ফিরিয়ে দেয়। আচ্ছা সবাইই তো ভালোবাসে নিজের সবটা দিয়ে। তবে কেন একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম ভালোবাসার রূপ ?

—-

আবিরের টেলিফোন পেয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই বেরিয়ে এসেছে বিনী। সে তখন শাহিদা খাতুনের সঙ্গে বসে গল্প করছিলো। তখনই শুনতে পেলো বসার ঘরে টেলিফোন বাজার শব্দ। সে শাহিদা খাতুনকে বসতে বলে নিজে উঠে গেলো। টেলিফোন কানে ধরতেই আবির বললো শাহিদা খাতুনকে জানিয়ে বাহিরে বের হতে। বিনী কয়েকবার কারণ জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু আবির উত্তর দেয়নি। বাধ্য হয়েই শাহিদা খাতুনকে জানিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো।

বিনী হাঁটতে হাঁটতে গলির মোড়ে এসে দাঁড়ালো। দেখলো সেখানে আগে থেকেই সাইকেল হাতে দাড়িয়ে আছে আবির। ও এগিয়ে গিয়ে বলল ‘ হঠাৎ বের হতে বললে কেন ? কারণ কি ? ‘
‘ একটা মাত্র বউ অথচ কাছেই আসতে চায় না। আমারও দোষ আছে। ঘুরতে নিয়ে যাই না বলে হয়তো অভিমান করেছে। তাই ভাবলাম একটু নিয়ে বেরোই। ‘

আবিরের কথা শুনে বিনী ওর দিকে সরু চোখে তাকালো। আবির বিনীর সেই দৃষ্টি গ্রাহ্য করলো না। না দেখার ভান করেই ধীর পায়ে সাইকেল ঠেলে এগোতে লাগলো। বিনী ওকে হাঁটতে দেখে নিজেও এগিয়ে গেলো। ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ সাইকেলটা কার ? তোমার সাইকেল আছে জানতাম নাতো। দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরনো সাইকেল। ‘

আবির মাথা নেড়ে বলল ‘ উহু আমার নয়। আমার এক বন্ধুর। সাইকেলের গ্যারেজে কাজ করে ও। ওখানে সাইকেলও ভাড়া দেওয়া হয়। তাই ওর থেকে ভাড়া দিয়ে এনেছি। ‘
বিনী খানিকটা অবাক হলো। ভাবলো আবির সাইকেল কিনতে পারবে না এমন তো নয়। বরং এমন আরও দশটা পাঁচটা সাইকেল কেনার ক্ষমতা আছে ওর। তবে!!!

বিনীকে চুপ থাকতে দেখে আবির বললো ‘ ভাবছো সাইকেল না কিনে ভাড়া কেন নিলাম তাইতো ? ‘ বিনী ওর কথা শুনে ওর দিকে এক পলক নজর দিল। আবির আলতো হেসে মলিন কণ্ঠে বলল ‘ আমরা বড়লোক মানুষ। উঠতে বসতে রাজার হালে চলি। চলা ফেরা দামী গাড়িতে করি। কাছের মানুষদের মৃত্যুতে শোকও পালন করি ঘটা করে। আয়োজন করে চল্লিশা হয়, অনেক লোকজন নিয়ে জানাজাও হয়। আমাদের দুঃখ হলে সকলে কষ্ট না পেলেও মিথ্যে সান্তনা দেয়।

কিন্তু এই পৃথিবীতে এমন এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের রাত্রি যাপন হয় মলিন কাথায় শুয়ে। বেলা পেরোয় আধ প্লেট ভাত খেয়ে আর কাছের কারোর মৃত্যু হলে দিন গড়াতে না গড়াতেই নেমে পড়তে হয় জীবিকা নির্বাহের কাজে। ওরা মধ্যবিত্ত। ওদের একটাই কষ্ট, যে ভাবেই হোক ভাত রুজি করতে হবে। ওদের ধ্যান জ্ঞানই ওটা।

অথচ আমাদের দেখো। কেউ কিছু বললে মন খারাপ, কোনো কিছু কিনতে ইচ্ছা করলো কিন্তু সেটা কেনা সম্ভব না তখনও মন খারাপ, কারোর মৃত্যু হলো তখনও মন খারাপ। ঘটা করে চল্লিশা করলাম নিজের মন খারাপ দেখাতে। আবার দান সদকাও করলাম সেই একই কারণে।

আমাদের এত রুজি, এত ক্ষমতা তবুও পান থেকে চুন খসলেই মন খারাপ হয়ে যায়। তার থেকে আমাদের তুলনায় মধ্যবিত্তরা বেশি খুশি। ওদের একটা জিনিষ নিয়েই মন খারাপ, কেন ভালো কিছু খেতে পায় না, একটু ভালো থাকতে পারেনা। আর আমাদের!! আমাদের উঠতে বসতে অভিযোগ। তাহলে বেশি সুখে কে আছে ? ‘

বিনী এক মনে আবিরের কথা শুনলো। এমন করে সে আগে ভাবেনি। আসলেই তো তাদের থেকে মধ্যবিত্তরা বেশী সুখী। তাদের একটাই চাওয়া। অথচ আমাদের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। আসলে মানুষ যত উপরের দিকে উঠে তার চাওয়া তত বৃদ্ধি পায়। বিনীর ভাবনার মাঝেই আবির আবারও বলতে শুরু করলো।

‘ ইচ্ছে ছিল আমাদের ঘরটা হবে টিন শেডের। যেখানে দুপুরে অনেক গরম তো পড়বে কিন্তু রাতটা হয়ে উঠবে শীতলতম এক রাত্রি। তখন সেই শীতল ঘরে তোমায় নিয়ে শুয়ে শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প করবো। কষ্ট একটাই, রুটি কামাই করতে হবে।

এছাড়া থাকবে না আর কোনো চাওয়া পাওয়া, থাকবে না কোনো অভিযোগ, থাকবে না কোনো শখ আহ্লাদ, থাকবে না কোনোকিছু হারানোর ভয়। এমন একটা জীবন আমারও পাওনা ছিল কিন্তু পাওয়া হলো না। হলো না মলিন কাথায় শুয়ে তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখা।

স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি আমার। হয়তো কোনওদিন এই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভবও না কারণ একবার যে বিরিয়ানির স্বাদ পেয়েছে সে আর ফিরে গিয়ে আলু ভর্তার কাছে যাবে না। এখন এমন স্বপ্ন দেখা আমার জন্য বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতোই। এই বুলি আওড়াতে তো পারবো কিন্তু সুযোগ হলে তখন সবটাই কঠিন মনে হবে।

তাই ভেবেছি অন্তত একটা দিনের জন্য নিজের স্বপ্ন পূরণ করব। তোমায় নিয়ে সাইকেলে চড়ে ঘুরবো, রাস্তার ধারের পরোটা ভাজি খাবো। বাদাম ভাজা খাওয়া হবে, পাঁচ টাকার কেক ও খাওয়া হবে আর সবশেষে আমাদের এই একদিনের মধ্যবিত্তের জীবন কাটানোর শেষটা হবে কাঠি আইস্ক্রিম খেয়ে। আমার এই স্বপ্নটা নাহয় এভাবেই পূরণ হোক। বলো, হবে আমার একদিনের মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গী ? ‘

বিনী এক দৃষ্টে চেয়ে রইলো আবিরের দিকে। আবির ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোলে তার মুচকি হাসি। চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। আজ এই মহেন্দ্রক্ষণে তার মনে হলো তার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই অতি সাধারণ পুরুষটির প্রেমে আচমকাই সে পা পিছলে পড়েছে। পেটের ভিতর প্রজাপতি উড়ছে, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আর চোখ দুটো অপলক চোখে তাকিয়ে আছে।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। নিমেষেই বৃষ্টির ঝড় এসে ভাসিয়ে নিলো বিনীর দ্বিধান্বিত মনের দ্বিধা। বিনী খুব করে চাইলো সামনে থাকা স্বপ্ন পুরুষটির হাত ধরে অচেনা ভিড়ে মিশে যেতে। মানুষটার মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গী হতে। সঙ্গে তার এও মনে হলো মানুষটার কোনো কথাই তার রাজি নাহলে নয়। তার পক্ষে সম্ভবই না তার কোনো কথা ফিরিয়ে দেওয়া।

বিনী এগিয়ে দিল হাত। আবিরের হাতে হাত রেখে বলল ‘ হবো, হবো আমি তোমার সঙ্গী। শুধু আজ নয়, আমি হতে চাই তোমার আমরণের সঙ্গী। আমাদের এই একদিনের স্বপ্ন কোনদিক না কাটুক। না ভাঙুক আমাদের কল্পনার রাজ্য। আমি শুধু তোমার হতে চাই আবির, শুধুই তোমার। আমি তোমার ছিলাম আর তোমারই থাকবো। ‘

আবির হাসলো। ঝুম বৃষ্টিতে বিনীর ঠান্ডা,বরফ হয়ে যাওয়া হাতটা ছুঁয়ে দিলো। তারপর!! তারপর সাইকেল রেখেই বিনীকে নিয়ে এই ঝুম বর্ষায় ছুটতে শুরু করলো। বিনী ছুটতে ছুটতে বললো ‘ সাইকেলটার কি হবে ? ‘

‘ ওটা থাকুক, আমরা ফিরবো। ফিরবো হারিয়ে যাওয়া এক ঝুম বর্ষায়। আছড়ে পড়ব বর্ষার এক গুচ্ছ কদম হয়ে। বেলী ফুলের মালায় তোমায় নিয়ে গাঁথবো আবারও এক ভালোবাসার গল্প। গল্পের নাম হবে এখানে বেলি ফুলের মালা, আবিরের বেলি ফুলের মালা। ‘

সমাপ্ত….

ছবিয়াল: Maksuda Ratna

(অবশেষে উপন্যাসের ইতি টানলাম। শেষ পর্বটা লেখা সহজ ছিল না। কেটেছি লিখেছি, কেটেছি লিখেছি এভাবেই গেছে দিন। শেষটা পুরো গল্পের থেকে একদম আলাদা। খানিকটা আধুনিক আর ড্রামাটিক হয়েছে তবে আমার মনে হলো একমাত্র এই এন্ডিংটাই মানায়। এর থেকে ভালো কোনো এন্ডিং খুঁজে পাইনি আমি। আমি বরাবরই চেষ্টা করি অল্প পর্বে গল্প শেষ করতে কাজেই এবারও একই চিন্তা ছিলো। যদি পুরো গল্পটা আমার মন মতো এগোতাম তাহলে জাদিদ আসফিয়ার এত সহজে মিল হতো না, রুনা মারা যেত না আর না গল্প এত ছোট হতো। আরও তিন চার পর্ব বেশি হতো। যাই হোক এতদিন খুব নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষই মন্তব্য করেছেন। তবে আমি চাই আজ সবাই মন্তব্য করুন। হিসেব মতো কিন্তু দুই জুটির মিল হয়েছে আর দুই জুটির হয়নি। ভালোবেসে সবার মিল হতে হবে এমন নয়। মাঝে অপ্রাপ্তিতেও পূর্ণতা থাকে। আজ কিন্তু ইয়া বড় মন্তব্য চাই আমার। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here