এখানে বেলি ফুলের মালা-৯,১০
০৯
————————-
বাড়ি ফিরে বিনী সালমা ইসলামের থমথমে মুখ দেখলো। সালমা ইসলাম বিরক্তি মুখে জানালেন শাহিদা খাতুন ফোন দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এও জানালেন দুই দিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেছে বিনী। তাতেও কি মহিলার শান্তি নেই যে রোজ টেলিফোন করতে হবে। প্রথমে সরাবকে পার্কে এক অন্য নারীর সঙ্গে দেখা এরপর এখন আবার মায়ের এসব কথা শুনে বিনীর মনটা বিষিয়ে গেলো।
বিনী দূর্বল পায়ে বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসলো। টেলিফোনের ডায়াল প্যাডে শাহিদা খাতুনের বাড়ির নাম্বার চেপে কানে ধরলো ফোনটা। কিছুক্ষণ ভনভন শব্দ করে ঐপাশ থেকে কেউ বললো ‘ আসসালামু আলাইকুম, মিসেস শাহিদা খাতুন বলছি। ‘
শাহিদা খাতুনের কণ্ঠ শুনে বিনীর জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো উপচে আসতে চাইলো। সে শুধু কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম আম্মা। কেমন আছেন ? ‘
‘ বউ নাকি ? কেমন আছো ? আবিরের কি অবস্থা ?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আম্মা। আবিরও ভালো আছে। আপনি যখন ফোন দিয়েছিলেন তখন আমরা দুজনে বাহিরে ছিলাম। আপনার কি কোনো জরুরী কথা বলার ছিল ? ‘
বিনীর কথায় আমতা আমতা করলেন শাহিদা খাতুন। কথাটা বলবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। বললেও বিনীর প্রতিক্রিয়া যেমন হবে কে জানে। কিন্তু সাহস করে তো বলা প্রয়োজন। তাই তিনি বললেন ‘ না মানে জরুরি কিছু না। শুধু জানতে চাচ্ছিলাম বেয়াই, বেয়াইন কেমন আছেন ? তোমার বোন কেমন আছে ? ‘
শেষ মুহূর্তে শাহিদা খাতুন কথা আর বলতে না পেরে কথা ঘুরিয়ে দিলেন। শাহিদা খাতুনের মুখে সালমা ইসলামের নাম শুনে বিনীর এবার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। সালমা ইসলাম তখন তার সামনেই বসে আছেন সোফাতে। বিনী যতবার শাহিদা খাতুনের সঙ্গে কথা বলতে বসার ঘরে আসে ততবারই তিনি কড়া পাহারায় থাকেন। এসবে বিরক্ত বিনী। সবকিছুর একটা সহ্য সীমা আছে যেটা সালমা ইসলাম পার করেছেন।
বিনী কোনোকালেই ধৈর্য্যধারী ছিল না কাজেই আজও তার ধৈর্য্যতে কুলালো না। সহসাই সে শাহিদা খাতুনকে বললো ‘ আম্মা আমি আর আবির কাল ফিরছি। ‘
যদিও ওদের ফেরার কথাটা সাহস করে বলতে পারছিলেন না শাহিদা খাতুন কিন্তু বিনী নিজ থেকে বলাতে শান্তি পেলেন তিনি। খুশি হয়ে বললেন ‘ তাই নাকি ? তাহলে আসো তোমরা। আমি বুলুকে দিয়ে তোমাদের ঘর পরিষ্কার করিয়ে রাখবো। ‘
এরপর আরও অনেক কথা শেষে বিনী ফোন রাখলো। সে ফোন রাখতেই এবার সালমা ইসলামের রাগত চেহারার মুখোমুখি হলো। তিনি ভীষন ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। তার সেই রাগের সামনে যে কেউ মিইয়ে যাবে কিন্তু বিনী দমলো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই উঠলো এবং বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এগোলো। ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে সালমা ইসলাম যেন আরও বেশি রেগে গেলেন। বিশ্রী ভাবে বলে উঠলেন ‘ নিজের শশুর বাড়ির দালালি করছিস তাইনা ? কি দিয়েছে ওরা তোকে ? জাদু করে ফাঁসিয়েছে নাকি যে তুই এখন তোর বাপের বাড়ি থাকতে চাইছিস না ? ‘
‘ এটা আমার বাপের বাড়ি নয় মায়ের বাড়ি। এই বাড়ির উপর বাবার অধিকার কোন দিন ছিল বলতে পারবে ? মেয়েকে যৌথ পরিবারে বিয়ে দিয়েছে বলে তুমি এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলনি। আমি শশুর বাড়িতে মানিয়ে নিয়েছি বলে তোমার তাতেও সমস্যা। আমি আমার মায়ের বাড়ি থাকতে চাইছি না। যেদিন এই বাড়ি মায়ের বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি হবে সেদিন আমি থাকবো। যেখানে আমার শশুর বাড়ির সম্মান নেই সেখানে আমারও জায়গা নেই। অন্তত আমার শশুর বাড়ি বাপের বাড়ি নিয়ে কিছু বললে দালালি করছি বলবে না। ‘
মেয়ের এতসব তিক্ত কথায় কিছু বলার বোধ হারিয়ে ফেললেন সালমা ইসলাম। যেই মেয়েকে উনি এত ভালোবাসেন, যার জন্য দিনরাত খেটেছেন সেই এমন তর কথা বলবে তাতো অভাবনীয়। যেই মেয়ে কিনা ছোটবেলায় উনার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কাদত সেই এখন শশুর বাড়ির হয়ে কথা বলছে। সব কি তবে যৌথ পরিবারে বিয়ে দেওয়ার ফল ?
ঘরে এসে নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে বিনী। আচমকা ওকে ব্যাগ গুছাতে দেখে আবির খানিকটা চমকে গেলো। ও অবাক গলায় বললো ‘ একি ব্যাগ গুছাচ্ছো কেন ? ‘
বিনী আবিরের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। সে নিজের মতো ব্যাগ গুছিয়েই যাচ্ছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো আবির। বিনীর পাশে দাড়িয়ে কাধে হাত রাখলো। আবিরকে কাছে পেয়ে বিনীর গলার কাছে জমে থাকা কান্নাগুলো উপচে পড়লো। কেঁদে উঠে বলল ‘ আমি আর এখানে থাকতে চাই না আবির। আমাকে নিয়ে চলো তুমি বাড়িতে। আমি আম্মার কাছে যাবো। আমি এখানে থাকবো না আর। আর কখনো থাকবো না। এই বাড়ির লোকেরা শান্তি দিবে না। তুমি আমায় নিয়ে চলো। ‘
—-
রুনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সন্ধ্যাতেই বেরিয়ে গেছে সরাব। তারপর আর তার কোনো দেখা নেই। সেই থেকে রুনা বসে অপেক্ষা করেই যাচ্ছে কিন্তু সরাব ফিরেনি। নূরজাহান কিছুক্ষণ বকবক করে তারপর নিজে থেকেই খেয়ে দেয়ে শুতে গেছেন। আজকাল ছেলের এসব কাজে উনার মেজাজ শুধুই গরম হচ্ছে বৈকি ঠান্ডা হচ্ছে না। ছেলের ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না এটাই বড় সমস্যা।
রুনা বুঝতে পারছে না কি করবে সে। এখন কটা বাজে তার ধারণা নেই। ঘরে ঘড়ি নেই। তবুও রুনা আন্দাজ করলো প্রায় মাঝরাত এখন। কিন্তু সরাব যে ফিরছে না। সে কি আদৌ এসে খাবে ? না খেলে খাবারগুলো তো নষ্ট হবে। অনেক ভেবেচিন্তে রুনা তরকারিগুলো জ্বাল করে ভাতে পানি ঢেলে রাখলো যাতে কোনোটাই নষ্ট না হয়। সরাবের চিন্তায় তার নিজেরও খেতে মন চাচ্ছে।
সরাবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রুনা একসময় অধৈর্য্য হয়ে লন্ঠন ধরিয়ে উঠে দাড়ালো। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। এতক্ষণ অন্ধকারের মাঝেই সে বসেছিল যদি এতে কিছু তেল বাঁচে। এমনিতেই আজ বাহিরে ঘুরতে গিয়ে টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন সেসব টাকার খরচ পোষাতে হবে। অন্ধকারে থাকার কারণে মশার কামড়ও খেতে হয়েছে। মশার কামড় খেয়ে রুনার এখন অবস্থা বিবর্ণ। হাত পা সব জ্বলছে।
ভালোবাসার মানুষটার চিন্তায় শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে লন্ঠন হাতে ঘরের বাহিরে ছুটে গেলো রুনা। সরাবকে এখন খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কে জানে কোনো বিপদে পড়লো কিনা। প্রচন্ড চিন্তায় রুনার মাথায় কিছু আসছে না। সে নূরজাহানকে জানাবে কি জানাবে না করে করেও দোনোমনা হয়ে কিছুই জানালো না। একাই লন্ঠন হাতে ছুটে বেরিয়ে গেলো।
লণ্ঠনের ঝাপসা আলোয় চঞ্চল রুনা তার পা দ্রুত চালিয়ে আঙ্গিনা পেরিয়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু দুশ্চিন্তায় তার আর খেয়াল হলো না আঙিনার বড় লোহার শিকলের গেটটা পেরিয়ে কেউ আসছে। সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে আঁধারে সেই আগন্তুক এগিয়ে এসেছে। ফল বশত যা হওয়ার তাই হলো। আনমনা রুনা তখন ধাক্কা খেলো বলিষ্ঠ দেহী এক আগন্তুকের গায়ে।
ধাক্কা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে টালমাটাল রুনা পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু আগন্তুক তাকে ধরে ফেললো। অন্ধকারে লোকটাকে ঠাওর করে উঠতে পারেনি রুনা। সে ভ্রু কুঞ্চিত চোখে লন্ঠন উপরে উঠিয়ে আগন্তুকের মুখের সামনে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচন হলো বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির চিরচেনা মুখ। ফর্সাটে মুখশ্রীর সুদর্শন সরাব ঘেমে নেয়ে, উস্কখুস্ক চুলে শার্ট, জিন্স পড়ে উদভ্রান্তের মতো দাড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটোতে কেমন ঘোর লেগে এসেছে। এক নজরে তাকিয়ে আছে রুনার দিকে।
লন্ঠনের আলোয় লালিমা মাখানো রুনার দোহারা চেহারা দেখে এই প্রথমবারের মতো বুকের কোথাও এক সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো সরাব। লন্ঠনের সোনালী আলো রুনার গোলগাল মুখে আছড়ে পড়ছে। যেন এই আলো রুনাকে ছুঁয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় তৎপর। সামান্য এই লণ্ঠনের এত বড় দুঃসাহস দেখে অবাক হলো সরাব। যেই নারীকে এখনও সেই ছুঁয়ে দেখেনি তাকে কিনা অর্থ বিত্তে সামান্য এক লন্ঠনের আলো ছুঁয়ে দিয়েছে। এত বড় স্পর্ধা তো অভাবনীয়।
সরাবের হা হয়ে যাওয়া মুখ আর স্তব্ধ হয়ে যাওয়া চোখের দৃষ্টি দেখে রুনার খানিকটা অদ্ভুত লাগলো। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘ এভাবে কি তাকিয়ে আছো ? বাড়ি ঢুকবে না ? এখানে অনেক মশা। বাড়ি চলো নাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মশার খাবারে পরিণত হতে হবে। ‘
সরাব লক্ষ্য করলো রুনা যখন কথা বলে তখন তার কাজল দীঘির মতো গভীর ভাসা ভাসা চোখ দুটো যেন অজান্তেই হেসে উঠে, ঠোঁট দুটো প্রশস্ত এগিয়ে যায়। চোখ দুটোয় অজানা এক আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠে। সামনের ছোট চুলগুলো গন্তব্যহীন উড়তে থাকে। সরাব সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ওর মাথাটা মনে হয় আজ খারাপ হয়ে গেছে। রুনার চিরকাল দেখা রুপ আজ সে অন্য ভাবে দেখছে। এসব কি হচ্ছে তার সঙ্গে ? সে কি রুনার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে ? এত তাড়াতাড়ি কি আদৌ কারোর প্রেমে পড়া সম্ভব ?
প্রেম অভাবনীয়। এর জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দকৃত কোনো সময় নেই। এটা যখন তখন, যেখানে সেখানে, যার তার সঙ্গে হয়ে যেতে পারে। এর উপর কারোর কোনো হাত নেই। কিন্তু প্রেম এবং ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য আছে। কারোর প্রেমে সহজে যত্রতত্র পড়া গেলেও কাউকে ভালোবাসা সহজ নয়। ভালোবাসতে হলে উপলব্ধি করাও জানতে হয়। কিন্তু সরাব কি করে বুঝবে কে তার প্রেম আর কে তার ভালোবাসা ? রুনা নাকি বিনী ?
সরাব স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ ও বিভ্রান্ত। বরাবর নিজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ সরাব আজ অজ্ঞ। সে পরিষ্কার হতে পারছেনা তার অনুভূতি সম্পর্কে। কিন্তু তাকে এভাবে একঘেয়ে, এক ধ্যানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বিনী বেশ বিরক্ত। সে অধৈর্য্য গলায় সরাবের হাতে হাত রেখে বল প্রয়োগ করে বললো ‘ তুমি কি ভিতরে আদৌ ঢুকবে ? মশা খাচ্ছে তো। পরে শরীরে ডেঙ্গু জ্বর বাঁধাবে। ‘
রুনার কথায় হেসে ফেললো সরাব। কোনওদিন যা তার দ্বারা হবে না ভেবেছিল তাই করে বসলো। রুনাকে জড়িয়ে ধরলো । কিন্তু কিছু বললো না। কিছু সময় নীরবে নিভৃতে কাটানো প্রয়োজন। এতে আত্মিক শান্তি আর শুদ্ধি দুটোই মিলে।
আচমকা সরাবের কাজে চমকিত রুনা থমকে গেলো। তার হাত পায়ের লোম শিউরে উঠছে। তাদের বিয়ের এক সপ্তাহ হয়েছে অথচ সরাব একদিনও তার কাছে আসেনি। রাতে তারা এক বিছানায় শোয় ঠিকই কিন্তু সরাব তাকে ছুঁয়ে দেখে না। অথচ আজ অনাড়ম্বরে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তাহলে এতদিনের আয়োজন করে বানানো দূরত্বের কারণ কি ?
সরাব নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরে আছে রুনাকে। আজ আর প্রেম,ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য করতে ইচ্ছে করছে না। প্রেম এবং ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যার মাঝে গ্যাড়াকলে পড়ে অঙ্ক কষে উত্তর বের করা যায় না। এরা যেমন আছে, যেভাবে আছে সেভাবেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। এতে যদি জীবন তার মতো চলে তাহলে চলুক। কি দরকার কে ভালবাসা আর কে প্রেম তার সমাধান বের করার ? সময় হলে সমাধান আপনিতেই এগিয়ে আসবে। ঈশ্বর যখন সমস্যা দিয়েছেন তখন তার সমাধানও দিয়েছেন।
—-
সবশেষে বাড়ি ফিরে এসেছে বিনী আর আবির। হঠাৎ তাদের ফেরার কথা শুনে আসফিয়া এবং জহির সাহেব দুজনই অবাক হয়েছিলেন কিন্তু এটা ওটা বুঝিয়ে বিনী চলে এসেছে। আসার আগে সালমা ইসলামের থমথমে মুখও তার নজর এড়ায়নি। কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই। ওই বাড়িতে থাকার মতো মন মানসিকতা তার এখন আর নেই। থাকলেই দেখা যাবে সালমা ইসলাম কথায়,আচরণে শুধু আবিরদের ভুল ধরবেন। তার থেকে ফিরে আসাই শ্রেয়।
প্রায় দুই দিন পর আবির আর বিনীকে দেখলেন শাহিদা খাতুন। তবুও তার মুখে কোনো উদ্বেগ নেই। শান্ত ভাবেই ওদের ঘরে ঢোকালেন তারপর বিশ্রাম নিতে নিজেদের ঘরে যেতে বললেন। শাহিদা খাতুন শক্ত পোক্ত মনের মানুষ তাই হয়তো তার মাঝে কোনো উৎকণ্ঠার ছাপ নেই। কিন্তু বিনী খানিকটা নরম মনের। টানা দুদিন মানসিক অশান্তিতে কাটিয়ে যখন শাহিদা খাতুনের দেখা পেলো তখন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি সে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
বিনী শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরতেই উপস্থিত অনেকেই খানিকটা চমকে যায়। আবিরের কাশি শুরু হয়। সে দ্রুত এক গ্লাস ভর্তি করে পানি গলাধঃকরণ করে। বিনী যে শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরার মত অবিশ্যম্ভাবী কাজ করবে সেটা তার জানা ছিল না। যদিও আফিফা বিনীর এমন আচরণ আশা করেনি তবে তার ভালো লাগলো বিনী অন্তত সাহস করে শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরেছে। তার তো সাহসই হয়না এমন করার।
সবার সঙ্গে সঙ্গে শাহিদা খাতুনও চমকেছেন। বিনী তাকে জড়িয়ে ধরবে এই আশা তিনি কস্মিনকালেও করেননি। যেখানে উনার ছেলেরাই বড় হওয়ার পর তাকে জড়িয়ে ধরার সাহস করতে পারেনি সেখানে দু দিনের মেয়ে এসে হুট করে জড়িয়ে ধরবে সেটা আশা করা নেহাৎ বোকামি। তবে আশা না করে যে শাহিদা খাতুন বোকামি করেছেন সেটা বিনী পরিষ্কার তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
মিফতা তিমু
এখানে বেলি ফুলের মালা-১০
—————————
আজও রোজকার দিনের মতো আসফিয়ার কলেজের বাহিরে দাড়িয়ে আছে জাদিদ। আসফিয়া যথারীতি বেরিয়ে এলো বান্ধবীদের সঙ্গে। তারপর বরাবরের মতোই বান্ধবীদের নিয়ে পথ চলতে শুরু করলো আর জাদিদ ওদের পিছন পিছন এগোতে শুরু করলো। কাল রানী আর কুসুম জাদিদকে লক্ষ্য না করলেও আজ তাদের চোখে ঠিকই পড়লো।
একলা নির্জন রাস্তায় একটা ছেলের পিছন পিছন আসার ব্যাপারটা রানী আর কুসুমের ভালো ঠেকলো না। খানিকটা ভয়ে ভয়েই কুসুম কথাখানা ফিসফিসিয়ে আসফিয়ার কানে তুললো ‘ এই আফু!! আমাদের পিছন পিছন একটা ছেলে আসছে। ‘
কুসুমের ভয় মিশ্রিত গলায় আসফিয়ার মাঝে ভাবান্তর হলো না। ও জানে কে আসছে ওর পিছন পিছন। তাই ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বলল ‘ তো ? ‘
‘ তো মানে ? ওই ছেলে যদি ছেলে ধরা হয় তাহলে ? তুই ব্যাপারটা বুঝেছিস ? এই ধরনের লোক যা ইচ্ছা তা করতে পারে। ‘ আসফিয়ার এমন পাত্তা দিলাম না ভাব দেখে বিস্মিত গলায় বললো রানী।
‘ উনি ছেলে ধরা নন আর না আমাদের অপহরণ করতে আমাদের পিছন পিছন আসছেন। উনি আমাদের পিছন পিছন না আমার পিছন পিছন আসছেন। ‘
আসফিয়ার কথায় প্রশ্ন করতে গিয়েও যেন আর কিছু বলল রানী আর কুসুম। তারা এখনও আতঙ্কিত। এখনকার সময় ভালো না। রোজ মেয়েদের অপহরণের খবর বের হচ্ছে পত্রিকায়। এই তো আজই কুসুমের বাবা সকালে পত্রিকায় পড়ছিলেন কুষ্টিয়ার এক ১০ বছরের মেয়েকে টাকার লোভে অপহরণ করে পরে ধরা খাওয়ার ভয়ে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
যথারীতি আসফিয়াদের বাড়ির কাছে আসতেই তিন জনের পথ আলাদা হয়ে গেলো। আবারও জাদিদ আর আসফিয়ার পথ একলা হলো। জাদিদ এগিয়ে আসফিয়ার পাশাপাশি পিচ ঢালা কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। দুজনের মাঝে পিনপতন নিরবতা। কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই।
প্রথম কথাটা জাদিদই আগালো। বললো ‘ বাড়ির সবার কেমন অবস্থা ? ‘
‘ আপা আর আবির ভাই বাড়ি ফিরে গেছে। ‘
বিনী আর আবিরের বাড়ি ফেরার কথা শুনে বিস্মিত জাদিদ বললো ‘ মাত্র না পরশু এলো ? এর মধ্যেই আজ আবার ফিরে গেলো। বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে দুই দিন থাকার কারণ কি ?অন্য মেয়েরা আরও বাবার বাড়ি গিয়ে দশ, পনেরো দিন থাকতে চায় ওরআর ভাবী সুযোগ পেয়েও মাত্র দুই দিন। কারণটা কি ? ‘
‘ মেয়েরা বাবার বাড়ি এসে দশ, পনেরো দিন থাকে, মায়ের বাড়িতে থাকে না। আমি যেই কারণে আপনাকে এড়িয়ে যেতে চাই আপাও ঠিক সেই কারণেই নিজের কষ্টগুলো ধামা চাপা দিয়ে ফিরে গেছে। ‘
‘ কি কারণ ? ‘
‘ আপার বিয়ে আপনাদের যৌথ পরিবারে হয়েছে। যৌথ পরিবার নিয়ে এক বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছে মায়ের সংসার জীবনে। আর সেসবের কারণেই উঠতে বসতে মা আপাকে কথাবার্তায় বুঝায় তার বিয়েতে মায়ের মত নেই। মায়ের ধারণা তার সঙ্গে যা অন্যায় হয়েছে সেসব তার মেয়েদের সঙ্গেও হবে যদি যৌথ পরিবারে বিয়ে হয় মেয়েদের। ‘
আসফিয়ার কথায় কি বলবে বুঝতে পারলো না জাদিদ। তাদের পরিবার নিয়ে এত আপত্তি সালমা ইসলামের শুধুমাত্র তারা যৌথ পরিবার বলে। ভালোবেসে এক পরিবারে থাকাও বুঝি অপরাধ। এরপর আর তাদের মধ্যে কোনো কথা হলো না। নিজের বাড়ির গলিতে ঢুকে যাওয়ার পূর্বে আসফিয়া বললো ‘ আর এ পথে আসবেন না বেয়াই সাহেব। এই ইট, কংক্রিটের তৈরি মানুষ আপনাদের মত বড় মনের মানুষদের জন্য নয়। ‘
আসফিয়া চলে গেছে অনেকক্ষণ। তবুও জাদিদ এক ধ্যানে দাড়িয়ে আছে। তার কার্নিশে নোনা অশ্রু জমেছে। চোখ দুটো সিক্ত হয়েছে কানায় কানায়। জাদিদ আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো। যদি আসফিয়া ফিরে আসে। কিন্তু না আসফিয়া আর ফিরেনি। সে চলে গেছে সবসময়ের জন্য। জাদিদও ভঙ্গুর হৃদয়ে ফিরতি পথে হাঁটা দিলো।
দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আসফিয়া। তার গলার কাছে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে। সে আড়াল থেকে একবার লম্বাটে, বলিষ্ঠ দেহী প্রতিমূর্তিকে দেখলো। মানুষটা তবে চলে যাচ্ছে। এছাড়া আর কিইবা করার থাকে। যাদের ভবিতব্য ছিল আলাদা হওয়া তাদের সম্পর্কের বাঁধন যে কখনও জোড়া লাগার নয়। এ তো আর বেলি ফুলের মালা নয় যে এবড়ো থেবড়ো ফুল গাট বাঁধলো এক সুতোয়। এ আস্ত দুই মানব মানবীর জীবন। যাদের মাঝে না আছে মিল আর না আছে এক হওয়ার মতো ভাগ্য লিখন।
—-
শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে নাকের জলে,চোখের জলে অবস্থা করে ফেলেছে বিনী। ওর কান্নাকাটি দেখে সকলেই হতভম্ব। শাহিদা খাতুন পড়ে গেছেন অসস্তিতে। তিনি বিনীকে নিজের কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন ‘ এমন কান্দনের কি আছে ? বাপের বাড়ি থেইকা এত তাড়াতাড়ি আসছো বইলা কান্না আইতাছে ? তাইলে আরও কয়দিন থাইকা আইতা ? এখন কাইন্দা লাভ কি ? এই আবির তোর বউরে নিয়া ঘরে যা। আমার শাড়ি নিজের চোখের পানি দিয়া ভাসায় দিতাছে তোর বউ। তাড়াতাড়ি ঘরে নে ওরে। ‘
শাহিদা খাতুন বিনীকে আবিরের কাছে ধরিয়ে দিয়ে শাহিদা খাতুন রান্নাঘরে গেলেন। রান্নাঘরের মেঝেতে থাকা সবজি কাটতে কাটতে ছেলে আবিরের উদ্দেশ্যে বললেন ‘ এখনও খাড়ায় আছস ? বউমারে ঘরে নে। একটু বিশ্রাম নে দুজনে। আজ আর রান্নাঘরে আসবার প্রয়োজন নাই। আমি,বড় বউমা আর জাহানারা সব কইরা ফেলমু। ‘
বিনী ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছে। চোখের পানি মুছে শাহিদা খাতুনকে মৃদু গলায় বললো ‘ আম্মা গাড়ি করেই এসেছি, বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে একটু সাহায্য করি ? ‘
বিনীর কথায় ধমকে উঠলেন শাহিদা খাতুন। বললেন ‘ তুমি বড় না আমি বড় ? তুমি বেশি জানো ? চুপচাপ ঘরে যাইয়া বিশ্রাম করো। বিকালে উইঠা তোমার আব্বারে চা কইরা দিবা। কথাখানা মাথায় রাখবা। মানুষটা তোমার হাতের চা খাইবো বইলা রোজ অপেক্ষা করে। ‘
শাহিদা খাতুনের ধমক খেয়ে বিনী চুপ করে গেলো। আবির তাদের দুই শাশুড়ি বউয়ের ধমকাধমকি দেখে উপরে চলে গেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। বাধ্য হয়ে এখন তাকেও যেতে হবে। বিনী মন খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো। আবির ততক্ষনে জামা,কাপড় বদলে নিয়েছে। বিনীকে ঢুকতে দেখে সে কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল ‘ তুমি যে কাদতেও পারো সেটা জানতাম নাতো ? ‘
আবিরের কথা শুনে ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। কিন্তু আবির ওর রাগী চোখ,মুখ পাত্তা দিলো না। সে হাসতে হাসতে বললো ‘ এত বড় মেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছে ভাবলেই তো হাসি পায়। ‘
বিনী এবার থমথমে মুখে বিছানার উপর পড়ে থাকা কোসন আবিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজেদের কাপড়ের ব্যাগ গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আবির কোসন তার গায়ে পড়ার আগেই ধরে ফেললো। তার হাসি এখনও চলমান। তাকে হাসতে দেখে প্রথমে বিনী কপট রাগ দেখালেও একসময় না পারতে সেও হেসে ফেললো কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে। আবির সেই হাসি মুগ্ধ চোখে দেখছে। বিনী আজ পর্যন্ত কোনওদিন তার সামনে বড় গলায় হাসেনি। বিনীর সবকিছুই পরিমিত। কথায় কথায় সে আবেগীও হয়ে পড়ে না।
—-
‘ ওহে প্রিয়
তুমি আছো যেথায়,
কভু পাবে নাকো আমায়
আমি যে তোমারই সাধ্যের বাহিরে সেথায়। ‘
শুভ্র কাগজে কালো রংয়ের গোটা গোটা অক্ষরে আঁকিবুকি করছে আসফিয়া। কল্পনায় তার জাদিদ। মানুষটা তাকে আর শান্তি দিলো না। যেদিন থেকে দেখা হয়েছে সেদিন থেকেই তার কল্পনায় যখন তখন চঞ্চল বিহঙ্গের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসছে। যখন তখন হাজির করছে কল্পনার রাজ্যে নিয়ে। তার কাজেকর্মে বিরক্ত প্রায় আসফিয়া। বিরক্তিতে ছেয়ে থাকা মুখে প্রায়ই ফিসফিসিয়ে বলছে ‘ অসহ্য অসহ্য ‘।
কিন্তু মুখে আসফিয়া অসহ্য বললেও তার বেয়াই সাহেবকে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে। তার এই ভাবাভাবি তাদের প্রেম পর্যন্তই। নিজেদের বিয়ের স্বপ্ন সে দেখেনা। কারণ সে জানে তার দৌড় কত দূর। তার মা তার বোনের বিয়েটা তো যৌথ পরিবারে হতে দিয়েছে কিন্তু তার বিয়ে কখনও হতে দিবে না।
সালমা ইসলামকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে বহু পূর্বেই। নিজের সাংসারিক জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কারণে যৌথ পরিবার নিয়ে একরকম আতঙ্কে ভুগছেন তিনি। বিগত দিনগুলোতে প্রচন্ড মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই কারণেই এখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করেনা। তবুও তো বিনীর বিয়ে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অশান্তি করেননি এই বেশি। এরপর আসফিয়ার সাহস নেই তার মায়ের মানসিক চাপ বাড়িয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
—-
আজাদ সাহেব বসার ঘরে থাকা প্রকান্ড কাঠের চেয়ারটায় বসে আছেন। তার হাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খ্যাত দূর্গেশনন্দিনী। বেশ মনযোগ সহকারে চেয়ারে দুলতে দুলতে বই পড়ছেন তিনি। চেয়ার যতবার নড়ছে ততবারই ক্যাচ ক্যাচ করে এক আওয়াজ হচ্ছে। এই চেয়ারটা বেশ পুরো সময়ের। আজাদ সাহেবের দাদার। উত্তরাধিকার সূত্রে দাদার বাড়ি থেকে এই চেয়ারটা পেয়েছিলেন তিনি।
আজাদ সাহেব ছিলেন তার দাদা আজিম সাহেবের খুব প্রিয়। সকালে হাটতে বেরোনো কিংবা বিকেলে বসে চা খাওয়া, সবক্ষেত্রেই তিনি আজিম সাহেবের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। সেই সূত্রেই আজিম সাহেব মারা যাওয়ার পর তার প্রিয় চেয়ারখানা নিজের কাছে নিয়ে আসেন তিনি।
‘ আব্বা ‘
আজাদ সাহেব যখন বিপুল মনযোগে বই পড়তে ব্যস্ত তখনই এক মেয়েলি গলার স্বর শুনতে পেলেন। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে সামনের দিকে নজর দিলেন। সামনে দাড়িয়ে আছে খয়েরী রংয়ের সুতি শাড়ি পড়া বিনী। নব বিবাহিতা বিনীর ফর্সা শরীরে তখন অল্প স্বল্প সোনার গয়না। হাতে সোনার চুড়ি, গলায় সরু চেইন আর কানে ছোট দুল। ফর্সা বদনে হালকা কিছু এই সোনার গয়নাতেই তাকে অপরূপ সুন্দরী মনে হচ্ছে।
বিনীর মাথায় ঘোমটা টানা। হাতের চায়ের ট্রে কিছুটা কাপছে। ভয়ে ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। আজাদ সাহেব আনমনে হাসলেন। হেসে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে চোখে হাত রেখে চোখ দুটো বুজলেন। চোখে ভাসছে তেতাল্লিশ বছর পুরনো সেই অম্লান স্মৃতি। ঠিক এরকমই এক স্মৃতি মৃন্ময়ীরও আছে।
মৃন্ময়ী তখন বছর পনেরোর কিশোরী আর আজাদ সাহেব তেইশ বছরের যুবক। মায়ের পীড়াপীড়িতেই বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলেন বছর পনেরোর এক কিশোরীকে। সেই কিশোরী মৃন্ময়ী ছিল তার প্রথম স্ত্রী। জীবনে প্রথম কোনো বাহিরের নারীর পদার্পণের জন্যই নাকি অন্য কিছুর কারণে কে জানে কিন্তু আজাদ সাহেব পড়েছিলেন সেই কিশোরীর প্রেমে। কিশোরীর উত্তাল প্রেমে ভেসে যাওয়া আজাদ সাহেব একদিন আবিষ্কার করলেন সপ্তদশী সেই কিশোরী মা হতে চলেছে আর উনি বাবা।
তারপর ? তারপরই একদিন এলো সেই সর্বনাশা রাত। সেই রাতে মৃন্ময়ী হঠাৎ শয্যাশায়ী হলো। আনিসের তখন এক মাস। এমনিতেই অল্প বয়সে বাচ্চা জন্ম দিয়ে মৃন্ময়ী সুস্থ ছিল না। তার উপরে সেই রাতে এমন কিছু একটা হলো যার পর মৃন্ময়ী আর বিছানা ছাড়তে পারলো না। তারপরই পরদিন সকালে আজাদ সাহেব পেলেন তার নিথর দেহ।
দৃশ্যখানা এখনও আজাদ সাহেবের চোখের সামনে অম্লান। সময়ের স্রোতে আজাদ সাহেবের বয়স বেড়েছে, বুড়ো হয়েছেন তিনি কিন্তু প্রথম স্ত্রীকে ভুলেননি তিনি। ছেলের জন্য মায়ের অভাব পূরণ করতেই শাহিদা খাতুনকে বিয়ে করেছিলেন আর সেই অভাব ঘুচেছেও। শাহিদা খাতুন কোনওদিন নিজের ছেলে আর আনিসের মধ্যে পার্থক্য করেননি। শাহিদা খাতুনকেও ভালোবাসেন আজাদ সাহেব কিন্তু সে শুধুই ভালবাসা। সে মৃন্ময়ীর মতো প্রেমিকা আর হয়ে উঠতে পারেনি।
আজাদ সাহেবের এখনও মনে পড়ে বিয়ের পরের দিন মৃন্ময়ী যখন তার জন্য চা এনেছিল তখন তার হাতও বিনীর মতোই কাপছিল। পড়নে অল্প কিছু সোনার গয়না আর তাতের শাড়ি। টসটসে টমেটোর মতো আলতা বরণ কিশোরীর ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে উঠা মুখ আজও ভুলতে পারেননি আজাদ সাহেব। বিনীকে দেখে আবারও তার সেই সপ্তদশী প্রেমিকার কথা মনে পড়ে গেলো যে একাধারে তার প্রেমিকা, স্ত্রী এবং সন্তানের মা ছিল।
সেই সোনালী দিনগুলোর কথা মনে পড়লেও এখন বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই আসে না। যদি সেদিন উনি একটু সতর্ক থাকতেন তাহলে আজ হয়তো মৃন্ময়ী তাদের মাঝে থাকতেন। অল্প বয়সে সংসার আর সন্তান যে একটা মেয়ের জীবনকে ঠিক কতটা ঝুঁকিতে ফেলে দেয় সেটা তিনি এখন বুঝেন। যদি এই কথাটাই আরও আগে বুঝতেন তাহলে আজ তার প্রিয়তমা বেচেঁ থাকতেন।
আজাদ সাহেবের আজও মনে পড়ে মৃন্ময়ী মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন তার ছেলেকে যেন দেখে রাখেন, তাকে যেন কখনও মায়ের অভাবে পড়তে না হয়। আজাদ সাহেব মৃন্ময়ীর কথা রেখেছেন। ছেলের জন্য মা এনেছেন আর নিজের জন্য স্ত্রী। কিন্তু সেই স্ত্রী আর তার প্রিয়তমা হয়ে উঠতে পারেনি। শাহিদা খাতুন বিয়ের পর থেকেই আনিসকে নিজের ছেলে মেনে নিয়েছেন। উনি নিজেও মা হারা ছিলেন তাই একজন সন্তানের মায়ের প্রতি হাহাকার বুঝেন তিনি।
শাহিদা খাতুন চেয়েছিলেন আনিস আর আবিরের মধ্যে যেন কখনও কোনো ভেদাভেদ না হয়। তারা যেন সবসময় আপন ভাইদের মতো থাকেন। তাইতো উনি যে আনিসের নিজের মা নন এবং আজাদ সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী সেই কথা বড়রা ছাড়া কেউ জানেন না। সন্তানদের জানিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্বেষ করতে চাননি কখনও শাহিদা খাতুন।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
ছবিয়াল: Maksuda Ratna