এবারও_তুমি _বুঝলেনা,পর্ব_৪

0
936

#এবারও_তুমি _বুঝলেনা,পর্ব_৪
#Alisha_Anjum

এই ঝুপ ঝুপ করে তুমুল বর্ষণ, আবার কখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। মেঘের গর্জন তো বিকট আওয়াজে হচ্ছে। তিশু একপ্রকার দৌড়ে আসছে। ইতিমধ্যেই শাড়িতে বৃষ্টি জমে একাকার। উদাস, এলোমেলো হাওয়ায় তিশুর মাথার ছোট চুলগুলো ভীষণ আনন্দে উড়ছে । তিশু দৌড়ে এসে দাড়িয়ে গেল রেল স্টেশনের পাশে অস্থায়ী এক দোকানের ছাওনির নিচে। তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তিশু গোল গোল চোখ মেলে দেখলো চারপাশ। হঠাৎ দু একজন ছাড়া অস্থায়ী তার সমক্ষ কাউকে চোখে পারে না। তিশুর দুঃখ ভরা অভিমানী মনে ভয়ের উদ্রেক হলো। বৃষ্টি তো ভীষণ হচ্ছে। সে এখন এই ঢাকা থেকে বগুড়ায় যাবে কখন? কিভাবে যাবে? এই বৃষ্টির মধ্যে রাতের বেলায় ট্রেনে একা যাবে কিভাবে? সাত আট ঘন্টার এই রাস্তা তিশু বিয়ের পর কখনো একা পারি দেয়নি। তিশু দুশ্চিন্তায় হাশফাশ করছে। এই দুশ্চিন্তা বহুগুণ বেড়ে দিতে কোত্থেকে যেন উদয় হলো এক কুনজর। তিশুর ঠিক ডানেই দাড়িয়ে আছে একটা মধ্যবয়স্ক লোক। তিশুর বাহুতে বাহু লাগানোর বিচ্ছিরি চেষ্টা করছে। ভয়ে তিশুর অন্তরাত্মা কাঁপছে। হৃদপিণ্ডর গতি সেকেন্ডে বাহাত্তর ছাড়িয়ে যেন একশ হয়ে গেছে। তিশু বারংবার শুকনো ঢোক গিলছে। ভেতর থেকে ঢেলে ঢুলে আচমকা কান্না আসছে। তিশু ছাউনি থেকে বেরিয়ে পরলো। লোকটার লোলুপতা বাড়ছে। তিশুর অস্বাভাবিক ভয় মনে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উঠছে। মন ভীষণ অধরকে কাছে চাইছে। বৃষ্টিতে আদ্র কাপলে তিশুর নয়ন জল গড়িয়ে পরলো। তিশু হন হন করে হাটতে হাটতে একান্তই আফসোসে ভেসে যাচ্ছে। অধরের উপর রাগ করে তার বাবার বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব ভুল হয়েছে। বোকামি করেছে সে এতো রাতে বেরিয়ে। যেমন বান্ধবীর বাড়িতে ছিল তিনঘণ্টা। তেমনই আজ রাতটা ওখানেই কাটালে এখন এমন নিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে পরতে হতো না।

লোকটা ধেয়েই আসছে তিশুর পিছু। তিশুর ভয় দমে দমে বাড়তে লাগলো। কি করবে সে? কতক্ষণ হাঁটবে? কোনদিকে মোড় নেবে? তিশু পেছন ফিরে চাইলো। লোকটা তার থেকে তিন হাত দূরে হবে।

.
অধর থেমে থেকে এগোচ্ছে। একটু বৃষ্টির বেগ একটু কমলেই সামনে এগোয়। দোকান পাঠে ভীষণ অস্থিরতা নিয়ে শুধায় তার তিশুকে কেউ দেখেছে কিনা। তার তিশু এদিকে এসেছে কিনা। এমন করে করে দ’ঘন্টা অতিপাত হলো। অধর বসে বসে আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টাতে তাকিয়ে আছে। কোথায় তার তিশু? ক্ষণিক ক্ষণ হলো তিশুর দেখা না পেয়েই অধরের যেন বিমর্ষের প্রতিমা হয়ে গেছে। অধর ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো। তার পাশেই কাঠের বেঞ্চে নসে আছে বৃদ্ধ যুগল। পাশাপাশি বসে তারা কত কি যে আলাপ করছে! অধরের ইচ্ছে হলো একদিন তিশুকে নিয়ে সে বৃদ্ধ কালে এমন করে বেরোবে। বৃষ্টি বিলাশ করবে। তার আগে তিশুকে সে খুজে পেয়ে গলা চেপে ধরবে। কেন অধরকে এক সাগর দুশ্চিন্তা, এক আকাশ ছটফটানি দিয়ে গুপ্ত হলো? অধরের চোখ ভিজে আসছে। সে কেমন ভালোবাসে তিশুকে, কতখানি ভালোবাসে তা আমি আমার কলমের সামান্য আঁচড়ে জীবন ভর লিখেও বোঝাতে পারবো না।

অধরের মন কাঁদানো ভাবনার মাঝেই হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো। হাতের উল্টো পিঠে ডলা দিয়ে চোখ মুছলো সে। তার আম্মা ফোন করেছে

— অধর তুমি ঠিক আছো? বৃষ্টির পানি বেশি গায়ে লাগতে দিও না। তোমার কিন্তু প্রচুর ঠান্ডা লাগে। মাথা ব্যাথা হবে।

ফোন তোলার সাথে সাথে অধরের মায়ের প্রথম বাঁক। সবসময় তিনি ছেলেকে আগলে রাখতে চান। অধর ফোনের এপাশে মায়ের প্রশঙ্গ না টেনে অস্থির ভঙ্গিতে বলল

— আম্মা তিশুকে এখনো পাইনি।

— হ্যা সেই কথাই বলবো। তিশুর বান্ধবী ফোন করেছিল। যে মেয়েটা ঢাকাতেই থাকে। খুশি মেয়েটা। ও বলল তিশু নাকি ওর থেকে টাকা ধার করে বাবার বাড়িতে যাচ্ছে। রেল স্টেশনের দিকে নাকি গেছে। তুমি আর বৃষ্টিতে ভিজো না। তুমি তাড়াতাড়ি ওখানে যাও তিশু হয়তো ওখানেই আছে।

মায়ের কথায় অধরের নির্লিপ্ত চেহারার একটু অব্যাহতি ঘটলো। সে মাকে ফোন রাখি বলে তড়িঘড়ি করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো। বৃষ্টির দাপট দমেনি। অধর তবুও নেমে পরলো খোলা আকাশে হঠাৎ হঠাৎ চিল্লিয়ে ওঠা বিজলির মাঝে। শার্ট বৃষ্টি বিলাশ করে ভিজে একাকার। অধরের এক ঝাক চুল ভিজে লতিয়ে পরেছে। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো পলকহীন তাকিয়ে আছে সামনের পথে। ভীষণ সুন্দর এই পুরুষটা ছুটে চলল। এখান থেকে স্টেশনে হেটে যেতে তার প্রায় পনেরো মিনিট সময় লাগবে।

.
তিশু দ্রিম দ্রিম করা হৃদপিণ্ড নিয়ে হাটছে। কি করবে সে? লোকটা এখনো পিছু ছাড়েনি। তিশু ঘাবড়াচ্ছে ভীষণ। এদিক ওদিক দশদিক সে চোখ বুলালো। ভালো করে লক্ষ্য করলো কোন যাত্রী ধরণের কেউ আছে কিনা। খুব চাওয়ার পর হয়তো ভাগ্য তার সহায় হলো। শঙ্কা কমানোর পথ জুটলো। তিশুর থেকে একটু দূরেই একটা দোকান। তার সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে আছে একটা লোক। বয়স হবে হয়তো অধরের মতো। লোকটার কোলে একটা বাচ্চা মেয়ে। আশপাশে আর কাউকে চোখে পরছে না তেমন। তিশু আর আগে পারে ভাবলো না। দ্রুত হেটে চলে গেল লোকটার কাছে। দোকান ঘরে ঢুকেই সে পেছন ফিরে চাইলো। পেছনের সেই নিকৃষ্ট লোকটাও তিশুর পিছু পিছু দোকান ঘরে এসে উঠেছে। তিশু কি করবে তার ঠাহর পাচ্ছে না। অস্থিরতায় শাড়ির আরচল হাতে পেঁচিয়ে গিট ফেলেছে। পাশের দাড়িয়ে থাকা বিশ্রী লোকটা ধীর গতিতে এগিয়ে এসে তিশুর গা ঘেঁষে দড়ালো। তিশুর ঘৃণায় যেন পেটের তলদেশ হতে বমি উঠে আসতে চাইলো। লোকটা তিশুর গা ঘেঁষে দাড়াতেই তিশু যেন হুড়মুড়িয়ে বসে পরলো বাচ্চা বুকে নিয়ে বন্ধ চোখে বসে থাকা স্থির লোকটার পাশে।

নিশান চমকে উঠলো। ভীষণ ক্লান্তিতে তার চোখ ধরে এসেছে। মেয়ের কান্নাকাটি একটু আগে বহু কষ্টে তাড়িয়ে দিয়ে একটু চোখ বুজেছিল। ঠিক তখনই এসে তিশু ধপ করে বসে পরেছে। আশ্চর্যতায় ডুবে থাকা চোখ নিয়ে নিশান পাশে তাকালো। চেনে না, জানে না সে পাশে ধপাস করে বসে পরা মেয়েটাকে। তিশু অসহায় অনুনয়ের দৃষ্টিতে নিশানকে যেন আহ্বান করছে। পেছনের লোকটার থেকে মুক্তি চায় সে। নিশান বুঝলো কিনা অচেনা তিশুর দৃষ্টি কে জানে! কিন্তু অবাক চাহনিটা প্রতিস্থাপন করলো সে নোংরা লোকটার দিকে। এবার মস্তিষ্ক বুঝি চট করে বুঝে গেল অচেনা মেয়েটার আগমন। অবাক চাহনি নিরাকন হলো। নিশান নিজের মেয়েকে কোল থেকে উঠিয়ে কাঁধের উপর নিলো। চোখ মুখে তাচ্ছিল্য একে এগিয়ে গেলো লোকটার দিকে। ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো লোকটার মুখে বড়সড় এক ভয়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলো। লোকটা অত্যন্ত শঙ্কিত মুখে পিছু হটছে। তিশু অবাকতার দমকায় দাড়িয়ে গেল। নিশান ইতিমধ্যে খপ করে লোকটার কলার চেপে ধরছে। তিশুর বুকে নব উদ্যোগে যেন ভয়ের উদ্রেক হলো। হঠাৎ তার মনে হলো লোকটার কোল থেকে বাচ্চাটা নেওয়া উচিত। তিশু এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশান মেয়েকে দিয়ে দিল তিশুর কাছে। তিশু বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে অবাক চোখে সরে এলো। সে বুঝতে পারছে না লোকটার এতো রেগে যাওয়ার কারণ। তিশু ভাবতে ভাবতে সামনে তাকালো। আশে পাশে কি কেউ আছে? যদি দু’জনের মধ্যে মারামারি লাগে কি হবে? তিশু ভয় মিশ্রিত চোখে চোখ বুলাচ্ছিল। ঠিক তখনই তিশুর অন্যরকম এক সুখবর অনুভূতির দেখা মিলল। তিশু যেন সব ভুলে গেল। নিঃশব্দে হেসে উঠলো বারিনয়নে। হৃদয় ভালোভার মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শনে খুশিতে ছুটতে চাইলো। তিশু বাঁধা দিল না। অদূরে অস্থির চোখে খুজে বেড়ানো অধরের দিকে তিশু টুটতে লাগলো। বৃষ্টির পিচ্ছিল মাটিতে যতোটা দ্রুত যাওয়া যায় তরশু যেতে লাগলো। অধরের৷ নজরে এখনও ধরা পরেনি তিশু। অধর এপাশে, ওপাশে, একে ওকে শুধাতে ব্যাস্ত তিশুর কথা। তিশু হাসছে। বোঝাই যাচ্ছে অধর কতটা অস্থির হয়ে আছে। তিশু ভাবলো অধরের কাছে গিয়ে প্রথমে সে অধরের সাথে কোন কথা বলবে না। কেন মারলো তাকে? ঐ নিধির মিথ্যে কথা, নিধির বাচ্চাকি তিশুর থেকে বড়! তিশুর মনে দলে দলে এসে অভিমান জমলো। শক্ত করে জরিয়ে নিল বুকে বাচ্চা মেয়েটাকে। ঠিক তখনই ভাগ্য, হতভাগ্য হয়ে গেল। তিশুর জমানো অভিমান, বুনানো পরিকল্পনা ছাপাছাপি করে দিয়ে নর্মম আকাশ বুক চিড়ে ছুড়ে মারলো বিজলি। বিকট, শব্দ, ভয়ংকর আলোর রেখা থেকে বেরিয়ে এলো বিদুৎ। এসে পতিত হলো ঠিক তিশু আর অধরের মাঝপথে। অধরের গলা থেকে তিশু শুনতে পেল চিৎকার। তার দেহ অবস হয়ে আসছে। তিশুর চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় পানি বইতে লাগলো। ‘অধরের যেন কিছু না হয়’। মনে মনে এ কথা আাওড়াতে আাওড়াতেই সে চোট্টা বাচ্চাটাকে বুকে নিয়েই ঢলে পরলো মাটিতে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here