#এবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_২
#Alisha_Anjum
তিশু জানে অধর কোথায়। আজ সাত দিন হল তার অধর তো তাকে ভুলেই গেছে! পুরনো রুটিনের সেই গোধূলি বেলায় দুজনে আর নিয়ম করে বেলকনিতে বসে এক কাপে চা খাওয়া হয়না। হয়না একে অপরের প্রেমে মুগ্ধ হওয়া। অধরের নতুন রুটিন অনুযায়ী সে নেহাল কে নিয়ে বাগানে ঘোরে। অধরের নতুন রুটিন অনুযায়ী সে নেহালকে নিয়ে বাগানে ঘোরে। তারপর যায় নিধির ঘরে। প্রায় আধঘন্টা আলাপচারিতা চলে। অবশেষে নিজ ঘরে আসে। তিশু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভীষণ দমবন্ধ লাগছে তার। বাগানে একবার হেঁটে আসা যাক।
বিশাল বাড়ির এক প্রাঙ্গণজুড়ে ফুলের বাহার, সুপারি গাছের সারি। মাঝে মাঝে দু একটা ফল গাছ। তিশু হাঁটছে সুপারির সারি ধরে। তার একটু দূরেই ইট-সিমেন্টের নির্মিত বাসার আসনে বসে আছে অধরের বাবা, নিধি, অধর, আর নিধির ছেলে। প্রত্যেকের মুখ হাস্যজ্জল। অধরের পাশ ঘেষে বসে বসে আছে নিধি। গল্পের মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে নিধি অধরের ওপর। অধর ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে হয়তো। সে একটু সরে বসছে। কিন্তু নিধি যেন নতুন উদ্যোমে আবার হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে অধরের গায়ে। তিশুর চোখ ছল ছল করে উঠলো। এখানে একটা বিষয় শিশুর অবুঝ মন এড়িয়ে গেল। ধরতে পারল না সে অধরের বিরক্তি মাখা মুখটা। এরইমধ্যে তিশুর ক্ষত হৃদয়কে আরো কত করে দিতে হঠাৎ উদয় হল তিশুর শাশুড়ি। তিশুর ভাবনার ঘোর বিরোধিতা করে তিনি বলে উঠলেন।
— পুরুষ মানুষ পূর্ণতা চায়। তারা সব না পেলে মন ফিরিয়ে নিতেও দ্বিধা করে না।
হঠাৎ কারও গলার স্বরে তিশু চমকে উঠলো। ঝটপট লুকাতে চাইলেও চোখের পানি। পিছন ফিরে মিথ্যে হাসি মুখে ঝুলিয়ে, শ্বাশুড়ির হৃদয়হীনা কথা শুনেও না শোনার ভান করে বলে উঠলো
— মা আপনি? কখন এলেন?
অধরের মা কটাক্ষ হেসে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো তিশুর প্রশ্ন। অতপর হঠাৎই চোখের দৃষ্টিতে শান্ত ছোপ ফুটিয়ে তুলে বলল
— নিধিকে দেখে খারাপ লাগছে তাই না? পারলে আঁচলে বেঁধে রাখো আধারকে। রূপ তোমার চেয়ে নিধির দ্বিগুণ। সক্ষমতাও তোমার চেয়ে অধিক।
অধরের মায়ের উত্তেজনাহীন কথায় তিশুর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাে। মুখটা শুকিয়ে চুপসান। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা অপমানের আঁচ যেন সুক্ষ্ম ভাবে গ্রহণ করলো। অসহ্য ব্যাথায় বিষিয়ে উঠলো তিশুর মন। তিশু মা হতে পারবে না এই কথাই তো খোঁচা দিয়ে বলল অধরের মা।
— তিশু তুমি খামোখা পরে থাকো।তুমি জানো? আমার ছেলে শুধুমাত্র তোমার জন্য সংসার বাধতে পরছে না। পূৰ্ণতা পাচ্ছে না জীবনে। অধর অন্যের কথা খুব ভাবে। সেজন্য ও আজও তোমাকে মুখ ফুটে মনের কথা বলতে পারছে না।
নির্মম শাশুড়ি মায়ের শীতল বাণী। তিশু নিশ্চুপ শুনছে। সত্যিই৷ কি তাই? অধর সত্যিই তাদের সম্পর্কে খুঁত এনেছে? শুধুমাত্র তিশু সন্তান দিতে পারবে না বলে? তিশুর মন অঝোর চিন্তায় বিক্ষিপ্ত হয়ে পরলো। ঠিক একটু পরেই আবার তিশু মনের জোরে ভবনা ছাপাছাপি করে দিল। না! এমন কিছু হতেই পারে না। তার অধর এমন কক্ষনো করবে না। আগের কল্পে ভুল করে সে চলে গিয়েছিল কিন্তু এবার যাবে না। বেশি বুঝবে না সে এবারের পরিস্থিতিতে। তুশি মন ভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চাইলো শাশুড়ির অভিমুখে। এক চিলতে হাসির ঢেউ তার ঠোঁটে। ভীষণ সুন্দর ভঙ্গিতে বলল তিশু
— মা, দোয়া করবেন আমি যেন আপনার ছেলেকে শুধুই আমার করে রাখতে পারি। শকুনের নজর থেকে যেন ও রক্ষা পায়।
তিশুর কথা অধরের মায়ের কান অব্ধি পৌঁছাতেই মুখটা শুকিয়ে গেল তার। কোত্থেকে যেন থোকা থোকা অপমান এসে জরিয়ে গেল মুখে। তিশু এখনও মুচকি হাসছে। অধরের মা হনহন করে প্রস্থান করলো মারাত্মক আত্নবিশ্বাসী, ঠান্ডা মাথার বৌমার সম্মুখ হতে। এই মেয়ে কি দিয়ে গড়া? একদম স্বামী, স্ত্রী দুজনেই পাক্কা শেয়ান। এদের এতো ভালোবাসা, বিশ্বাস যে কিছুতেই উল্টাপাল্টা বোঝানো যায় না।
.
ঘুম ঘুম দুইটা চোখ কিছুতেই যেন খুলে রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু টিভিতে নিউজ চলছে। তিশুর ভীষণ বিরক্ত লাগছে। এমনিতেই প্রচন্ড ঘুমে মনে হচ্ছে সে নেশাা করেছে তার উপর অধর বিরক্তিকর নিউজ দেখছে। তিশুর নিউজ দেখতে ভালো লাগে না! তিশু উঠার জন্য প্রস্তুত হলো। নিউজ দেখার চেয়ে ঘরে গিয়ে ঘুমানো ঢের ভালো। তিশু উঠে পরলো অধরের কাছ থেকে। অধর আড়চোখে দেখলো। তিশুও হঠাৎ তির্যক দৃষ্টিতে তাকালো অধরের দিকে। আকস্মিক দুজনের চোখাচোখি। অধর তড়িৎ গতিতে চোখ ফিরিয়ে নিল। টিভির দিকে এমন করে তাকালো যেন আশেপাশে দুনিয়া সুদ্ধ ভয়ঙ্কর বণ্যায় তলিয়ে গেলেও তার চোখ ফেরানোর সময় নেই। তিশু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি হলো এটা? বউয়ের দিকেই তো তাকাবে! আবার লুকোচুরি খেলতে হবে? তিশু অবুঝ চাহনি মেলে তাকিয়ে রইল অধরের দিকে। হঠাৎ ক্ষনিক পরে অধরের কন্ঠ হতে কাঠ কাঠ কন্ঠে ধ্বনিত হলো
— এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার অস্বস্তি হয়।
টিভির পর্দা থেকে চোখ সরেনি অধরের। তিশু হতভম্ব ভাব গিলতে পারলো না। হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে বিনাবাক্যে ঘরের পানে ছুটলো। তিশু চলে যেতেই অধরের মুখে ফুটে উঠলো অসহায়ত্ব। ঘরে যাবি যা বউ! কিন্তু স্বামীকে কেন রেখে গেলি? অধর ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো। তিশুকে সে কতবার বলবে দুজনে একসাথে বসে টিভি না দেখলে তার মনোযোগ আসে না। অধরের মনে অসহায়ত্বের গান বেজে উঠলো
” এতো বুঝাই তবু তুমি বাঁকাই রইলা বউ ”
তিশু নিজ রুমের দরজায় এসে দাড়িয়ে আছে। মনে এক খটকা লাগে আছে। দরজা খোলা। একদম পুরোপুরি খোলা। তিশুর ভালো মনে আছে সে দরজা বন্ধ করেছিল। খোলা কেন থাকবে? তিশু ভাবতে ভাবতে তড়িঘড়ি করে ঢুকে পরলো ঘরে। নিধির আত্মা লাফ দিয়ে উঠলো। তড়িঘড়ি করে সে ওড়নার নিচে হাত লুকালো৷ তিশু অবাক হয়ে দ্রুত নিধির কাছে গেল। সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল
— কি লুকালেন হাতের মধ্যে। দেখি কি ওটা?
তিশু বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে দিল নিধির দিকে। নিধি হাত ক্রমশ পেছন দিকে নিচ্ছে। ঘাম ঝড়ছে প্রচুর। চোখ মুখ শঙ্কায় শুকিয়ে উঠছে। তিশু ছাড়বার পাত্রী নয়। সেও যেন দেখেই ছাড়বে তার হাতে কি ওটা। দুজনের প্রায় ধস্তাধস্তি অবস্থা। নিধি হঠাৎ জরানো গলায় চেচিয়ে উঠলো
— ধরবা না তিশু। কিছু নেই আমার হাতে।
তিশু নিধির চিৎকারও দমলো না। এই মেয়ে বড় ভয়ংকর। তিশুর শুধুই ভয় অধরকে নিয়ে। তিশু কৌশলে নিধির একহাত হালকা মুচড়ে ধরলো। অপর হাতে যেইনা নিধির মুষ্টি পাকানো হাত উন্মুক্ত করবে ঠিক তখনই নিধির ছেলে ভ্যা ভ্যা করে কেদে দিল। উচ্চশব্দে কান্না। তিশু নজর ফিরিয়ে নেহালের দিকে চাইলো। ভাগ্য অসহায় ভাবে খুব বাজে ভাবে ফেসে দিল তিশুকে। নেহালের কান্নার শব্দে অধর ছুটে এসেছে। তখন নিধির হাত তিশুর হাতে বন্দী। তিশু ঘাবড়ে গেল। এ যেন মরার উপর খারার ঘাঁ। অধর অবাক। ভীষণ অবাক চাহনি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে তিশুর দিকে। এরই মধ্যে হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলো নিধি। তিলু চোখ ফিরিয়ে নিধির দিকে চাইলো। বোকা বনে গেল সে। পরিস্থিতির দরুন হাতের বাঁধন নিমিষেই হালকা য়ে গেল। নিধি এক ঝাড়িতে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল অধরের কাছে। অধর শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েই আছে। নিধি কান্নারত কন্ঠে বলে উঠলো
— অধর তিশু আমার নেহালকে মেরেছে। আচ্ছা অধর আমরা কি খুব জ্বালাতন করি তোদের? তোর বউ একদম দেখতে পারে না আমার বাচ্চাকে।
নিধির কথা শুনে তিশু যেন আকাশ থেকে পরলো। সে এগিয়ে এলো নিধির দিকে। কড়া গলায় বলে উঠলো
— একদম মিথ্যা বলবেন না। আপনার বাচ্চার গায়ে আমি কখন হাত দিলাম। আমার সংসারে খেয়ে পরে আমার নামে মিথ্যা অপবাদ রটাতে লজ্জা করে না? নির্লজ্জ! আপনি নিজেই আমার স্বামীর সাথে ঢলাঢলি করতে আসেন। আমি সাফ সাফ বলে দিচ্ছি আমার বাড়িতে থাকতে হলে কুটচাল চালতে পারবেন না। আমার স্বামীর থেকে দশ হাত দূরে থাকবেন।
কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই একটা শক্ত হাতের থাপ্পড় পরলো তিশুর গালে। থমকে গেল তিশু। সব তেজ নিমিষেই উবে গেল। ছলছল ননে সে তাকিয়ে রইল অধরের দিকে। অধরের চোখ রঞ্জিত। ক্ষোভ নিয়ে সে বলে উঠলো
— ছিঃ তিশু! তুমি এতো নিচু কাজ করে আবার এসব….. এমন কথা তুমি কিভবে বলো?
অধর ছটফট করছে। তিশুর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে গলা ছেড়েছে। অধর তার গায়ে হাত তুলল? কই দু তিন বছর হলে সে সংসার করছে কখনো তো অধর জোরে একটা ধমকও দেয়নি। তিশু দৃষ্টি নিম্নগামী করলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। ডুকরে কান্না আসচে ভেতর থেকে। তিশু আর একমুহূর্ত না দাড়িয়ে, এক কথা না বলে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
( ভুল ত্রুটি মার্জনীয়)