#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৯.
ইদটা কাটিয়ে খেয়াম প্রায় দেড় মাস পর ঢাকা ফেরে। এই দেড়টা মাস ছিল তার জীবনের সব থেকে আলস্যকর সময়। শুধু খাওয়া, ঘুম, পড়া আর বিশ্রাম ছাড়া কিছুই করার সুযোগ পায়নি সে। তবে এই দেড়মাসে কিছু অনাকাঙক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে তার সাথে। ইব্রাহীমের ফোন, মেসেজ তো অনবরত তার ফোনে আসতই। তবে সেই সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে তরঙ্গের ফোন কল। প্রায় প্রায়ই ফোন করে সে তার কাছে। কোনো কোনো দিন কথা বলতে বলতে আধঘণ্টার বেশি সময়ও কাটিয়ে দেয় তরঙ্গ। কখনো তার লাইভ প্রোগ্রামের সময়সূচি বলে তাকে টিভিতে দেখার আমন্ত্রণও জানায়। তরঙ্গের সহজ, সাধারণ এমন নতুন আচরণ খেয়ামকে অনেকটাই ভাবনাতে ফেলে দিয়েছে। ঘটনাগুলো সে তার রুমমেট ও একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড রাহির কাছে না বলেই পারল না। এসব জেনে রাহি নিমিষেই বলে ফেলে, ‘দোস্ত, পোলা তোর প্রেমে পড়ছে। খাসা প্রেম এক্কেরে।’ খেয়াম তা শুনে চেহারা কুুঁচকায়। অবিশ্বাসের সুরে বলে, ‘এমন একটা কথা বললি যে কথার বাপ-মা নাই।’ রাহি হাসে, ‘বাপ-মা নাই মানে? অবশ্যই ভিত্তি আছে কথার। তুই ভাবতেছোস অত বড় সিঙ্গার, অ্যাক্টর তোর মতো সাধারণ মানুষের প্রেমে ক্যান পড়ব? তুই প্রথমে তোর আউটলুক বিচার কর। কোনো কৃত্রিমতা নাই তোর চেহারায়। একদমই ন্যাচরাল বিউটি যারে কয়। যা তুই অবশ্য নিজে বুঝতে পারিস না। এই চেহারার প্রেমে একজন খাঁটি হৃদয়ের মানুষ পড়বেই।’ চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের হাসি রাহির। খেয়াম যেন মহাবিরক্ত, অতিষ্ট আর অধৈর্য রাহির কথায়। তেমন অভিব্যক্তিতে চেয়ে আছে সে তার দিকে। আর রাহি ওদিকে থেমে নেই।
-‘আর তোর পার্সোনালিটিও কম যায় না, দোস্ত। তার ওপর পোলাটারে দুই দুইবার যেভাবে উপকার করছোস তাতে এই পোলা তোর প্রেমে পড়বে তা অস্বাভাবিক কিছু না।’
খেয়াম তার কথাকে যেন ফাউল কথা বলেই উড়িয়ে দিলো। নির্বিকারভাবে ফোনটা নিয়ে চেপে যাচ্ছে সে। রাহি তার মনের এই ভাব বুঝতে পারে। সে ভেংচি কেটে বলে, ‘এমন ডোন্ট কেয়ার রিয়্যাক্ট দিলি তো? আমার কথা যদি সত্যি না হয় তখন এসে বলিস।’
এর উত্তরে খেয়াম বলে, ‘দোস্ত, এই দেড়মাসে আমার একটা বিরাট উপকার হইছে। রাত, দিন প্রাণ খুলে পড়তে পারছি, বুঝছোস? কিন্তু সমস্যা হলো ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার খুব বেশি দেরিও নাই। বাবা বলতেছে কাজ ছেড়ে দিতে। পরে না হয় আবার বাবা কথাবার্তা বলে কাজে ঢোকাবে। কিন্তু এটা তো সম্ভব না, তাই না? একে তো কাজের মাঝে কত কত ফাঁক পড়ে যাচ্ছে। আবার কাজ ছেড়ে কাজ পাওয়া যায়?’
রাহি বুঝতে পারল তরঙ্গের ব্যাপারে কথা বলতে খেয়ামের অনীহা ভাব। তাই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। রাহি তাই রাগ করে উঠে চলে গেল। আর সে যেতেই খেয়াম ফোনটা বুকের ওপর নিয়ে ভাবনাতে পড়ে অন্য কাউকে নিয়ে। ভাবে, এই দেড়টা মাসে সেটের অনেকেই তো তার খোঁজ খবর নিয়েছে কল করে। শুধু একজন বাদে। যার থেকে ফোন কল অবশ্য আশা করাও বোকামি। কিন্তু তবুও মনের কোথাও যেন ‘তার থেকে ফোন আসবে’ এমন আশার ক্ষীণ আলো জ্বলত।
***
স্টুডিয়োর উপর তলায় এসে পৌঁছয় মেহফুজ আর ইমরান। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মেহফুজ সবাইকে বলে, ‘আর মাত্র পাঁচ মিনিট টাইম দিচ্ছি সেট রেডি করতে। আজকে শট নিতে হবে অনেক রাত পর্যন্ত। বেশি টাইম নিস না তোরা।’
খেয়াম লাভ শেপের রেড ক্যান্ডেলগুলো জ্বালানোর ফাঁকে একবার তাকাল মেহফুজের দিকে। সেট প্রায় রেডি। শুধু ক্যান্ডেলগুলো জ্বালানোই বাকি আছে। মেহফুজ সোজা স্টোরিবোর্ডের কাছে এল। অন্যান্য কলাকার স্টোরিবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মেহফুজের গল্পের চিন্তা-ভাবনা শুনছে তার থেকে। তরঙ্গসহ আরও তিনজন অভিনেতা এসে সেটে দাঁড়াল। ততক্ষণে সেট সম্পূর্ণ রেডি। তাদের দেখে মেহফুজ তাদের কাছে এসে কিছু সময় তাদেরও আবার বোঝাল আজকের স্ক্রিপ্টের কাহিনিটুকু। তবে সেদিকে তরঙ্গের একদমই নজর নেই। খেয়াম তারার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তার সঙ্গে। সেদিকেই নজর তরঙ্গের। কথার ফাঁকে খেয়ামের নজর এল তরঙ্গের দিকে। তরঙ্গ হেসে হাত উঁচু করে তখন তাকে হাই জানায়। মেহফুজ তা খেয়াল করে তরঙ্গকে বলে ওঠে, ‘আমি কী বলছি আর তুমি কোনদিকে চেয়ে আছ, তরঙ্গ?’ কথাটা বলেই সে রাগান্বিত চেহারা নিয়ে তরঙ্গের দৃষ্টি লক্ষ করে তাকায় খেয়ামের দিকে। খেয়ামের প্রতি তরঙ্গের এত সৌজন্য আচরণ, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না মেহফুজ। তবে রাগ হতে থাকল তার দুজনের ওপরই। এর মাঝেই আরও তিনজন কলাকার মেকআপ শেষ করে সেটে এসে দাঁড়াল। রাগটা শেষমেশ ঝারল মেহফুজ তাদের ওপর, ‘কটার সময় সেটে আসার কথা ছিল সবার? আমি কি আজকে সারা রাত ভরে শট নেবো?’
খেয়াম কাজ সেড়ে ছাদের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তরঙ্গের জন্য। তরঙ্গ তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ভাবনাতেই মশগুল ছিল সে। হঠাৎ তরঙ্গের কী হলো তা নিয়ে সে বেশ চিন্তাগ্রস্ত।
শট দেওয়া শেষে তরঙ্গ একটুও না বসে সোজা চলে এল তার কাছে। একটুখানি হাসল খেয়ামের দিকে চেয়ে। অপ্রস্তুতভাবে হাসল খেয়ামও। জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবেন স্যার?’ তরঙ্গের ইচ্ছা করছে খুব, এত সুন্দর একটা নিস্তব্ধ রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে খেয়ামের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবেই কাটিয়ে দিতে। এই কটা দিনে সে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে ছিল খেয়ামের ফেরার জন্য। আর আজ সে ফিরে এসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে বলার মতো কোনো কথা তরঙ্গ খুঁজে পাচ্ছে না। তবে আনন্দে টইটুম্বুর তার মনটা।
রাত বাজে প্রায় সাড়ে এগারোটা। নয়ন হঠাৎ কল করে খেয়ামকে জানাল তাকে আজকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সে নেবে। খেয়াম সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখতেই তরঙ্গ হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে তো ফিরতে হবে হোস্টেল, না? টেনশন করতেছ ফেরা নিয়ে? আমি পৌঁছে দিলে সমস্যা?’
-‘না না স্যার। আপনি কেন পৌঁছে দেবেন? নয়ন ভাইয়া এগিয়ে দেবে বলল তো।’
-‘নয়ন কেন? ও তো ডাইরেক্টর সাহেবের লেজ।’ বেশ অসন্তুষ্টি আর রাগ তরঙ্গের গলায়। খেয়াম কিছু খুঁজে পায় না বলার মতো। এবার তার মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে রাহির বলা কথাগুলো। তরঙ্গের নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে পড়ছে সে। তবে কি সত্যিই এই খেপাটে পাগলটা তার প্রেমে পড়ল? এও কি সম্ভব?
মেহফুজ শট নেওয়া শেষ করে ভিডিয়ো নিয়ে কথা বলছিল ইমরানের সঙ্গে। তার ফিরতে আরও রাত হবে। নয়নকে দেখে কথার ফাঁকে তাকে ইশারা করল কিছু একটা বোঝাতে। তার ইশারা পেয়ে নয়ন খেয়ামকে খুঁজতে থাকল সব জায়গায়। খেয়ামকে পৌঁছে দিয়ে আসার কথায় ইশারায় জানিয়েছে মেহফুজ। কিন্তু খেয়ামকে তো সেটের আশপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না! শেষে তাকে তরঙ্গের সাথে ছাদ থেকে নেমে আসতে দেখা গেল। নয়ন ঝটকা খেলো যেন তরঙ্গকে খেয়ামের সাথে দেখে। সে একবার বিস্ময় নিয়ে তাদের দেখে পরেরবার মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজ ওদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখে ফেলল কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু মেহফুজের দিকে চেয়েও সে আরেকটাবার ঝটকা খেলো মেহফুজের প্রকাশিত ক্রোধযুক্ত চেহারাখানা দেখে। নয়ন তা দেখে দ্রুত পায়ে খেয়ামের সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কই ছিলে, হ্যাঁ? কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে? তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হবে না?’ খেয়াম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ‘আসলে… স্যার একটু ডেকেছিল ছাদে। কথা বলছিলাম।’ এমন একটা কথা শুনতে একটুও প্রস্তুত ছিল না নয়ন। সে একবার আড়দৃষ্টিতে মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজের চোখা দৃষ্টি এদিকেই। নয়ন তা দেখে খেয়ামকে বলল, ‘আচ্ছা, চলো এখন।’
-‘ওকে আমি পৌঁছে দিয়ে যাব। তুমি তোমার কাজ করো, যাও।’ কাটকাট সুরে বলল তরঙ্গ। খেয়াম তরঙ্গের আচরণে শুধুই বিস্মিত হচ্ছে। যেন অদৃশ্য অধিকার প্রয়োগ করছে তরঙ্গ তার ওপর। দিনের বেলা হলে হয়তো সে কারও গাড়িতেই যেতে রাজি হতো না। এদিকে নয়নও আর কিছু বলতে পারল না। চেয়ে রইল খেয়ামের মুখের দিকে। খেয়াম তখন তরঙ্গকে বলল, ‘ভাইয়া হয়তো আমাকে, তারা আপুকে মানে আমাদেরকে পৌঁছে দেবে আজ। স্যার বোধ হয় দায়িত্ব দিয়েছে। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা নয়ন ভাইয়ার সঙ্গেই যাই।’
-‘আরে কীসের কষ্ট? না কি তুমি আমাকে ট্রাস্ট করতে পারতেছ না খেয়াম?’
খেয়াম এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কথা তো সত্য, অবিশ্বাস তো আছেই তার বাইরের পুরুষগুলোর প্রতি। তবে তা এই মুহূর্তে অকপটে স্বীকার করাটা তরঙ্গের জন্য অনেকখানিই অপমানজনক। আর সেটা তার একেবারেই করা উচিত নয়। ওদিকে যে আরও দুটো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে চেয়ে আছে তা আর খেয়ামের নজরে পড়ল না। সে নিজের নিরাপত্তা বস্তুগুলোর ভরসাতে নয়নকে মানা করে তরঙ্গের সাথে যেতে রাজি হলো। আর তখনি হঠাৎ মেহফুজ চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘নয়ন! আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব। কোথাও যেতে হবে না তোমাকে।’
ছবি ‘মনিরা মনি’