এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন #ইসরাত_জাহান_দ্যুতি ১০.

0
496

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

১০.
নিস্তব্ধ শহর আর রাস্তার দু’ধারে ল্যাম্পপোস্টের আলো। মাঝে মধ্যে দুচারটা বড়ো বড়ো গাড়ির যাওয়া আসা। রাস্তার ধারের দোকানপাটগুলোর সামনে ছোটোখাটো বাল্বের আলো জ্বলছে। ছেঁড়া কাঁথা, কম্বল, বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ফুটপাতে বসবাস করা মানুষগুলো। মেহফুজের গাড়িটা চলছে দ্রুত গতিতে। রাতে শহরের রাস্তায় শীতের বর্বরতা বেশ খানিকটা অনুভব হয় ফুটপাতের এই মানুষগুলোর করুণ অবস্থা দেখে। এদের দেখেই বোঝা যায় শীতের প্রখরতা কতখানি। তাই আর গাড়ির জানালাটা খোলারও সাহস হয়নি নয়নের। নয়ন গাড়ি চালানোর ফাঁকে গাড়ির ফ্রন্ট মিররে একবার তাকাল মেহফুজের দিকে। গাড়িতে ওঠার পর থেকে তাকে বেশ চুপচাপ দেখছে সে। অন্যান্য দিনে দেখা যেত বাড়ি পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলত সে। নয়নের মনে হচ্ছে তার স্যার বোধ হয় খেয়ামের বিষয় নিয়েই ভাবছে বসে। যেটা তার মতো একজন ডাইরেক্টরের সঙ্গে একেবারেই যায় না। তার মতো একজন মানুষ কিনা সাধারণ কর্মচারীকে নিয়ে ভাবছে? তার স্যারটা কি নিজের পজিশন আর স্টেটাস ভুলে যাচ্ছে? নাহ্, ব্যাপারটা তার একদমই ভালো লাগছে না। মেনে নিতে পারছে না সে। সে কি কিছু বলবে এই বিষয়ে তাকে? একজন অ্যাসিসট্যান্ট হিসাবে নয়, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে তো কিছু বলা-ই যায়। অনেক সময় তো শিক্ষকরাও অঙ্ক ভুল করে বসেন। সেই ভুলটা নিশ্চয়ই একজন ছাত্র শুধরে দিতে পারে? ফ্রন্ট মিররে নয়ন আরেকবার মেহফুজকে দেখে কথা বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তার আগেই মেহফুজ বলল, ‘ইব্রাহীম কি আর কোনো ফোন করেছিল?’ নয়ন সাবধানে ড্রাইভিং স্টিয়ারিং ধরে ফ্রন্ট মিররের দিকে চেয়ে থেকেই জবাব দিলো, ‘জি স্যার, করেছিল। সব ঠিক আছে। সমস্যা নেই।’ মেহফুজ এটুকু জিজ্ঞাসা করেই চুপ। এবার নয়ন মনের কথাগুলো বলতে মুখ খুলল, ‘স্যার কিছু কথা বলব? যদি বেয়াদবি না নেন।’ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল মেহফুজ তার দিকে, ‘কী কথা? বলো।’

-‘খেয়ামকে নিয়ে আমরা একটু বেশিই ভাবছি না? মানে ও তো আর পাঁচজন কর্মীদের মতোই কিছু। অথচ ওকে নিয়ে…’
কথার মাঝপথে থেমে যেতে হলো নয়নের। মেহফুজ বলে উঠল, ‘আমার ওকে নিয়ে ভাবার এক বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা নেই। যতটুকু করতে হচ্ছে একজন বাবার অনুরোধের জন্য। ওর বাবা প্রায়ই আমাকে ফোন করেন। কখনো ধরি, কখনো ধরি না। কিন্তু যতবারই ধরেছি ততবারই ওনার কথাগুলো শুনলে ফোন রাখতে পারি না। ওনাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বলই এখন এই মেয়ে। আর মাও সেদিন বলছিল, উনি এক সময় আমার বাবাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিলেন যখন আমরা দেশের বাড়ি ছিলাম। তখন ওনাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আমাদের থেকেও ভালো ছিল। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই আর ওনার অনুরোধেই ওনার মেয়েকে এইটুকু কেয়ার নিতে হচ্ছে। আর আমিও শুধুই এই কৃতজ্ঞতা থেকে করছি এটুকু। সেদিন দেখলে না? যখন ওর বেতনটা দিচ্ছিলাম ওর বাবার হাতে তখন কীভাবে কেঁদে ফেলেছিলেন উনি! আমার খারাপ লাগে। আমি উপলব্ধি করতে পারি একজন বাবার কষ্ট। কারণ, আমার ঘরেই এমন একটি বাস্তব চিত্র আছে।’

নয়ন চুপ করে গেল। সেও উপলব্ধি করতে পারল মেহফুজের বলা কথাগুলো। বুঝতে পারল মেহফুজের এতটা সদয় হওয়ার কারণ। এই মানুষটাকে তার সত্যিই ভীষণ অদ্ভুত লাগে, ভালো লাগে খুব। এই সময়ে এমনভাবে কে ভাবে পরের জন্য? তাও শুধু কৃতজ্ঞতা থেকে? এই মানুষটি পারে। কারণ, এই মানুষটির ভেতরের অন্তরটা যে নরম কাদার মতো কোমল, আর স্বচ্ছ পানির মতোই পরিষ্কার। সে তো ভুলেই গিয়েছিল তার এই রূপটির কথা। গত বছর তার বোনটা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মরতে বসেছিল। হসপিটালে ভর্তি করার পরও তার অবস্থার কোনো উন্নত হচ্ছিল না। এদিকে তার বোনের স্বামীটার সে কী রাগারাগি! তার চিন্তা ছিল শুধু বাচ্চাটাকে নিয়ে। বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে ওই বউ সে ঘরে রাখবে না। এমনই ছিল তার বক্তব্য। মেহফুজ সেদিন শুধু আর্থিকভাবেই সহায়তা করেনি নয়নকে। তার বোনের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের সকল ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। এখানেই শেষ হতে পারত তার উদারতা। কিন্তু সেদিন তার বোনের স্বামীর কথাগুলো সেও শুনেছিল। তার বোনটা সুস্থ হওয়ার পর একটি অচিন্তনীয় কাজ করে বসেছিল মেহফুজ। ওই স্বামীর ঘরে তার বোনের ভবিষ্যত যাতে অনিশ্চিত না হয় সে জন্য নিজেদের কোম্পানিতেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় সে তার বোনের। যার বিন্দু পরিমাণও নয়ন কল্পনা করেছিল না। সেই মানুষটির থেকে তুচ্ছ কোনো সাধারণ কর্মীর ক্ষেত্রে এতটা দায়িত্বশীল আচরণ পাওয়া অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

মেহফুজ নীরব মুহূর্তের মাঝে বলে উঠল, ‘কিছুটা স্বজনপ্রীতি সত্যিই কাজ করছে আমার মধ্যে। এটা অস্বীকার করা যায় না। আর তরঙ্গ সাহেবকে তো চিনিই। এ কারণেই এতটা ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটাকে বুদ্ধিমতী বলেই জানতাম।’

-‘সুপারস্টার দোরগোড়ায় আসলে বুদ্ধিমতী মেয়েরা নিরেট মাথারই হয়ে যায়। বছরখানিক আগের কথা মনে আছে স্যার? ওই যে সামান্য ফেসবুক সেলেব্রিটি এক মেয়েকে নিয়ে কত রঙ্গ তামাশাই না করেছিল তরঙ্গ স্যার! লাইভে এসে কী না কী গান করত মেয়েটা। তাকে একদিন ধরে নিয়ে এল অভিনয়ে। তারপর কোথায় গেল সেই মেয়ে?’

-‘খেলা করা শেষ হলে যেখানে যাওয়ার কথা সেখানেই। আমার যতটুকু করার করেছি। এর থেকে বেশি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমার সেই টাইম ওয়েস্ট করার উপায়ও নেই।’

নয়ন খেয়াল করল মেহফুজকে। চোখে মুখে কেমন রাগ আর বিরক্তি ফুটে উঠেছে তার। সে বলল, ‘কিন্তু স্যার আপনি কি লক্ষ করেছেন তরঙ্গ স্যারের ভাবমূর্তি? আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে সে সত্যিই সিরিয়াস খেয়ামকে নিয়ে।’

-‘সময়ই বলে দেবে। এখন গাড়ি টান দাও জোরে।’
***

অন্যান্য কিছু দিনের মতো আজও হোস্টেল ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় খেয়ামের। গেটের দারোয়ানের সাথে আরিফ আগে থেকেই কথা বলে গিয়েছিলেন বলে ঝামেলার সম্মুখীন কমই হতে হয় তাকে। তবে এরপরও যে ঝামেলা হয় না তা নয়। হোস্টেল সুপার তাকে বেশ কয়েকবারই ডেকে পাঠিয়েছিল। কতরকম প্রশ্ন আর জেরা! আজ তো গেটের দারোয়ান এক প্রকার ঢুকতেই দেবে না বলে ঝামেলার সৃষ্টি করে বসে। দারোয়ানের বক্তব্য, খেয়ামের দেখাদেখি এরপর থেকে অন্যান্য মেয়েরাও চাইবে এভাবে রাত দশটার পরেও ঘোরাফেরা করতে। তাকে ছাড় দিলে অন্য মেয়েরাও এমনটা করতে চাইবে। তরঙ্গকে বেশ দূরেই নামিয়ে দিতে বলেছিল সে। তরঙ্গ করেছিলও তাই। তবে সে ফিরে যায়নি। খেয়াম আর দারোয়ানের বাকবিতণ্ডার মাঝে হুট করেই কোথা থেকে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। আর তাকে কে না চেনে? সে কয়েকটা কথা বলতেই দারোয়ান পথ ছেড়ে দেয়। আর সেটা হোস্টেলের অন্যান্য মেয়েদের চোখেও পড়ে যায়। সেই থেকে হোস্টেলের কোনো না কোনো রুম থেকে কেউ না কেউ আসছেই খেয়ামের সঙ্গে তরঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে। আর তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত খেয়াম এক পর্যায়ে বলে বসে, ‘আমার কাজের জায়গা নিয়ে আর একটা কথা বলতেও রাজি না আমি। আপনারা প্লিজ আর কোনো প্রশ্ন করবেন না আমাকে।’
সেই সব মেয়েগুলো মুখ বেজার করে চলে গেলেও রুমমেটদেরও আগ্রহের শেষ ছিল না। সবার সব কথার উত্তর দিয়ে কিছুক্ষণ আগে সে বইটা নিয়ে একটু বসেছে। তবে পড়তে বসেও মন স্থির করা কষ্টসাধ্য হয়ে গেল। সারা পথ তরঙ্গ তার সব বিষয়ে প্রশ্ন করে তাকে জেনেছে, তার পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলোও জেনেছে। বেশ আগ্রহী তরঙ্গ তার প্রতি। কিন্তু এই উঁচু জায়গার মানুষ হয়ে তার মতো সাধারণ মানুষের প্রতি আগ্রহ দেখানো যে খ্বু বেশি সুখের আর স্বাভাবিক নয়। অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কোনো কারণ ছাড়া তার মতো মানুষ কেনই বা আগ্রহ দেখাবে? ‘তার প্রেমে পড়েছে তরঙ্গ’ এই কথাটি একদমই মিথ্যা এবং অবিশ্বাস্যকর। তরঙ্গ নিজে মুখে বললেও তা বিশ্বাস করা অসম্ভব। এবার তো তাকে আরও সাবধান থাকতে হবে। তার প্রতি স্টুডিয়োর যেসব মানুষের আগ্রহ ছিল, তা শুধু তাকে বিছানায় পাওয়ার জন্যই। আর এসব জায়গায় কাজের জন্য এমন অনেক মেয়েদেরই নাকি সম্মান বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু এত বড়ো বিসর্জন সে তো কোনোদিনও দিতে পারবে না।
***

ড্রয়িংরুমের ডিভানেই হেলে ঘুমিয়ে পড়েছে মুন। সামনের টি টেবিলে তার ল্যাপটপ, আর কতরকম ফাইলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গায়ে ভারী কোনো শীতের পোশাক নেই বলে কুঁকড়ে পড়েই ঘুমিয়েছে। মেহফুজ ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাকে এভাবে দেখে ডেকে উঠল, ‘কীরে? মুন? এখানে কেন ঘুমোচ্ছিস?’

আকস্মিক ডাকে মুন একটু চমকে উঠল। মেহফুজকে দেখে চোখটা মুছে বলল, ‘কাজ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুই কি মাত্র এলি?’

-‘হুঁ। যা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়। আর এত রাত জেগে কাজ করতে বলে কে? অফিসের কাজ বাড়ি টেনে আনবি না। বিরক্ত লাগে দেখতে।’

মুন হেসে বলল, ‘মুহিতও বাবাকে রাগারাগি করত অফিসের কাজ বাড়ি বসে করলে।’

মেহফুজ সিঁড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল। মুহিতের নামটা শুনতেই থেমে যায়। মুনের দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখটা আজ ভীষণ শুকনো লাগছে। নিশ্চয়ই মুহিতের কথা ভেবেছে আজ সারাদিন। মেহফুজের বসার ইচ্ছা ছিল না। কেন যেন আজ কলেজ জীবনের এই বন্ধুটিকে তার সত্যিই ভাবি বলে মনে হচ্ছে। এতগুলো বছরে কখনো মনে হয়নি এই মেয়েটা এ বাড়ির বউ। মেয়ের মতোই থেকেছে। আর বন্ধুর মতোই মিশেছে সে তার সাথে। ভাবির মতো কোনো আচরণ, কোনো কাজ কখনো করতে দেখেনি তাকে। কিন্তু সামান্য এই একটা কথায় মেহফুজ হঠাৎ নতুন করে উপলব্ধি করল, এই মেয়েটি শুধু তার বন্ধু নয়। তার ভাইয়ের বউ। আর তার ভাবি। সে এসে বসল তার সামনের সোফাটায়।
-‘কী কাজ করছিলি?’

-‘এই পুরোনো ফাইলগুলোই ঘাটাঘাটি করছিলাম। বাসায় বসে আর তো কোনো কাজ নেই। তুই এখানে বসলি যে? ফ্রেশ হয়ে আয়, খেতে দিই।’

-‘খাব না।’

-‘তাহলে কি কফি করে আনব?’

-‘নাহ্, রুমে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ব। বাড়িতে কথা বলছিস না কেন?’

মুনকে একটু গম্ভীর দেখাল এ প্রশ্নে। মেহফুজ বলল, ‘আঙ্কেল কল করেছিল আজও। ফোন ধরছিস না তোর ভাইয়ের। বাড়িতেও কথা বলছিস না তাদের সঙ্গে। এটা তো ঠিক না।’

-‘কী বলেছে তোকে বাবা?’ রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে মুন।

মেহফুজ একটু চুপ থাকে। এরপর বলে, ‘দ্যাখ মুন, জীবনটা ছোটো হলেও সহজ না। এভাবে চলে না, চলতে পারবি না তুই। আর এটা জীবনও না। একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে আছিস তুই। তোর ভাই যে হাফ বাঙালি হাফ ব্রিটিশ ছেলেটাকে দেখেছে তোর জন্য, সে কিন্তু সত্যিই পারফেক্ট। বলা যায়, মুহিতের থেকেও যোগ্যতায় বেশি সে। আমার মনে হয় তোর রাজি হওয়া উচিত। আল্লাহ পাক চাইলে ভালো থাকবি তুই। তুই যেভাবে জীবন কাটাতে চাইছিস এটা আদৌ সম্ভব না। একা একটা মানুষ কখনোই সুখী হতে পারে না। তোর তো আঙ্কেল আন্টির কথাও ভাবা উচিত। তারাও তো তোকে নিয়ে চিন্তিত।’

-‘মেহফুজ, তোর এসব বলার রাইট আছে। তুই চাইলে আমাকে চলে যেতেও বলতে পারিস। কারণ, এ বাড়িতে আমার কোনো অধিকার নেই বললেই চলে। জোর করে পড়ে আছি এক রকম। কিন্তু আমার জীবন কীভাবে চলবে আর কীভাবে আমি সুখী থাকব এটা নিয়ে ভাবার তো অধিকার আছে আমার। আমি যেমন আছি ভালো আছি। এটা কেন তোরা মানতে চাইছিস না? আমি বিয়ে করলেও যে সেখানে সুখী থাকব এটা কেন মনে হচ্ছে তোদের? আমি পারি না আর পারবও না মুহিতের জায়গা অন্য কাউকে দিতে। এই বিষয়টা আমি কেন বোঝাতে পারছি না তোদের?’

-‘তুই যে কথাগুলো বললি সবটাই ভিত্তিহীন। কে বলেছে তোর অধিকার নেই এ বাড়িতে? তুই অন্য কাউকে বিয়ে করলেও যখন খুশি তখন তুই এ বাড়িতে এসে থাকবি, অফিসটাও তুই সামলাবি। আমি তোকে শুধু এ বাড়ির সদস্য হিসাবে না, তোর বন্ধু হিসাবেও বলছি তোকে কথাগুলো।’

মুনের কণ্ঠটা কান্নায় কেঁপে ওঠে। সে বলে, ‘যদি বন্ধু হয়ে ভাবিস আমার কথা, তবে কেন বুঝতে পারছিস না আমাকে?’ বলতে বলতে চোখদুটো থেকে তার বড়ো বড়ো দু’ফোটা জলও গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে মেহফুজ থেমে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছা থাক আর কাঁদতে হবে না। এখনও তোর স্বভাব আগের মতোই থেকে গেল। তোকে বিয়েও করতে হবে না। যা ওঠ, রুমে যা।’

মুন নড়ল না। মাথাটা নিচু করে ভেজা চোখদুটো মুছে বসে রইল। মেহফুজ তাড়া দিয়ে বলল, ‘কীরে ওঠ, উঠতে বললাম না? শীতের মধ্যে এভাবে কুঁজো বুড়ি হয়ে বসে থাকতে হবে না।’ এরপর মুন উঠে মেহফুজের পাশাপাশি সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠতে লাগল। মেহফুজ বলল, ‘বাবা অনেক ইমপ্রুভ করেছে। খেয়াল করেছিস? এখন কথা বললে তাকিয়ে থাকে।’

-‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি। কিন্তু তুই তো বাবার কাছে তেমন যাস না। ঘুমিয়ে পড়লে যাস। তখন কি আর তোকে দেখতে পারে?’

-‘যাই না তো ইচ্ছা করেই। আমাকে দেখলেই মুহিতের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনই কেঁদে ফেলে। ভালো লাগে না রে। সহ্য করতে পারি না।’
***

-‘তুমি কি আমাকে ইগনোর করতেছ, খেয়াম? হোয়াই?’
দুম করেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে তরঙ্গ। খেয়াম বেসিনে হাত ধোঁয়ার মুহূর্তে চমকে যায় তরঙ্গে আকস্মিক আগমনে।

-‘ইগনোর করব কেন? কী বলছেন স্যার? আপনি যখনই যে কাজে হেল্প চাইছেন আমি করে দিচ্ছি তো।’

-‘উহুঁ। তুমি বুঝতে পারতেছ আমি অলরেডি ইন্টারেস্টেড তোমার সঙ্গে ফ্র্যাঙ্কলি মিশতে। আর এটাই তুমি ইগনোর করতেছ। তুমি চাও না আমার সঙ্গে মিশতে। কিন্তু কেন?’

খেয়াম একটু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় তরঙ্গের এ প্রশ্নে। ভেবে পায় না কী বলবে। এখন অবধি যতগুলো শিডিউল পড়েছে ততগুলো শিডিউলের দিনে খেয়াম তরঙ্গের থেকে সব সময় যেন দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। আর এদিকে তরঙ্গও প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সব সময়ই তাকে ডাকে। যেটা ইতোমধ্যে সেটের প্রায় সবার চোখেই পড়েছে।

তরঙ্গ চেয়ে আছে খেয়ামের দিকে, তার প্রশ্নের উত্তরের আশায়। কিন্তু খেয়াম অপ্রস্তুত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ইতস্তত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তরঙ্গ হঠাৎ তখন অভাবনীয় একটি কাজ করে বসে। খপ করে খেয়ামের হাতটা ধরে বলে, ‘আই নিড টু টক টু ইয়্যু। চলো আমার সঙ্গে।’

খেয়াম এ আকস্মিকতায় এলোমেলো কথা বলা আরম্ভ করে। কিন্তু তার কিছুই কানে পৌঁছায় না তরঙ্গের। খেয়ামকে টেনে ধরে তার মেকআপ রুমে নিয়ে আসে। রুমের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে তখন কেউ একজন দরজা টেনে ধরে। তরঙ্গ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কার এত বড়ো দুঃসাহস?’

বলতেই সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে একটু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যায় সে। তাকে সে একেবারেই আশা করেনি এই সময়ে। মেহফুজ শান্ত, কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তরঙ্গ বেশ অসহ্য ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু প্রয়োজন? আমার শট আসতে তো বাকি।’
মেহফুজ জিজ্ঞেস করল, ‘ওর এখানে কী প্রয়োজন?’
তরঙ্গ সোজা উত্তর দেয়, ‘এটা আমাদের পার্সোনাল বিষয়। এভাবে এসে জেরা করার অর্থ কী?’
খেয়ামের হাতটা তখনও তরঙ্গের হাতের মুঠোয়। মেহফুজ সেদিকে একবার তাকিয়ে খেয়ামকে বলে, ‘তোমার কাজ আছে এখানে? যদি থাকে তাহলে শেষ করে বাইরে এসো। তোমার কোনো পরিচিত এসে খোঁজ করছে তোমার।’

বলেই মেহফুজ চলে যায়। খেয়াম তখন তরঙ্গের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বলে, ‘এটা আপনার থেকে আশা করিনি। আপনার মতো মানুষ এমন আচরণ করছেন আমার সঙ্গে, যেটা সবার চোখেই লাগছে। আর সব থেকে খারাপ লাগছে আমার।’

-‘দেখো, আমি মানুষের কথা কোনো সময়ই পরোয়া করি না। আমার যেটা করতে ভালো লাগে, যেটা আমার পছন্দ আমি সেটাকেই গুরুত্ব দিই বেশি। এমন নয় যে আমার বেকার, গরিব কোনো বন্ধু নেই। আমার থেকে লো ক্লাসে বিলং করা কোনো আত্মীয় নেই এমনটাও না। আমি তাদের পরিচয় দিতে কখনোই হেজিটেশন ফিল করি না। বাইরে কখনো দেখা হলে তাদের সাথে হাই ফাইভ করতেও ভুলি না। তাহলে তোমাকে নিয়ে কে কী ভাবল এটা দেখারও টাইম নেই আমার। আমাকে নিয়ে কী সমস্যা তোমার সেটা বলো? আমি মন থেকেই তোমার সঙ্গে একটা গুড রিলেশন গড়তে চাই। আমাকে নিয়ে তোমার কী ভাবনা আর কী সমস্যা?’

-‘তার আগে আপনি বলুন, আমার মতো মানুষের সাথে কেন আপনার কোনো সম্পর্ক তৈরি করার ইচ্ছা হলো?’

-‘এটার উত্তর স্পেসিফিকলি অনেকভাবেই দেওয়া যায়। প্রথমত আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, খেয়াম। ইয়্যু সেভ্ড মাই লাইফ। আর তোমার মতো মানুষ বলতে তুমি কী বোঝাও? তোমার কাজ? বাট এক সময় আমিও একটা কম্পিউটারের দোকানে বসছি আমার আব্বুর সাথে। আমি তোমার মতো ভালো ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাইনি। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব হাই নয়। একটা ন্যাশনাল ভার্সিটিতে কোনোরকমে অনার্স পাস করে বের হইছি। এদিক থেকে তুমি আমার থেকেও এগিয়ে। আর তুমি কতটা এক্সেপশনাল তা তুমি নিজেও জানে না। তোমার চারিত্রিক গুণ, কর্মশক্তি, স্ট্রং পার্সোনালিটি, এগুলোই তোমাকে আমার পছন্দ হওয়ার কারণ। এর থেকে বেশি কিছু আমি গুছিয়ে বলতে পারতেছি না। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।’

এমন পরিস্থিতিতে শেষ কবে পড়েছিল খেয়াম? আদৌ পড়েছিল কখনো? মনে তো পড়ছে না এমন কিছু! এর জন্যই বুঝি তরঙ্গের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে তার সারা গায়ে অস্বস্তির কাঁটা ফুটছে। তবে তার মনে পড়ে তার মায়ের একমাত্র অতি আপন বোনের ছেলে আশিকের কথা। যে ছিল তার থেকে প্রায় বছর আটেকের বড়ো। একদিন হঠাৎই এক সন্ধ্যায় আশিকের আগমন হয় তার শোবার ঘরটিতে। তখন সে সবে ক্লাস টেনে উঠেছে। তার সঙ্গে এ গল্প, সে গল্প জুড়ে বসে হঠাৎ করেই বড্ড বেমানান একটি কথা বলে বসে আশিক। খালাতো ভাইয়ের সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে সে নতুন একটি সম্পর্ক গড়তে চায় খেয়ামের সঙ্গে। সেই নতুন সম্পর্কটির নাম বলেছিল সে ফ্রেন্ডশিপ। ক্লাসমেট বা ইয়ারমেট কিংবা প্রতিবেশী সমবয়সিদের সাথে ছাড়া এর বাহিরে এত বড়ো বয়সের কারও সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ বলে কখনো কিছু হওয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়ে খেয়ামের জ্ঞানের মস্তিষ্ক ছিল সেদিন কেবলই প্রশ্নবিদ্ধ। তার জানাতে আর অভিজ্ঞতাতে এমন বয়সের পার্থক্যে কখনোই ফ্রেন্ডশিপ সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বুঝার ক্ষমতা তার ছিল। এই বয়সের পার্থক্যে এমন সম্পর্ক গড়তে চাওয়ার একটি মাত্র কারণ পছন্দ বা ভালোবাসার। সেদিন সে আশিককে সামলে নেওয়ার মতো পরিপক্কতা অর্জন করেনি। কিন্তু ভাগ্যিস সেদিনই ভাইয়া বাড়িতে এসেছিল! আর সে সবটাই শুনতে পেরেছিল টিনশেডের পাশের ঘরটিতে বসে। আর বাদ বাকিটা সেদিন ভাইয়াই কীভাবে যেন সামলেছিল আশিককে ডেকে নিয়ে গিয়ে। এরপর আর আশিককে কোনোদিনও সে তার আশপাশে অবধি ঘেঁষতে দেখেনি। তবে আজকের পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল। এখন তো আর ভাইয়া নেই। সামলাতে হবে যে তাকেই। এখন শুধুই নিজেকে টিকিয়ে ভবিষ্যত গন্তব্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়। হঠকারীর মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না কোনোভাবেই। আগে পিছে ভেবেই তাকে অতি সাধারণ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
খেয়াম একবার দরজার বাহিরে তাকিয়ে কী যেন দেখে। এরপর তরঙ্গকে বলে, ‘ভালো সম্পর্ক তৈরি বলতে আপনি অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলছেন, রাইট?’

তরঙ্গ একটু হাসে, ‘হ্যাঁ, ঠিক ধরতে পারছ।’

খেয়ামও হাসে। সে বলে, ‘আপনি একটু বসুন। আপনার মেকআপ ঠিক করতে হবে আবার। শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছেন। আমি হৃদয় ভাইকে ডেকে যাই।’

-‘ডেকে যাই মানে? তুমি আমাকে নেগলেক্ট করতেছ কিন্তু। আর আমার মেকআপ নিয়ে তুমি আপাতত না ভেবে আমার কথাগুলো নিয়ে ভেবে জবাব দাও।’

-‘আমি এখানে কাজে আছি, স্যার। আপনাকে বা যে কাউকে নেগলেক্ট করার সাহস দেখিয়ে কাজ খোয়ানোর সাধ নেই। তবে হ্যাঁ, কথা সম্পূর্ণই ক্লিয়ার করা উচিত।’

তরঙ্গ খেয়ামের সুরে সুর মেলায়, ‘এক্সাক্টলি। আমিও সেটাই বলতেছি।’

-‘আমরা কিন্তু বাইরে গিয়েও কথা বলতে পারি। যেহেতু আপনার আমার মধ্যকার একটা না হওয়া সম্পর্ক নিয়ে সবার মন সন্দিগ্ধ। তাই ভেতরে কথা বলে সেটাকে না বাড়ানোটাই ভালো। এর মধ্যে কিন্তু সেদিনের হোস্টেলের ব্যাপারটা সোশ্যাল মিডিয়াতে মোটামুটি ঝড় তুলে দিয়েছে। কে বা কারা আপনার ছবিও তুলে আপলোড করে দিয়েছে।’

-‘সেটা নিয়ে ভাববার বিষয় আমার। তোমার হওয়ার কথা না কিন্তু। তুমি ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলে বলে তোমার ছবি তুলতে পারেনি। শুধু আমার ছবিটাই আসছে। তাহলে তুমি এত কেন ভাবতেছ?’

-‘আপনার কথায় ভাবছি। নিউজটার শিরোনাম ছিল কিন্তু বেশ বাজে।’

-‘আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলব না, খেয়াম। এখানে কিছু কাণ্ডজ্ঞানহীন, নির্বোধ চরিত্রের মানুষ আছে। তাদের অস্বাভাবিক দৃষ্টি আমার সহ্য হয় না। তখন কী করে দরজা টেনে ধরে কথা বলতে চলে আসলো দেখলা না? মানুষের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে তা এত জ্ঞানী মানুষদেরও নতুন করে পুনরায় বুঝাতে হয়। যাচ্ছেতাই!’ প্রচণ্ড ক্রোধিত গলা তরঙ্গের।

তখন মেহফুজের অকস্মাৎ উপস্থিতি খেয়ামও কল্পনা করেনি। এখানে যতবার তাকে ডাকার প্রয়োজন পড়েছে মেহফুজের, ততবার সে অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনাটা ছিল কল্পনাতীত। তবে মেহফুজকে বলা তরঙ্গের চড়া বাক্যগুলো খেয়ামের সহ্য হলো না।

-‘স্যরি স্যার। আমাদের মধ্যে এমন কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছিল না, যে সেখানে কারও হঠাৎ আগমন অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা, আপনি যেভাবে আমার হাতটা ধরেছিলেন সেটাতে আমি নিজেই অপ্রস্তুত আর হতভম্ব হয়েছিলাম।’ বেশ কাঠিন্য সুর খেয়ামের।

তরঙ্গ মাছি তাড়ানোর মতো করে বলল, ‘যা হোক বাদ দাও, আমাদের কথার প্রসঙ্গে আসা যাক। আচ্ছা তার আগে তুমি তোমার গেস্টের সঙ্গে কথা বলে আসবে? অনেকক্ষণ যাবৎ ওয়েট করতেছে সে।’

-‘সে আজ সারাদিন অপেক্ষা করলেও আমার সমস্যা নেই। আমি কথা শেষ করেই বের হবো।’

-‘এটা বোধ হয় ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আসছে সে নিশ্চয়ই?’

-‘না। সে প্রয়োজনে আসেনি। যে এসেছে কেবল কৌতূহলী হয়ে। মানে আমার অতি প্রয়োজনীয় মানুষগুলো যে আসেনি তা আমি নিশ্চিত। এই শহরে আমার ভার্সিটির চারটা ফ্রেন্ডস ছাড়া আমার কাছে প্রয়োজনীয় কেউ নয় এখানে। আর বাবা-মা কখনোই হঠাৎ করে এভাবে এখানে চলে আসবে না। ফ্রেন্ডসও এখানে কখনোই দেখা করতে আসবে না। কারণ, তারা এ মুহূর্তে ভার্সিটিতে।’

-‘তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্যও তো তারা আসতে পারে।’

-‘না পারে না। তারা জানে আমি এখানে কখনোই তাদের আশা করব না। আর যে এসেছে সে আমার প্রয়োজনীয় কেউ নয় বলেই আমার তাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি না আসা অবধি সে হয় সারাদিন অপেক্ষা করবে আর না হয় চলে যাবে। তার কৌতূহল দমানোর দায়িত্ব আমার নয়।’

ছোটো এই মেয়েটির কথা বা আচরণ কিছু মানুষের কাছে হয়তোবা অশিষ্টতা বলেই মনে হবে। কিন্তু যারা তাকে কাছ থেকে জানার সুযোগ পাবে এবং তাকে চেনার সুযোগ পাবে, কেবল তারাই বুঝতে পারবে তার আচরণ কোনো অশিষ্টতা নয়। বরং এটাই মেয়েটির স্বাতন্ত্র, অসাধারণত্ব। তরঙ্গের ভালো লাগে মেয়েটির এমন আরও নতুন আচরণের সাথে পরিচিত হতে। একটু হেসে জিজ্ঞেস করে সে, ‘কেমন করে জানলে সে কৌতূহলী হয়ে তোমার সাথে দেখা করতে আসছে? আর এই শহরে তোমার তেমন কোনো কাছের মানুষ নাই। তাহলে তোমারও তো তাকে দেখার জন্য কৌতূহল সৃষ্টি হওয়ার কথা।’

খেয়াম অপরিবর্তনীয় সুরে বলে, ‘সে কৌতূহলী হয়ে এসেছে এটা নিশ্চিত হয়েছি তার এখানে দেখা করতে আসার ব্যাপারটাতে। এখানে শ্যুটিং চলে, টিভির পর্দার মানুষগুলোর আনাগোনা এখানে। আমি তাদের মাঝে কী কাজ করছি বা কেমনভাবে করছি তা জানা আর দেখায় তার মূল উদ্দেশ্য। আমাকে তার সিরিয়াসলি প্রয়োজন হলে সে হোস্টেলের ঠিকানাতে আসত এবং ওখানে অপেক্ষা করত। এখানে যেহেতু এসেছে সে, তার মানে এ খবরটা নিয়েই সে এসেছে আজ আমি এ সময়ে এখানেই থাকব। এ ছাড়াও বোঝার আরও একটা উপায় হচ্ছে আপনি।’

-‘আমি?’ পৃষ্ট চেহারা তরঙ্গের।

-‘হ্যাঁ আপনি। আপনি যে আমার হোস্টেলের সামনে রাত বারোটায় দাঁড়িয়েছিলেন তা তো প্রতিটা মানুষ জানে। আর যে ব্যক্তি এসেছে সেও জানে। সে জানে আমি ওই হোস্টেলেই থাকি। আমার ছবিটা আপনার সাথে প্রকাশ না হলেও আমার নামটা তো প্রকাশ হয়েছে। আর সেটা গেটের দারোয়ানের দ্বারা হোক আর যার মাধ্যমেই হোক। আমার এসব বিষয়ে জানার আগ্রহ নিয়েই সে এসেছে এখানে। আর এসব মানুষের থেকে আমি বেশ সূক্ষ্ম একটা দূরত্ব বজায় রাখি। তাদের সাথে কথা বলতে হলেও কথা বলার জন্য এমন একটি সময় বেছে নিই যখন তার নিজের হাতেও অজস্র সময় না থাকে।’

-‘তোমার বয়সের সাথে তোমার বুদ্ধির তুলনা করাটা সত্যি একেবারেই অযৌক্তিক।’
তরঙ্গ বেশ মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলে। প্রশংসাটুকু যেন খেয়াম সানন্দে গ্রহণ করল না। তাকে পুলকিত দেখাল না। স্বাভাবিক ভাবমূর্তিতে বলল, ‘আমি যা বলতে চাইছি তা এখন বলি?’

-‘হ্যাঁ বলো।’

-‘আমি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গাটার পায়ের নিচের জমিন মজবুত নয়। যখন তখন ভেঙে পড়ে যেতে পারি নিচে। কিন্তু আমি এখন চেষ্টায় আছি এই দুর্বল জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে আসার পথ তৈরিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যদি আমার পথ তৈরির সময়টুকু আশপাশের রঙিন ছবিগুলো দেখার মাঝে ব্যয় করি তাহলে আমার পথটা তৈরি হবে না দ্রুত। এদিকে পায়ের নিচের দুর্বল জমিনটুকুও ভেঙে পড়ার সময় ঘনিয়ে আসবে। তখন আমি না পারব আমার এগিয়ে যাওয়ার পথটুকু তৈরি করতে আর না পারব সেই জমিনে টিকে থাকতে। আমার বাবা সময় নিয়ে দারুণ কিছু কথা বলেন। প্রতিটা কাজেরই একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। সেই সময় আমি যেমন তেমনভাবে ব্যবহার করে কাজটা করতে পারি। কিন্তু সময় শেষে কাজটা সঠিক এবং সম্পূর্ণ হলো কিনা সেটাই দেখার বিষয়। যে কাজের জন্য যে সময়টা আমাকে দেওয়া হয়েছে, সেই সময়টা আমি সেই কাজে ব্যয় না করে বাইরে থেকে কেবল দেখতে চাকচিক্য কিন্তু তা আমার জন্য অপ্রয়োজনীয় আর অকল্যাণকর, এমন সব কাজে যদি ব্যয় করি তবে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়ব নিশ্চিত। প্রতিটা কাজের যেমন একটা নির্দিষ্ট বয়স থাকে তেমন নির্দিষ্ট সময়ও থাকে। আমার এখন যে সময়টা সেই সময়টা আমার আগামী দিনে চলার পথ তৈরির সময়। আশপাশের রঙিন ছবি দেখার সময় নয়। আমার আগামী দিনে চলার পথ তৈরি হয়ে গেলে আমি এই রঙিন ছবি দেখার অফুরন্ত সময় পাবো।’

কথাগুলো বলে খেয়াম থামল আর দেখল সামনের মানুষটির চেহারা। অসন্তুষ্টির চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরঙ্গ। খেয়াম জানত, এই ব্যক্তিটি তার অতি নম্রতাপূর্ণ কথাগুলোতেও টলবে না নিজের চাওয়া থেকে। এ কটা দিনে তাকে চিনে গেছে খেয়াম। তরঙ্গ মানুষটি বড্ড বেশিই গোঁয়ার। নিজের চাওয়া পাওয়া আদায়েই সে সদা নিবদ্ধ। আর তার ওপর সে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই কারণেই, একজন সাধারণ কর্মীর প্রতি তার আগ্রহ জন্ম নিয়েছে যা শুধু সে ছাড়াও ইতোমধ্যে সবাই বুঝতে পেরেছে। সেখানে কর্মীটি তাকে ভীষণ যত্নে এড়িয়ে যাচ্ছে। যা তরঙ্গের জন্য ভয়ংকর অপমানজনক। এখানে নিজের চাওয়াটা আদায় করে নেওয়া যেন এক প্রকার যুদ্ধ জয় করার মতো তরঙ্গের কাছে। খেয়াম এও জানে, এই রগচটা, বেপরোয়া মানুষটি নিজের সন্তুষ্টি অর্জনে আরও বেশি বেপরোয়াও হতে পারে। সে রাজি না হলে যে অপমানে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে তরঙ্গকে এই স্টুডিয়োর মানুষগুলোর সামনে! যা তরঙ্গ এ জীবনে মেনে নিতে পারবে না।

খেয়ামকে থামতে দেখেই তরঙ্গ বলে উঠল, ‘আমি তোমার ক্যারিয়ারে বাধা হবো। এমন ধারণা কেন হলো তোমার? আমি কি তোমার জন্য ক্ষতিকারক? এটা ভাবতেছ তুমি?’

খেয়াম হেসে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। তরঙ্গ থামল না, ‘তবে? তুমি নিশ্চয়ই এ কারণে অবাক হচ্ছো না যে একজন সেলেব্রেটি তোমার প্রতি আগ্রহী? তুমি অবশ্যই আমাকে বুঝতে পারছ, আমাকে বিচার করতে পারছ আমি মানুষটা কেমন।’

খেয়াম পূর্বের হাসিটা বহাল রেখে বলে, ‘আমি ভিনগ্রহের প্রাণী নই যে অবাক হওয়ার জিনিসেও অবাক হবো না। বরং আমিও অন্য সবার মতো অবাক হচ্ছি, আপনি বদ্ধ পরিকর আমার সঙ্গে মিশতে।’

তরঙ্গের দৃষ্টি নিবদ্ধ খেয়ামের চমৎকার হাসিতে। মেয়েটাকে সে কী করে বোঝাবে তার অতি তুচ্ছ বিষয়েও সে যে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হয়ে পড়ছে? আর এ কারণেই তার সঙ্গে মেশার একটি প্রবল টান সৃষ্টি হচ্ছে। সেই টানও যে ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে। এতগুলো বছরে কত মেয়েই তো তার পাশাপাশি ঘুরল, ফিরল। কিন্তু এমন সাংঘাতিক টান তাদের জন্য আসেনি কখনো। তাদের দূর থেকে দেখতেও যেমন আকর্ষণীয় তেমন কাছ থেকেও। কিন্তু এই মেয়েটিকে দূর থেকে দেখলে কখনোই আকর্ষণ সৃষ্টি হবে না। যত কাছে আসবে তত তার আকর্ষণের বিষয়গুলো চোখ পড়বে। আর তখন হতে হবে মুগ্ধ। এই যে, এখন যেমন সে হচ্ছে। সে ভাবনা থেকে ফিরল কথার প্রসঙ্গে, ‘আমি তোমার জায়গা উপলব্ধি করতে পারছি, খেয়াম। আমি শুধু চাই আমাদের মাঝে একটা ভালো সম্পর্ক থাকুক। যে সম্পর্ক থেকে আমরা কখনো চাইলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ভালো লাগা, খারাপ লাগা দুজন দুজনের সাথে শেয়ার করতে পারি বিনা সঙ্কোচে। অবশ্যই প্রেমিক-প্রেমিকার মতো নয়। আর আমি এমন কিছুই চাইব না যাতে তুমি তোমার লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়ো। এইটুকু বিশ্বাস তুমি করো আমাকে। আমি যা বলি তা সরাসরিই বলি। তোমাকে আমার ভালো লাগার একটাই কারণ, তুমি আমার কাছে প্রচণ্ড ইউনিক। এমন মানুষ আমার জীবনে কম আসছে। বলতে গেলে আসেইনি। এর জন্যই তোমার প্রতি আমার এতটা আগ্রহ। সেটা কোনো খারাপ কিছুর উদ্দেশ্যে নয়। এই সম্পর্কে তোমার আমার বয়সটার অ্যাডজাস্টমেন্ট থাকাটা মূল নয়। কারও শুভাকাঙ্ক্ষী হতে বয়সের অ্যাডজাস্টমেন্ট থাকাটা কখনোই মূখ্য নয়, খেয়াম। আমরা শুধু একে অপরে ওয়েল উইশিং থাকতে চাই। কথা বেশি আর টানব না। সে সময়ও নাই। আমি নিজেকে তোমার কাছে কতটা এক্সপ্লেইন করতে পারছি তা আমি জানি না। বাট যা বলছি আমি তা অনেস্টলি বলছি।’

-‘বুঝলাম, আচ্ছা আপনার যাওয়া উচিত এখন। শট দেওয়ার সময় সত্যিই হয়ে গেছে।’

-‘সেটা আমিও জানি। বাট আমার ইচ্ছা করতেছে না যাইতে, তোমার ক্লিয়ার কাট আন্সার না পাওয়া পর্যন্ত।’

খেয়াম হেসে বলল, ‘আপনি তো আর আমাকে প্রপোজ করেননি। তাহলে এত ভাবছেন কেন?’

-‘তুমি আমাকে কীভাবে বিচার করলা সেটা জানার জন্য।’

-‘যেভাবে আপনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন সেভাবেই বিচার করেছি।’ নির্বিকার লাগল খেয়ামকে।

তরঙ্গ পরাস্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে খেয়ামের দিকে। যে চেহারাটা দেখে খেয়ামের খুব হাসি পেয়ে গেল। একটা মানুষ তার চাওয়া হাসিলে কতখানি উন্মত্ত হতে পারে তা চোখের সামনে এই মানুষটির মাঝে দেখে খেয়াম আরও এক নতুন চরিত্রের মানুষকে চিনতে পারল। মানুষ চেনার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও একটু ভারী হলো তার। খেয়াম বেরিয়ে আসলো মেকআপ রুম থেকে। তরঙ্গ তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠল তখন, ‘খেয়াম! এটা আমি সত্যিই আশা করছিলাম না তোমার থেকে।’ খেয়াম দাঁড়িয়ে গেল তার দিকে ফিরে। জিজ্ঞেস করল, ‘কী আশা করেননি?’ তরঙ্গ সে প্রশ্নের উত্তরের বদলে আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে বিচার করলে কীভাবে?’
খেয়াম হেসেই জবাব দিলো, ‘বয়সেই বড়ো, বুদ্ধিতে না।’
***

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here