এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন #ইসরাত_জাহান_দ্যুতি #পর্ব_৯ (পূর্বাংশ)

0
441

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
#পর্ব_৯ (পূর্বাংশ)

[গতকালের পর্বটার আগের অংশ এটুকু। যেটা ভুলবশত কেটে গিয়েছিল]

শহরে আসার সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে এই প্রথম কোনো অঘটন ঘটল খেয়ামের সঙ্গে। সেদিন গাজীপুর থেকে ফেরে সে গায়ে বেশ জ্বর নিয়ে। ঠিক দুদিন পর আবার শ্যুটিঙের ডেট পড়ে। সেদিন রোযা রেখে আর জ্বর গায়ে নিয়েই ছুটে যায় আবার কাজের গন্তব্যে। সেদিনের শ্যুটিং ছিল বিকালে। স্টুডিয়োর কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা বাইকের ধাক্কা পায় সে। তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই রাস্তার মাঝে পড়ে প্রায় বুঁজে আসা নিস্তেজ চোখ দুটোতে দেখে, তার দিকে ছুটে আসছে কয়েকজন পথচারী। এরপর তাকে কয়েকজন ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। কাছের একটা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে দেয় তারা। পুরো পথেই তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু পায়ের যন্ত্রণায় শুধু মনে হচ্ছিল, তার সময় বোধ হয় শেষ।

প্রায় দুদিন হলো সে হাসপাতাল ভর্তি। পায়ের একটা হাড় ফেঁটে গেছে। প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে। সদর হাসপাতালের পঞ্চাশ বেডের রুমে এক গাদা রোগীদের মাঝে থাকছে সে। রাহি শুধু তিনবেলা খেতে দিতে আসে তাকে। এ ছাড়া তাকে খুব একটা সময় রাহি দিতে পারে না। বাসায়ও কাউকে জানায়নি সে। এর মাঝে গতকাল রাতে ইব্রাহীম তাকে ফোন করেছিল শিডিউলের দিন কেন আসছে না সে, তা জানার জন্য। তাই অসুস্থতার কথা জানাতে তাকে বাধ্য হয় খেয়াম। আর আজ সকাল হতেই ঘুম ভেঙে দেখে ইব্রাহীম তাকে দেখতেও চলে এসেছে। সে বিদায় নিতেই দুপুরের সময় হাজির হলো আরও একটি মানুষ। তবে সেই মানুষটির আগমন ছিল খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। আসার পর থেকে নাকে টিস্যু চেপে তার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে প্রায় পাঁচ মিনিট যাবৎ। দাঁড়িয়ে শুধু আশপাশের পরিবেশ দেখছে সে। এর মাঝে একটা কথাও বলেনি সে খেয়ামের সাথে। আর খেয়াম বিছানায় হেলে বসে তার ঘৃণায় নাক শিটকানো চেহারাটা দেখছে। শেষে তার দিক থেকে কোনো কথা না আসায় খেয়ামই জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আপনি? হঠাৎ?’
খেয়ামের কথায় তার দিকে ফিরে তাকায় সে। তার প্রশ্নের কী জবাব দেবে সে ভাবতে থাকে। এর ফাঁকে খেয়াম আবার তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার কি আমাকে দেখতে এসেছেন?’

এ প্রশ্নটা ব্যক্তিটির কাছে বেশ উদ্ভট লাগল। হ্যাঁ, দেখতেই তো এসেছে সে। তাকে দেখতে না এলে এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সে কী করতে আসবে? এটা আবার জিজ্ঞেসও করতে হয়? তাই খ্যাঁক মেরে উঠে বলল সে, ‘তোমাকে না তো এই মানুষগুলোকে দেখতে আসছি? কী অদ্ভুত প্রশ্ন!’
বলেই সে খেয়ামের প্লাস্টার করা পা’টার দিকে তাকায়।

-‘আসার পর থেকে তো আশপাশের রোগীগুলোকেই দেখছেন। তাই জানতে চাইলাম আরকি।’

কথাটায় পাত্তা দিলো না ব্যক্তিটি। খেয়ামকে বলল, ‘ইব্রাহীমের থেকে শুনলাম। হাঁটার সময়ও কি অমনোযোগী হয়ে হাঁটো? যদি এর থেকে বড়ো কিছু হয়ে যাইত?’

খেয়াম খেয়াল করল তার বলা দ্বিতীয় কথাটি। সেই কথার বিপরীতে বলল, ‘হাঁটার সময়ও অমনোযোগী হয়ে হাঁটি না, আর কাজের সময়ও অমনোযোগী থাকি না। আপনি কি বসবেন স্যার?’

এ কথার পর হঠাৎ দুজন নার্স ব্যক্তিটির কাছে এগিয়ে আসে। তরঙ্গ! তরঙ্গ! বলে তারা চেঁচিয়ে উঠে তাকে অনুরোধ করে তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে আর তাদের হাতে অটোগ্রাফ দিতে। এমনিতেই তরঙ্গের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে এই জায়গায় আসার পর। শুধু খেয়ামের জন্যই সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপর এই নার্সগুলোর সঙ্গে এমন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তার সারা অশরীরে ঘৃণায় অস্বস্তির কাঁটা বিঁধছে যেন। অবশেষে আর না পেরে তরঙ্গে তাদের বলেই বসল, ‘একটু স্পেস প্রয়োজন আমার।’

তারা বাধ্য হয়ে সেখান থেকে যেতেই তরঙ্গ হাঁপ ছাড়ল। ধপাস করে বসে পড়ল খেয়ামের পায়ের কাছে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘এই, তুমি চলো তো আমার সঙ্গে। ভালো কোনো হসপিটাল নিয়ে গিয়ে কেবিনে শিফ্ট করে দেবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে এই শীতেও, পেটের নাড়িভুড়িও সব উগ্রায় আসতেছে। তুমি ক্যামনে থাকতেছ?’ খেয়াম হেসে ফেলল, ‘কী বলেন? আমি কেন যাব? আমার তো সমস্যা হচ্ছে না। আপনি এসেছেন কিছুক্ষণের জন্য। চলে যাওয়ার পর তো আর সমস্যা হবে না।’

-‘সেটা তো চলে যাওয়ার পরের কথা। এখনি তো বসে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে আমার। আর তুমি কী বললে? এই আনহাইজিনিক পরিবেশে তোমার সমস্যা হচ্ছে না? খাবার খাও কী করে?’

-‘খাবার খাই হাত দিয়ে। আর এখানে থাকতেও আমার সমস্যা হচ্ছে না আপনার কষ্ট হলে আপনি…’
খেয়ামের কথা শেষ হবার আগেই তরঙ্গ মহাবিরক্ত দেখিয়ে বলল, ‘ধুর! বললাম না কথা বলব? তার জন্যই তো এখনও পাকা দশ মিনিট আছি।’

খেয়াম তরঙ্গের ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছে না। তাকে সহ্য করতে না পারা এই মানুষটি হঠাৎ এসে হাজির, তাও হাতে করে এক গাদা খাবার নিয়ে। এখন আবার বলছে তার সঙ্গে কথাও বলবে। মনের ভেতরে কোনো প্রশ্ন জাগলে তা সে প্রকাশ না করা অবধি শান্তি পায় না। এ ক্ষেত্রেও তার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটল না। তরঙ্গকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?’ যেন সে প্রচণ্ড বিস্মিত তরঙ্গের আগমন আর আচরণে।
তরঙ্গ তিরিক্ষি নজরে তাকাল, ‘ঠিক আছি মানে?’

-‘না মানে আপনি এসেছেন আমাকে দেখতে? আবার বলছেন কথাও বলবেন! ব্যাপারটা বিশ্বাস করা মুশকিল।’

খেয়ামের এ কথায় তরঙ্গ অপ্রস্তুত হলো। তোতলাভাবে বলল, ‘ওই আর কী… মানে…এমনিই। ধন্যবাদ দিতে আসছি।’ বলার সময়ও তরঙ্গের দৃষ্টি অস্থির হয়ে আশপাশ ঘুরছিল।

-‘ধন্যবাদ দিতে আসছেন মানে? আমার অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য?’ কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে খেয়াম জিজ্ঞেস করল।

-‘আরে নাহ, কী বলো? অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিতে আসব ক্যান? ওই যে সেদিনের জন্য।’

-‘কোন দিনের জন্য?’ যেন খেয়াম ভুলে গেছে তেমনটা চেহারা করে জিজ্ঞেস করল।

-‘সেদিন ওই যে আমার প্যান্টের ফাঁকা থেকে সাপটা টেনে বের করলা।’

-‘এত দিন পর আজকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা হলো?’

তরঙ্গের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপের দিকে যাচ্ছে। মেয়েটিকে সে যে সেদিনের পর থেকেই ভীষণ মিস করছিল তা সে কী করে বলবে? আবার এদিকে অনবরত প্রশ্ন করেই চলেছে খেয়াম। ইচ্ছা করছে তার বাজখাঁই গলায় ধমক দিতে একটা। কিন্ত খেয়ামের পায়ের অবস্থা দেখে সেই ইচ্ছাটা দাবিয়ে রাখল। সেদিন খেয়াম ওই দুঃসাহসিক কাজটা না করলে হয়তো সত্যিই খুব খারাপ কিছু হতো তার সঙ্গে। আল্লাহ সেদিন তাকে বাঁচানোর অসিলা করে খেয়ামকে পাঠিয়েছিল। আর আজকে সেই মেয়েটিকে এভাবে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে তার। কী কষ্টটাই না পেয়েছিল বাইকের ধাক্কা খেয়ে! তার ওপর আবার এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে । আরও দুদিন আগেই কেন জানতে পারল না সে? তাহলে সত্যিই সে খেয়ামকে এমন জায়গায় রাখত না।

-‘পায়ের কী অবস্থা এখন? কতদিন লাগবে সুস্থ হতে?’ খেয়ামের প্রশ্নটা এড়িয়ে পালটা প্রশ্ন করল সে।

-‘মাসখানিক।’

-‘তোমার বাবা-মা কোথায়? এখানে কেন রাখছে তোমাকে? বাসায় নিয়ে গেলেই তো পারে।’

-‘আমার বাবা-মা থাকে দেশের বাড়িতে। তাদের জানাইনি।’

-‘ও, আর কেউ নেই এখানে? কোনো রিলেটিভ?’

-‘না, এখানে আমার কোনো রিলেটিভ নেই।’

-‘থাকো কই তাহলে?’

-‘হোস্টেল।’

-‘তাহলে তোমার দেখাশোনা কে করতেছে?’

-‘সেভাবে কেউ না। আমার বান্ধবী আসে খাবার দিতে। আর এখানের নার্স এসে মাঝে মাঝে দেখে যায়।’

-‘হোস্টেল ফিরবে কবে?’

-‘আগামীকাল।’

মেহফুজ ব্যস্ত থাকায় খেয়ামের খবর শুনেছে মাত্র ঘণ্টাখানিক আগেই। একটা দরকারে মুনকে নিয়ে বাইরে এসেছিল সে। এ খবর শোনামাত্রই মুনকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ঢুকে কতরকম খাবার নিয়েই নয়নকে সঙ্গে করে ছুটে আসে হাসপাতাল। নয়নকে জিজ্ঞেস করে, ‘কত নম্বর ফ্লোরে, নয়ন?’

নয়ন মেহফুজের চিন্তিত মুখ দেখতে মশগুল তখন। খেয়ামকে নিয়ে তাকে এমন চিন্তাগ্রস্ত দেখে সে রীতিমতো অবাক। মেহফুজ এদিকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আরও একবার জিজ্ঞেস করে তাকে, ‘ইব্রাহীম কোন ফ্লোরের কথা বলেছে যেন?’

নয়নের থেকে কোনো উত্তর না আসায় হাঁটার মাঝে মেহফুজ পাশে ফিরে তাকায়। নয়ন তার দিকেই চেয়ে আছে বোবার মতো। তা তেখে তার ওপর ধমকে ওঠে সে, ‘কী দেখছ? কথা বলছ না কেন?’

ধমকে থতমত খেয়ে নয়ন জিজ্ঞেস করে, ‘জি স্যার? কী শুনছিলেন?’

মেহফুজ বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে। নয়ন অবশেষে বুঝতে পারে মেহফুজ কী জানতে চাইছে। সে দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে মেহফুজকে নিয়ে আসে পঞ্চাশ বেডের রুমটির সামনে। তবে দরজার মুখে ঢুকতেই মেহফুজ বড়োসড়ো একটি ধাক্কা খায় সামনের অনাকাঙ্ক্ষিত, আশ্চার্যন্বিত একটি দৃশ্য দেখে। থমকে যায় নয়নও। তরঙ্গ খেয়ামের বিছানাতে বসে খাবার বক্স থেকে খুলে প্লেটে খাবার বাড়ছে। আর খেয়াম তাকে বাধা দিয়ে কিছু বলছে। মেহফুজ দ্রুত বেরিয়ে আসে রুম থেকে। মিনিটখানিক সময় সে একই জায়গায় জড়ীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নয়ন খেয়াল করে মেহফুজের কাঠিন্য চেহারাখানা।

হঠাৎ করে তার হাতের খাবারের প্যাকেটগুলো সে নয়নের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো নিয়ে ওকে দেখে আসো।’

বলেই মেহফুজ পা বাড়াল যাওয়ার জন্য। নয়ন খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল মেহফুজের যাওয়ার দিকে। তবে মিনিটখানিক না পেরোতেই মেহফুজ আবার ফিরে আসে। কেমন যেন বিমূঢ় দেখায় তাকে।

-‘খাবারগুলো দিয়েই চলে আসবে না। কিছুক্ষণ কথা বলবে। আর…’
কথা বলতে বলতে থেমে যায় মেহফুজ। কোমরে বাঁ হাত রেখে ডান ভ্রুটার মাঝে আঙুল দিয়ে চুলকাতে থাকে খাবারের প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে। তাকে হঠাৎ যেন অচেনা লাগছে নয়নের কাছে। তার স্যারকে এর আগে কখনও সে এমন অপ্রতিভ হতে দেখেনি। তবে তার এমন অবস্থার কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারল সে। তাই সে বলে বসল, ‘আর তরঙ্গ স্যার না ওঠা অবধি দাঁড়িয়ে থাকব, তাই তো?’

মেহফুজ চকিতে তাকায় নয়নের দিকে। তার চেহারার কাঠিন্যভাবটা এখনও স্পষ্ট। নয়ন তার এমন চেহারা দেখে খানিকটা চমকাল। ভাবল, ভুল কিছু বলে ফেলল কিনা। কিন্তু মেহফুজ একটুক্ষণ নীরবে চেয়ে থেকে তারপর বলে, ‘ওকে বলবে না আমার কথা। তুমি দেখতে এসেছ ওকে, ঠিক আছে? আমি নিচে গাড়িতে ওয়েট করছি।’

বলেই সে চলে গেল তার বড়ো বড়ো পা ফেলে। তার মেজাজ চটে যাওয়ার একটি জ্বলন্ত কারণ যে তরঙ্গ, তা নয়নের বুঝতে সমস্যা হলো না। কেবল সমস্যা, তার দেখতে আসার কথা খেয়ামকে জানাতে কেন বারণ করল?
***

ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোর। করিডোর ধরে হেঁটে ডান দিকে একদম কর্ণারে তালাবদ্ধ একটি কক্ষ। যেটা আশহাব ও তার দুই পুত্র আহবাব মুহিত আর আরহাম মেহফুজের লাইব্রেরি ঘর বলেই উল্লেখিত হতো বছর চারেক আগেও। মুহিত মারা যাওয়ার পর থেকে এই ঘরটিতে আশহাবের আর কোনো পদার্পণ ঘটেনি। আর মেহফুজ তখনও বাড়ির বাইরে থাকত তার পেশার জন্য। তখন থেকেই রুমটি তালাবদ্ধ ছিল। এ বাড়িতে তারা তিনজনই ছিল একান্ত মুহূর্তে বই পড়ে সময় কাটানোর মতো মানুষ। সেই ঘরটি এখন সপ্তাহে একবার কি দুবার খোলা হয়, যখন মেহফুজ ঘরটিতে ঢোকে। তবে এখন এই ঘরটিতে বইয়ের শেল্ফগুলো সাদা কাপড়ে ঢেকে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে বিশাল ঘরটির এক কর্ণারে। বই পড়ুয়া মানুষগুলোর অস্তিত্ব যে বিলীন, তারই প্রমাণ। ঘরটির মাঝ বরাবর একটি পিয়ানো। মুহিত আর মেহফুজের কিছু কিছু শখ ছিল একই। দুজনের শখ প‚রণ করতেই আশহাব এই পিয়ানোটি কিনেছিলেন, যখন তারা স্কুলের গণ্ডি সবে পেরিয়েছে। পিয়ানো মাস্টার রেখে তাদের পিয়ানো বাজানোও শিখিয়ে দেন। আর ঘরটির উত্তরের জানালার কাছে বড়ো একটি গোলাকৃতির মাঝারি সাইজের টেবিল, সাথে দুটো চেয়ার। টেবিলের এক কোণে কলমভর্তি একটি কলম দানি, একটি ল্যাম্প বিনা ব্যবহারে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। ঘরটির পূর্বদিকের দেয়ালভর্তি মেহফুজ আর মুহিতের একক কিছু ছবির ফ্রেম বেঁধে রাখা। অন্যদিকে তাদের বাবার ছবিও আছে কয়েকটা। তবে সেগুলো আশহাবের খুব জোয়ান সময়ের ছবি। কিছুক্ষণ আগেই মেহফুজ ঘরটিতে এসেছে। এ বাড়ির সব থেকে বড়ো ঘর এটিই। যে ঘরটির উত্তর, দক্ষিণে বড়ো বড়ো মাত্র দুটো জানালা। মেহফুজ ঘরে ঢুকে প্রথমেই সেই জানালার কাচের পাল্লা দুটো খুলে দেয়। আজও তা-ই করেছে। তারপর ঘরের মাঝে মৃদু আভার হলুদ বাতি জ্বেলে দেয় সাঁঝের আলো হিসাবে।

নিঝুম কুয়াশায় মোড়া সাঁঝ। জানালার কাচের পাল্লাগুলো কুয়াশার জলে ভেজা। মুক্তদানার মতো জলবিন্দুগুলো গড়িয়ে পড়ে কাচের গায়ে আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ দাগ তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণের জানালা বরাবার দাঁড়িয়ে আছে মেহফুজ। এখান থেকে লনের বাগানের জায়গাটুকু দেখা যায় স্পষ্ট। শীতে সারা শহরে কুয়াশার চেহারা ফুটে না উঠলেও এই লনের সামনে দাঁড়ালে কুয়াশার আস্তরণ পুরোটাই চোখে পড়ে। অপূর্ব লাগে দেখতে এই নিঝুম, মায়াবী, কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যা ক্ষণ। ছোটো সময়ে যখন সে আর মুহিত এক সঙ্গে এই ঘরে আসত বাবার সাথে, বাবা তখন তাদের দুটো বই দিয়ে নীরবে পড়তে বলে তিনিও ওই গোল টেবিলের সামনে বসে বই পড়তেন। পড়তে পড়তে সন্ধ্যাও নেমে আসত কখনো। তখন তারা দুভাই দক্ষিণের এই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের হাতে তৈরি বাগানের ফুলগুলো দেখত আর নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করত কে কোন গাছটা নেবে। ছোটো থেকেই দুভাইয়ের পছন্দেরও মিল অনেক। এই কুয়াশা জড়ানো সন্ধ্যাও তারা দুই ভাই ভীষণ পছন্দ করত। ইদের আগের দিন চাঁদরাতে ইফতার শেষ করে নামায আদায় করেই ছুটে আসত এই ঘরটিতে। এই ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চিকন কাঁচির মতো চাঁদটা দেখা যেত স্পষ্ট। আর সেটা এখনও।

-‘কীরে, আযান পড়ে গেছে শুনতে পাসনি?’ মা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার মুখে। মেহফুজ ফিরে তাকাল তার দিকে। খুব বেশি সময় হয়নি আসা হয়েছে ঘরটিতে। ক্ষণিকের মধ্যেই পুরোনো মিষ্টি মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণে আটকা পড়ে গিয়েছিল সে। মাগরিবের আযানের ধ্বনি একদমই তার কর্ণকুহরে পৌঁছয়নি। মা এসে খেজুর আর পানির গ্লাসটা হাতে তুলে দিলেন তার।

-‘কী করছিলি? নিচে আয়।’

-‘কিছু না। সন্ধ্যা প্রদীপ দিতে এসেছিলাম। চলো।’

ইফতারের জন্য খাবার টেবিলে মেহফুজ বসতেই মুন জিজ্ঞেস করল, ‘কোথাও কি বের হবি?’

-‘হ্যাঁ, একটু কাজ আছে।’

-‘আমাদের তো শপিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল। যাবি না?’

-‘যাব না কেন? তুই আর মা বেরিয়ে পড়বি। আমি কাজটা সেড়েই চলে আসব। শুধু ফোন করে তোদের লোকেশন জানিয়ে দিবি।’

এর মাঝেই নয়ন এসে হাজির হয়। তাকে দেখে মেহফুজ শেষবারের মতো পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘রোযা রাখছ না কেন বলো তো? আজ তো কোনো শিডিউল ছিল না।’ নয়ন বেশখানিকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ল যেন। ইতস্তত মুখ করে হেসে বলল, ‘আসলে স্যার…একটু কষ্ট হয়ে যায় বেশি।’

মুন হেসে ফেলে তার কথায়। নীহার বলেন, ‘এ কথা বললে চলবে? আল্লাহ শুনবেন এ কথা?’ নয়ন লজ্জিত মুখ করে কিঞ্চিৎ হাসে। মেহফুজ ইফতার শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমি বসো, আমি নামাযটা ঘরেই পড়ে আসি। মসজিদে গেলে দেরি হয়ে যাবে।’

-‘সমস্যা নেই স্যার, আপনি মসজিদেই যান। দেরি হবে কীসের?’

নয়নের এ কথায় মেহফুজ চোখা নজরে তাকায় তার দিকে। তার চাউনি দেখেই নয়নের মনে পড়ে যায় তাদের কাজের কথা। মুখটা অপরাধীর মতো করে মৃদুস্বরে তখন বলে ওঠে সে, ‘স্যরি স্যার।’ মেহফুজ উপরে চলে যায়। নামায শেষ করে খুব দ্রুতই বেরিয়ে পড়ে তারা।

-‘স্যার ড্রাইভার নেবেন না?’ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে নয়ন।

মেহফুজ তাকে ইশারায় ড্রাইভিং সিটে উঠতে বলে তার পাশের সিটে উঠে বসে পড়ে। নয়ন বুঝতে পারে আজকে তাকেই ড্রাইভিং করতে হবে। এ ব্যাপারটাতে সে ভীষণ খুশিই হয়। কেননা, তার নিজের একটা গাড়ি কেনার বহু পুরোনো শখ। আর নিজের গাড়ি নিজেরই ড্রাইভিং করার ইচ্ছা তার। মাঝে মাঝে যখন মেহফুজ তাকে ড্রাইভিং করতে বলে তখন নয়নের মনে হয় যেন নিজের গাড়িই সে ড্রাইভিং করছে। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে তখন।
গাড়িটা ছুটছে খেয়ামের বর্তমান লোকেশন সদর হাসপাতালের দিকে। মেহফুজ হাত ঘড়িতে সময় দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ও ফোন করে কী বলেছে?’

নয়ন একবার ড্রাইভিং এর ফাঁকে মেহফুজের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে নজর রাখে। জবাব দেয়, ‘বলল তরঙ্গ স্যার ওর থেকে খেয়ামের ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছে। ও আবার সাহস করে তরঙ্গ স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল কী প্রয়োজন। স্যার তখন ধমক দিয়ে ওঠে ওকে। পরে আবার ওকে বলে খেয়ামের আজ হসপিটাল ছেড়ে হোস্টেল ফেরার কথা। তাই দেখা করতে যাবে।’

-‘তাহলে ফরিদপুর থেকে ওর বাবা-মা এখনও কেউ আসেনি?’

-‘কাউকেই তো দেখলাম না। বোধ হয় জানায়নি খেয়াম বাড়িতে।’ এটুকু বলে নয়ন থেমে যায়। মেহফুজের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার আপনি কি ওর বাসায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন?’

-‘হ্যাঁ, এভাবে তো ও হোস্টেল থাকতে পারবে না। ওকে দেখাশোনা করার জন্য কে আছে ওখানে? বাসায় তো যেতেই হবে। পাগল না কি মেয়েটা! বাসায় না জানালে দেখবে শুনবে কে ওকে? তাই আমি আজ কথা বলেছিলাম ওর বাবার সাথে।’

-‘সেটাই তো। এখন তাহলে ওকে আমরা হোস্টেল নামিয়ে দিয়ে আসব?’

-‘হুঁ, আর ওর এক মাসের স্যালারিটাও দিয়ে দেবে বোনাসসহই।’

-‘মানে অ্যাডভান্স স্যালারি?’

-‘না। যে এক মাস কাজ করতে পারবে না সেটার।’

রাস্তার বাঁ পাশে গাড়িটা দাঁড় করেছে নয়ন। মেহফুজ রাস্তার এপাশ থেকেই দেখছে রাস্তার ওপাশের বিস্ময়কর দৃশ্য। খেয়াম প্লাস্টার করা পা’টা উঁচু করে আরেক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কোনো বান্ধবীর ঘাড়ে হাত ফেলে। পাশে তার আরও চারজন ছেলে আর মেয়ে বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত তারা নিতে এসেছে ওকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তরঙ্গ তার গাড়িটার দরজা খুলে খেয়ামকে ভেতরে ঢোকার কথা বলছে বেশ শক্তমুখে। খেয়ামকে দেখা যাচ্ছে সে নারাজ তার গাড়িতে উঠতে। বারবার না বলছে হয়তো। যা তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখা বোঝা যাচ্ছে। নয়ন আর মেহফুজ দুজনেই নির্বাক দৃষ্টিতে দেখছে সেই দৃশ্য। প্রায় দশটা মিনিট চলল সেই বিস্ময়কর মুহূর্ত। অবশেষে তরঙ্গের জোরাজুরিতে খেয়ামকে উঠতে হলো তার গাড়িতে। সাথে উঠল তার বন্ধুরাও। মিনিটখানিকের মধ্যে গাড়িটা এগিয়েও গেল।

নয়ন গাড়িটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, ‘কাহিনিটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না, স্যার।’ মেহফুজ সিটে হেলান দিয়ে মাথার পিছে দুহাত ফেলে আরাম করে বসল। চেহারাটা তার স্বাভাবিক, মসৃণ। তারপর হঠাৎ ফোন করে মুনকে। ওপাশ থেকে মুন জানায় তারা মাত্রই বেরিয়েছে বাসা থেকে। তাকে বসুন্ধরার সামনে চলে আসতে বলে। কথা বলা শেষ করে নয়নকে সে বলল, ‘আজকের মতো কাহিনি এখানেই শেষ। পরবর্তীতে দেখা যাবে আবার। আপাতত বসুন্ধরার সামনে চলো।’

আসল অংশটুকুই মিস করতে যাচ্ছিলেন আপনারা। উপন্যাসের আর মাত্র ২/৩ টা পর্ব আপলোড করা হবে৷ অর্থাৎ বইয়ের ১২০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। ফেসবুকের জন্য এই নির্দিষ্ট অংশ অবধিই সিলেক্ট করেছি। যারা উপন্যাসটি পড়তে ইচ্ছুক তাদের বই কিনে পড়তে হবে৷ স্বপ্নবাড়ি বুকশপ, রকমারি.কমসহ আরও অন্যান্য বুকশপে বইটি পাবেন।
***

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here