এমন_কেনো_তুমি,part_5,6

0
807

#এমন_কেনো_তুমি,part_5,6
[ সত্য ঘটনার অবলম্বনে ]
#ফাতেমা_তুজ
#part_5

দিন টি কি বার মনে নেই আরহানের। বার, তারিখ, সময় সমস্ত কিছু থেকে পিছিয়ে গেছে বহু পূর্বেই। আরহানের গলা ভারী হয়ে আসে বারং বার। মনে হয় বহু বছর ধরে কোনো বিষাক্ত কাঁটা বিঁধে আছে। বুকের ভেতরে ও চরম শূন্যতা কাজ করে। প্রিয় প্রেমিকা সিয়ার মুখ টা এখনো তাজা ওর হৃদয়ে। তবে ঔষধের রিয়্যাকশনে অনেক টাই আবছা হয়ে গিয়েছিলো সেই মুখ। মায়াবী শ্যাম কন্যার চিকন ঠোঁটের হাসি টা এখনো অনুভব হয় ওর।মনে হয় এই তো সিয়া এসে ওকে স্পর্শ করে যাবে হুটহাট করে। গালে হাত দিয়ে বুঝতে পারে নেই সেই চিকন ঠোঁটের স্পর্শ। অথচ কতো শত চুমু লেগে ছিলো এই গালে। যা অতীত হয়ে ভেসে আছে স্মৃতির ফাঁক ফোঁকরে। সম্ভবত আজ ই রিলিজ দেওয়ার কথা। লোক গুলো টাকা নিতে নিতেও বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গেছে। অবশ্য সেসবে ধ্যান নেই আরহানের। ওর মন মস্তিষ্ক সবটাই জুড়ে এক জন সিয়া, সিয়া আর সিয়া।

****

সিয়া তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সদ্য কিশোরীর মতো ওর রূপের ঝলক ও বহিছে চারপাশে। লোক চোখে নজর পরছে বেশ। লোকে বলে উজ্জল শ্যাম বর্ণের নারী নাকি সব থেকে বেশি সুন্দর হয়। তবে সিয়ার ক্ষেত্রে এটা যেন অধিক প্রচলিত। সিয়ার পুতুলের মতো চোখ সবাই কে মুগ্ধ করে। আর আরহান হয় বিচলিত। প্রচন্ড পাগল ছেলেটা। সিয়া মানে ওর আত্মা ওর প্রাণ। এর ভাগ কখনোই দেওয়া সম্ভব নয়।

ঘুমিয়ে ছিলো তখন। হঠাৎ করেই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা বোধ হয় কোনো ব্যক্তির জন্য ই আনন্দের নয়। আরহান ও তদ্রুপ বিরক্ত হয়। তবে কেন যেন বিরক্তি ঠেলে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে সিয়ার স্থির কন্ঠ
” হ্যালো। ”

” সিয়া! আননোন নাম্বার থেকে কল করেছো কেন? ”

” না মানে। ”

” কি মানে মানে করছো? ”

” আচ্ছা বলছি।”

” হুম বলো। ”

ততক্ষণে উঠে বসেছে আরহান। ওর মন মস্তিষ্ক সব টা এখন সিয়ার কথা শোনার জন্য আকুল হয়ে আছে।
” যদি রাগ না করো তবেই একটা কথা বলবো।”

আরহান লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে
” এই কি হয়েছে তোমার? দ্রুত বলো কি হয়েছে।দেখো আমার টেনশন হচ্ছে খুব। ”

সিয়া নিরুত্তর। বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক ফালি দীর্ঘশ্বাস। এ কোন পাগলের সাথে প্রণয় হয়েছে ওর? আরহান আবারো বলে
” বলছো না কেন। কি হয়েছে? ”

” দেখছো এর জন্যই তোমাকে বলতে চাই না কিছু। ”

” আচ্ছা বলো। ”

আরহানের কন্ঠে কিছুটা শান্তি। তাই ওপাশ থেকে মিনমিনে কন্ঠে সিয়া বলল
” একটু স্কুলে আসতে পারবা? ”

সিয়ার কন্ঠ শুনে আরহানের ভ্রু কুঁচকে যায়। ইতো মধ্যে মন আর মস্তিষ্ক একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়েছে। আরহান রগরগা কন্ঠে বলল
” কি হয়েছে বলো সঠিক করে? ”

” এমনিই কিছু হয় নি। আসো তুমি। ”

লুঙ্গি পরা ছিলো আরহান। মাথা কাজ করছে না। সিয়ার চিন্তায় ভনভন করছে সব। যা তা অবস্থা যেন। বুক টা কেমন প্রখর খড়ার মতো খা খা করছে। মন আকাশে মেঘে দের অভাব অনুভব হলো খুব। এতো শত ভাবনায় আসে না সাজসজ্জা। জীবনে প্রথম লুঙ্গি পরেই বাসার বাহিরে অবস্থান করে সে।
যে ছেলেটা এক পা বের হওয়ার পূর্বে আরশি তে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে শতবার। সেই ছেলেটা নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে সে চিন্তা ও ভুলে যায় আজ। বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়েই বেরিয়ে পরে। স্কুলের পাশের ফেক্সিলোডের দোকানের সামনে এসে রিক্সা থামায়। দেখে সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। হাত কাঁচুমাচু করছে বার বার। অপর প্রান্তে কিছু ছেলে ইট ভাঙা দিয়ে দেয়ালে লিখছে আমি তোমাকে ভালোবাসি সহ নানা ধরনের কথা বার্তা আর বাজে অঙ্গভঙ্গি। আরহান সেগুলো স্পষ্ট দেখে তবে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। সিয়ার চোখে মুখে আতঙ্ক। আরহান স্থির কন্ঠে বলে
” রিক্সা তে উঠো। ”

সিয়া রিক্সা তে উঠতেই আরহান নেমে যায়। বুকের ভেতর ছ্যত করে উঠে সিয়ার। বলে
” আরে আসো তুমি। দেখো ঝামেলা করবে না একদম। ”

আরহান উত্তর করে না। সিয়া ব্যস্ত হয়ে যায়। আরহান কে নানান কথা বলতে থাকে। তবে আরহান সেসব কথা কে বিন্দু মাত্র পাত্তা দেয় না। বরং রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বলে
” মামা আপনি যেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসছেন ঠিক সেখানেই নামাবেন ওকে। আগে নামতে চাইলে প্রয়োজনে থাপ্পড় দিবেন।কিন্তু নামাবেন না ওরে। আমি আপনাকে দায়িত্ব দিলাম। ”

” আচ্ছা মামা। ”

” দেখো তুমি এখনি আমার সাথে যাবা। ভেজাল করবা না কোনো। আসো তুমি, না হলে আমি ও যাবো না। ”

নিজের রাগ কে প্রশমন করার চেষ্টা চালায় আরহান। তবে রাগ চড়ে গেছে নাকের ডগায়। তাই সামান্য চেঁচানো কন্ঠে বলল
” ঝামেলা করবা না সিয়া। না হলে গাড়ির নিচে পরে যাবো আমি। ”

সিয়া চুপ হয়ে যায়। আরহান সম্পর্কে বেশ ভালোই অবগত সে। যদি এখন আর কিছু বলে তো সত্যিই গাড়ির নিচে পরে যাবে আরহান। রিক্সা চলতে থাকে,
সিয়া তাকিয়ে থাকে পেছনের দিকে। আরহানের রাগ কতো দূর তা ধারণার অতীত।কথায় আছে প্রিয় কোনো কিছুর জন্য লড়াই করলে শক্তি নাকি আপনা আপনিই বেড়ে যায় কয়েক গুন। হয়তো সৃষ্টিকর্তা শক্তি ঠেলে দেয় তাঁর ওপর। আরহানের পরিস্থিতি টা ও ঠিক তেমনি হলো। এটা নিশ্চিত যে অন্য সময় হলে চার টে ছেলে মিলে ওকে অনেক বেশি আ’ঘাত করতো। কিন্তু আজ একাই চার জন কে মা’রতে থাকে। ঐ যে কলিজা তে আঘাত করেছে। মাথা ঠিক নেই একদম ই। রাস্তার পাগল কে ঠান্ডা করা যায় তবে প্রেমিক পাগল কে নয়। ব্যাটের স্টাম্প দিয়ে এতো টাই মা’রে যে আশে পাশের কেউ আগানোর সাহস পায় না। লোক জন জড়ো হয়ে যায় একদম।

আশে পাশেই আরহানের বন্ধুরা ছিলো। তাঁরা এসে পরে মুহুর্তেই। অলিতে গলিতে সবাই জানে সিয়া আরহানের গার্লফ্রেন্ড। কারো সাহস হয় না চোখ তুলে তাকানোর। সেই প্রিয়তমার প্রতি বাজে দৃষ্টি ফেলেছে এরা। এতো সহজে রক্ষা পাবে তা কি করে হয়? স্টাম্প দিয়ে এতো মা,রার পর ও আরহানের রাগের দমন হয় নি। কল করে সিয়া কে। ওপাশ থেকে সিয়া পারে না শুধু কেঁদে দিতে। আরহান বলে
” তুমি আসো এখন। ”

” ঝামেলা করো না তুমি প্লিজ। ”

” বলছি তো আসো। ”

ধমক খেয়ে চলে আসে সিয়া। এসে দেখে চার জন কেই প্রচুর মে’রেছে আরহান। আবারো মা’রতে থাকে ওদের।সিয়ার চোখ দুটো নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।এমন করে চার জন কে একাই আ’ঘাত করতে, কি করে পারলো আরহান? তবে এটাই কি ভালোবাসার সেই অদৃশ্য শক্তি?

———–

আরহানের ছোট দুই ভাই ও এসেছে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে। আরমান আর ইমরান কে দেখে বুক টা ছ্যত করে উঠে ওর। ইশারা করে কাছে ডাকে ওদের। ভাইয়ের কাছে এসে দুজনেই আবেগ লুকাতে ভুলে যায়। অদ্ভুত ভাবে কেঁদে উঠে তিন ভাই। এতো এতো ভালোবাসা ফেলে আরহান কি না ম’রতে গিয়েছিলো?
উহু প্রচুর অন্যায় হয়েছে। এমন টা আর কখনোই করবে না ওহ। তবে সিয়া? অন্তরে থাকা ভালোবাসা টা কে কি করে দমন করবে ওহ? পারবে না এই ভালোবাসা কে দমন করতে। চোখ বন্ধ করে আরহান। কেঁপে উঠে হৃদয়স্থল। বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হয় ওহ। কেবলি বলে
” আমি দুঃখিত আম্মু, আমি দুঃখিত আব্বু। ”

ছেলের স্বাভাবিক কন্ঠ। আহা কতো শত দিনের অপেক্ষা যেন। সাজিদা কেঁদে উঠেন সজোরে। চাঁপা কান্নায় ছেয়ে যায় পুরো ঘর। এই মিলন সুখের, এই মিলনে রয়েছে এক মায়ের ভালোবাসা, এক বাবার ভালোবাসা, এক সন্তানের ভালোবাসা, এক ভাইয়ের ভালোবাসা। জীবন হয়তো সুন্দর, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে জীবন বড্ড দুঃখের ও। তবে প্রিয় মানুষ গুলোর মুখ চেয়ে অনেক ত্যাগ ই স্বীকার করতে হয়। মনে মনে আরহান ও ভেবে নিয়েছে করবে না আর পাগলামি, সবাই কে সুখে রাখার চেষ্টা করে যাবে। আর বুকের ভেতর জমে থাকা প্রণয়ের কষ্ট টা না হয় একাই অনুভব করে যাবে অন্তত জীবন।

** আরহান সত্যিই একা চার জন কে মে’রেছিলো। বিষয় টা কিছু টা অদৃশ্য শক্তির মতোই। কারন একা হাতে ঐ চার জনের সাথে পারা সহজ কথা নয়। অন্য সময় হলে ওকেই মে’রে যেতো ছেলেগুলো। **

চলবে

#এমন_কেনো_তুমি [ সত্য ঘটনার অবলম্বনে। ]
#ফাতেমা_তুজ
#part_6

বহিরাগত বাতাসের অনু প্রবেশ হতেই কেঁপে উঠলো আরহান। শরীর অদ্ভুত ভাবে জ্বলতে শুরু করেছে। নিষ্প্রাণ চোখ গুলো হন্ন হয়ে গেল মুহুর্তেই। অসহ্যকর এক সূক্ষ্ম যন্ত্রনা এসে গলা টিপে ধরলো যেন। মৃদু স্বরে চিৎকার করলো সে। ভাই কে কাঁপতে দেখে ছুটে এলো ইমরান। সামান্য উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল
” কি হয়ে ভাইয়া? এমন করছো কেন? ”

” শরীর জ্বালা পোড়া করছে। ”

কথা টা বলেই আলো থেকে আড়ালে এসে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে হাজির। তিনি প্রথমে না বুঝলে ও পরে বুঝতে পারলেন বিষয় টা। আরহানের পিঠে হাত রেখে তিনি ঘন শ্বাস প্রশ্বাস ফেললেন। বললেন
” বহু দিন ধরে বন্দী জীবন যাপন করছো। রোদের প্রভাব পরে নি একদম ই। স্যত স্যতে বিছানায় ঘুমিয়েছো। তাছাড়া সূর্যের আলোর সাথে সম্পর্ক নেই বহুদিন। তাই তোমার শরীরে জ্বালা পোড়া অনুভব করছে।খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”

ডাক্তার কিছু নির্দেশনা দিলেন। আরহান কিছু টা শুনলো তবে মন টা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

****

প্রতি টা মানুষ ই চায় একটি বিশ্বস্ত মানুষ। সিয়ার জীবনের এক অংশ জুড়ে নয় বরং সব অংশ জুড়েই আরহান। বিশ্বাস, ভরসা ভালোবাসা সব টা মিলিয়ে যেন অনুভব করে নিয়েছে আরহান ই ওর জীবন। যাঁর মাঝে লাজ লজ্জার কোনো বিষয় নেই। প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকা রা ভালোবাসার ক্ষেত্রে সম্মান প্রদর্শন করে। আরহান আর সিয়া ছিলো খেলার সাথী স্বরূপ। ওদের ভালোবাসা সম্মান সব টাই যেন ছিলো আরো প্রখর। মেয়েলি ব্যাপার গুলো তে লজ্জা পাওয়া প্রাচীন কাল থেকেই শুরু হয়েছিলো। আর তা চলবে অন্তত জীবন।
সিয়া তখন সপ্তম শ্রেনির ছাত্রী। হঠাৎ করেই ক্লাসে প্রচন্ড পেট ব্যথার অনুভব হয়। ছোট মস্তিষ্ক টা বিষয় টা বুঝতে পারে না ঠিক। স্কুলের ম্যাডাম রা জানান দেয় যে কালের বিবর্তনে ঘটে আসা অস্তিত্ব টা সিয়ার মাঝে ও চলে এসেছে। প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে যায় সিয়া। এমন টা হওয়ার ই কথা। ম্যাডাম মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন
” কিচ্ছু হয় নি সিয়া। এটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। ”

সিয়া যেন একটু ঠিক হয়। তবে নিজেকে সবার থেকে আলাদা অনুভব হলো। কেন যেন মন টা শীতল হতে পারছিলো না। ম্যাডাম বললেন
” ফ্যামলির কারো নাম্বার দাও। ওনারা কেউ এসে তোমায় নিয়ে যাক। ”

সিয়ার মনে আর কারো চিন্তা আসে নি। ফট করেই আরহানের নাম্বার দিয়ে দেয় ওহ। কতো টা ভরসা আছে ওর মনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরহানের ফোনে কল আসে। আননোন নাম্বার দেখে কিছু টা ভ্রু কুঁচকে যায়। পর মুহুর্তে রিসিপ করে।
” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি সিয়ার স্কুলের ম্যাডাম বলছি।”

চমকিত হলো আরহান। ফোন টা কান থেকে নামিয়ে আবার কানে ধরলো। ওপাশ থেকে ম্যাডাম বললেন
” আপনি কি হোন সিয়ার? ”

” কাজিন। কিছু প্রয়োজন ম্যাডাম। সিয়া ইজ ফাইন? ”

” ওহ। হ্যাঁ ঠিক আছে সিয়া। একটু প্রয়োজন ছিলো আর কি। স্কুলে কোনো মহিলা মেম্বার পাঠাবেন কাইন্ডলি। ”

” কি হয়েছে ম্যাডাম। স্কুলে যেতে হবে কেন? ”

” আপনি ব্যস্ত হবেন না ঠিক আছে সব। একজন কে পাঠাবেন। ”

আরহানের শরীর বেয়ে ঘাম নেমে গেল।
” আমি আসছি ম্যাডাম। ”

” না না কোনো মহিলা মেম্বার পাঠান। ”

” সমস্যা নেই আমিই আসছি। ”

বিপাকে পরলেন ম্যাডাম। সিয়া ইশারা করে বোঝালো আরহান কে আসতে বলতে। ম্যাডাম তাই ই বললেন।

আরহানের গাঁয়ে পাঞ্জাবি। সাথে এক টা চাঁদর জড়ানো ছিলো। কিছু মুহূর্ত পর স্কুলে এলো আরহান। সিয়া কাঁচুমাচু হয়ে আছে। ছেলেটার মুখের ভঙ্গিমা অদ্ভুত ঠেকলো সিয়ার। ম্যাডামের সাথে কথা হলো ওর। তবে বিশেষ কিছু জানালেন না তিনি। শুধু বললেন সিয়া কে নিয়ে যেতে। বিড়াল পায়ে এগুলো আরহান। সিয়া উঠে দাঁড়ায়।
” আসো যাই। ”

” কি হয়েছে তোমার? ”

” কিছু না এমনি পেট ব্যথা। ”

দুজনের মাঝে কিছু টা দূরত্ব রইলো। আরহান আগে আগে হাঁটছে। সিয়া সামান্য নিচু করে আছে মাথা। রাস্তার কাছে এসে আগায় সিয়া। মেয়েটার জামায় দাগ থেকে ব্যস্ত হয়ে যায় আরহান। বলে
” কি হয়েছে? ব্যথা পেয়েছো কোনো ভাবে? চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ”

কিছু টা আড়ষ্ঠতা লাগার কথা। তবে সিয়া একদম ই সজল। সে বলল
” কিছু হয় নি। আর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। ”

” পাগল হয়ে গেছো? আরে এখনি যাবো আমরা। ”

সিয়া বুঝলো আরহান এ সম্পর্কে অবগত হয়। ধীরস্থির ভাবে শ্বাস ফেললো মেয়েটি। বলল
” এটা একটা প্রক্রিয়া। নির্দিষ্ট বয়সে আসলে প্রতি টা মেয়ে মানুষের ই হয়। যাকে বলে পিরিয়ড। ”

উক্ত বিষয়ে জানতো না আরহান। তবে সিয়া খুব সুন্দর করে বোঝালো ওকে। গাঁয়ের চাদর দিয়ে জাপটে ধরলো আরহান। সিয়ার অনুভব হলো একজন প্রকৃত প্রেমিকের ছোঁয়া। যাঁর মাঝে আছে ভয়, দায়িত্ব আর একনিষ্ঠতা। হাসলো সিয়া। আরহানের চাঁদর গাঁয়ে জড়িয়েই রিক্সা তে উঠলো। পুরো রাস্তা জুড়ে সিয়া কে আগলে রাখলো আরহান। মেয়ে, মায়ের জাত যাঁদের কে বলা হয়। বুকের ভেতর থেকে সম্মান জেগে উঠলো। একজন মা সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা রাখার জন্য ঠিক কতো কষ্ট করে তা এখন পুরোপুরি জানতে পারলো আরহান।

—————-

মুখ টা কেমন যেন চিন্তিত লাগছে ফারেগ সাহেব এর। ডাক্তারের সাথে কথোপকথন শেষ করেছেন তিনি। ডাক্তার যেটা জানালেন এটা নিয়েই ওনার চিন্তা। আরহান কি বিয়ে করতে চাইবে? যদি ও এ বিষয়ে আপাতত কোনো কিছু বলা যাবে না। না হলেই বিপত্তি হতে পারে। মনে মনে নিজে কে ধাতস্থ করলেন তিনি।
আরহানের চোখ দুটো গাড়ির দরজার দিকে নিবদ্ধ। হালকা জ্বালা করছে শরীরে। তবে সেসব এখন মলিন লাগছে খুব। কেন যেন মানসিক হসপিটালের দিকে চোখ যাচ্ছে বার বার। মায়া থেকে নয় বরং করুণা থেকে। চৌদ্দ মাসে ও পারে নি একটি নাম মুছে দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এই নাম দলিল করে দিয়েছেন অন্তরে। চোখ বন্ধ করলো আরহান। সিয়ার পুতুল চোখ ভেসে এলো ওর দুই চোখে। প্রতি টা প্রেমিক প্রেমিকার মতো ওদের ও ছিলো বিশেষ কিছু মুহূর্ত। সে সব এখন অতীত আর অর্ধ স্পষ্ট মাত্র।

****

ছোট সময়ে বর বউ খেলে নি এমন মানুষ খুব কম ই আছে এই ধরায়। সুমা, সিয়া আর আরহান এক সঙ্গে বহু বার এই খেলা খেলেছে। সুমা অভিভাবক হয়ে সিয়া আর আরহানের বিয়ে ও দিতো। তখন খিল খিল করে হাসতো সিয়া। কি জোড়েই না হাসতো মেয়েটা। আরহান শুধু পারতো না ওর গলা টিপে দিতে।

আরহান সিয়ার সব থেকে সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে নদীর পাড়ে। বহু বার চেষ্টা করে ও কোনো ফুড কার্ড এ সিয়া কে নিয়ে যেতে পারে নি ওহ। প্রকৃতি প্রেমি সিয়া নিজেদের সুন্দর মুহূর্ত গুলো নদীর পাড়ে কাটাতেই পছন্দ করতো। মেয়েটার বায়নার কাছে হার স্বীকার করতো আরহান।

তখন ছিলো আরহানের জন্মদিন। দীর্ঘদিন ধরে প্ল্যান করেছে সিয়া। স্টুডেন্ট হওয়ার কারনে হাতে আহামরি টাকা পয়সা নেই। তবে মনে ছিলো অফুরন্ত ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা টুকুই জমিয়ে রাখতো সিয়া। সারা বছর একটু একটু করে টাকা সঞ্চয় করতো। যাতে আরহানের জন্মদিনে কিছু উপহার দিতে পারে। আরহান কতো বার মেয়েটার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে হিসেব নেই। তবে সিয়া সে টাকা গ্রহণ করে নি। বলতো ” তুমি ও স্টুডেন্ট আমি ও স্টুডেন্ট। তাই টাকা নিবো না আমি। ”

হার মেনে নিতো আরহান। পাগলি টা এমন এমন কান্ড করতো যে ওর মন গলে যেতো। হুট হাট চুমু খাওয়া ছিলো সিয়ার অভ্যাস। মনে মনে সংসার গড়ে নিয়েছিলো কি না। দুজনের মনেই ছিলো পূর্ণতার অপেক্ষা। কারণ হাজার টা ঝগড়ার পর ও দুজন জানতো যে একে অপর কে ছাড়া অচল। তাই একটা সংসার হয়েই গিয়েছিলো। আরহানের জন্মদিনের জন্য ছোট করে বিশাল আয়োজন যাকে বলে সেটাই করেছে সিয়া। নদীর পাড়ে কেক, আর কিছু গিফ্ট নিয়ে হাজির হয় বান্ধবী দের সাথে। আর আসতে বলে আরহান ও তাঁর বন্ধুদের। সিয়ার কান্ড দেখে অবাক হয় আরহান। মাঝে মাঝে বকা ও দেয় প্রচুর। তবে ওর ঠোঁটের কোনে লেগে থাকে ঝলকানো হাসি। কেক কাটলো আরহান। একে অপর কে খাইয়ে দিয়ে এখন গিফ্ট খোলার পালা। আরহান গিফ্ট এর প্যাকেট নিয়ে ও রাগারাগি করলো। ওর কথা কেন টাকা খরচ করতে গেল সিয়া? উত্তরে সিয়া বলল
” মাঝে মাঝে আমার ও তো ইচ্ছে করে কিছু দিতে। ”

” এতো ইচ্ছে করে কেন? ”

” ভালোবাসি যে। ”

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আরহান। কিছু টা ভেঙ্চি কেঁটে সিয়া বলল
” এমন কেনো তুমি? ”

” আমি নয় তুমি এমন। সর্বদাই এমন উল্টো পাল্টা কান্ড করো। পাকনিদের মতো।”

” এখন খুলো তো। ”

আরহান শ্বাস ফেললো। সিয়ার চোখে মুখে উৎকন্ঠা ছড়িয়ে আছে। যেন সব মায়া ঠেলে দিবে সে। প্যাকেট খুলে দেখলো মোটামুটি দামি একটা ঘড়ি, পাঞ্জাবি, পারফিউম, চকলেট। আরহান এবার সিয়ার দিকে তাকালো।
” এগুলো কে দিতে বলেছিলো? টাকা গুলো অন্য কাজে ও ভাঙতে পারতে সিয়া।”

” আমার আর কি কাজে লাগতো। ”

” এমন কেনো সিয়া। তুমি এমন কেনো বলো তো। এতো ভালোবাসো কেন হু? ”

উত্তর করে না সিয়া। কোনো ভাষা দিয়ে এর উত্তর করা যাবে না। এটা শুধুই অনুভব করা যাবে।

আরহানের হাত ধরে সিয়া। যত্ন নিয়ে তাঁতে চুমু একে বলে
” নৌকায় ঘুরাবে না? ”

——–

‘ ঘুরাবো সিয়া, ঘুরাবো। ‘

আনমনেই আওড়াতে থাকে আরহান। ঠোঁটের কোনে লেগে আছে স্বচ্ছ হাসি। ডুবে ছিলো প্রিয়তমার পাগলামি তে। আহা কি দৃশ্য সেটা। বিড়বিড় করার মাঝেই থমকে দাঁড়ালো গাড়ি। চোখ গুলো গাড়ির জানালা ভেদ করে তাকালো। সামনেই নিজের বহু পরিচিত বাড়ি। চোখ ভিজে গেল ওর। হাজার খানেক স্মৃতি জমে আছে এতে। তবু ও সব কেমন যেন অচেনা লাগছে। কিছুর অভাব বোধ হলো। কিসের অভাব তবে? সিয়ার অভাব ই বটে।

** পিরিয়ড নিয়ে কখনোই উল্লেখ করি না আমি। তবে এই সুন্দর ঘটনা টা উল্লেখ না করে পারলাম না। ঠিক কতো টা ভরসা আছে সিয়ার তা ভাবতে পারেন আপনি? প্রথম পিরিয়ড কতো টা আড়ষ্ঠতা দেয় তা অজানা নয়। আর সবার উদ্দেশ্যে আমার একটি কথা গর্ভধারণ অর্থাৎ আপনি আমি জন্মের বিশাল দায়িত্ব পালন করে এটা। যদি কখনো রাস্তায় কোনো মেয়ের জামা তে দাগ দেখেন তো হাসাহাসি করবেন না। এটা হাসাহাসির বিষয় নয় বরং এটা সম্মানিত একটি মাধ্যম। আর মেয়েরা লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু না এটা। এই একটা জিনিস আমাদের গর্বিত করে। কারণ এর জন্যই নারীরা হয় মা। আশা করি উক্ত বিষয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করবেন না কেউ। **

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। আমি অনুভব করতে পারি বাস্তব গল্প আমার পাঠক দের হৃদয় কে টানতে পারে না। তবু ও বলবো একটি খাঁটি ভালোবাসার স্বাক্ষী হতে পড়ুন এই গল্প টা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here