এমেলিয়া,১৫,১৬

0
350

#এমেলিয়া,১৫,১৬

১৫

দূর্গম জনমানবহীন তিন্দুতে তাদের প্রথম দিনের সফর সঙ্গী হন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা।গাইড না থাকায় আশ্রয় নেন স্থানীয় মহিলা প্রধানের বাংলোতে।আতিথীয়তার এক পর্যায়ে জানতে পারেন মায়ানমারের সাথে সম্প্রতি বান্দরবানের বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কের ফায়দা লুটছে একদল জঙ্গি। প্রায়ই আক্রমণ করছে স্থানীয় এবং আগত ভ্রমণপিপাসুদের উপর।সিলভা জঙ্গিদের নাম শুনে আৎকে ওঠে।মুহূর্তের মধ্য এডভেঞ্চারের ভুত মাথা থেকে নেমে যায়।রাতে শুয়ে শুয়ে এহতেশামুল সাহেবকে বলেন,
শুনোনা,চলোনা আমরা ভোরেই চলে যাই।এমেলিয়াকে নিয়ে টেনশান হচ্ছে।আমি চাইনা ওর উপর কোনো আঁচ আসুক।
এহতেশামুলঃ আরে তুমি শুধুই ভয় পাচ্ছ। এত কষ্ট করে এসেছি ২/১ দিন থাকিনা প্লিজ।আর আমিতো আছিই, প্রয়োজনে আমার জীবন দিয়ে তোমাদের রক্ষা করব।
সিলভা অনিচ্ছা সত্বেও স্বামীর উৎফুল্লতা দেখে আর কিছু বলে না।

পরদিন সারাদিন ঘুরে বিকেলের দিকে তারা চলে যায় কুমারী ঝর্ণায়।ঝর্ণা দেখে এহতেশামুল সাহেব মনে হয় কিছুটা রোমান্টিক হয়ে পড়েন।
প্রিয়তমা
অলিভিয়া সিলভা
তোমার মনে আছে আমাদের প্রথম দিনের কথা??আচ্ছা তুমি তো বাংলা আগে থেকেই জানতে তাহলে সেদিন যখন আমি তোমাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম তুমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাওনি কেন?
সিলভা মুচকি হাসে,পরখ করে দেখতে হবেনা এই মানুষটা আমায় ভালোবেসে ঠিক কতদূর যেতে পারে।।
ওরে দুষ্ট…
স্বামী এহতেশামুল সাহেবকে চমকে দিয়ে সিলভা গেয়ে উঠেন
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…..
দুজনে আজ যেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে নেতিয়ে পড়া সময়গুলোর বাঁধা ভেঙ্গে যৌবনের তাপ দাহে জ্বলছে।

অকস্মাৎ এহতেশামুল সাহেবের উদ্বেগ ভরা কন্ঠে সিলভার গান বন্ধ হয়ে যায়।
এমেলিয়া কোথায়???

উদ্বেগ উৎকন্ঠা আর শঙ্কায় পাগলপ্রায় অবস্থা। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে দু’জনে।একে তো প্রতন্ত দূর্গম পাহাড়ি এলাকা, তার উপর বৈরি আবহাওয়ায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মত দূর দূরান্তে একটা প্রাণীও নেই।সিলভার বুক ফাটা আত্মচিৎকার ততক্ষণে পাহাড়ের বুকে মুশলধারে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে।প্রত্যেকফোটা পরশপাথর ন্যায় বৃষ্টিও তীরের মতো গায়ে এসে ঠেকছে।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।সময়টাও যেন নিষ্ঠুরতার চরমে উঠে গিয়েছে।টাইম লুপের মত সিলভা আর্তনাদ করতে করতে একই জায়গায় এসে ক্লান্তিতে ধপাস করে বসে পড়ে।গা যেন এলিয়ে দিয়েছে।মুখ দিয়ে শুধু একটাই শব্দ,
আমার এমেলিয়া।।

এহতেশামুল সাহেব অসহায় পথিকের ন্যায় সিলভার দিকে তাকিয়ে আছে।বার বার নিজেকে শাপ শাপন্ত করছে কেন সিলভার কথা মেনে নিয়ে ভোরে চলে গেলাম না।গ্রীষ্মের কাঠফাটা শুষ্কতায় এমেলিয়া যেন একফালি বসন্তের মিষ্টতা নিয়ে এসেছিলো আমাদের জীবনে।হুশ ফিরলে আমি সিলভাকে কি জবাব দেব??

এমন সময় পায়ের সাথে কিছু একটা নরম অনুভব করেন এহতেশামুল সাহেব।অন্ধকারে ঠিক বোঝাও যাচ্ছেনা।কিছুটা শঙ্কিত হন তিনি।সারাজীবনে তো অতিপ্রাকৃতিক কিছুতে বিশ্বাস রাখেন নি। তাহলে…হঠাৎ নরম জিনিসটি একটু নড়ে চড়ে উঠে।এহতেশামুল সাহেব এবার আরো বেশি কুন্ঠা বোধ করেন।
নাহ এভাবে চলবেনা।বুকে সাহস এনে তিনি পদার্থটি হাতে নেড়ে চেড়ে দেখে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে ওঠেন।এমেলিয়া…..

চিৎকারে সিলভা হুঁশ ফিরে পান।তাকিয়ে দেখেন,পাশেই বসে আছেন এহতেশামুল সাহেব,কোলে এমেলিয়া।কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে ওঠে।সৃষ্টিকর্তাকে লাখো কোটি শুকরিয়াহ জানান।দু’জনে যখন আপন মনে হারিয়ে গিয়েছিলো মুহূর্তের হাতছানিতে,এমেলিয়া একা একা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।বাবা মাকে ডেকে ডেকে সারা না পেয়ে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে মাটিতেই।

বাইরে তখন ফজরের আযান পড়ে গিয়েছে।অদ্রি দেখতে পায় ডায়েরিতে পরের বেশ কিছু পেইজ ফাঁকা।শেষের দিককার পাতা উল্টাতেই আবারো লেখা –

আজ এমেলিয়ার ঠিক ৫ বছর ৬ মাস ৩ দিন।৬ টা মাস আমার চোখে ঘুম নেই,সিলভার মুখে হাসি নেই।আমার জীবনে সেদিনের কালো রাতটা ভয়ংকর অমানিশা নামিয়ে দিয়েছে।রিক্ত হস্তে জীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছি।সিলভার অসহ্যকর যন্ত্রণা,না পারছি সহ্য করতে না পারছি মুক্তি দিতে।সিলভা বার বার মুক্তি চাচ্ছে আমিও আর পারছিনা।তোমাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারিনি সিলভা।আমাকে মাফ করোনা তোমরা কখনো।

অদ্রি বুঝতে পারে ঘটনা কি হয়েছে।তবে প্রশ্ন থেকে যায় এমেলিয়াকে যদি পেয়েই যায় তাহলে কি এমন ঘটেছিলো সেদিন যা এহতেশামুল সাহেব অন্য কাউকে জানাতে চান নি।কেনই বা তার ডায়েরিতেও স্থান দেন নি।সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বান্দরবান গেলে।
পরদিনই অদ্রি আর এমেলিয়া বেড়িয়ে পড়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।

চলবে…..

লেখনীতে -Shahana urmi

#এমেলিয়া

সোজাসুজি ডায়েরি থেকে টুকে নেওয়া ঠিকানায় গিয়ে পৌছায় দু’জন।
পুরোনো বাংলোটা বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা এখনও পৌঁছায়নি।
এমেলিয়ার চোখে মুখে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে না।বাংলোর কেয়ার টেকার সুবল কুমার চাকমা তাদের সাদরে স্বাগতম জানায়।অদ্রির খানিকটা সন্দেহ হয়। সাধারণের চেয়ে যেন লোকটা একটু বেশি কেয়ার নিচ্ছে তাদের।কায়দা করে বয়বৃদ্ধ সুবল চাচার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে অদ্রি।রাতে খাবার পরিবেশনের সময় কথায় কথায় চাচাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা চাচা আপনি এখানে কতদিন ধরে আছেন?
— তা হবে বৈকি।
–শুনেছি এখানকার মহিলা প্রধান অনেক আন্তরিক ।তার এখনও দেখা পেলাম না যে?
–উনি বছর দুয়েক আগে পরলোকগমন করেছেন।
–আই এম সরি।
— তোমরা খাওয়া দাওয়া করো।কিছু লাগলে জানিও।
— ঠিক আছে।চাচা….
একটা বিষয়ে আপনার সহযোগীতা চাই,যেহেতু এখানকার সবথেকে পুরোনো আপনি।আই থিংক আপনি আমাদের বলতে পারবেন।চাচা আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে একটা দম্পতি সন্তানসহ….
সুবল চাকমা তাদের থামিয়ে দিয়ে বলে,শোনো বাপু,ঘুরতে এসেছো ঘুরে যাও অযথা নিজের আর আমাদের সময় নষ্ট করো না।অদ্রি আর কিছু বলে না।

সুবল চাকমা তাদের দুজনকে দুটো পাশাপাশি রুম দেখিয়ে দেয় শোয়ার জন্য।রাত প্রায় ১২ টা,অদ্রি বসে বসে হিসেব মেলাচ্ছে কার্যত কিছুই মিলছে না।সুবল চাচা নিশ্চই কিছু জানেন।না হলে এভাবে রিএক্ট করতেন না।এমেলিয়ার সাথে কথা বলা দরকার।অদ্রি ধীর পায়ে এমেলিয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
–এমেলিয়া, এমেলিয়া, ঘুমিয়ে গিয়েছো আসবো??
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়না।ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে অদ্রিও গিয়ে শুয়ে পড়ে।

তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি। তুমি আবার কেন এসেছো?আমিতো বলেছি আমি কিছু জানিনা।চলে যাও তুমি চলে যাও।রগরগিয়ে বলে ওঠে সুবল চাকমা।
এমেলিয়ার ধৈর্যের বাধঁ ডিঙ্গিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে প্রতিউত্তর দেয়।
চলে যাওয়ার জন্য তো আসিনি চাচা।এবার আপনাকে বলতেই হবে সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো আমার পরিবারের সাথে।আমি জানি আপনি সব জানেন।পেছনের বেশ কয়েকবছর আমি এসেছি।আপনাকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করেছি আপনি কিছুই বলেন নি।এবার আপনাকে বলতে হবে।না হলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।আপনাকে খুন করতে আমার একটুও হাত কাঁপবে না।

সুবল চাকমা ভয় পেয়ে যায়।কপাল বেয়ে ঘাম বের হচ্ছে।তারপরও গর্জে ওঠে।
আমি বলেছি তো আমি কিছু জানিনা।

এমেলিয়া রাগে ফুঁসতে থাকে।ভরা জোৎস্নার দীপ্ত আলোতে সবুজ চোখ দুটো যেন হায়নার রূপ ধারণ করেছে।খোলা চুলে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া সুন্দরী রমণীকে হিংস্র ডাকিনীর সর্দর বলে মনে হচ্ছে।যেন চোখের সামনে স্বয়ং শমন দেবতা দাঁড়িয়ে আছে হাতে রামদা নিয়ে।এমেলিয়া সজোরে চর বসিয়ে দেয় সুবল চাকমার গালে।তাল সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারান তিনি।

জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান সুউচ্চ পাহারের কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা হ্যাংলা জংলী গাছের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা। গাছটা যেন তার ভর নিতে গিয়ে নেতিয়ে পড়েছে।উনিশ থেকে বিষ হলেই সোজা মৃত্যু।জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে হৃদপিন্ড শুধু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে জল জল জল….
এমেলিয়া মুখের সামনে জলের বোতল ধরে।সুবল চাকমা যেন ধরে প্রাণ ফিরে পান।আকুতি মিনতি করতে থাকেন একফোটা জলের জন্য।ভাগ্য এ কোন পরিহাস করছে তার সাথে?সামান্য একটু কসুরের এতবড় শাস্তি.. এ যেন লঘু পাপে গুরু দন্ড।
জীবন বাঁচানোর তাগিদে রাজি হয় সব ঘটনা খুলে বলতে।

এদিকে অদ্রির ঘুম আসছে না।কি করবে ভেবে না পেয়ে এক প্রকার ব্যক্তিত্বের তোয়াক্কা না করে চলে যায় সোজা এমেলিয়ার ঘরে।এমেলিয়ার দেখা না পেয়ে কিছুটা ভড়কে যায়।এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজির পর দেখা মেলে এমেলিয়ার।রাম দা হাতে সুবল চাচার সামনে।খুব বেশি অবাক হয়না অদ্রি।এখানে এসেছে থেকে এমেলিয়ার শান্ত থাকার দরুন এরকম কিছু একটা হওয়ার আশঙ্কা সে করেছিল।এতক্ষণ ধরে তাদের দূর থেকে অনুসরণ করছে সে।দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এমেলিয়া সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি।

সুবল চাচা বলতে শুরু করেন,’সেদিন যখন প্রলয়ংকারী ঝড়ের মুখে হন্তদন্ত হয়ে তোমার বাবা-মা তোমাকে নিয়ে বাংলোতে ফিরে আসেন,ঠিক তার কিছুক্ষণ আগে একদল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র আশ্রয় নেয় বাংলোতে।যুবক বয়স, রক্ত গরম,মাথাও গরম।স্বভাবতই আমি সবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কতে দেই।ঢোক গিলে আবারও বলা শুরু করেন।

মাঝ রাতে ভয়ংকর আর্তনাদে ঘুম ভেঙে যায়।ঘুম ঘুম চোখে লন্ঠণ হাতে এসে দেখি তোমার বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পরে আছেন।পাশেই মানুষরূপী হায়নার দল খুবলে খাচ্ছে তোমার মায়ের দেহ।ভয়ং আত্নচিৎকারে আকাশ বাতাশ কম্পিত হয়ে ওঠে। ততক্ষণে তুমিও ঘুম থেকে জেগে উঠেছো।ছোট্ট তুমি আতঙ্কে আম্মু আম্মু করে চিৎকার করছো।ওরা তোমাকেও…..
তোমার মা আমাকে দেখতে পেয়ে অনেক আকুতি মিনতি করে।ওদের একজন আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়,আমি যদি কাউকে কিছু জানাই তবে আমার স্রী কন্যারও একই দশা হবে।দেশের মাটিতে বিদেশি রূপ দেখে হয়তো ওদের….

আমি অন্যায় করেছি।সেদিন যদি আমি ভয় না পেয়ে সামান্য সাহায্যের হাত বাড়াতাম, দৌড়ে গিয়ে কাউকে জানিয়ে দিতাম।তাহলে হয়তো তোমার জীবনটা এমন হতো না।
আমি পাপী।আমাকে ক্ষমা করো।দয়া করে আমার প্রাণ ভিক্ষা দেও আম্মা।

পর্ব ১৬।
চলবে…..

লেখনীতে-Shahana urmi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here