এমেলিয়া,১৯,অন্তিম পর্ব

0
609

#এমেলিয়া,১৯,অন্তিম পর্ব

১৯

অদ্রিকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে বসে আছে এমেলিয়া।পৃথিবীতে এটাই একমাত্র শান্তির জায়গা,ভরসার জায়গা,বিশ্বাসের জায়গা।

আচমকা বাচ্চাদের মত গগনবিদারী আর্তনাদ জুড়ে দেয় মেয়েটা।বড্ড নিরাধার লাগছে আজ।পাপা সেদিন কেন আমাকেও মেরে ফেললো না?আত্নবাদী মানুষের মত শুধু নিজেদের মুক্তির কথাই চিন্তা করে গেল?কেন অদ্রি,কেন?

অদ্রি কোনো কদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।সত্যিই তো,সারাটা জীবনে কি পেল মেয়েটা?ছোটবেলায় বলাৎকারের শিকার,সম্ভ্রান্ত পরিবারের আদরের রাজকন্যা হওয়া সত্বেও মানুষ হলো রাস্তায় রাস্তায়,বাবা মায়ের ভালোবাসাও পেলোনা।
অদ্রির গলা ধরে আসছে।কিছু বলতে গিয়েও নীরব হয়ে যায়।শুধু আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অবহেলিত রাজকন্যাকে।

এমেলিয়া দীর্ঘক্ষণ যাবত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।এক পর্যায়ে নিজেকে শক্ত করে অদ্রির দিকে তাকায়,
–অদ্রি,তোমাকে দেওয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই।আমার অতীত বড্ড ভয়ংকর,একাকীত্বের।
চোখ মুছে দিয়ে অদ্রি তার ভালোবাসার জানান দেয়।
–হোক ভয়ংকর,আমি পরোয়া করি না।
–আমি পাপী।
–পাপকে ঘৃণা করি,পাপীকে নয়।
–যখন তোমার দায়িত্ব বোধ সামনে এসে দাঁড়াবে তখন কি করবে তুমি?
এবার আর অদ্রি কোনো কথা বলে না।সত্যিই তো।সে তো এখন আইনের রক্ষক।সে প্রত্যক্ষ করেছে,কি নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করেছে এমেলিয়া।

অদ্রিকে না জানিয়ে উপর মহল থেকে কেইস সিআইডিকে হস্তান্তর করা হয়েছে।ডিবি পুলিশের উপর থেকে যেন তাদের আস্থা সরে গিয়েছে।অদ্রির সংগ্রহীত কিছু তথ্যও তাদের হাতে পড়ে গিয়েছে।সেখান থেকে এ কথা প্রমাণিত যে,খুনির সাথে অদ্রির কোনো গোপন সম্পর্ক আছে।এমনও হতে পারে অদ্রিও এই সব খুনের সাথে জড়িত।এমন খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অদ্রি ভেতর থেকে ভেঙ্গে পড়ে।কি করবে সে?এই চাকরিটাই যে গ্রামে পড়ে থাকা অসুস্থ মায়ের ঔষধের যোগান দেয়।বাবার বাজার খরচের,বোনের বিয়ের,ভাইয়ের পড়াশোনার।এতগুলো মানুষ তার উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে।অন্যদিকে পড়ে আছে তার এক আকাশ সমান ভালোবাসা,এমেলিয়া।কোন দিক বেছে নেবে সে??

ডিপার্টমেন্টে মিটিং বসেছে।তারা প্রায় খুনি পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে।বলা হচ্ছে এই ভয়ংকর সিরিয়াল কিলারকে গোপন টর্চার সেলে রাখবে।নির্মমভাবে অত্যাচার করবে কিন্তু সারা দুনিয়া জানবে ক্রস ফায়ারে মৃত্যু হয়েছে।
মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে আসামীদের সাথে এরকমটা করা হয়।বাংলাদেশে এ নিয়ম চালু করবে?ভেবেই অদ্রি দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।কি করবে সে?কি করা উচিত তার?

প্রায় এক সপ্তাহ অদ্রি কোথাও বেড়োয় না,খায়না,কথা বলেনা।ওদিকে এমেলিয়া তীর্থের কাকের মত পথ চেয়ে বসে থাকে প্রাণপ্রিয় প্রেমিকের।সপ্তাহখানেক পর অদ্রি মনস্থির করে।জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নেয়।
রাতে এমেলিয়াকে জানায়,পরদিন যেন সে কালো শাড়ি পড়ে।অদ্রির জন্য সাঁজে।একগুচ্ছ বেলিতে খোঁপাটা রাঙ্গিয়ে তোলে।হাত ভর্তি বেলোয়ারি পড়ে।
এমেলিয়া বুঝতে পারছেনা এমন বায়না কেন করলো অদ্রি……

চলবে…..

লেখনীতে-Shahana urmi

#এমেলিয়া
অন্তিম পর্ব।

এমন পাগলামী বায়না এমেলিয়ার শূন্য মনে এক সমুদ্র স্বপ্ন এনে দেয়।তবে কি এতদিনের নামহীন সম্পর্কের পরিণয় ঘটতে যাচ্ছে??

প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে নিজেকে সাজায় সে,ঠিক যেমনটা অদ্রি চেয়েছে।গায়ে কালো শাড়ী,মোটা কাজলে আবৃত করা হরিণী সবুজ চোখ,হাত ভর্তি প্রেমিকের দেওয়া বেলোয়ারী।ঠোঁটে হাল্কা লাল লিপস্টিক।খোপায় বেলির গাঁজড়া।অপ্সরার মত লাগছে তাকে।প্রতি অঙ্গে স্নিগ্ধতা চুইয়ে পড়ছে।নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখে বেড়িয়ে পরে এমেলিয়া।

দেখো তো আমায় কেমন লাগছে??
অদ্রি হা হয়ে তাকিয়ে আছে।যেন প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য নেমে এসেছে তার প্রেয়সীর সারা অঙ্গে।রূপের দীপ্তিতে ঝলসে যাচ্ছে তার চোখ।কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় সে।

অন্যদিকে খবর পেয়ে ফোর্স নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে সিআইডি টিম।সন্দেহের জের ধরে অদ্রির পিছনে খোচর লাগিয়ে দিয়েছিলো, অদ্রি টেরই পায়নি।

পদ্মার পাড়।দূর দূরান্তে বিশাল এলাকা জুড়ে শুধুই কাশফুলের বন।যেন সাদা শিশিরের চাদর পড়ে আছে প্রকৃতি।

কি হলো,আমায় এখানে কেন নিয়ে এসেছো?
এমেলিয়ার কথায় অদ্রি কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে।চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
এমেলিয়া এখন আমি তোমায় কিছু শক্ত শক্ত কথা বলবো তুমি প্রস্তুত হও।দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আবারও বলা শুরু করে,

এক আকাশ সমান ভালোবাসা হারিয়ে যখন জীবনের সব রং মাটিয়ে মিইয়ে গিয়েছিল ঠিক তখনই তুমি শরৎ এর শুভ্রতা নিয়ে আমার জীবনটা আবারও রাঙ্গিয়ে দিয়েছো।আমি তোমায় অসম্ভব রকম ভালোবাসি এমেলিয়া।তোমার অতীত,তোমার বর্তমান,কিছুই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।আমি শুধু ব্যক্তি তোমাকে ভালোবাসি।তবে আজ আমি অসহায়,বড্ড নিরুপায়।ওরা তোমাকে পেলে ছারবে না।তোমার কষ্ট আমি বেঁচে থাকতে সহ্য করতে পারবোনা এমেলিয়া।বোধ হয় আমিও স্বার্থপর হয়ে গিয়েছি।

তোমাকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার সারাজীবন রয়ে যাবে।
আমায় তুমি মাফ করো।

বিকট আওয়াজ।আওয়াজে কাশবন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায় পক্ষীকূলেরা।চারিদিক স্তব্ধ।এমেলিয়া তাকিয়ে দেখে বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।ঠিক দুই ফিট সামনে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে তারই ভালোবাসার মানুষটা।এক মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এমেলিয়া।

অসহায় অদ্রি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।সামনে পড়ে আছে এমেলিয়ার নিথর দেহ।হেচকা টানে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রেয়সীর লাশ।নিজ হাতে নিজের সর্বস্ব শেষ করে দিয়েছে সে।হারানোর যন্ত্রণা তো এবার কম হওয়ার কথা।কিন্তু না,এবারের যেন হারানোটা ভয়ংকর যন্ত্রণা দিচ্ছে।হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলতে থাকে,
আমি তোমায় ভালোবাসি এমেলিয়া,আমি তোমায় ভীষণরকম ভালোবাসি,আমি তোমায় ভালোবাসি……..

_____________

কেটে গিয়েছে ২০ টা বছর।
চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,আজকাল চুলে খানিকটা পাকও ধরেছে,শরীরে আর আগের মতো জৌলুস নেই।বয়সের ভারে পেটা শরীরটায় সামান্য ভুরি উঁকি দিয়েছে।বসে আছে অদ্রি টিএসসির পাশে সেই চিরচেনা জায়গাটায়।
হঠাৎ কালো শাড়ি পড়া একটি মেয়ে স্বামী সন্তানসহ এগিয়ে আসে।
এক মুহূর্তের জন্য যেন মনে হয় এমেলিয়া আসছে।

ভাইয়া চিনতে পেরেছেন????
অদ্রি দীর্ঘক্ষণ পরখ করে জবাব দেয়,তুমি…..সিতারা না??
–জ্বি ভাইয়া।আপনাকে অনেক খুঁজেছি কোথাও পাইনি।
হাতে থাকা সাদা খামটি এগিয়ে দেয় সে।এমেলিয়া দিদি এটা আপনাকে দিতে বলে গিয়েছিলো।এতগুলা বছর আমি যত্নে তুলে রেখেছিলাম।আজ যেন নিজেকে হাল্কা লাগছে।নেন আমার দায়িত্ব শেষ।

অদ্রির বুকের মধ্যে যেন আচমকা বিদ্যুৎ খেলে যায়।সেই প্রথম দিনের মত অনুভুতি হচ্ছে।দ্রুত খামটা নিয়ে পড়তে থাকে,

প্রিয়তমেষু অদ্রি,
হাতের লেখা দেখে হাসি পেলে খানিক হেসে নিও।কাকতালীয়ভাবে আজ বুধবার।তার উপর ১১ তারিখ।এই তারিখটায় নিয়ম করে আমি দুনিয়া থেকে মানুষরূপী কিছু জঞ্জাল সরিয়ে দিয়েছি।কল্পনাও করতে পারিনি এই দিনটাই আমার অন্তিম দিন হবে।কাল যখন তুমি আমায় সাজতে বলেছিলে,তাও তোমার জন্য।প্রথমটায় আমি ভেবেছিলাম আমার সব স্বপ্ন যেন সত্যি হতে চলছে।তোমাকে নিয়ে মাঝরাতে হাতে হাত রেখে হাটার দিন বোধ হয় এসে গিয়েছে।আমাদের ছোট্ট সংসারে পুচকু কে নিয়ে আমরা দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবো।একবার মায়ের দেশেও যাব। কতশত স্বপ্ন।কিন্তু,তোমার গলার স্বর আমার খুব চেনা।তোমার চোখের ভাষা আমার জানা।আমিতো পাপী।পাপীকে নিশ্চয় কর্তব্যের উপরে রাখবেনা….
আমি জানি,আমার আর ফেরা হবে না।তোমার হাতে মরতে পারলেও আমার শান্তি।তোমার পরিবারকে দেখে রেখো।

ভালোবাসি তোমায়,ভীষণ ভালোবাসি প্রিয়।

ইতি
তোমার হৃদয়ের সামান্য অংশে ঠাই পাওয়া
এমেলিয়া।

অদ্রির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে বিরহের ঝর্ণা।একমনে সিতারার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে,
এরকম একটা সংসার আমার হলেও হতে পারতো।।

লেখনীতে-Shahana urmi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here