এ কেমন ভালোবাসা,পর্ব -২,০৩

0
1910

এ কেমন ভালোবাসা,পর্ব -২,০৩
মাসুরা খাতুন
০২

ক্লাস রুমের বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। আজ তার ভেতরে যাওয়া নিষেধ। আজ ক্লাসে প্রায় বিশ মিনিট পরে এসেছে ও।পাশেই কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোঁয়াকে পরখ করছিলো,আর দুই একটা বাজে ইঙ্গিত ও করছিল।রুমের ভেতরে যেই মেয়ে গুলোকে বাইরে দাঁড়িয়ে ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছিল তারাও ছোঁয়ার করুন অবস্থা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছিল,যেন চিড়িয়াখানার কোন জন্তু দেখছে।ভাবা যায় ওদের ক্রাশ সাহারিয়ার স্যার মেয়েটাকে কেমন অপমান করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, বেশ হয়েছে! সাহারিয়ার স্যার অন্য কোন মেয়েকে পাত্তা না দিক এটায় সবাই চায়। সবার ইচ্ছা নিজেকে নিয়ে,এমন সুন্দর চকলেট বয়ের মতো টিচারের নজরে আসতে কোন মেয়েই বা চায় না।

ছেলেগুলো যথেষ্ট বাজে কথা বলা শুরু করেছে,লজ্জায় আর অপমানে ছোঁয়া মুখ তুলে তাকাতে পারছে না।রুমের ভেতর ছোঁয়ার একমাত্র বান্ধবী কেয়ার ও খুব মন খারাপ, ছোঁয়া প্রতিদিন এমন অপমানিত হয় বলে।সাহারিয়ার স্যারকে ও নিজেও পছন্দ করে কিন্তু ছোঁয়ার প্রতি করা স্যারের আচরণ বড্ড গায়ে লাগে কেয়ার।

অতীত,,,

ছোঁয়া সকালের নাস্তা খেয়ে নিজের রুমে যায় কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে।ঠিকঠাক সময়ে তৈরি হয়ে এসে ছোঁয়া বড় মার রুমে যায় বলে যাওয়ার জন্য । কিন্তু গিয়ে দেখে সাহানা বেগম মাথা খানিকটা ধরে বসে আছেন, মুখটা ও কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।আলম চৌধুরী এখনো আসেনি হাঁটাহাঁটি করে । ছোঁয়া সাহানা বেগমের কাছে গিয়ে কপালে হাত রেখে বলে,

“কি হয়েছে বড় মা? তোমার জ্বর হচ্ছে? ”

“নারে মা,জ্বর না।মাথাটা কেমন ঘুরছে,আর চোখের কাছে অন্ধকার অন্ধকার দেখছি।”

“কি বলছো? প্রেশার চেক করেছো,মনে হচ্ছে আজও তোমার প্রেশার লো হয়ে গেছে। “উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ছোঁয়া।

“না করিনি,”

“আমায় ডাকোনি কেন? কি যে করো বাপু? দেখি হাতটা দাও”

সাহানা বেগমের প্রেশার দেখতে ছোঁয়া হাতটা এগিয়ে নেয়।

“ওমা! প্রেশার তো অনেক কমে গেছে বড় মা।নিশ্চয় কাল রাতে ঔষধ খাও নি? কি যে করো না? কাল আমি একটু ভুলে গিয়েছিলাম বলে নিজেও আর ঔষধ খাও নি।”

ঔষধ গুলো এগিয়ে দিতে দিতে বলল ছোঁয়া।

“মায়ে মেয়ের ঔষধের কথা ভুলে গেলে মেয়ের কি করে মনে থাকবে বলতো? ”

ঔষধ গুলো ছোঁয়ার হাত থেকে নিতে নিতে বলে সাহানা বেগম।

“হয়েছে হয়েছে, আর এতো কথা বলতে হবে না,দোষ করে আবার যাতে বকা খাওয়া না লাগে তায় ওকালতি করা হচ্ছে। ”

খাবার স্যালাইন বানাতে বানাতে বলে ছোঁয়া।

“আমি কিন্তু ঔষধই খাবো না,এতো বকলে। এতো কথা শোনাস কেন রে,বাঁদর মেয়ে? “রাগ করার ভান করে বলে সাহানা বেগম।

“ইস! দোষ করে আবার নিজেই রাগ করা হচ্ছে? বকা খাওয়ার কাজ করো কেন?একটু ও শান্তি দাও না বাপু।”

গ্লাস টা এগিয়ে দিয়ে বলল ছোঁয়া।

এরই মধ্যে আলম সাহেব ও এসে পড়ল।এসে সবটা শুনে ছোঁয়া কে বলল কলেজে যেতে, তিনি আছেন এখন, দেখে রাখবেন।

ছোঁয়া বড়মার এই অবস্থা রেখে কলেজে যাবে না বললে সাহানা বেগম বলেন,

“পাগলামি করিস না মা,আমার তো কিছুই হয়নি।এই টুকু কারণে কলেজ মিস করিস না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে,কিন্তু দুপুরের রান্না কলেজ থেকে এসে আমি করবো,তুমি করতে পারবে বা কিন্তু? এসে যদি দেখি তুমি এই শরীরে উঠে রান্না ঘরে গিয়ে রান্না করছো তাহলে কিন্তু ভালো হবে বা বলে দিলাম । ”

শাসিয়ে বলে ছোঁয়া।

“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে,আমি রান্না করবো না।কিন্তু এখন তুই কলেজে যা।পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি চলবে না।”

ততক্ষণে অনেক টা দেরি হয়ে যায় ছোঁয়ার। এদিকে স্বাধীন ক্লাসে অলরেডি এসে গেছে।ঠিক বিশ মিনিট দেরিতে ছোঁয়া রুমের দরজায় দাঁড়ায় ভেতরে যাওয়ার অনুমতির জন্য।

চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্ত নিয়ে তাকায় সাহারিয়ার। অনেক রাগ লাগে ছোঁয়া এতো দেরিতে পৌঁছানোর জন্য। মেয়েটার অনিয়ম বেড়েই যাচ্ছে,

“কি ব্যাপার কেন এসেছো?”

“স্যার ক্লাস স করতে”

ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয় ছোঁয়া।

“ক্লাস করতে? এই সময়? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার জন্য বসে আছি তুমি কখন আসবে? ক্লাসে বসবে সেই জন্য? অলরেডি বিশ মিনিট পরে এসে বলছো ক্লাস করতে চাও।”

রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে সাহারিয়ারের।

ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।তাতে সাহারিয়ার আরো রেগে ধমক দেয়,

“কেন দেরি করেছো বলো? ”

“আসলে স্যার,বড় মা,,,”

বাকিটা আর বলতে পারে না ছোঁয়া, তার আগেই সাহারিয়ার ওকে থামিয়ে দেয়।

“সব সময় শুধু বড় মা।বড় মা, বড় মা বলে আর কতো সুযোগ নেবে? সব জায়গায় বড় মা কে টেনে আনতে হবে? গেট আাউট,আউট,বেরিয়ে যাও।তোমার ক্লাস করতে হবে না।”

রেগে বলে স্বাধীন।

ভয়ে ভয়ে ছোঁয়া আর বাকি টা বলার সুযোগ পায় না।বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে ক্লাস রুমের।

বর্তমান,,

ছেলেগুলোর কথায় ছোঁয়া প্রায় চোখ বন্ধ করে ফেলছিল লজ্জায়।

“ইস কি ফিগার দেখেছিস? তামান্না ভাটিয়া কেও হার মানাবে।”

“একদম দোস্ত। এক্কেবারে সেই,”

এমন সময় ঠাস করে একটা চড় পড়ার শব্দ পেয়ে চোখ খুললো ছোঁয়া। পাশে তাকিয়ে দেখে স্বাধীন দাঁড়িয়ে আছে ছেলেগুলোর কাছে।আর দলের মধ্যের একজন ছেলে গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে আছে।

“কি বলছিলো তোমরা? আর একবার বলো? বলো বলো?”রাগে লাল হয়ে বলল স্বাধীন।

“আসলে স্যার আমাদের ভুল হয়ে গেছে, আর এমনটা হবে না।”মাথা নিচু করে বলল ছেলেটা।

“না ভুল কিসের? আর হবে না কেন? অবশ্যই হবে।নেক্সট টাইম আবারও বলবে,এই যে ধরো বাসায় গেলে গিয়ে মাকে বলবে,ছোট বোন আছে না বাসায়? ওকেই একবার এই সব কথা বলবে,কি বলবে না? ভালো কথায় তো বলছো,এই যে আমও শুনলাম, প্রসংসায় তো করছিলে।”

“সরি স্যার,আর এমন টা হবে না।”

“কি নিজের বোনকে বলা যাবে না,নিজের মাকে বলা যাবে না,অথচ অন্যের বোনকে খুব বলা যায় তায়না? অন্যের মেয়ে কে বলা খুব সহজ? ”

ছেলেগুলো একদম মাথা নিচু করে আছে।আর এতোক্ষণ ছোঁয়া কে দেখে হাসা মেয়ে গুলোও চুপসে গেছে। সাহারিয়ার স্যার ঐ মেয়েটার জন্য ছেলে গুলোকে মারল? ঐ মেয়েটার হয়ে এভাবে প্রতিবাদ করলো? হিংসায় গা জ্বলে যাচ্ছে ওদের।

ছেলেগুলো কে দিয়ে ছোঁয়ার কাছে সরি বলালো সাহারিয়ার ওরফে স্বাধীন। রাগে লাল হয়ে ছোঁয়ার দিকে রাগী চোখে তাকাল একবার।তারপর সেখান থেকে সোজা চলে গেলো নিজের রুমে।

ফাঁকা মাঠের এক কোনায় দেবদারু গাছের নিচে বসে আছে ছোঁয়া আর কেয়া।

“আরে ছোঁয়া, যায় বল দোস্ত আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না সাহারিয়ার স্যার তোর জন্য এভাবে প্রতিবাদ করলো?”বিস্ময় নিয়ে বলল কেয়া।

“আমার জন্য মানে? এটা যে কোন মেয়ের জন্যই উনি করতেন।”আড় চোখে তাকিয়ে বলল ছোঁয়া।

“আরে না,সবার জন্য প্রতিবাদ আর আজকের এটা এক মনে হলো না।ছেলেগুলো যখন তোকে বাজে কথা বলল তখন যদি স্যারের মুখটা দেখতি।একদম রাগে লাল হয়ে টমেটোর মতো হয়েছিল। আসলে তোর সাথে স্যার এতোদিন এমন খারাপ আচরণ করায় আমার ও একটু একটু খারাপ লাগতো উনাকে,কিন্তু আজ আবারও আমি উনার ওপর ক্রাশ খায়ছি ভাই।”

হাত দিয়ে নানা রকম ভঙ্গিতে কথাটা বলল কেয়া।

“আমার সাথে ওমন করে তায়,হয়তো কোন ব্যক্তিগত রাগ আছে উনার আমার প্রতি,কিন্তু উনি অনেক ভালো মনের মানুষ। ”

“ব্যক্তিগত রাগ মানে? উনি কি ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন তোকে? ”

“আরে ধুর এমনিই বললাম, হয়না এমন আমাকে হয়তো উনি পছন্দ করেন না।”(স্বাধীনের পরিচয় দেওয়া বারন আছে ছোঁয়ার। এটা স্বাধীনের গোপন হুমকি।)

“আচ্ছা থাক রে,আজ বড় মা অসুস্থ। দুপুরের রান্না টা আমিই করবো বলে এসেছি। বাসায় যেতে হবে। ”

কেয়াকে বিদায় জানিয়ে কলেজের গেইটের বাইরে এসে গাড়ির জন্য এগোতে থাকে ছোঁয়া। এমন সময় স্বাধীনের কালো রঙের গাড়িটি সামনে এসে দাঁড়ায় ছোঁয়ার।

বারবার হর্ন দেওয়ার পরও যখন ছোঁয়া গাড়িতে না ওঠে দাঁড়িয়ে থাকে। ছোঁয়া বুঝতে পারে না স্বাধীন কি চায়ছে।কখনো নিজের আশেপাশে সহ্যই করতে পারে না স্বাধীন আর এখানে গাড়ি থামিয়ে ওকে তুলে নিতে চায়ছে এটা অবিশ্বাস্য।

গাড়ি থেকে মাথা বাড়িয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে স্বাধীন,

“কি হলো গাড়ি থামিয়ে আছি দেখা যায় না।গাড়িতে ওঠা বাদ দিয়ে ঢং করছিস কেন?”

স্বাধীনের সম্মতি পেয়ে গাড়ির পেছনের ছিটে বসতে যায় ছোঁয়া।

“এই আমাকে কি তোর ড্রাইভার মনে হয়? সামনে বস।”

সামনের সিটে জড়সড় হয়ে বসে ছোঁয়া।

আড়চোখে একবার ছোঁয়ার দিকে তাকায় স্বাধীন। তারপর সিটবেল্টটা নিজ হাতেই বেঁধে দেয়।

গাড়ি চলতে থাকে আপন গতিতে, তারপর বাড়ির রাস্তা বাদ দিয়ে যখন অন্য রাস্তায় গাড়ি যায় তখন ছোঁয়া ফিরে তাকায় স্বাধীনের দিকে।

“ভাইয়া আমরা কোথায় যাচ্ছি? এটা তো বাড়ির রাস্তা না।”তোতলাতে তোতলাতে বলে ছোঁয়া। পৃথিবীতে এই একটা মানুষকেই ও ভয় পায়,ভিষণ রকম ভয় পায়।

“জাহান্নামে।এখন চুপ করে বসে থাক।”

একটু পরেই গাড়ি এসে থামে শপিং কমপ্লেক্সের সামনে।ছোঁয়া কে নামতে বলে নিজেও নামে স্বাধীন।

তারপর একটা মলে গিয়ে বোরকা, হিজাবের ডিজাইন গুলো দেখতে চায়।নিজের পছন্দ মতো তিনটে বোরকা হিজাব পছন্দ করে স্বাধীন।সবগুলোই বেশ দামী।ছোঁয়ার গায়ের সাথে ধরে মাপটা দেখে নেয় শুধু।ছোঁয়া অনেক টা অবাক হয়।এসব ভাইয়া কার জন্য কিনছে? কোন গার্লফ্রেন্ড নাকি ওর জন্য? এসব কি ভাবছে।এসব ভাবা বড়ই বেমানান। ওর জন্য স্বাধীন কিছু কিনবে?

একটা আকাশী রঙের লেহেঙ্গা দেখে ভিষণ পছন্দ হয় ছোঁয়ার। ঘুরে ফিরে শুধু লেহেঙ্গা টায় দেখতে থাকে ও।আর মনে মনে ভাবে বাসায় গিয়ে বড়আব্বুকে বলবে এই লেহেঙ্গা টা নিয়ে যেতে।

ছোঁয়া কে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে স্বাধীন শপিং গুলো প্যাক করে নেয়।

তারপর গাড়ি একছুটে বাসার পার্কিংয়ে এসে থামে। স্বাধীন প্যাকেট গুলো ছোঁয়ার হাতে দিয়ে বলে,

“সামনের দিন থেকে এসব বোরকা পড়ে কলেজে যাবি।নেক্সট টাইম আর যেন না দেখি বাইরে বোরকা ছাড়া যেতে। ”

বলেই বাড়ির মধ্যে চলে যায় স্বাধীন। আর থ মেরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছোঁয়া,,,,,,,,,

চলবে,,,,,,,,

এ কেমন ভালোবাসা
পর্ব -৩
মাসুরা খাতুন

অলস বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। চুল গুলো এখনো শুকায়নি,খোলা রেখেছে, সেখান থেকে শ্যাম্পুর মিষ্টি ঘ্রাণ ভুরভুর করে বেরচ্ছে। গায়ে শরৎতের আকাশের মতো শুভ্র রঙা জামা। সূর্যের তির্যক রশ্মি কিছুটা এসে পড়ছে ছোঁয়ার গায়ে,তাতেই যেন ঝলমলিয়ে উঠছে উজ্জ্বল শ্যামা রঙের মেয়েটি।সারাদিনের হাসি কান্নার মাঝে ভুলে থাকা নিজের জীবনের ভবিষ্যতের ছক কষে মেয়েটি।কোন দিক থেকে কোথায় গড়াচ্ছে ওর জীবন। ছোটবেলায় বাবা মা কে হারিয়েছে।বাবা আসাদ চৌধুরীর বড়ভাই আলম চৌধুরীর ঘরে মানুষ হচ্ছে ও।দাদি ছিল,সেও সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। এখন আপন বলতে এই বড় আব্বু আর বড়মা।তারাও বা কয়দিন বাঁচবেন? তারপর? তারপর কি হবে ছোঁয়ার জীবনে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ও? মায়ের সম্পর্কের মামা বাড়ি আছে, তারাও যথেষ্ট ধনী।বাবা মা মারা যাওয়ার পর উনারা এসেছিলেন ওকে নিয়ে যেতে, কিন্তু ওর দাদি আর বড়মা মিলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সবার কথা ওদের বাড়ির মেয়ে অন্য কোথাও পরগাছা হয়ে মানুষ হবেনা,উনারাই যথেষ্ট ছোঁয়ার দেখাশোনার জন্য। দাদি বড়মা তাদের কথা রেখেছে।বড়মা কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।ভাগ্যিস সেদিন বড়মা, দাদি বাঁধা হয়েছিল।নিজের বড়আব্বুর বাড়িতে,যেখানে ওর বাবার ও অর্ধেক অধিকার সেখানে ও ছোঁয়া মাঝে মাঝে নিজেকে বাড়তি ঝামেলা মনে করে, আর তো মামার বাড়িতে যতোই ভালোবাসা পাক,কিছুতেই ছোঁয়া মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতো না।বড়মা মানুষ টা ভিষণ রকমের ভালো।শুধু ছোঁয়ার জন্যেই একমাত্র ছেলের সাথে ভালো করে কথা বলেন না তিনি।ভেতরে ভেতরে বড়মা যে খুব কষ্ট পায় তা ছোঁয়া বুঝতে পারে । মাঝে মাঝে ছোঁয়ার মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে।ও চলে গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।স্বাধীন ভাইয়া আবার আগের মতো হাসবে।বড়আব্বু, বড়মা নিজের একমাত্র ছেলেকে কাছে টেনে নিতে পারবেন। ছোট বেলা থেকেই একটা সম্পর্কের কথা শুনে শুনে বড় হচ্ছে ও।নিজের অজান্তেই যেই সম্পর্কে বাঁধা পড়ে গেছে ও,আজ এখন বড় হয়ে সেই সম্পর্কটায় ওর সব সুখ নষ্টের একমাত্র কারণ।যেই স্বাধীন ভাইয়া ওর সাথে হাসতো,কথা বলতো সেই স্বাধীন ভাইয়ায় ওকে পছন্দ করে না, শুধু মাত্র ঐ একটা সম্পর্কের রেষারেষিতে।কিন্তু ছোঁয়া? ওর কি দোষ? ওতো মন থেকেই সম্মান করে সম্পর্কটিকে,মন থেকেই মানে এই পবিত্র বন্ধনকে।

এতোকিছু ভাবতে ভাবতে কখন চোখের পাতা ভিজে উঠেছিল বুঝতে পারে নি ছোঁয়া। পেছনে কারো কণ্ঠ শুনে একটু চমকে ওঠে ছোঁয়া।এখনো চোখের পাতা ভেজা।

“কিরে আসবো?”

ছোঁয়া আশ্চর্য হয়।খুব বেশী অবাক হয়। স্বাধীন ওর সাথে শান্ত মেজাজে কথা বলছে! আজ কতোদিন পর তা ছোঁয়া জানে না।তাড়াতাড়ি চোখ দুটো মুছে নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ ভাইয়া এসো।”
স্বাধীন ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে আসে।তারপর ছোঁয়ার মতোই বারান্দার কাছে দাঁড়ায়।চাহনি বারান্দার বাইরে আকাশের দিকে। কিন্তু দ্বিধাভরা স্বাধীন কিছু বলতে পারে না।ছোঁয়া বুঝতে পারে স্বাধীন কোন দরকার ছাড়া ওর সাথে কথা বলবে না।তায়তো নিজেই আবার কথা বলা শুরু করে,

“কিছু বলবে ভাইয়া? কিছু কি লাগবে তোমার? ”

“ছোঁয়া, আমি আসলে সরি।কলেজে তোর কথা টা শোনা উচিত ছিল।না শুনেই তোকে শাস্তি দিয়েছি।”চাহনি আকাশের দিকে রেখেই বলে স্বাধীন।

“আমি কিছু মনে করিনি ভাইয়া।তোমার সরি বলতে হবেনা। ”
স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল ছোঁয়া।

“না তারপরও, মার শরীর খারাপের জন্য তোর দেরি হয়েছে আর আমি না শুনেই তোকে শাস্তি দিয়েছি। ভুলটা আমারই ছিলো।”

“তুমি একদম মনে কিছু করোনা ভাইয়া।এতোটুকু অপমানে আমি কিছু মনে করিনা,এসব আমার অভ্যেস আছে। তুমি কি কফি খাবে?”
খুব সতর্ক ভাবে স্বাধীন কে নিজের মনের আক্রোশটা বোঝালো ছোঁয়া।

“তুই কি আমাকে কথা শোনাচ্ছিস? ”
ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলল স্বাধীন।

“তোমাকে কথা শোনাবো? এতোটাও সাহস কি আমার আছে ভাইয়া। তোমাদের বাসায় আছি,তোমাদের খাচ্ছি আর তোমাকেই কথা শোনানোর সাহস আছে আমার?”

রাগে আবারও জ্বলে ওঠে স্বাধীনের অনুতপ্ত মন।কিছুক্ষণ আগেই যেই কাজটার জন্য সরি বলতে এসেছিল ও আবার সেই রাগটায় ঘিরে ধরল ওকে।
“তুমি যেই সম্পর্ক টাকে ঘৃণা করো,আমি সেটাকো সম্মান করি ভাইয়া।আমি আজও বিশ্বাস করি একদিন নিশ্চয়ই তোমার ভুল ভাঙবে। সৃষ্টিকর্তা ঠিক আমার কথা শুনবে।সেদিন আর আমার নিজেকে এ বাড়িতে পরগাছার মতো লাগবে না,সেদিন যথেষ্ট অধিকার নিয়ে হাজারটা কথা শোনাবো তোমায়।”

“শাট আপ! জাস্ট শাট আপ।বড্ড সাহস হয়ে গেছে তোর তায়না।আকাশের চাঁদ ধরার খুব ইচ্ছা? তাহলে শোন, তোর সেই আশা কোন দিনও পূর্ণ হবেনা।ধুর,,”
চোখ রাঙিয়ে কথা গুলো বলে পাশে থাকা বেতের চেয়ারে একটা লাথি মেরে চলে গেলো স্বাধীন।

“এক রত্তি মেয়ের কতোবড় সাহস আমাকে কথা শোনায়! আমি ঘৃণা করি ঐ মেয়েটিকে,যাস্ট সহ্য করতে পারিনা। “নিজের রুমে গিয়ে ফুলদানি টা ছুঁড়ে মেরে বলল স্বাধীন।প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল ওরই মতো দেখতে একটা অবয়ব ওকে দেখে হাসছে।

“কি ব্যাপার এখানে হাসির কি হলো? সবাই কি আমাকে চিড়িয়াখানার জন্তু পেয়েছে, যে যার মতো মতামত চাপিয়ে দেবে আমার জীবনে? ”

“হাসছি তোমার বোকা বোকা কথা শুনে।”
“আমার কথা গুলোকে বোকা বোকা মনে হচ্ছে? ”
“তা নয়তো কি?হা হা”
“স্টপ! যাস্ট স্টপ! ”
“তুমি বলছো তুমি ওকে সহ্য করতে পারোনা? তাহলে কলেজে অন্য ছেলেরা যখন ওকে খারাপ কথা বলছিল তখন কেন ওমন ভাবে প্রতিবাদ করলে?”
“সেটা তো আমি যেকোনো মেয়ের জন্যই করতাম।এটা আবার হাসির কি হলো?”
“যেকোনো মেয়ের জন্য করতে ঠিক আছে, কিন্তু এতোটা কি করতে? ছেলেগুলোর মুখে বাজে কথা শুনে অন্য মেয়ের বেলায় ও কি ওমন ভাবে জ্বলে উঠতো তোমার চোখ? রাগে কি এতোটায় উত্তেজিত হয়ে যেতে তুমি?”

“হ্যাঁ অবশ্যই যেতাম। মেয়েদের বাজে কথা বললে আমি কিছুতেই চুপ থাকতাম না।”

“ওহ! সিউর? তাহলে কয়টা মেয়েকে গাড়ি করে নিয়ে এসে বোরকা কিনে দিয়েছো তুমি? আর লেহেঙ্গার কথা? সেটাও কি মনে করিয়ে দিতে হবে আমার? ওটা কেন কিনেছিলে?”

“লেহেঙ্গা টা কিনেছিলাম কারন ওটা ওর পছন্দ হয়েছিল বলে।এতোটুকুই ব্যাস।”

“ওর পছন্দ হয়েছিল বলে! হাহা,,, ওর পছন্দের প্রতি এতোটা নজর তোমার,আর বলছো তুমি ওকে ঘৃণা করো? হাহা,,”

“হাসবে না,একদম হাসবেনা।তোমার হাসি ভিষণ বিশ্রী লাগে আমার।”

“তুমি মিথ্যা বলছো স্বাধীন। তুমি জেদের বসে এসব করছো,এসব বলছো।তুমি নিজেও মনে মনে ওকে চাও।”

“না না, একদম না।”বলেই হাতের কাছের বালিশটা ছুঁড়ে মারল অবয়ব টার দিকে।সাথে সাথেই কোথায় মিশে গেলো অবয়ব টা।মাথা চেপে ধরে শুয়ে পড়ে স্বাধীন।

বিকেলের খাবারের জন্য রুটি বানাচ্ছিল ছোঁয়া। আজ সারাদিন সাহানা বেগম কে একটা কাজেও হাত লাগাতে দেয়নি মেয়েটা।মাঝে মাঝে বড়দের মতো আচরণ করে মেয়েটা।একদম সাহানা বেগমের মায়ের মতো।ওকে দেখলে সাহানা বেগমের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে।মেয়েটাকে একদম কাছ ছাড়া করতে ইচ্ছা হয়না।সারাক্ষণ মনে হয় কোলের ভেতর নিয়ে লুকিয়ে রাখতে, যাতে কেউ এসে ছিনিয়ে নিতে না পারে ওর বুকে ধরে রাখা রত্মটিকে।শুধু আফসোস! ছেলেটায় বুঝলোনা আসল হিরে টাকে।
রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একমনে মেয়েটিকে দেখছিল সাহানা বেগম।
রুটি বেলতে বেলতে সাহানা বেগম কে খেয়াল করল ছোঁয়া।

“ওমা বড়মা তুমি? কিছু কি লাগবে? ”
“নারে মা।এমনিই তোকে একটু দেখছিলাম।কিছু কি হয়েছে তোর? মনটা এতো ভার ভার লাগছে কেন?”

“না বড়মা কিচ্ছু হয়নি।তবে একটা খবর আছে। তোমার ছেলে আজ আমায় বোরকা হিজাব কিনে দিয়েছে।”

“কি বলছিস? স্বাধীন তোকে বোরকা কিনে দিয়েছে? আল্লাহ কি আমার কথা শুনলো তাহলে? এবার কি সত্যিই সবটা ঠিক হবে?”
খুশিতে বলল সাহানা বেগম।

“এতোটা আশা করো না বড়মা।এমনিই হয়তো খারাপ লেগেছে তায় কিনে দিয়েছে।উনার কি মন মেজাজের কোন ঠিক আছে?”
তাওয়া থেকে গরম রুটি তুলতে তুলতে বলল ছোঁয়া।

“না না,এবার দেখিস ঠিক একটা কিছু ভালো হবে।”
এমন সময়ই ওপর থেকে স্বাধীনের জোরে চিৎকার করে ডাকার শব্দ কানে এলো।মনে হচ্ছে কিছু ভেঙে ও ফেলছে।সাহানা বেগম তাড়াতাড়ি ওপরে ছুটলেন।সাথে ছোঁয়া ও শেষ রুটি টা নামিয়ে চুলোর গ্যাস কমিয়ে দুধের পাতিলটা দিয়ে রাখলো।তারপর নিজেও গেল কি হয়েছে তা জানার জন্য।

“মা মা এখান থেকে আমার সাইকোলজির একটা বই পাচ্ছিনা।বইটা কি হয়েছে “চিৎকার করে বলল স্বাধীন।

“কি জানি বাবা,একটু খুঁজে দেখ,নিশ্চয়ই পেয়ে যাবি।এতে এতো চিল্লানোর কি আছে? ”

“চিল্লানোর কি আছে মানে? আমার দরকারি বইটা খুঁজে পাচ্ছি না।এটা তোমার কাছে কিছুই না? ওকে তাহলে আসছো কেন? যাও নীচেই যাও,যা করছিলে করো।”রেগে বলল স্বাধীন।
এদিকে ছোঁয়া এসে ভয়ে জবুথবু হয়ে সাইকোলজির বইটা স্বাধীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া,এইটা?”
র*ক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো স্বাধীন।
“আমার বই তোর কাছে মানে? এটা তোর কাছে গেলো কি করে?”চেঁচিয়ে বলল স্বাধীন।

“আসলে ভাইয়া,তোমার রুম পরিষ্কার করার সময় বইটা পাই,আমি যেই বই গুলো ফলো করি সেগুলো অন্য সিরিজের। এখানে কিছু সংঙ্গা খুব ভালো মনে হয়, তায় একটু নিয়েছিলাম।”

“কিহ! তোর এতো বড় সাহস আমার জিনিসে হাত দিস? আমাকে না বলে আমার জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস কোথায় পেলি?”
রেগে চিৎকার করে বলল স্বাধীন।
এদিকে ছোঁয়া ভয়ে প্রায় শুকিয়ে গেছে। গলায় একটু পানি পড়লে ভালো হতো।গলাটাও যে কাঠ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কোন কথা উচ্চারণ করার ক্ষমতা নেই।
এরই মাঝে এগিয়ে আসে সাহানা বেগম,,,,,

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here