এ কেমন ভালোবাসা
পর্ব -১
মাসুরা খাতুন
“স্বাধীন ভাইয়া প্লিজ আমার হাতটা ছাড়ো,খুব ব্যথা লাগছে তো,আমার হাতটা মনে হয় ভেঙেই যাবে”
প্রচন্ড ব্যাথায় মুখ চোখ কুঁকড়ে নিয়ে বলল ছোঁয়া। তার হাত দুটো পেছনে বেঁকিয়ে স্বাধীন ধরে আছে।
“এটায় তোর প্রাপ্য, খুব ব্যথা লাগে না? লাগুক, মরে তো আর যাস না।কেন আসিস তুই আমার সামনে?”
হাতদুটো আরো শক্ত করে ধরে বলে স্বাধীন।
“বড় আম্মুই আমাকে আসতে বলেছে ভাইয়া,তোমার ময়লা জামা কাপড় গুলো নিয়ে যেতে। “বলেই কেঁদে দিলো ছোঁয়া।
এতোক্ষণে ওর হাতদুটো ছাড়লো স্বাধীন।
“মা বলল আর তুই চলে এলি? তোকে না বারন করেছি, আমার রুমের আশেপাশে ও যেন আসিস না।এরপর যদি আর কখনো দেখি আরো খারাপ কিছু হবে। “বলেই হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো স্বাধীন।
ছোঁয়া নিজের হাতদুটোর দিকে একবার করুণ চোখে তাকালো, যেই জায়গাটায় স্বাধীন ধরেছিল একদম কালসিটে পড়ে গেছে। ও ফর্সা হলে হয়তো লাল দেখাতো,কিন্তু শ্যামলা হওয়ায় পুরো জায়গাটা কালো হয়ে গেছে। বড় হবার পর থেকেই স্বাধীন ভাইয়ার এমন অত্যাচারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ও।স্বাধীন ভাইয়ার মার খেতে বিশেষ কোন অপরাধ করতে হয়না ওকে।সামান্য পান থেকে চুন খসলেই তার কপালে জোটে এমন অত্যাচার।তার দাদির করে যাওয়া একটি ভুলের জন্যই ছোঁয়ার আজ এমন পরিনতি। বড়আব্বু আর বড় মা যথেষ্ট ভালোবাসে ওকে।কিন্তু একমাত্র ছেলে স্বাধীন কে হাজার শাসন করেও মানাতে পারেনা মিস্টার আলম চৌধুরী আর সাহানা বেগম।
হাত দুটোতে একটু পানি দিচ্ছিল ছোঁয়া। এমন সময় নিচে থেকে সাহানা বেগম ডাকেন ওকে।যথাসম্ভব ওড়না দিয়ে ঢেকে নীচে যায় ছোঁয়া। বড়মা দেখতে পেলে শুধু শুধু বাড়িতে আবারও অশান্তি হবে,তারচেয়ে না জানায় ভালো।
“হ্যাঁ বড়মা, বলো,কিছু বলবে?”
“স্বাধীন কি আজও কিছু বলেছে তোকে? সত্যি করে বল? ”
গরম চোখে তাকিয়ে বলল সাহানা বেগম।
“না না বড়মা।ভাইয়া আমাকে কিছু বলেনি।তুমি শুধু শুধু ভাবছো।”
“তাহলে ও এমন করে হনহন করে বের হয়ে গেলো কেন? ”
“কি জানি, হয়তো ভাইয়ার কোন জরুরি দরকার আছে বড় ম”আমতা আমতা করে বলে ছোঁয়া।
“দেখ আমার সাথে একদম মিথ্যে বলবি না।আমি তোকে চিনি,আমার ছেলেকেও চিনি।ও কি তোর গায়ে আজও হাত তুলেছে? ”
“না বড় মা,তুমি চিন্তা করো না তো।”
“দেখ ছোঁয়া মা,অধিকার কেউ যেচে দেয় না,নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়।”
কাঁধে হাত রেখে বলল মিসেস সাহানা বেগম।
ছোঁয়া শুধু বড় মার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো,কিন্তু এ যে কোন দিন ও সম্ভব না তা ছোঁয়া জানে।যেই স্বাধীন ভাইয়া ওকে সহ্য করতেই পারেনা,সে আবার দেবে ওকে অধিকার? এযে হাস্যকর।কিন্তু এই বয়সে এসে বড় মা, বড় আব্বু কে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? তায়তো যতোক্ষণ না উনারা নিজে থেকে দেখতে পান,তার আগে স্বাধীন ভাইয়ার অত্যাচার সম্পর্কে কিছুই বলে না ছোঁয়া। উনারা কি ওকে কম ভালো বাসেন! ছোট বেলায় মা বাবা মা রা যাওয়ার পর থেকেই উনারাই মানুষ করেছে ছোঁয়া কে।কোন অভাব বুঝতে দেয় নি।
এসব ভাবতে ভাবতে বড় মার সাথে রুটি বেলছিল ছোঁয়া, হাতে ধরে সব কাজ ওকে শেখান সাহানা বেগম। পরবর্তীতে সব কাজ তো ওকেই করতে হবে, তায়তো এখন থেকেই শিখে থাকা ভালো।
“এই ছোঁয়া তোর আজ কলেজে যেতে হবে না? এখনো রান্না ঘরে আছিস কেন? যা দুটো রুটি খেয়ে কলেজে যা।”
“ঠিক আছে বড় মা, আমি যাচ্ছি। ”
বলে উঠে যায় ছোঁয়া। বড়মার হাতে হাতে একটু কাজ এগিয়ে দিতে ভালোই লাগে ছোঁয়ার। খুশিতে গদগদ বড়মার মুখখানি দেখলে ওর মায়ের মুখশ্রী ভেসে ওঠে।
কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় ছোঁয়া। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে সাহানা বেগমের নিরলস বকবকানি।
“হয়েছে ছেলেটা এমন বেয়াড়া,একই কলেজে যাস দুজন,একই বাড়ি থেকে। মেয়েটাকে একটু সাথে নিয়ে গেলে কি হয়? বুঝিনা বাপু,এদের জ্বালায় আমিই পাগল হয়ে যাবো।”
ছোঁয়া বেরিয়েই গিয়েছিল, কি জানি ভেবে আবার বাড়ির ভেতর এসে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে সাহানা বেগম কে।
“তোমায় শুধু পাগল বানাবো না সাহানা বেগম, এক্কেবারে পাবনা পাঠিয়ে দেবো,তারপর শাঁকচুন্নিদের দিয়ে তোমার চুল ছিঁড়িয়ে নেব।হাহা।”
“দাঁড়া রে বাঁদর মেয়ে,আজ তোর পিঠে লাকড়ি ভাঙবো।”বলেই ছোঁয়ার চুলটা টেনে ধরে সাহানা বেগম ।
“আহা বড় মা চুল ছেড়ে দাও বলছি,চুল গুলো এলোমেলো হয়ে যাবে তো,তাহলে আর কোন ছেলে তাকাবে না এই ছোঁয়ার দিকে। ”
“তাহলে তো আরো এলোমেলো করবো,আমার বাড়ির জিনিসে অন্য লোকের বদ নজর! বদমায়েশ মেয়ে। ”
ছোঁয়া সাহানা বেগমের হাতটা ছাড়িয়েই মুখে ভেংচি কেটে দৌড়ে চলে গেলো।
ওদের মা মেয়ের এমন দৃশ্য ড্রয়িং রুম থেকে দেখেই চোখ জুড়ালো আলম চৌধুরী।
প্রতিদিন লেগেই থাকে এমন।এসব খুনসুটি যেন আর শেষ হয় না।ছোঁয়ার এমন দুষ্টমিতে সাহানা বেগম ও যে সেই আগের মতো কিশোরী হয়ে যান তা খুব খেয়াল করে আলম চৌধুরী।
“দেখেছো তুমি? দেখেছো? তোমার মেয়ে টা কতো পাজি হয়ে গেছে? ”
মুখ ফুলিয়ে বলল সাহানা বেগম।
“কেন মিসেস সাহানা, তুমি ও যখন রোজ কলেজে আসতে আমাকে দেখানোর জন্য কতোই না সেজেগুজে আসতে, ভুলে গেছো?”রসিকতা করে বলে আলম চৌধুরী।
“ও শুরু করেছো বাবা মেয়ে একসাথে আমার পেছনে লাগার, তায়না? “মুখ ফুলিয়ে বলল সাহানা বেগম।
“আর তুমিও যে আমাকে দেখতে রোজ ক্লাস মিস দিয়ে বয়েজ স্কুল থেকে গার্লস স্কুলের গেইটে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে,তাকি আমি বলেছি?
পাল্টা চাল দেয় সাহানা বেগম।
তখনই থতমত খেয়ে যায় আলম চৌধুরী, ধরা পড়ে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টায়।
“আচ্ছা স্বাধীনের মা,স্বাধীন কি কখনো মানবে ছোঁয়া কে? কি মনে হয় তোমার? ”
“কি জানি,আমিও তো কিছু বুঝিনা,ছেলেটা এমন বেয়াড়া হয়েছে, ছোঁয়া কে তো সহ্যই করতে পারে না। “উদাস হয়ে বলে সাহানা বেগম।
“ঠিকই বলেছো।তবে আমি একটা কথা বলি,তোমার ছেলের জন্য আমি কিন্তু মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারবো না।আমি ওর অন্য কোথাও ব্যবস্থা ঠিক করবো।”গম্ভীর হয়ে বলে আলম চৌধুরী ।
“কি সব অলক্ষুণে কথা বলছো! ছোঁয়া ছোট আছে, আর একটু বড় হোক, তখন ঠিক মানবে।আর আস্তে আস্তে ঠিক মন ফিরবে স্বাধীনের।”
এমনই কথা চলতে থাকে চৌধুরী বাড়িতে রোজ।দুজন মধ্য বয়স্ক মানুষ এই একটা বিষয়ে চিন্তা করেই কাটিয়ে দেন নিজেদের সময়।
সকাল সাড়ে আটটা।কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া, সাড়ে আটটা বাজতে কিছু বাকি আছে। গভীর ভাবে ভাবছে ও।ক্লাস টা কি করবে নাকি? আজও সাহারিয়ার আলম ওরফে স্বাধীন স্যারের ক্লাস। স্বাধীন আছে বলেই এই কলেজেই ভর্তি করিয়ে দিয়েছে ওর বড় আব্বু । স্বাধীন এখানের সাইকোলজির টিচার।আর ছোঁয়া ও সাইকোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো প্রতিদিনই স্বাধীনের ক্লাসে গিয়ে ছোঁয়া কে নানা ভাবে অপমানিত হতে হয়।তায়তো ছোঁয়া প্রতিদিনের মতো আজও ক্লাসে যাওয়া নিয়ে ভাবছে।
কলেজের প্রতিটি মেয়ের জন্যই সাহারিয়ার স্যার মানেই অন্য রকম ফিলিংস।রাগী গম্ভীর শাহারিয়ার হাসে খুব কমই,হয়তো ভুল করে।সবসময় রাগী রাগী লুক টা চেহারার ওপর ঝুলিয়ে রাখে।ধবধবে ফর্সা ছেলেটা যেকোনো মেয়ের ক্রাশ হওয়ার যোগ্য। সুন্দর ছিমছাম মানুষটির নাকের ডগায় যেন রাগ ঝরে পড়ে। সুঠাম দেহি সাহারিয়ার কে গোপনে অনেক মেয়েই আড়চোখে দেখে।কিন্তু সামনাসামনি গিয়ে সামান্য কথা বলার সাহস জোগাড় করতে পারে না।আর সাহারিয়ার কে মন ভরে দেখার জন্য, ওই সুন্দর মুখের ছোট ছোট কথা শোনার জন্য, ঐ তীক্ষ্ণ চোখের চাহনিতে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য ওর ক্লাসে উপস্থিত থাকা ছাড়া উপায় নেই। তায়তো মেয়েরা অন্তত কিছুতেই মিস করতে চায় না এই সময় টা।
ভিরু ভিরু পায়ে ক্লাস রুমের দরজায় পা রাখলো ছোঁয়া। কেবল আটটা বেজে পয়ত্রিশ হয়েছে। তার মানে ছোঁয়া প্রায় পাঁচ মিনিট লেইট।ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চায়তেই সাহারিয়ারের ক্লাসে বিঘ্ন ঘটে। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে তাকায় সাহারিয়ার ওরফে স্বাধীন । যখন দেখে বিরক্ত করা মেয়ে টি আর কেউ নয় ছোঁয়া নিজে,তখন ওর রাগটা যেন আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়।
কপাল কুঁচকে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। আগাগোড়া একবার পরখ করে নিয়ে মুখ খুলে সাহারিয়ার।
“ইউ ষ্টুপিড গার্ল! কয়টা বাজে এখন? ক্লাসের সময়ের দিকে মনোযোগ থাকে না? “ধমক দিয়ে বলল স্বাধীন।
“স সরি স্যার।আসলে কলেজে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আর এমন হবে না।”
মুখটা নীচ দিকে করে শুকনো মুখে বলে ছোঁয়া।
“আচ্ছা আর হবে না ঠিক আছে, বাট এখন যে বিষয় টা পড়ানো হচ্ছিল তুমি তা বোর্ডে লিখে দেখে।পাঁচ মিনিট লেইট অলরেডি, আর এখন এসে বলছো আর হবে না।যাও এতোক্ষণ যা বুঝিয়েছি তা বোর্ডে লিখে দাও।”ধমক দিয়ে বলল স্বাধীন।
ভয়ে অনেক টা আড়ষ্ট হয়ে গেলো ছোঁয়া। ভয়ে ওর মুখটা র ক্ত শূন্য হয়ে গেলো। শুধু ঝরঝর করে কেঁদে দেওয়ায় বাকি।
“কি হলো যাও বলছি বোর্ডে, লিখে দাও।”দ্বিগুণ ধমক দেয় স্বাধীন।
ভয়ে ভয়ে ছোঁয়া বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখে আজকের পড়ার যে শিরোনাম বোর্ডে লেখা আছে তা সে গতকাল রাতেই পড়ে ঘুমিয়েছিল।অনেক টা সাহস পায় ছোঁয়া। হাতে মার্কার পেন টা নিয়ে এগিয়ে যায় বোর্ডের দিকে। যতটুকু মাথায় আসছে পুরোটায় সুন্দর করে গুছিয়ে লেখে বোর্ডে। লেখার সময় ওড়না টা সরে আসে সকালে পড়া হাতের কালসিটের ওপর থেকে। স্পষ্ট দেখা যায় কতোটা নির্দয় ভাবে হাতটাকে মোচড়ে ধরা হয়েছিল।
কোনরকমে ক্লাস টা শেষ করে বাইরে আসে ছোঁয়া। একে একে সব ক্লাস করে যখন বাড়িতে আসে তখন দেখে স্বাধীন আগে থেকেই এসে ড্রয়িং রুমে বসে আছে। ছোঁয়া শুকনো মুখে নিজের রুমের দিকে চলে যেতে লাগে।তখনই কানে আসে বহু আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বর টা।
“কলেজে গিয়ে কোথায় ঘুরতে যাস তুই? ঠিক মতো ক্লাসে আসতে পারিস না।নাকি বন্ধু টন্ধু জুটিয়ে নিয়েছিস?”টেলিভিশনের দিকেই তাকিয়ে থেকে বলল স্বাধীন।
“আমি আসলে আজ বাড়ি থেকে বের হতেই একটু দেরি করে ফেলেছিলাম ভাইয়া।তুমি বড় মা কে বলে দেখো।”
মাথা নিচু করে বলে ছোঁয়া।
তার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছু বলে না স্বাধীন। কারণ সে ভালো করেই জানে ছোঁয়া মিথ্যা কথা বলে না।
গভীর রাত,ছোঁয়া ও ঘুমে কাতর।ঘুমের মাঝেই ছোঁয়া অনুভব করে, কে যেন খুব যত্ন করে ওর কালসিটে পড়া জায়গা টা ছুঁয়ে দিচ্ছে। সকালে ছোঁয়া ঘুম থেকে ওঠে দেখে হাতে মলম লাগানো। আর ব্যথাও অনেক কমে গেছে। বেডের পাশে টেবিল টায় পায় পেইন কিলারের কৌটা।অবাক হয় ছোঁয়া। এই কৌটা টা সে কোথায় যেন দেখেছে,কিন্তু কোথায় তা মনে করতেই নিজে নিজেই বলে ওঠে “না না এটা হতে পারে না।এটূ আমার স্বপ্ন বৈ কিছুই না।হয়তো বড়মা এসেছিল ঘরে। ”
চলবে,,,,,