এ-কেমন ভালোবাসা #পর্ব-৪,০৫

0
1640

#এ-কেমন ভালোবাসা
#পর্ব-৪,০৫
#মাসুরা-খাতুন
০৪

“কি ব্যাপার স্বাধীন, তুই ওমন করছিস কেন? ও একটু তোর বইটা নিয়েছে পড়ার জন্য, তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? ”

“আমার কোন জিনিসে অন্য কেউ হাত দিক তা আমি পছন্দ করিনা।সেটা তোমরা জানোনা? ও কেন হাত দেবে আমার বইয়ে। ”

রেগেমেগে বলল স্বাধীন।

“ও অন্য মানুষ নয় স্বাধীন। ওর সম্পুর্ন অধিকার আছে তোর এসব জিনিসে হাত দেওয়ার। ”

“অধিকার!কিসের অধিকার? আমি দিয়েছি ওকে অধিকার? ওকে কোন রকম অধিকার আমি দেইনি।তোমরা ওকে মাথায় তুলে রাখতে পারো,কিন্তু আমার বিষয়ে নাক গলাতে ওকে মানা করবে।”

“কিসের অধিকার তুই জানিসনা।তুই ওকে অধিকার দে আর না দে, কিন্তু ওর সবরকম অধিকার আছে তোর সব বিষয়ে কথা বলার।”

“হ্যাঁ, আমি সত্যিসত্যিই জানিনা।কিসের অধিকার ওর বলো? আমি ও শুনতে চাই।”

মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল স্বাধীন।

“তুই বোধহয় ভুলে গেছিস ছোঁয়া তোর বিবাহিতা স্ত্রী। তুই মানিস আর না মানিস।এটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।”

“হা হা,,,মা তুমি হাসালে ঐটা কি সত্যিই বিয়ে ছিলো? পুতুল খেলার মতো দুটো ছেলে মেয়েকে বসিয়ে বিয়ে পড়ানো।যেখানে বিয়ে মানে কি দুজনের কেউই ভালোমতো বুঝে না। একবারও আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না?”

তিরস্কারের হাসি হেসে বলল স্বাধীন।

“তোর তখন মত ছিলোরে স্বাধীন। আর তোর দাদিমা ও এটায় চেয়েছিলেন।”

ছেলেকে বোঝাতে বলল সাহানা বেগম।

“আমার মত ছিলো? আদৌও কি মত ছিলো মা? যখন বিয়ে মানে কি সেভাবে জানতামই না,সেই বয়সে বড়রা তোমরা যা বললে মজার ছলে আমিও তায় মেনে নিলাম। আর এটায় কি আমার চাওয়া হলো মা? এতো টা তাড়া না দিলেও তো পারতে।আমাদের একটু সময় ও দিলে পারতে,ব্ড় হওয়া পর্যন্ত। ”

“ওভাবে বলিস নারে বাবা।সেসময় তোর দাদির শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো,বয়ষ্ক মানুষ।এদিকে ছোঁয়ার বাবা মার ও চলে যাওয়া সব মিলিয়ে ছোঁয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে তোর দাদিমা খুব ভেঙে পড়েছিলেন।সেসময় এটা করা ছাড়া কোন উপায় ছিলো নারে বাবা।আর তায় তোর দাদিকে বোঝাতে, উনাকে সান্ত্বনা দিতে আমরা সেটাই করি যেটা ছোঁয়ার জন্য ভালো,যেটা তোর জন্য ভালো হয়।”

“ব্যস মা, ব্যস।এতোটুকুই বলো।ছোঁয়ার জন্য ভালো এটায় বলো,এখানে আর আমাকে টানতে এসোনা।আমার কতোটা ভালো করেছো তা বোঝাই যাচ্ছে। ”

“কেন রে বাবা।ছোঁয়ার দোষটা কোথায়? ও খুব ভালো মেয়ে। এমন মেয়ে তুই কোথায় খুঁজে পাবি? আর এভাবে বললে তোর দাদির আত্মা কষ্ট পাবে রে।”

আকুল হয়ে বলে সাহানা বেগম।

“আমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে মা।তোমরা সবাই মিলে আমার সাথে অন্যায় করেছো।নিজের জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্ত নিতে এতোটুকু ভাবতে ও দাও নি তোমরা আমায়।আমার ভালো লাগছে না,আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ। নইলে আমি এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবো।”

এতোক্ষণ যাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল সেই ছোঁয়া ভয়ে সাহানা বেগমের পেছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো।কথাগুলো যে বিশেষ ভালো লাগছিলো তা নয়।বরং বিশ্রী একটা অনুভূতি ঘিরে ধরছিল ওকে।এতোক্ষণে মুখ খুললো ছোঁয়া,

“বড়মা প্লিজ চুপ করো।আমার ভালো লাগছে না।খুব বিরক্ত লাগছে আমার এই কথা গুলো শুনতে।তোমরা যদি এই বিষয় গুলো নিয়ে কথা বলতে থাকো তাহলে কিন্তু আমি সত্যি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

বলেই নিজের রুমের দিকে চলে গেলো ছোঁয়া।

বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে ছোঁয়া। স্বাধীনের মনোভাব ও কিছুই বোঝে না। এইমাত্র দুপুরে স্বাধীনের দেওয়া প্যাকেটটা খুললো।তিনটি বোরকার সাথে সেই লেহেঙ্গাটাও আছে,যেটা ছোঁয়া মলে বারবার দেখছিল।কেন এমন করে স্বাধীন ভাই? ছোঁয়া কি দেখতে এতোটাই কুৎসিত? গায়ের রং টায় শুধু উজ্জ্বল ফর্সা নয়।এছাড়া কোন খামতি ওর ভেতর আছে বলে তো মনে হয়না।বারবার আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ছোঁয়া। উজ্জ্বল শ্যামা রঙের মায়াবী মুখ টা যেকোনো পুরুষের মনে প্রেম জাগাতে যথেষ্ট। টানাটানা চোখ দুটো যেন কোন পদ্মপুকুর।হাসলে যখন গালে টোল পড়ে তখন কোন অপ্সরীর থেকে কম লাগে না ওকে।কিন্তু মেয়েটির দুর্ভাগ্য যে, যেই মানুষটা ওর সবটা জুড়ে আছে সেই মানুষটার চোখেই ও অযোগ্য, বড়ই ফেলনা।একটু বড় হবার পর থেকেই শুনে আসছে স্বাধীন ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। চার বৎসর বয়সে ওর মা বাবা মারা যায়।তাদের কথা কিছুই মনে নেই ছোঁয়ার।ছোটবেলা থেকেই মা হিসেবে বড়মা কে দেখে আসছে ছোঁয়া।দাদির কথা কিছুটা মনে আছে ওর।ওর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন দাদি মারা যান। স্বাধীন তখন বারো তেরো বৎসরের। দাদি মারা যাওয়ার আগে একদিনের কাহিনী ওর আজো আবছা আবছা মনে আছে।ছোট্ট পাঁচ বৎসরের ছোঁয়ার জন্য সেদিন বড়মা লাল টুকটুকে একটা শাড়ি কিনে এনে দিয়েছিলো।আর ওর মায়ের আর বড়মার গয়না মিলে অনেক গয়না চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছোঁয়া তো তখন মহা খুশি। ওকে এতো গয়না,লাল শাড়ি দেওয়া হয়েছিল বলে। আর স্বাধীন ভাইয়া কেও সেদিন পাজামা পাঞ্জাবী পড়ানো হয়েছিল। ওদের নাকি বিয়ে। দুজনেই খুব হাসি খুশি হয়ে বড়মার কাছ থেকে সাজিয়ে নিয়েছিলো।ওদের পুতুলের বিয়ের দিনে যেমন পুতুল কে অনেক সাজায় ছোঁয়া, তেমন একটা মজার বিয়ে যে ওর ও হবে তা ভাবতেই নেচে উঠছিল ওর মন।স্বাধীন ভাইয়া ওর বর পুতুলটার মতোই বর সেজেছিল।তারপর বাসায় ওদের প্রিয় রান্না গুলো করে বড়মা।একজন মুরব্বি মতো লোক আসলেন।তারপর ওদের একসাথে বসিয়ে কি কি বললো লোকটা।তারপর যখন ওকে যখন বললো স্বামী হিসেবে কবুল? পাশ থেকে বড়মা বলে “ছোঁয়া মা কবুল বলতে হয়,বলো?”তখন হেসে ওঠে ছোঁয়া বলেছিল “কবুল”।এভাবে তিনবার ও কবুল বলেছিল,আর স্বাধীন ভাইয়া ও তিনবার বলেছিল।লোকটি যাওয়ার সময় ওদের দুজন কে বলে গিয়েছিলো,”আজ থেকে ধর্মীয় মতে তোমরা স্বামী স্ত্রী। ”

সেদিনের সেই কঠিন কথা গুলো কোনটায় বোধগম্য হয়েছিল না ছোঁয়ার।কিন্তু কে জানতো সেদিনের সেই কথা গুলোয় কাল হয়ে দাঁড়াবে ওর জীবনের। দাদিমা যে নিজের নাতনির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গিয়ে কতোটা অনিশ্চিত করে গেছেন, তা হাড়ে হাড়ে টের পায় ছোঁয়া।

তারপর ও কিছু বছর স্বাধীন ভাই ভালোই ছিলো।ওর সাথে খেলতো,বেড়াতে যেতো,ওর বায়না মেটাতো।কিন্তু সমস্যা হলো যখন স্বাধীন ভাইয়া ক্লাস নাইনে টেন উঠলো।তারপর থেকেই কেমন এড়িয়ে চলা শুরু করলো ওকে।অনেক বন্ধুবান্ধব হতে থাকলো ভাইয়ার।কলেজে যাওয়ার পর থেকে স্বাধীন একেবারে কথা বলায় ছেড়ে দিতে থাকলো ছোঁয়ার সাথে। দুজনার দূরত্ব বাড়তে থাকলো।ছোঁয়া যতোই স্বাধীনের সাথে মেশার চেষ্টা করতো স্বাধীন ততোই এড়িয়ে যেতো।সবকিছুতেই ভুল ধরা শুরু করে।রাগারাগি, ধমক দেওয়া,এমনকি গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত বাকি থাকেনা।আস্তে আস্তে ছোঁয়া ও ভয় পেতে থাকে স্বাধীন কে।কিন্তু মনে মনে ও স্বাধীন কে ভিষণ ভালোবাসতে শুরু করে। যতোই ভুলে যেতে চেষ্টা করে তবুও মনে পড়ে বয়ষ্ক লোকটার কিছু কথা, “স্বামী হিসেবে কবুল? “”আজ থেকে তোমারা ধর্মীয় মতে স্বামী স্ত্রী। ”

চোখের পানি মুছে ছোঁয়া বড়মার ঘরের দিকে যায়।মানুষ টা অনেক কষ্ট পেয়েছে স্বাধীন ভাইয়ার কথা গুলো শুনে।তায়তো ছোঁয়া এখন নিজেকে দুর্বল দেখালে আরো ভেঙে পড়বেন বড়মা।

গায়ে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছেন সাহানা বেগম।পাশেই আলম চৌধুরী অফিসের কাগজ পত্র দেখছেন।মুখটা হাসি হাসি করে গেল ছোঁয়া।

“বড়মা খুব ক্ষুধা লাগছে গো,চলোনা খেতে দাও।”

ছোঁয়ার গলা শুনে ওঠে বসলেন সাহানা বেগম।

“ছোঁয়া এসেছিস?বস রে মা”

“না না বড়মা বসতে পারবো না,খুব ক্ষুধা লাগছে খাবার দাও।”

“তোর কতো ক্ষুধা লাগছে তা আমি জানি।আমার সামনেও নাটক করতে হবে না।”

পাশ থেকে আলম চৌধুরী বলে উঠলেন,

“এই ছোঁয়া, তোর বড়মাকে বলে দে,আলম চৌধুরী এখনো বেঁচে আছে। তার মেয়ের ভবিষ্যৎ সে নিজেই ঠিক করতে জানে।ঐ লো প্রেসারের রোগী কে এতো চিন্তা করতে হবে না।একটু টেনশন করলেই তো আবার হাত পা উল্টে পড়বে থাকবে”

পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বললেল।

হেসে উঠলো ছোঁয়া। পাশ থেকে সাহানা বেগম বলে উঠলেন,

“এই ছোঁয়া, ঐ ডায়াবেটিসের ভদ্রলোক কে বলো দে তো,প্রেসার লো আমার প্রতিদিন থাকে না,আর উনার যে প্রতিদিন ফার্মেসী, ঔষধ, হাটাহাটি করে বেড়াতে হয়? তার বেলা কি?”

এভাবেই দুটো মধ্য বয়স্ক মানুষ নিজেদের অভিযোগের ঝুলি খুলে বসে।ছোঁয়া বারেবারে অবাক হয়।কিসের জোরে, কিসের মন্ত্র বলে দুটো মানুষ এই বুড়ো বয়স পর্যন্ত একসাথে আছে? কোন সুতো বেধে রেখেছে উনাদের? ঐ একই সুতো তো ছোঁয়া কে আর স্বাধীন কে বাঁধতে পারেনা? স্বাধীন কে জড়াতে পারেনা ছোঁয়ার মায়ায়।ছোঁয়ার ও বড্ড ইচ্ছে, বড়আব্বু বড়মার মতো সেও স্বাধীন ভাইয়ার সাথে একসাথে বুড়ো হবে।একই লাঠিতে ভর করে চলবে ওরা দুজন।

ক্লাস শেষে ছোঁয়া আর কেয়া বসে আছে কলেজের গেইটে। দুজনেরই ইচ্ছে আজ আইসক্রিম খাবে।তায়তো আইসক্রিমের দোকানের দিকে যাচ্ছিলো ওরা।এরই মাঝে ওদের সাথে এসে যোগ হয় লাবিব।লাবিব ওদের ইয়ারেরই।ভিষণ মিশুকে টাইপের ছেলে।ছোঁয়া আজ বোরকা পড়ে আসায় সে নাকি প্রথমে চিনতেই পারেনি,সেই নিয়েই হাসছিলো তিনজন। আইসক্রিম ওয়ালা মামার কাছ থেকে ছোঁয়া ওর পছন্দের ভ্যানিলা আইসক্রিম নিলো।আর কেয়া আর লাবিব নিলো ম্যাংগো ফ্লেভার।তিন বন্ধু মিলে খুব মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছিল আর কথা হচ্ছিল কেয়ার বিয়ে নিয়ে। কেয়ার বিয়ের দিন ছোঁয়ার মতোই একটা বোরকা কেয়া কে আর লাবিব কে পড়ানো হবে।তারপর বাসরে দুজনকেই রেখে বরকে বলবে কোনটা বউ? সেটাকে নিয়েই বাসর ঘরে যেতে।যদি কেয়াকে পায়, তাহলে ওদের বাসর হবে।আর যদি লাবিব কে পায় তাহলে ওদের বাসরে লাবিব কেও রাখতে হবে।মানে ওদের আর সেদিন বাসর করা হবেনা।এসব বলেই হা হা করে হেসে উঠলো তিন বন্ধু। কিন্তু ছোঁয়ার হাসি যে সবসময় স্থায়ী হয়না তা অক্ষরে অক্ষরে টের পায় ছোঁয়া। দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই একজোড়া চোখ বেশ বিরক্তি নিয়ে দেখে যায় ওকে।ছোঁয়া ও খেয়াল করে সেই র ক্ত চক্ষুর অধিকারি কে।বন্ধুদের খুব তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়েই বাড়ি যায় ছোঁয়া । কিন্তু সব কিছু ঠিকই আছে।স্বাধীন কেও অন্যান্য দিনের মতোই চুপচাপ মনে হয়। কিন্তু রাতে যখন ছোঁয়া নিজের রুমে ছিলো তখন বাইরে থেকে ডাক আসে স্বাধীনের।আলম চৌধুরী আর সাহানা বেগম অনেক আগেই নিজেদের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে।এই সময় স্বাধীনের ডাক পেয়ে ছোয়ার অন্তর কেঁপে ওঠে,,,,,,,

চলবে,,,,,,,

#এ-কেমন-ভালোবাসা
#পর্ব-৫
#মাসুরা_খাতুন

স্বাধীনের ডাক পেয়ে তড়িঘড়ি ছোঁয়া ছুটে গেলো স্বাধীনের ঘরে। যদিও একটু ভয় লাগছিল যে আবার হয়তো কিছু নিয়ে রেগে যাবে, কিন্তু তার পরেও তো যেতে হবে। যদি কিছু দরকার পড়ে স্বাধীনের।স্বাধীনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো ছোঁয়া,
“আমায় ডেকেছিলে ভাইয়া?”
“হ্যাঁ ভেতরে আয়।”স্বাধীনের এমন শান্ত ভাবে কথা বলে ভেতরে যাওয়ার অনুমতিতে ছোঁয়া কিছু টা আশ্চর্য হলো।হটাৎ এক ভালো লাগার ছোঁয়ায় ঘিরে ধরলো ওকে।স্বাধীন ভাই ওকে ভেতরে ডাকছে? তাও আবার এতো শান্ত স্বরে।গতকালকের স্বাধীনের বলা সেই কথা গুলো কিছুসময়ের জন্য ভুলে গেলো ছোঁয়া ।
ধীর পায়ে ভেতরে গেলো ছোঁয়া। চোখে এখনো অবিশ্বাস।
“কিরে আয়? বোস।”
ল্যাপটপের ওপরে চোখ রেখেই বলল স্বাধীন।
ছোঁয়া গিয়ে দাঁড়ালো স্বাধীনের ঘরে। ও ভাবতেই পারছেনা স্বাধীন ভাই ওর সাথে এতোটা শান্ত হয়ে কথা বলছে।এটা কি ওর ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন? নাকি সত্যি। ভালো করে চোখ দুটো কচলে নেয় ছোঁয়া। এরই মাঝে স্বাধীন ল্যাপটপ অফ করে পাশে রেখে ওঠে দাঁড়ায়। এক পা দুপা করে একদম ছোঁয়ার কাছে চলে যায়। দুহাত রাখে ছোঁয়ার দু কাঁধে। শিহরিত হয় ছোঁয়া। খানিকটা কেঁপে ওঠে। যেই হাতের এতোটুকু আদুরে স্পর্শ পাওয়ার জন্য ও এতোকাল অপেক্ষা করেছে,অথচ সেই হাতের আঘাত ছাড়া কিছুই পায়নি ও।আর আজ এতো রাতে সেই প্রাণপুরুষ নিজে থেকেই আহ্বান করে ওকে ডেকে নিয়ে ছুঁয়ে দিলো ওকে?
ছোঁয়া চোখ দুটো বড়বড় করে তাকায় স্বাধীনের দিকে।
স্বাধীন দুহাত দিয়ে ছোঁয়ার কাঁধ ধরে ওকে সোফায় বসায়।
“তুই এখানে বস,আমি আসছি।”
বলেই স্বাধীন কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যায়।আর একটু সময় পর ফিরে আসে হাতে মাঝারি আকারের একটা বাক্স নিয়ে। ছোঁয়া অবাকের পর অবাক হয়।বাক্স টা এনে রাখে ছোঁয়ার সামনে টেবিলে।
“কিরে তোর না আইসক্রিম খেতে ভালো লাগে? খুব তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের সাথে আইসক্রিম খাস,এই নে, আইসক্রিম খা? ”
বলেই খুব যত্ন করে প্যাকেটটা খুলে স্বাধীন। তারপর বের করে অনেক গুলো আইসক্রিমের প্যাকেট।অনেক ফ্লেভারের আইসক্রিম। ছোঁয়া অবাক হয়।স্বাধীন কি ওর পছন্দ বলে আইসক্রিম এনে দিলো নাকি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়ায় কথা শোনালো,তার কিছুই বুঝলো না ছোঁয়া।
“ভাইয়া আমি তো এতো আইসক্রিম খেতে পারবো না।”
ছোট ছোট করে বলল ছোঁয়া।

ছোঁয়ার কথা শুনে ধক করে জ্ব লে উঠলো স্বাধীনের দুটি চোখ।
“পারবিনা মানে? অবশ্যই পারবি।সবগুলো আইসক্রিম খেতে হবে তোকে।এখানে পঞ্চাশ টা আইসক্রিম আছে।গুনে গুনে পঞ্চাশ টায় খেতে হবে তোকে।নে শুরু কর।”
দাঁত কিড়মিড়ে বলল স্বাধীন।

“কিন্তু এতোগুলা আইসক্রিম খেলে তো আমার ঠান্ডা লেগে যাবে ভাইয়া? তুমি তো জানো আমার ভিষণ ঠান্ডা লাগার অভ্যাস।”
করুন স্বরে বলল ছোঁয়া।
“কেন সেই কথা কি রাস্তায় ছেলেদের সাথে আইসক্রিম খাওয়ার সময় মনে ছিলো না? খুব তো হেসে হেসে খাচ্ছিলি।এখন শুরু কর বলছি, নাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
চোখ পাকিয়ে বলল স্বাধীন। ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটোয় ভিষণ হিং* স্রতা।
ভয়ে ভয়ে ছোঁয়া খাওয়া শুরু করে। কারণ ও জানে, একবার যখন স্বাধীন বলেছে তখন আর না করে লাভ নেই। মিছে তর্ক করে ওকে আরো রাগিয়ে দেওয়ার থেকে ভালো,ও যা বলেছে তা মেনে নেওয়া।
একটা একটা করে আইসক্রিম খাওয়া শুরু করে ছোঁয়া। প্রথম গুলো ভালো লাগলেও আস্তে আস্তে ওর ঠোঁট অসাড় হয়ে আসে।বেশ কয়েকটা খাওয়ার পরে ওর শরীর ঠান্ডা বরফের মতো হতে থাকে।পাশেই বসে আছে স্বাধীন। তার চোখের হিং স্রতা মাপা কঠিন।এতোটুকুও মায়া কাজ করছে কিনা সন্দেহ।
“কিরে ভালো লাগছে না? মুখ টা ওমন করছিস কেন? রাস্তার ঐ ছেলেটার সাথে দাঁড়িয়ে তো খুব মজা লাগছিল,আর এখন খেতে বুঝি মজা লাগছে না।”
মুখে ডেভিল হাসি নিয়ে বলে স্বাধীন।
ছোঁয়ার চোখ দুটো কেমন ভার ভার লাগছে। ওর জ্বর আসছে,নাকি জ্ঞান হারাচ্ছে বুঝতে পারে না ও।
“আমার খুব ঠান্ডা লাগছে ভাইয়া।ভালো লাগছে না খেতে। ”
লাল টকটকে চোখ দুটো টেনে তুলে বলল ছোঁয়া ।

“কেন ভালো লাগছে না? তোর না আইসক্রিম খাওয়ার সখ? তোর সাহস কি করে হলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে আইসক্রিম খেতে।”
ছোঁয়ার দুটো গাল নিজের হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বলল স্বাধীন।

“ওটা আমার বন্ধু ভাইয়া।আমরা একই ইয়ারের।তুমি খেয়াল করোনি হয়তো।”
“চুপ কর বেয়াদব মেয়ে! এরপর আর কখনো যদি কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখি তোকে তাহলে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”ধমক দিয়ে বলল স্বাধীন।
কিন্তু ছোঁয়া কি আদৌও ওর কথা শুনতে পাচ্ছে কি না তার কোন খেয়াল নেই ওর।
“তুই ভালো করেই জানিস আমার কোন জিনিসে আমি অন্য কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না।সেখানে আমার সবথেকে প্রিয় জিনিস টায় কারো সংস্পর্শে যাবে সেটা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না।”
রাগে জ্ব* লতে জ্ব*লতে কথা গুলো বলে স্বাধীন তাকিয়ে দেখে ছোঁয়া একদম বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।তড়িঘড়ি ছোঁয়া কে কোলে তুলে নেয় স্বাধীন। খুব যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয় ছোঁয়া কে।ওর গা খুব গরম হয়ে আসছে।মনে হয় জ্বর এসেছে। ছোঁয়া শুধু অজ্ঞান অবস্থায়ই কাঁপতে থাকে।পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। স্বাধীন ওকে শুইয়ে দিয়ে ওটার সময় ছোঁয়া আরো খানিকটা আঁকড়ে ধরে ওকে।শার্টের কলারটা খিমচে ধরে আছে।স্বাধীন ও ওঠে না।কিছুক্ষন খুব জড়িয়ে ধরে রাখে ছোঁয়া কে।খুব যত্ন করে আগলে রাখে নিজের প্রিয়তমাকে।খুব পবিত্র লাগছে দেখতে ছোঁয়া কে।স্বাধীন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। টুপ করে একটা ঠোঁটের স্পর্শ একে দেয় ছোঁয়ার কপালে।না এই মেয়ের সাথে এভাবে থাকা সম্ভব নয়।এই মেয়ের মায়া আছে, ভিষণ মায়া।স্বাধীন নিজের কন্ট্রোল হারাবে।ওর এতোদিনে জিইয়ে রাখা জেদ,রাগ সব উবে যাবে।নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হয় স্বাধীন।কাকে ও এতো কাছে নিয়ে আছে? এই মেয়েকে? কি হয় ওর মাঝে মাঝে নিজেই বুঝতে পারে না।যেই মেয়েটা ওর সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, এমন কি ওর নিজের বাবা মার ভালোবাসায় ও ভাগ বসিয়েছে। ওর কিশোর জীবনের আবেগ,যৌবনের আকাংখা,আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের মতো বিন্দাস লাইফ, কোনটায় উপভোগ করতে পারে নি ও শুধু মাত্র এই মেয়ে টার জন্য। যখনই অন্যন্য বন্ধুদের মতো প্রেম ভালোবাসায় নিজেকে জড়াতে চেয়েছে, কোন মেয়ে কে ভালো লেগে প্রেমপত্র দিতে চেয়েছে তখনই অদৃশ্য ভাবে বাঁধা দিয়েছে এই মেয়ে টি।বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠেছে এই মায়া জাদু করা মেয়ে টির মুখশ্রী। আর সেদিনের সেই বয়ষ্ক লোকটার কথা,”আজ থেকে ধর্মীয় মতে তোমরা স্বামী স্ত্রী। ”
উফ,এই কথাটা তো ও স্বিকার করে না।তাও কেন ঐ কথাটায় ওর প্রত্যেকটা কাজে কর্মে বাধা দেয়।বোঝে না স্বাধীন। সব দোষ এই মেয়েটির।আবারও পুরোনো রাগে ভরে ওঠে স্বাধীনের মন।সাথে সাথেই ছোঁয়ার কাছ থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে নেয় নিজেকে। অবচেতন ছোঁয়া কে ডাক দিয়ে তুলে কোন রকমে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেয়।তারপর ওভাবেই কোলে করে নিয়ে যায় ছোঁয়ার রুমে। বিছানায় রেখে কম্বলটা দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দেয় ছোঁয়ার শরীর। তারপর আলো নিভিয়ে চলে যায় নিজের রুমে। সে রাতে আর স্বাধীনের চোখে ঘুম আসে না।সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে ব্যালকোণিতে কাটিয়ে দেয় সারারাত।মাঝে মাঝে গিয়ে উঁকি দিয়ে আসে ছোঁয়ার রুমে।মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। জ্বর টাও খানিকটা কমে যায় শেষ রাতের দিকে।
স্বাধীনের ও শেষরাতের দিকে চোখ লেগে আসে।ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে ও নিজেও।
চোখ খুলে ছোঁয়া নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করে।গতরাতের স্বাধীনের হিং*স্র তার কথা মনে পড়ে সাথে সাথেই।দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা পানি। কাল যখন নরম কণ্ঠে স্বাধীন ওকে ডেকেছিল,কতোকিছুই না ভেবেছিল ছোঁয়া। হয়তো স্বাধীন গতকাল বলা কথার জন্য সরি বলবে ছোঁয়া কে।অথবা বলবে ”ছোঁয়া কাল ওগুলো আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি রে।তুই মন খারাপ করিসনা”কিন্তু সেই দিন আসে না ছোঁয়ার জীবনে।প্রিয় মানুষটির মুখে দুটো ভালো কথা শোনার কপাল ছোঁয়ার নয়।যখন স্বাধীন ছোঁয়া কে স্বীকারই করে না, তাহলে ছোঁয়া কার সাথে মিশলো,কোন ছেলের সাথে কথা বলল এগুলোতে এতো গায়ে লাগে কেন? কই ছোঁয়া তো দেখতে যায় না ও কার সাথে মিশলো,কার সাথে কথা বলল।এসবই ভাবতে থাকে ছোঁয়া। আর বিসর্জন দিতে থাকে অজস্র অশ্রুকণা।
অথচ অবচেতন ছোঁয়া জানতে ও পারলো না যে ওকে শাস্তি দিয়ে আর একটি প্রেমিক মন কিভাবে নিজেকে পু ড়িয়েছে।সারারাত জেগে জেগে নিজের প্রিয়তমা কে পাহারা দিয়ে রাতের প্রতিটি প্রহর কাটিয়েছে।কিন্তু মজার কথা হলো সেই প্রেমিক পুরুষ টি নিজেও জানেনা যে সে নিজেও প্রিয়ার দহনে দ গ্ধ হচ্ছে। তারমনেও যে প্রতিটি কোণায় কোণায় ওই একরত্তি মেয়ের বসবাস, সেটা সে নিজেও মানতে নারাজ,,,,,

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here