এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ৩
ফারজানা আহমেদ
রোহিতা কোচিংএ ভর্তি হয়েছে। সোহেলই ভর্তি করিয়েছে। তার বন্ধুর কোচিং। মাঝেমধ্যে সে নিজেও এসে ক্লাস করায়। ক্লাসের সময়সীমা বিকেল তিনটা হতে পাঁচটা৷ ছেলে আর মেয়েদের আলাদা ব্যাচ। আজ রোহিতার সাথে নিহিনও এসেছে। নিহিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যতোদিন লেখাপড়া করবে ততোদিন রোহিতার সাথেই থাকবে। রোহিতা আসমানে গিয়ে ক্লাস করলেও সেও আসমানে যাবে।
ক্লাস শেষের পথে। আজকের হিসাববিজ্ঞান ক্লাসটা সোহেল করাচ্ছে। সেই ক্লাসের শুরু থেকে যে নিহিন সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে, ক্লাসের শেষ পর্যন্তও এক ধ্যানে তাকাচ্ছে। রোহিতার কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে নিহিনকে। ক্লাস শেষে সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সোহেল রোহিতাকে ডেকে বলল, একটু দাঁড়া। কথা আছে।
রোহিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে নিহিনও দাঁড়ালো। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর সোহেল নিহিনকে বলল, তুমি একটু বাইরে যাও তো নিহিন।
– কেন? বাইরে একা দাঁড়াতে ভালো লাগে না, স্যার।
– পাঁচ মিনিট মাত্র। তোমাকে কেউ টেনে নিয়ে যাবে না। মানে নিয়ে যেতে পারবে না। সেই শক্তি কারোর নেই।
নিহিন অসহায় মুখ বানিয়ে বলল, স্যার আপনি আমাকে…
সোহেল বাইরে ইশারা করে হালকা ধমকে বলল, বাইরে যাও।
নিহিন চুপচাপ বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। রোহিতা সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলল, বলো কী বলবে।
– এই জোকারটা কি রাতেও তোর সাথে পড়বে?
– তুমি ওকে এভাবে জোকার ডাকো কেন?
– আমার কাছে জোকারই লাগে। বলে দিবি, এভাবে যেন না তাকায়।
– আচ্ছা।
– আর শোন, আগামী দিন থেকে নিকাব পরে আসবি। তোকে যেন আমি নিকাব ছাড়া না দেখি।
রোহিতা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, মানে কী?
সোহেল ভ্রুকুটি করে বলল, বাংলা বুঝিস না?
– এবার যাই?
– যা। আর আমি চাই না আমি তোকে যখন পড়াব তখন অন্য কেউ থাকুক।
রোহিতা হেসে বেরিয়ে গেল। বাইরে নিহিন গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোহিতাকে দেখে হাঁটতে হাঁটতে বলল, এই পাঁচ মিনিট? তোরা এতোক্ষণ কী কথা বললি?
– তোকে কেন বলব?
– কারণ আমি তোর সোহেল ভাইর ওপর ক্রাশড।
রোহিতা হাঁটা থামিয়ে নিহিনের দিকে তাকাল। নিহিন বলল, কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?
– তোর সমস্যা কী?
– কই?
– তুই রিলেশনশিপে আছিস। তাহলে সোহেল ভাইর দিকে তোর নজর কেন?
নিহিন চমকে উঠল। রোহিতা কী করে জানল যে নিহিন প্রেম করছে? সে সতর্ক ভাবে জিজ্ঞেস করল, কে বলল?
– তোর মোবাইলেই দেখলাম একটু আগে। তোর জান কল করেছে। কলিং এ তোদের কাপল পিক ও দেয়া।
কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো নিহিন। হেসে হেসে বলল, হ্যাঁ ওটা তো রিয়েল। একটু টাংকি মারার জন্য তোর সোহেল ভাইর দরকার ছিল আরকি।
রোহিতা চোখ গরম করে হাঁটা শুরু করে বলল, সোহেল ভাই টাংকি মারার মতো মানুষ না।
নিহিন সরু চোখে তাকালো রোহিতার দিকে। তারপর টেনে টেনে জিজ্ঞেস করল, তুই উনাকে ভালোবাসিস তাইনা?
রোহিতা ধাক্কা খেলো, কিন্তু হাঁটা থামাল না। গতি ধীর করল। নিহিন আবার বলল, চুপ করে আছিস কেন? আমি তো তোর বান্ধবী। আমাকে বলতে পারিস।
– বাড়ি চল। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
নিহিন আর কিছু বলল না। চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
____________
খলিল চৌধুরী একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। কাজের কারণে সাত মাসের জন্য উনাকে নারায়ণগঞ্জ যেতে হয়েছে। তাই নিহিন আর নিলুয়া বেগম বলতে গেলে এখন একাই থাকেন। খলিল চৌধুরী বিয়ে করেছেন দেরিতে৷ তাই সন্তানও দেরিতে পেয়েছেন। ছেলেটা লনডনে, ঠিকমতো রোজগার করতে পারছেনা। সেজন্য উনাকে এখনও চাকরি করতে হচ্ছে। ছেলের কথা মনে হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নিলুয়া বেগম। তার জীবনটা কেমন যেন শুকনো পাতার মতো হয়ে গেছে। একটু চাপ খেলেই মুড়মুড় করে গুড়ো হয়ে যাবেন। নিহিন তো সারাদিনই থাকে রোহিতার সাথে৷ নিলুয়া বেগম অসুস্থ শরীর, কোমরে ব্যথা নিয়ে সারাদিন আস্তে আস্তে কাজ করেন। কষ্ট করে খাবার বানান। তার জীবনের চাপা কিছু কষ্ট আছে যা কেউ জানে না। আল্লাহ তার কপালে এমন কিছু রাখবেন, এটা তিনি জানতেন না।কী পাপের ফল এটা? উনি কি মারাত্মক কোনো পাপ করেছেন? যার কারণে আর এই চাপা কষ্ট উনাকে খুড়ে খুড়ে খাচ্ছে। কাউকে বলতেও পারছেন না, আবার সহ্যও করতে পারছেন না। টেবিলে খাবার রেডি করে বাইরে বেরোলেন তিনি। উঠোন পেরিয়ে রোহিতাদের ঘরের সামনে গিয়ে হাঁক ছেড়ে নিহিনকে ডাকলেন। নিহিন রোহিতাদের ড্রইংরুমেই ছলো। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, কী হয়েছে মা?
– খাবার দিয়েছি। খেতে আয়।
– তুমি খেয়ে নাও, মা। মাত্র ন’টা বাজে। আমি একটু পর আসছি।
নিলুয়া বেগম কিছু বললেন না। নিশ্চুপ চলে গেলেন। রোহিতা নিহিনকে বলল, তোর মা কে দেখে মনে হয় উনার শরীর অনেক দুর্বল। একা একা এতো কাজ করেন। একটু সাহায্যও তো করতে পারিস।
নিহিন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, উনার শরীর দুর্বল? কিছু সময় তো ঠিকই শরীর চাঙ্গা থাকে।
নিহিনের কথাটা কেমন রহস্যময় শোনালো। রোহিতা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, মানে?
– মানে কিছু না। আজ তোর সোহেল ভাই এলেন না?
– না। কাল থেকে আসবেন।
নিহিন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ভেবে রেখেছিলাম তোর সাথে আমিও উনার কাছে পড়ব। কিন্তু এখন দেখছি তা আর হবে না। তোদের স্পেস দিতে হবে। রোমান্স টমান্স করবি…
রোহিতা চোখ গরম করে তাকালো। নিহিন ঢোঁক গিলল। রোহিতা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা নিহিন তোর বয়স কত? আঠারো তো হয় নি।
নিহিন অবাক স্বরে বলল, কে বলেছে আঠারো হয় নি?
– মানে? কীভাবে হবে? ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়িস। আঠারো এখনও হওয়ার কথা না।
নিহিন লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, আমার বয়স উনিশ। আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি দেরিতে। আর আগে তো আমরা ঢাকাতে ছিলাম। সিলেটে আসার ঝামেলায় এক বছর লস হয়েছে। তাই, সব মিলিয়ে আমি আঠারো বছর পেরিয়ে এখন উনিশে।
রোহিতার মুখ হা হয়ে গেল। সে বলল, তুই আমার বড়?
– আমরা ক্লাসমেট। সো যেমন আছি তেমন থাকব। বয়স কোনো মেটার না। তোকে আমি একেবারে টসটসে পাঁকা বানিয়ে ফেলব। নো চিন্তা।
বলে খিটখিট করে হাসল নিহিন। রোহিতা নিহিনের পিঠে থাপ্পড় বসালো। এমন সময় রিনা বেগম রোহিতাকে ডাকলেন। রোহিতা গিয়ে বলল, হ্যাঁ মা, বলো।
মঞ্জুর মিয়া রিনা বেগমের পাশে ছিলেন। তিনি কাপড় পরে কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন। এইমাত্র খবর এসেছে, উনার বড় বোন বাথরুমে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। পিঠ কেটে গেছে। অবস্থা বেশি ভালো না। হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। বয়স্ক মানুষ, চাপ নিতে পারেন নি। মঞ্জুর মিয়াকে বাইরে যাওয়ার কাপড়ে দেখে রোহিতা জিজ্ঞেস করল, বাবা কোথায় যাবেন?
রিনা বেগম বললেন, শুধু বাবা না, আমিও যাব। তোর বড় ফুফু বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। অবস্থা ভালো না।
রোহিতা আঁতকে ওঠে বলল, কী বলো! আমাকে নিবে সাথে?
মঞ্জুর মিয়া বললেন, এই রাতের বেলা তোমার যাওয়ার দরকার নেই। ন’টা বেজে গেছে। আমরা হয়তো আজ আসতেও পারব না। একা হলে সাথে করে নিয়ে যেতাম। এখানে নিহিন আছে, ওর মা আছে। খাওয়াদাওয়া করে ওদের ঘরে চলে যাও। ওদের সাথে আজ রাতটা থেকে যাও।
– আচ্ছা। আমাকে খবর জানিয়ো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে গেলেন উনারা। রোহিতা খাওয়াদাওয়া শেষ করল। নিহিনকেও জোর করে খেতে বসালো। পরে নিজের ঘরে তালা মেরে নিহিনের সাথে তাদের ঘরে গেল। নিহিন গিয়ে দেখলো নিলুয়া বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেও নিজের রুমে এসে বিছানা ঠিক করতে লাগল। রোহিতা বলল, এই তোদের টেবিলে তো তোর জন্য খাবার রেখেছেন দাদী।
– খেয়ে আসলাম তোর সাথে। এখন আবার খাব নাকি?
– না খাস, ওগুলো গুছিয়ে রেখে আয়। তোর মা তো ঘুমিয়ে গেছেন।
নিহিনের প্রচণ্ড বিরক্ত লাগল। তবুও চক্ষুলজ্জায় গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে আসল। তারপর বিছানা করে শুয়ে পড়ল দুজনে। নিহিন গল্প করছে আর হা হা করে হাসছে জোরে জোরে। রোহিতা ফিসফিস করে বলল, এতো জোরে কথা বলিস না। তোর মা জেগে যাবেন।
নিহিন আরো জোরে জোরে বলল, আরে চিৎকার করলেও জাগবে না। মা কানে শোনে না। সারাদিন কানে মেশিন লাগানো থাকে, আর রাতে ঘুমাবার সময় মেশিন খুলে ঘুমায়। কানের কাছে গিয়ে চেঁচালেও শুনবে না।
– ও!
রোহিতার ভারি খারাপ লাগলো কথাটা শোনে। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। নিহিন তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তো বলনা, তোদের লাভ স্টোরি টা বল
– কিসের লাভ স্টোরি?
– তোর আর সোহেল ভাইর।
রোহিতা বিরক্তি নিয়ে বলল, এই তুই সম্পর্কে আমার ফুফু লাগিস। এসব কথা বলতে লজ্জা করে না?
– ওটা পরে। তার আগে আমি তোর বান্ধবী। আমাকে এতো পর ভাবিস?
কথাটা নিহিন খুব অসহায় মুখ করে বলল। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন মায়া লাগল রোহিতার। সত্যিই তো! বান্ধবী তো নিহিন রোহিতার! বান্ধবীর সাথে তো সব শেয়ার করাই যায়। রোহিতা অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে মিনমিন করে বলল, আসলে… আমার ভালো লাগে সোহেল ভাইকে। কিন্তু উনার হাবভাব আমি বুঝি না।
নিহিন রোহিতার দিকে তাকালো। নীলাভ ডিম লাইটের টিমটিম আলোয়ও তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, রোহিতা লজ্জা পাচ্ছে। নিহিন জিজ্ঞেস করল, উনি তোকে পছন্দ করে?
রোহিতা নিহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি না বুঝতে পারি না।
– ঠিক আছে। তোকে পাঁকা বানাতে হবে। তার আগে বল, তুই চাস সোহেল ভাই তোর প্রতি দুর্বল হোক?
রোহিতা আবার দৃষ্টি ফেরালো অন্যদিকে। আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। নিহিন বলল, তাহলে এখন তোকে পাঁকা হবার ছোটখাটো অধ্যায় দেখাব।
কথাটা বলার সাথেসাথেই নিহিনের মোবাইলে একটা ম্যাসেজের টোন বেজে উঠলো। নিহিন তাদের বিছানার সাথে লাগোয়া জানালাটা দেখিয়া রোহিতাকে বলল, ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমি এই জানালায় টোকা দিব। তুই নিঃশব্দে জানালাটা খুলবি। আবার বলছি, নিঃশব্দে। কোনো শব্দ যাতে না হয়। চুপচাপ সবকিছু দেখবি। আমি এসে বাকিটা বুঝাব।
রোহিতা চোখ কুঁচকে বলল, কই যাবি?
– আসছি।
বলে বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিহিন। এমনভাবে বেরিয়ে গেল, যেন সে এভাবে রাতের বেলা বেরিয়ে যাওয়াতে খুব দক্ষ৷ যথারীতি পাঁচ মিনিটের মাথায় ঐ জানালায় বাইরে থেকে টোকা দেয়ার শব্দ এলো। নিহিনের কথামতো যতটা সম্ভব নিঃশব্দে জানালাটা খুললো রোহিতা। এই জানালার বাহিরটা হচ্ছে নিহিনদের ঘরের পেছনদিক। এদিকটা একেবারে জনমানবহীন। খুবই কম আলোর একটা লাইট জ্বালানো আছে সেখানে। সেই আধো আধো আলোয় রোহিতা যে দৃশ্য দেখলো, তা দেখার জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুতি ছিলো না তার। সদ্য সতেরো বছর পার হওয়া মেয়েটার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল তা দেখে। শরীরে অদ্ভুত শিরশিরানিতে বিদ্যুৎ বেগে কেঁপে উঠল রোহিতার শরীর। সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে তাকিয়ে থাকল। সে কী দেখবে? নাকি এক্ষুণি এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত। মস্তিষ্ক কোনো উত্তর দিচ্ছেনা।
_________
(চলবে)