এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ৪

0
505

এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ৪
(ওয়ার্নিং: এই পর্বে কিছু আপত্তিকর দৃশ্য/কথোপকথন রয়েছে।)
ফারজানা আহমেদ

পরনের কামিজটা উঠিয়ে গলা পর্যন্ত ধরে রেখেছে নিহিন। তার শরীরের উপরিভাগ উন্মুক্ত। আধো আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে নিহিনকে ধরে চুমু খাচ্ছে আর নিহিনের শরীরে বিশ্রীভাবে হাত দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে রোহিতার মাথা শূন্য হয়ে গেছে। সে জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। ছিঃ! কী নোংরা দেখাচ্ছে এসব! রোহিতার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে তড়িৎ বেগে জানালা থেকে সরে গেল। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে লাগল। কতোক্ষণ কাটলো কে জানে! তন্দ্রা লাগায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো রোহিতা। ঘুম ভাঙে নিহিনের ডাকে। চোখ খুলে তাকাতেই নিহিন ধমক দিলো, কীরে? জানালাটা লাগালি না? মশা ঢুকে গেছে তো!

রোহিতা কিছু বলল না। উঠে বসল চুপচাপ। তার ভালো লাগছে না। নিজের ঘরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। নিহিন আবার বলল, দেখেছিস? যা দেখাতে চেয়েছিলাম?

এবার রোহিতা চোখ মেলে চাইলো নিহিনের দিকে। মুখে তার স্পষ্ট বিরক্তি। সাথে একটু ঘৃণাও আছে হয়তো! নিহিন মনেহয় আন্দাজ করতে পারলো রোহিতার মনের অবস্থা। সে বলল, জানতাম। আমি জানতাম তুই এখনও বাচ্চা। এ বাবারে বাবা! উনি সোহেল ভাইরে উনার প্রেমে পড়াতে চান। ঠেঙা করবি তুই!

রোহিতা সেসব কানে নিলো না। শান্ত, নিষ্কম্প গলায় বলল, তোর লজ্জা করে না?

– মানে! লজ্জার কী আছে এখানে? আশ্চর্য!

কণ্ঠে একরাশ অবাক ঢেলে কথাটা বলল নিহিন। রোহিতা যারপরনাই বিরক্ত। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে নিহিনকে কটা কটু কথা শুনিয়ে দিতে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি ঘুমাবো। শুভরাত্রি।

নিহিন রোহিতাকে টেনে ধরে বসিয়ে বলল, না ঘুম নেই। সবে বারোটা বাজে। গল্প করব।

– আমার গল্প করতে ইচ্ছা করছে না।

নিহিন এবার সরু চোখে তাকাল। রোহিতাকে ভালোভাবে দেখে বলল, তুই নরমাল তো? মানে আমার না সন্দেহ হচ্ছে।

রোহিতা ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু কিছু বলল না। নিহিন আবার বলল, এইরকম একটা দৃশ্য দেখার পরে তোর হট থাকার কথা। তুই এক্সাইটেড থাকবি। আমাকে অনেককিছু প্রশ্ন করবি। এইটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু তোর মধ্যে এমন কিছুই দেখছি না।

– তোর মা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। কানে শুনেন না। অসুস্থ মায়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে তুই নোংরামি করে বেড়াচ্ছিস। তোর বুক কাঁপে না নিহিন?

হালকা কম্পনরত গলায় বলল রোহিতা। নিহিন কথাটা শুনে থমকে গেল। চুপ করে বসে থাকল। রোহিতাও কিছু বলল না। কয়েক মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর নিহিন বলল, বড় মানুষের মতো জ্ঞান দেয়ার কথা বাদ দে তো! আমার মা কেমন এটা আমি জানি, তুই না। বারবার এরকম তোর মা এমন তোর মা তেমন এসব করবি না রোহিতা। সিচুয়েশন বলে একটা কিছু আছে। যে যার জায়গায়, সে বুঝে। অন্য কেউ না।

রোহিতা চকিতে তাকালো নিহিনের দিকে। জিজ্ঞেস করল, মানে? বুঝিয়ে বল।

– বাদ দে। শোন, আমাকে খারাপ ভাবতে পারিস। স্বাভাবিক, কারণ তুই প্রেম করিস নি কোনোদিন। তুই বুঝিস না এসব। প্রেম শুরু করলে শারীরিক ভাবে এসব আসবেই। তাছাড়া, এমন না যে আমি সতিত্ব নষ্ট করে দিয়েছি আমার। এটা জাস্ট আদর, যা একটা বয়ফ্রেন্ড একটা গার্লফ্রেন্ড কে করে। তুই ফিল্ম দেখিস না?

– আমার ভালো লাগছে না নিহিন। বন্ধ কর এসব। নোংরা লাগছে।

বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ল রোহিতা। নিহিন কিছু বলল না। শুয়ে পড়ল নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর রোহিতার মস্তিষ্ক সচল হলো। আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারল, নিহিনের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করেছে। এটা করা উচিত হয় নি। পৃথিবীর এক এক মানুষ এক এক রকম। তাদের করা প্রতিটি কাজের পেছনে একটা না একটা কারণ থাকে। রোহিতা একটা লম্বা শ্বাস নিলো। পাশ ফিরে ডাকলো, নিহিন।

নিহিন ঘুমায়নি। ডাক শুনেই সে শব্দ করে হেসে ফেলল। রোহিতাকে বলল, এবার তুই আমাকে স্যরি বলবি। আমি জানি। শোন এসব স্যরি টরি বলা লাগবে না।

রোহিতা হেসে দিলো। তার হালকা লাগছে কেন জানি। নিহিন আবার বলল, আমি জানি তোর খারাপ লেগেছে। কিন্তু রোহিতা, ফিল্ম তো দেখিস। বিয়ের আগে এটা নরমাল। আমি ওকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। ভালোবাসায় সব জায়েজ। ওকে খুশি রাখার জন্য আমাকে যা করতে বলবে আমি করব। সে তো আমার সতিত্ব নষ্ট করছে না। ঐ একটু আদর চায়, রোমান্স।

– আসলে কোনোদিন সরাসরি এভাবে…

– আমি বুঝতে পেরেছি। কিজন্য এইভাবে লজ্জাশরম এর মাথা খেয়ে তোকে লাইভ টেলিকাস্ট দেখালাম সেটা শোন।

– নিহিন আমার লজ্জা লাগছে।

রোহিতা মাথানিচু করে ফেলল। নিহিন আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, এসব করলে সোহেল ভাই জীবনেও প্রেমে পড়বে না।

সোহেল ভাইর নাম শুনে রোহিতার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। হ্যাঁ, সে চায় সোহেল ভাই তার প্রতি দুর্বল হোক। তাকে নিয়ে ভাবুক। কিন্তু তাই বলে… তাই বলে এরকম কিছু সে ভাবে নি। স্বপ্নেও ভাবে নি!

– শোন রোহিতা। ছেলেদের পটানোর অনেক রাস্তা আছে। ফিজিক্যাল রাস্তাটা হচ্ছে সবচেয়ে ইজি ওয়ে।

নিহিনের কথা শুনে রোহিতার এবার বেশি বিরক্ত লাগল। সে বলল, এর মানে কী? আমি এখন সোহেল ভাইকে ধরে চুমু খাবো? কীসব যা-তা বলছিস? হুট করে চুমু খাবো আর শরীরের উপরিভাগ উন্মুক্ত করে দেব, এতেই উনি পটে যাবে?

হো হো করে হাসল নিহিন। অনেকক্ষণ হাসলো। রোহিতা পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিহিন হাসতে হাসতে রোহিতাকে জড়িয়ে ধরল। রোহিতা ঝাড়ি দিয়ে নিহিনের হাত সরিয়ে বলল, এভাবে ধরবি না তো। আমার এসব ভালো লাগে না।

নিহিন হাসি বন্ধ করে উঠে বসল। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ওকে, এবার সিরিয়াস কথা বলি। আমাদের মিশন হচ্ছে সোহেল ভাইকে পটানো। সোহেল ভাই যাতে তোর প্রতি দুর্বল হয়। এমন কিছু ট্রিকস শিখিয়ে দেব না! বাবাজী সুড়সুড় করে তোর প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য হবে।

রোহিতার বুক ধুকপুক করতে লাগল। সত্যিই কি সোহেল ভাই তার প্রতি দুর্বল হবে? সে সাবধানে প্রশ্ন করল, আমাকে কী করতে হবে? আমি কিন্তু তোর মতো এসব করতে পারব না।

– আরে গাধি, এখনই কে বলেছে সব করতে? আর এসব তুই কেন করবি? সোহেল ভাই প্রেমে পড়লে সে নিজেই এসব করবে।

– সোহেল ভাই এমন করবে আমার সাথে!

ভাবতেই সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল রোহিতার। শরীর কেঁপে উঠল। নিহিন উৎসাহ নিয়ে বলল, এই এই তোর শরীর কাঁপছে। কেমন লাগছে তোর?

– আ-আমি সোহেল ভাই কে ভালোবাসি নিহিন। সত্যিই। কিন্তু…

নিহিন রোহিতার হাত চেপে ধরে বলল, আমি বুঝতে পারি। তোর ভালোবাসা তোর চোখে ভেসে ওঠে।

রোহিতা কিছু বলল না। উঠে বসল। নিহিন বলল, সোহেল ভাইর সামনে যাওয়ার সময় এভাবে একেবারে পুরো শরীর ঢেকে যাসনা বুঝলি।

রোহিতা অবাক হয়ে বলল, মানে? কী বলিস!

– দাঁড়া।

নিহিন উঠে গিয়ে রুমের লাইট জ্বালিয়ে আসল। তারপর রোহিতার পাশে বসে রোহিতার শরীরের ওপর থেকে ওড়না টান দিয়ে নিতে নিতে বলল, এই ঘুমানোর সময় এভাবে শরীরে ওড়না পেঁচানো লাগে? আমার সামনে এতো সতি সাজতে হবে না। তোমার যা আমারও তা।

– আরে… আরে এমন করছিস কেন?

– শোন, এভাবে থাকলে হবে না। ওড়না ছোট করে পরবি। আর কামিজার গলা টা সামনে দিকে টেনে রাখবি, ক্লিভেজ যেভাবে দেখা যায়। ওয়াও রোহিতা! তোর গড়ন তো অনেক আকর্ষণীয়।

রোহিতা মুখ হা হয়ে গেল। কী বলছে এসব! সে লেপ টেনে নিজেকে ঢেকে বলল, ছিঃ! আমি জীবনেও এসব করব না।

নিহিন রোহিতার ওপর থেকে লেপ টেনে নিয়ে বলল, একটা থাপ্পড় দিব। এমন করলে সোহেল ভাইকে হারাবি।

রোহিতা এবার সোজা হয়ে বসল। না, সে সোহেল ভাইকে হারাতে পারবে না। তিন বছর থেকে ভালোবাসে। আর লুকিয়ে রাখবে না। এবার সোহেল ভাইকে তাকে ভালোবাসতেই হবে। সে করবে… নিহিন যা করতে বলে সে করবে! সে মন দিয়ে সব শুনছে।

কথা বলার মাঝখানে নিহিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, তুই কোনোদিন ওসব ভিডিও দেখেছিস?

– কিসব ভিডিও?

– ঐযে। আজকে যা লাইভ দেখলি, তার পুরোপুরি সব।

রোহিতা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখি নি।

– তোকে আজ আমি একেবারে পাঁকা বানিয়ে ফেলব। কদিন এভাবে থাকবি? দুদিন পর বিয়ে দিয়ে দিলে এভাবে সব না জেনে কেমনে চলবে?

কথাটা বলতে বলতে রোহিতার সামনে নিজের মোবাইলে একটা ভিডিও চালু করে দিলো নিহিন। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের অন্তরঙ্গতার পুরো ভিডিও। রোহিতার দুর্বল মস্তিষ্ক সেটা সহ্য করতে পারে নি। সে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, বন্ধ কর নিহিন, আমি এসব দেখব না।

নিহিন হাসতে হাসতে বন্ধ করে দিল। রোহিতার শরীর কাঁপছে। সে লেপমুড়ি নিয়ে শুয়ে পড়ল। নিহিন অনেক ডেকেছে, রোহিতা সাড়া দেয় নি। মধ্যরাতে রোহিতার ঘুম ভাঙলো। সে একটা স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নে সোহেল ভাই ছিলেন। অনেক রেগে ছিলেন তিনি। সোহেল ভাই রেগে গিয়ে তাকে একটা কথা বললেন। কথাটা হচ্ছে, ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে – কথাটা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও, আমার কাছে মনে হয় মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। মানুষ চাইলে সব পারে। নিজেকে খারাপের থেকে সরিয়ে রাখতে পারে। আমি যদি ভালো থাকতে চাই তাহলে কেউ আমাকে খারাপ বানাতে পারবে না। মানুষ যখন খারাপ হয়ে যায় তখন নিজের দোষ চাপতে এই প্রবাদটা বারবার উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে। তুই যদি এমন হোস, আমি তোকে ক্ষমা করব না রোহিতা।’

স্বপ্নটা দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসল রোহিতা। চারিদিকে পানি খুঁজলো। পেলো না। লাইট এখনো জ্বালানো রয়েছে। পাশে নিহিন ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। রোহিতা উঠে লাইট বন্ধ করে আসবে? পানিও খেয়ে নিতো একটু। কী মনে করে লাইট জ্বালানো রেখেই পিপাসিত বুক নিয়ে আবার শুয়ে পড়ল সে। তার বিষন্ন লাগছে খুব।
___________

সকালে ফোন এলো, খলিল চৌধুরী এক্সিডেন্ট করেছেন। উনার স্পট ডেথ হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে উনাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাদের বাড়িতে কবর দেয়া হবে। ঘুম থেকে উঠেই খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নিহিন। তার বাবা নেই। তার বাবা মারা গেছেন। সে আর কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারবে না। ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠলো। সে রোহিতাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ফ্লোরে মূর্তি হয়ে বসে আছেন নিলুয়া বেগম। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেঝেতে। আচমকা রোহিতাকে ছেড়ে দিয়ে নিহিন তেড়ে গেল নিলুয়া বেগমের দিকে। গিয়েই ইচ্ছামতো চড় থাপ্পড় মারতে লাগল নিজের মা কে। খামচি দিলো, চুলে টানলো। পিঠে কিল দিলো। কুকুরের মতো মারতে মারতে চেঁচাতে লাগল নিহিন। বারবার বলতে লাগল, আমার বাবাকে তুই শান্তিতে বাঁচতে দিলি না মা*। তোর জন্য আমার বাবা শান্তিতে বাড়িতে থাকতে পারত না খান*। তুই মরে যা। তোকে আমি মেরে ফেলব।

নিলুয়া বেগম মার খেয়ে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। নিহিন তখনও অশ্লীল গালি দিচ্ছিল আর মারছিলো। হুট করে এই পরিস্থিতি দেখে রোহিতা অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়ল। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। উঠে গিয়ে নিহিনকে ধরে আটকালো অনেক কষ্টে। আটকাতে গিয়ে একটু মার তার ওপরও পড়ল। নিহিনের শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। নিলুয়া বেগম নড়ছেন না। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন মেঝেতে। মাথা ফেটে গেছে, নাক মুখ লাল হয়ে আছে রক্তে। রোহিতা মাথা ঘুরছে। সে সবকিছু অন্ধকার দেখছে। নিহিনকে টেনে নিয়ে বসালো বিছানায়। নিহিন তখনও খারাপ খারাপ গালি দিচ্ছে তার মা কে। রোহিতার গা গুলাচ্ছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ফোনটা হাতে তুললো। ডায়াল করলো তার বাবার নাম্বারে।
__________

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here