#এ_কেমন_ভালোবাসা
#পর্ব_৩৯,৪০
#মাসুরা_খাতুন
৩৯
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। রাতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাঁদের আলো।আকাশে থালার মতো গোলাকার রুপোলী চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। আজ হয়তো পূর্ণিমা, তাই তো চাঁদের আলো একটু বেশিই উজ্জ্বল। প্রকৃতিতে বিরাজ করছে মায়াবী শান্ত এক প্রহর।শহরের আলো গুলো এক এক করে নিভতে শুরু করেছে। কাছেই কোথায় হয়তো কোন নিশাচর ব্যক্তির রাতের সঙ্গী হয়ে সাউন্ড বক্সে গান বাজছে,
“কিচ্ছু চাইনি আমি,”
“আজীবন ভালোবাসা ছাড়া,”
“আমিও তাদের দলে”
“বারবার ম*রে যায় যারা।”
এই মূহুর্তে এই গানটা বেশ বিরক্তিকর লাগছে বাঁধনের কাছে। আজ এতো দ্বিধার পর ও ওর প্রিয়তমা কে ভালোবাসার কথা বলতে এসেছে, আর কোন এক ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক নিজের ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়ে এমন গান শুনছে যে বাঁধন কে বারবার কাঁপিয়ে তুলছে অজানা এক প্রিয়া হারানোর ব্যথায়।ভালোবাসায় যে অনেক য*ন্ত্রনা থাকে তা বাঁধন জানে।কিন্তু এ য*ন্ত্রনাদায়ক ভালোবাসাটায় ও ছুঁতে চায়,একদম মন থেকে আপাদমস্তক পান করতে চায় এ ভালোবাসার অমৃত সরাব।
চারদিক নানা ফুলের গাছে সাজানো ছাদের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিল রাখা, আর দুটো চেয়ার।বাঁধন কিছু সাদা পর্দা এনে চারপাশ দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। টেবিলে রেখেছে কিছু ক্যান্ডেল।ছোঁয়ার গোলাপ গাছ থেকে কিছু গোলাপ নিয়ে রেখেছে টেবিলে। গোলাপের পাপড়ি গুলো টেবিলে চেয়ারে ছড়ানো।ফুল গাছ গুলো থেকে নানান রকম ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে চারদিক।একদম মৌ মৌ করছে গন্ধে।বলা হয়ে থাকে প্রায় প্রতিটি ফুলেরই গন্ধ দিনের তুলনায় রাতে বেশি ছড়ায়,কিন্তু কখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি বাঁধনের। কিন্তু আজ বুঝতে পারল,রাতে যেকোন ফুল কতটা সুঘ্রাণ ছড়ায়।
অপেক্ষার প্রহর গুলো যেন হাজার গুন দীর্ঘ হয়।এক একটি মূহুর্ত গুলো হাজার বছরের সমান।তাতে আবার যদি থাকে না বলা ভালোবাসা বলার তীব্র ইচ্ছা তাহলে সেটি আরও বেশি য*ন্ত্রণাদায়ক।প্রিয় মানুষ টি গ্রহণ করবে? নাকি প্রত্যাক্ষান করবে এটায় মূখ্য ভাবার বিষয়।
এক সময় বাঁধনের প্রতিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে কেয়া। বাঁধনের দেওয়া চিরকুট টি পেয়ে ও কিছু টা দ্বিধায় ছিল। এতো রাতে একা একটা ছেলের সাথে ছাদে দেখা করতে যাওয়া টা কি মোটেও ঠিক হবে? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়,বাঁধন তো আর দশটা ছেলের মতো নয়,যে ছেলে দেশের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁ*কি নিতে পারে, যে ছেলে জীবন বাজি রেখে ভয়া*নক
স*ন্ত্রা*সী দের সাথে মিশে এতো মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে পারে সে ছেলে কে নিয়ে এসব ভাবনা মানায় না।এতে তার সততা কে অপমান করা হয়।যারা সত্যি সত্যিই দেশের জন্য নিজের প্রানের এমন ঝুঁ*কি নেয়, সর্বশক্তি দিয়ে দেশকে,দেশের মানুষ কে র*ক্ষা করে,এমন মানুষের কাছে রাত এগারোটায় ছাদে কেন? যেকোন সময় সব সব জায়গায় যাওয়া যায়। আর যায় হোক,কোন বি*পদ আসলে এমন মানুষ ঢাল হয়ে দাঁড়াবে, কখনো জানোয়ারের মতো ভোগ করতে চাইবে না।তাই তো কেয়া ও এক পা এক পা করে ছাদের দিকে বাড়ায়।
কিন্তু ছাদে গিয়েই ও অবাক হয়ে যায়।এতো সুন্দর করে কখন সাজালো বাঁধন? চারদিকে দেখতে থাকে কেয়া,রঙ বেরঙের বেলুন উড়ছে চারদিকে।জ্বল জ্বল করে জ্বলছে ক্যান্ডেল গুলো।একটা কাচের জারে অনেক অনেক জোনাকি আলো জ্বা*লাচ্ছে।কিছু প্রজাপতি ও উড়ছে আরেক টা জারে।কেয়া একদম বাকরুদ্ধ! ওর মতো অসহায় মেয়ের জন্য এমন সারপ্রাইজ নিয়ে কোনদিন যে কেউ অপেক্ষা করবে তা কেয়ার কল্পনা উর্ধ ছিল।বাঁধন শেষ মোমবাতি টা জ্বা*লিয়ে চলে যায় কেয়ার কাছে।হাত ধরে নিয়ে আসে ওর সাজানো রাজ্যে।কেয়ার নিজেকে এই রাজ্যের রাণী মনে হচ্ছে,যেন মহা সমারোহে সম্ভাষণ জানানো হচ্ছে ওকে।হাত ধরে বাঁধন কেয়া কে প্রথমে জোনাকি ভরা জারের কাছে নিয়ে যায়,মুখ টা খুলে দিতেই শতশত জোনাকি বের হয় জার থেকে।মূহুর্তেই চারপাশ ছোট ছোট বিন্দু বিন্দু আলোয় মেতে ওঠে।কেয়ার এসব কিছু স্বপ্ন মনে হয় । তারপর কেয়াকে আনে প্রজাপতির জারটার কাছে।মুখ খুলে দিতেই রঙবেরঙের প্রজাপতি বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে একটা প্রজাপতি বসে কেয়ার কোঁকড়ান চুলে।বাঁধন ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয় প্রজাপতি টা।বাঁধনের দেওয়া ফু টা কেয়ার চোখে মুখে লাগে,কিছু অবাধ্য চুল উড়ে আসে কপালের দিকে। শীতল এক শিহরনে কেঁপে ওঠে কেয়া।চারদিকে শুধু জোনাকি আর প্রজাপতির মেলা বসেছে তখন।বাঁধন পকেট থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ বের করে হাঁটু গেঁড়ে বসে কেয়ার সামনে।
দু’হাতে ধরে গোলাপ টা কেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেছি তোমার মায়াবী চোখের। তারপর প্রেমে পড়েছি তোমার সাহসীকতার।মুগ্ধ হয়েছি বারবার তোমার ব্যক্তিত্বে।বিমোহিত হয়েছি তোমার মুক্ত, স্বাধীন চিন্তা ভাবনায়,তোমার মেধা,মননে।বারবার ডুবে যেতে চাই তোমার স্বপ্ন ভরা দুচোখের মাঝে।তোমার বাচ্চা বাচ্চা চেহারা আমায় পাগল করে মা*রে।”
বাড়িয়ে দেয় গোলাপ টি কেয়ার দিকে। আস্তে আস্তে হাত এগিয়ে কেয়া ধরে নেয় গোলাপ টি।উঠে দাঁড়ায় বাঁধন, তারপর কেয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি তোমায় পেতে চাই কেয়া,নিজের সহধর্মিণী রূপে।তবে আমি হয়ত কখনোই তোমার দায়িত্ববান স্বামী হতে পারবো না।আমি শুধু স্ত্রী কেয়া কে চাই, পুরোপুরি কেয়া কে না।আমি চাই তুমি যেমন, ঠিক তেমনই স্বাধীন ভাবে নিজের সত্তা টা কে ধরে রেখো।আমি আমার ঝগড়া ঝাটির সঙ্গী হিসেবে তোমায় চাই,আমার দুষ্টমি মাখা আবদার গুলো পূরণের জন্য তোমায় চাই,আমার উদ্ভট কথাবার্তায় রাগে গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকা কেয়া কে চাই,নিজের অগোছালো আদর দিয়ে তোমার রাগ ভাঙাতে চাই।আমার কখনো লক্ষী মন্ত কেয়া কে চাইনা।যেটা তোমার স্বভাব বিরো*ধী তেমন কেয়া কে চাই না।আমার এমন রাগী,অগোছালো কেয়া কে চাই।হবে কি তুমি আমার এসব বেসামাল ইচ্ছে গুলোর সঙ্গী? হবে কি গভীর রাতে ঘুমানো বাদ দিয়ে হাত ধরে রাস্তায় নিরিবিলি হাঁটার সঙ্গী? দেবে কি আমায় একটা সুযোগ? যাস্ট একটা সুযোগ চাই।প্লিজ”
বাঁধনের কথা গুলো ভেতর থেকে কাঁপিয়ে তুলছে কেয়া কে।প্রত্যেকটা কথা গায়ে বিঁ*ধছে। বাকরুদ্ধ কেয়া এবারে মুখ খোলে,
“দদেখুন,আপনি আমার অতীত টা জানেন না তাই তো এমন কল্পনা সাজিয়েছেন।এতোটাও সুখকর নয় আমার অতীত! বেদনায় মোড়ানো জগৎ আমার।কেন হতে চান এমন ব্যথাতুর হৃদয়ের সঙ্গী? এখন মোহে পড়েছেন আপনি, তাই তো সব কিছু রঙিন লাগছে। কিন্তু মোহ কে* টে গেলে যখন দেখবেন আমার অতীত পুরোটায় অমাবস্যা রাতের মতোই কালো,তখন আপনার এ পূর্ণিমার অবসান ঘটবে।আবারও অমাবস্যায় নিমজ্জিত হবে আমার জীবন। তার চেয়ে আমি এমনই ভালো আছি।”
“তোমার কি মনে হয়,মোহে পড়ার মতো বয়স আমার? চোখে রঙীন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঠিক ভুল যাচাই না করে প্রেমে পড়ার বয়স এটা আমার? আমি যা বলছি ভেবে চিন্তে যাচাই করে বলছি।আবেগের বশে আগুনে হাত দিয়ে ভুল করতে যাওয়ার মতো তরুণ বয়স আমার নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমার চোখে তুমি শুধুই আমার সাহসী কেয়া রানী।এর বেশি কোন পরিচয় আমার দরকার নেই। তোমার বাবা মা নেয়,আমি জানি।চাচির কাছে অনেক অবহেলা কষ্ট পেয়ে তুমি এ শহরে এসেছো তাও আমি জানি। আর এতটুকু জানাই আমার যথেষ্ট। আর কিছু আমি জানতে চাইনা।”
“কিন্তু তা বললে তো হবে না।আরো অনেক কিছুই আছে আমার অতীতে। যেগুলো প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয় আমায়।আর এগুলো শুনলে আপনিও হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবেন আমার থেকে।অনেক প্রিয় জনদের আমি হারিয়েছি।আর কাউকে হারাতেও চাই না,আর তাই নতুন কোন প্রিয় জন বানাতেও চাই না।মাফ করবেন আমায়।আমি আপনার মতো সুন্দর মনের মানুষের যোগ্য নই।”
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কেয়া।ঝট করে কেয়ার হাত ধরে ফেলে বাঁধন।
“তাহলে কি কিছুই নেই তোমার মনে আমার জন্য? এতোদিনের এগুলো কি সব মিথ্যে?”
“কিছু থাকলেও সেটা মনের ভুল। মন তো কথা শোনে না,কোন বাঁধা বারণ ও মানে না।তাই তো ভুল করে বহুবার হেরে যায় আপনার কাছে। কিন্তু এ সম্ভব নয়। ”
“তাহলে কেন? কেন ছেড়ে যাচ্ছ আমায়? কি দোষ আমার? আমি তো তোমার সব অতীত নিয়েই তোমায় ভালোবেসেছি।তাও কেন কষ্ট দিচ্ছ আমায়?”
কেয়ার হাত টা আরে শক্ত করে ধরে বাঁধন। বাঁধনের দিকে না তাকিয়েই কেয়া বলে,
“হাত ছাড়ুন।পরস্ত্রী কে ধরতে নেই।আমায় যেতে দিন।”
সাথে সাথেই কেঁপে ওঠে বাঁধন।কি বলল কেয়া? পরস্ত্রী? তার মানে টা কি?
আলগা হয়ে আসে বাঁধনের হাতে।কেয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নীচে চলে যায়। একদৌড়ে সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
এদিকে বাঁধন একমনে বিড়বিড় করতে থাকে কেয়ার বলা শেষ কথা টি।”পরস্ত্রী কে ধরতে নেই। ”
“পরস্ত্রী “! কে পরস্ত্রী? ওর কেয়া অন্যের স্ত্রী হতে যাবে কেন? কেয়া তো শুধু ওর।ওর উগান্ডা বাসী কেয়া।সে কেন অন্যের স্ত্রী হবে? সে তো স্বচ্ছ! একদম পানির মতো স্বচ্ছ কেয়া। কি বলে গেলো ওগুলো।প্রচন্ড আঘাতে ভেঙে পড়ে বাঁধন। কাঁদতে শুরু করে,নিজেকে ওর পাগল পাগল লাগে।টেনে ছিঁ*ড়ে ফেলে পর্দা গুলো।গোলাপ গুলো দুমড়ে মুচড়ে ছিঁ*ড়ে ফেলে, ছেঁ*ড়ার সময় গোলাপে থাকা কাঁ*টায় ছিঁ*ড়ে ফুঁ*ড়ে যায় বাঁধনের হাত।গোলাপের পাপড়ির মতোই টকটকে লাল র*ক্ত বেরোয় অনেক জায়গা থেকে। কাদতে কাঁদতে বসে পড়ে ছাদের কার্ণিশে।
কাছেই সেই নিশাচর ব্যাক্তিটির বক্স থেকে এখনও ভেসে আসছে সেই গান,
“কিচ্ছু চাই নি আমি”
“আজীবন ভালোবাসা ছাড়া, ”
“আমিও তাদের দলে”
“বারবার ম*রে যায় যারা।”
______________
আজ বাড়িটা প্রায় খালি।প্রায় আত্মীয়রা চলে গেছে। শুধু স্বাধীনের কাজিন গুলো আছে এখনও।স্বাধীন ছোঁয়া ঘুম থেকে ওঠে নামাজ আদায় করে। বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ছোঁয়ার হাত ধরে ফেলে স্বাধীন। শাড়ীর ফাঁকে উন্মুক্ত কোমড় ধরেই বলে,
“আজ তোর শাড়ী পড়তে হবে না।আপাতত বাড়িতে যে কয়দিন বাইরের সবাই আছে সে কয়দিন তুই সালোয়ার কামিজই পড়বি।আর সবাই চলে গেলে আমার লক্ষী বউ ছোঁয়া হয়ে শাড়ী পড়বি।যাতে আমি বারবার নে*শায় ডুবে যায় তোর এই শাড়ী পরা শরীরের ভাঁজে। এতোদিন তোকে শাড়ী ছাড়া দেখেছি।এখন থেকে তোকে শাড়ীতে আলাদা সাজে দেখতে চাই,যেন বারবার আমার মনে হয় এটা সাহারিয়ার স্বাধীনের বউ।”
দুহাত দিয়ে ছোঁয়া ও স্বাধীনের গলা জড়িয়ে ধরে, তারপর স্বাধীনের মতোই ব্যঙ্গ করে বলে,
“তা এখন শাড়ী পরলে কি হবে শুনি? এখন পড়বোনা কেন?”
সাথে সাথেই স্বাধীন ছোঁয়ার ধরে রাখা উন্মুক্ত কোমড়ে চিমটি কে*টে কাটে।”আউহ্ “বলে ওঠে ছোঁয়া।
“এই যে,এখন শাড়ী পড়লে কি হবে বুঝতে পেরেছিস? এই শরীর গুলো তোর দেখা যাবে। আর আমি চাই না আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষ তোর এসব সৌন্দর্য ভক্ষণ করুক।তুই যে বেহুঁশ! কাপড় কিচ্ছু ঠিক রাখতে পারিস না।তাই বাসায় মেহমান আসলে তোর শাড়ী পরা নিষেধ, বুঝলি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু এতো জোরে চিমটি কা*টলে কেন? আমার বুঝি ব্যথা পাই না?শয়তান ছেলে একটা।”
মুখ ফুলিয়ে বলে ছোঁয়া।
ছোঁয়ার গালে নিজের গাল ঘষে স্বাধীন। সেভ থাকার পর ও হালকা দাড়ি ঘর্ষণ লাগে ছোঁয়ার গালে,চোখ মুখ খিঁচে ফেলে ছোঁয়া।
“এটা তোর আমাকে ফাঁকি দেওয়ার শা*স্তি,রাতে শয়তানি করে আমি আসার আগেই ঘুমিয়ে যাওয়ার শা*স্তি। তুই জানিস কতো কষ্ট দিয়েছিস আমায়? কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তোর দিকে,তুই জাগবি বলে।খুব তো আমার বুকে মিশে গিয়ে ঘুমাচ্ছিলি।পাশের মানুষ টাকে কন্ট্রোললেস করে। ”
“ছিহ্,কি যা তা তুমি বলো? কখন আমি তোমার বুকে গিয়েছিলাম,ফালতু কথা একদম বলবে না।বুঝলে।এই ছোঁয়া নিজে থেকে কখনোই তোমার কাছে যায় না বুঝলে।”
বলে লজ্জায় মুখ নত করে ছোঁয়া। কারণ ও নিজেও জানে ঘুমের ঘোরে ও গিয়েছিল স্বাধীনের বুকে।কিন্তু ও মানবে কেন? উহুৃ,একদম মানবে না।
“বুকে ছিলি না বলছিস।একদম এভাবে বুকে মিশে গিয়েছিলি।”বলেই ছোঁয়া কে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিয়ে বলে স্বাধীন।
স্বাধীনের বুকে আলতো আঁচড় দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েই দৌড়ে নীচে চলে আসে ছোঁয়া।
এসেই জানতে পারে বাঁধন চলে গেছে। কোন এক জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় ফজরের সময় যখন সাহানা বেগম নামাজ পড়তে ওঠেন,তখন উনাদের বলেই চলে যায় বাঁধন। এদিকে কেয়া ও খুব চুপচাপ।,,,,,,,,
চলবে,,,,,,,,,,
#এ_কেমন_ভালোবাসা
#পর্ব_৪০
#মাসুরা_খাতুন
স্বাধীনের ক্লাসে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। প্রায় আধাঘন্টা থেকে দাঁড়ান সে।পাশেই কেয়া উশখুশ করছে। অন্য দিন ছোঁয়া দাঁড়িয়ে থাকার সময় মন খারাপ করে মাথা নিচু করে থাকে।কিন্তু আজ রাগে ওর গা জ্ব* লে যাচ্ছে। এ কেমন ছেলেরে বাবা! নিজের বউ বলেও একটু খাতির নাই? ছোঁয়ার অপরাধ, স্বাধীন বোঝানোর সময় প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিল ওর,তাই তো ভালো করে মনোযোগ দিতে পারে নি,আর তাই তো স্বাধীন প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে নি।কিন্তু তাই বলে এখনও ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখবে ছোঁয়া কে? ওর ক্লাসে ঘুম ধরার কারণ টা কে? আগে তো এমন হতো না। নিজে দোষ করে এখন আসছে শুধু ছোঁয়া কে শা*স্তি দিতে?রাগে ফুঁসছে ছোঁয়া। কিন্তু ওর রাগের কারণ পুরুষটুর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।সে তার মতো লেকচার দিয়েই যাচ্ছে। “আজ যাই বাড়িতে, বোঝাবোনে মজা।নিজে ঘুম নষ্ট করে নিজেই শা*ন্তি দেওয়া হচ্ছে? শয়তান ছেলে! আজ এসো খালি মাগনা পিরিত দেখাতে,তোমার আদর করা আমি মিটিয়ে দেব।খুব তো ভালো ভালো কথা বলো,আর কলেজে এসেই শুরু করেছ নিজের হিটলারগিরি? আমি ও ছোঁয়া হুহ্। “মনে মনেই এক পশলা বিড়বিড় করে ছোঁয়া। কিন্তু বিড়বিড় শেষে সামনে তাকিয়েই দেখে স্বাধীন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে,
“তোমার মনে মনে বকা বন্ধ হলে আজকের পড়া টা বুঝে নাও মিসেস ছোঁয়া। এতো গাল পাড়তে হবে না।”
বলেই একটা ডেভিলমার্কা হাসি দেয়,যে হাসির মানে শুধু ছোঁয়া ছাড়া আর কেউ জানে না।
“আজব! এ ছেলে কি মন পড়তে পারে নাকি? কি করে বুঝলো? আমি যে মনে মনে গালি দিচ্ছি। ”
আবার ও মনে মনে ভাবে ছোঁয়া।
এবার ধমক দিয়ে ওঠে স্বাধীন,
“কি হলো? বললাম না,কল্পনা পরে করবে,আগে পড়া।”
“সসরি স্যার।”
চুপচাপ বলল ছোঁয়া।
মুখ টাকেও একেবারে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো করে রেখেছে।
ছোঁয়ার এমন পরিস্থিতি দেখে মনে মনেই খুব হাসি পাচ্ছে স্বাধীনের।অন্য সময় তো খুব জ্বা*লায় স্বাধীন কে আর এখন এমন ভীতু হয়েছে। খুব কষ্ট করে হাসি আট*কিয়ে পড়া টা দেখিয়ে দিল।ও নিজেও জানে আজ ওর কপালে দুঃখ আছে, অনেক কাঠখড় পো*ড়াতে হবে আজ মহারাণী কে মানাতে।
____________
চুপচাপ বসে আছে কেয়া।এ যেন ওর স্বভাব বি*রোধী! কেয়া কলেজে এসেছে,মাঝখানে ক্লাসে এতোবড় একটা কান্ড হয়ে গেলো আর ছোঁয়া কে রাগাবে না এটা সত্যিই সপ্তম আশ্চর্য দেখার মতো বিষয়।ছোঁয়া বুঝতে পেরেছে ওর কিছু একটা হয়েছে। আজ নয় গতো কয়েকদিন ধরেই ও এমন দেখছে।সেদিন বাঁধন ও ওভাবে না বলেই চলে গেলো,তারপর থেকেই ফোন দিলে না না কাজের বাহানা দিচ্ছে,আর এদিকে সেদিনের পর থেকে কেয়াও একদম চুপচাপ। কোন কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে না,উত্তর দেয় না,কখনো চোখ গুলো ফোলা ফোলা লাগে,মনে হয় যে এখুনি কেঁদে এলো। এসব বুঝতে পারে ছোঁয়া। এ দুই লাইলি মজনুর মধ্যে যে কিছু একটা হয়েছে তা বুঝতেই পারছে ছোঁয়া। এবার হয়েছে টা কি তা জানতে হবে।
“এই কেয়া,চল আইসক্রিম খাবি?”
“নারে আমি খাবো না,তুই খেয়ে আয়।আমার ভালো লাগছে না।”
“তাহলে চল ঝালমুড়ি খাই? কিছু তো খাবি?”
“আমার কিছু খেতেই ভালো লাগছে না।”
“কি হয়েছে আমায় বল? আমি জানি তোর কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে প্লিজ আমায় বল? আমি তোর সবথেকে ভালো বন্ধু না বল? সেদিন বাঁধন ভাইয়াও ওভাবে চলে গেলেন, তারপর থেকে দেখছি তোর ও মন খারাপ। কি হয়েছে লক্ষীটি? প্লিজ আমায় বল?”
কেয়া কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল ছোঁয়া।
সাথে সাথেই কেয়া ছোঁয়া কে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিল।মাঠের মধ্যে বসে এমন করে কেঁদে দেওয়ায় আশেপাশের অনেকেই ওদের দেখতে লাগলো।ছোঁয়া হতবাক! এ কেমন কেয়া কে দেখছো ও? এতো কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিয়েও যে কেয়ার চোখে মুখে ও ভয় দেখেনি,দেখেনি কোন কান্না, আর আজ সেই কেয়া এমন করে কাঁদছে? ছোয়া তো ভাবতো এ মেয়ের বোধ হয় চোখে কোন জল নেই, সব বুঝি শুকিয়ে গেছে, কিন্তু আজ দেখছে ওর চোখে ভরা বর্ষা। এ মেয়ে কাঁদতে জানে,খুব কাঁদতে জানে।
কেয়া কে উঠিয়ে নিয়ে লাইব্রেরি রুমে আসলো ছোঁয়া। ওখানে অনেকেই মজা দেখার জন্য জড় হচ্ছিল, তাই তো ওকে নিয়ে উঠে আসে ছোঁয়া।
“কি হয়েছে কেয়া? আমায় বল,আমি আছি তো তোর পাশে।কেন কাঁদছিস তুই?”
“ছোঁয়া আমিও এতিম,তুই ও এতিম।তবে কেন আলাদা আমাদের ভাগ্য? কেন আমার ভাগ্য টাও তোর মতো হলো না? কেন সব থেকে ও আমি বঞ্চিত, কেন আমার চাচী তোর বড়মার মতো হলো না? কেন আমার জীবন এতো অগোছালো? কোন অভিভাবক,কোন ছায়া,কোন কিনারা নেই আমার।কেন আমি এতোটা অসহায় বলতে পারিস?”
“পৃথিবীর সব মানুষ একরকম হয় না কেয়া।আমার বড়মা ফেরেস্তার মতো মানুষ, তাই বলে ইবলিসের মতো মানুষ যে পৃথিবীতে থাকবে না এমনটি নয়।আর কে বলেছে তোকে তুই অসহায়? আমি আছি না তোর সাথে। ”
“তুই তো আমার একমাত্র আপনজন ছোঁয়া। কিন্তু আর কতো যু*দ্ধ করবো আমি বল? কতো টিকে থাকার ল*ড়াই করবো? কতোদিন এভাবে চলবে? কবে আমার ল*ড়াই শেষ হবে?”
“তোর আর লড়াই করতে হবে না কেয়া,বাঁধন ভাই তোকে খুব ভালোবাসে রে।উনি খুব ভালো ছেলে,তোকে সুখে রাখবেন।”
“কিন্তু আমি যে উনার যোগ্য নই রে।আমি উনার অযোগ্য। প্লিজ তুই উনাকে বলে দিস ক্ষমা করে দিতে আমায়। ”
“কেন এসব বলছিস তুই? তুই খুব ভালো মেয়ে। আর বাঁধন ভাইয়া ও তোকে ভিষণ ভালোবাসেন।তুই জানিস কিড*ন্যা*পের ঐ কয়টা দিন উনি সুযোগ পেলেই শুধু তোর কথা শুনতে চেয়েছেন,গভীর রাতে একাকী দেখা করেছেন উনি আমার সাথে, চাইলেই কতো কিছু বাজে কাজ করতে পারতেন,কিন্তু কখনো বোন ছাড়া বাজে কোন সম্পর্কে উনি তাকান ও নি আমার দিকে। এমন ছেলে কে না বলিস না প্লিজ। ”
“আমি কি বলেছি উনি খারাপ? উনি খুব ভালো মানুষ, আমি তা জানি।কিন্তু আমিই উনার যোগ্য নই।উনি অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন। আর আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায় আছে যা প্রতিটা রাতে স্লিপিং পিল ছাড়া ঘুমুতে দেয় না আমায়।ক্ষনে ক্ষনে জেগে ওঠে আমার সেই ব্যথা।”
“কি হয়েছিল কেয়া? বল আমায়,আমি সব ঠিক করে দেব।প্লিজ বল।তোর এতো কষ্ট অথচ আমায় বলিস না? বল প্লিজ। ”
“আজ বলতে পারবো না।তুই থাক আমি মেসে যাবো।খুব অস্বস্তি লাগছে আমার।থাক বাই”
বলেই একরকম এড়িয়ে ছোঁয়া কে রেখেই চলে গেলো কেয়া।
“এই কেয়া থাম,থাম বলছি।”
কিন্তু কেয়া থামে না।ও চলে যায়,চোখের কান্না মুছতে মুছতে অল্প ক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে যায়।হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছোঁয়া, কি হলো কিছুই বুঝলো না।বাধন আর ছোঁয়ার মধ্যে যে কিছু একটা হয়েছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে ও।হয়তো কেয়াই সেদিন বাঁধন কে প্রত্যাক্ষান করায় ছেলে টা ওভাবে চলে গেছে। আমার বাঁধন ভাইয়ার সাথে কথা বলতেই হবে। মনে মনে ভাবে ছোঁয়া।
আর একটা ক্লাস বাকী থাকতেই ছোঁয়া বেরিয়ে পড়ল কেয়ার মেসের উদ্দেশ্যে।মেয়ে টা যেভাবে গেলো নিশ্চিত এখনও রুমে গিয়ে কান্না করছে।
কলেজের ছাত্র পা দিতাম দর্শনে মিলে ওর হিটলার বর সাহারিয়ার স্বাধীনের সাথে। এমন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি একা একায় বের হয়ে যাওয়া দেখে সামনে এসে দাঁড়ায় স্বাধীন। তির্যক দৃষ্টিতে একবার আগাগোড়াই পরখ করে নেয় ছোঁয়া কে।তারপর বলে,
“ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এমন চুপিচুপি কোথায় যাওয়া হচ্ছে? তোর না ক্লাস আছে? আর কেয়া কই? ওকে দেখছিনা?”
“আসলে আমি কেয়ার মেসে যাচ্ছি, ও ওর অতীতের কথা মনে করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে, মেসে গিয়ে এখনও কাঁদছে হয়তো,তাই ওর কাছে যাচ্ছি। ”
“কেন ওর আবার কি হয়েছে? আর বাঁধনের ও তো কোন খোঁজ নেই। ”
“কিছু একটা হয়েছে ওদের মধ্যে। তুমি একটু বাঁধন ভাইয়া কে ফোন করে কাল আমাদের বাসায় ডাকো।ওদের সমস্যার সমাধান করতেই হবে। ”
“আচ্ছা ঠিক আছে।আর তোকে কি আমি ড্রপ করে দেবো? না মানে একা একায় যাবি”
তিরস্কার নিয়ে তাকায় ছোঁয়া, তারপর মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“তার আর কোন প্রয়োজন নেই। আমি একায় যেতে পারি, কারো এতো হেল্প আমার লাগবে না”
“কি ব্যাপার? মহারাণী কি খুব রাগ করেছে? অনেক অভিমান? ঠিক আছে, রাতে আমি সব অভিমান দূর করে দেবো নে।”
মুচকি হেসে বলে স্বাধীন।
“থাক,এতো আর নাটক করতে হবে না।এসব আমার একদম ভালো লাগছে না।আমি গেলাম। ”
বলে চলে যেতে লাগে ছোঁয়া।
“তুই জানিস,এমন রাগী লুকে তোকে আরও ভয়া*নক সুন্দর লাগে? ইস,এটা কলেজ,নাহলে এখনই ইচ্ছে করছিল কন্ট্রোললেস পড়ি,যা ইচ্ছে তাই করি।”
“পথ কি ছাড়বে,নাকি এখানেই নিজের লুচুগিরি শুরু করবে? আজাইরা ফালতু পাবলিক।। ”
বলেই স্বাধীন কে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ছোঁয়া। লজ্জা পাওয়া ছোঁয়া কে দেখে স্বাধীন ও বাঁকা হাসে।
ছোঁয়া গিয়ে দেখে কেয়া চুপচাপ ব্যালকোণি তে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো ফোলাফোলা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব কেঁদেছে মেয়ে টা।ছোঁয়া গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তারপর অনেক চেষ্টা করে কেয়ার মন ভালো করার।কিন্তু সচরাচর যাদের মন খারাপ হয়না,হটাৎ তাদের মন খারাপ হলে ভালো করা টা এতোটাও সহজ নয়।চেষ্টা করেও কিছু বলে না কেয়া,তবে আসার সময় একটা চিঠি ধরিয়ে দেয় ছোঁয়ার হাতে। এটাও বলে যে তোদের সব প্রশ্নের উত্তর এই চিঠিতেই পাবি।এটা যেন বাঁধন কেও পড়তে দেওয়া হয়।কারণ নোংরা অতীতের কথা ও বারবার সবাই কে মুখে বলতে পারবে না।চিঠি টা নিয়ে চলে আসে ছোঁয়া। এই চিঠিতে কেয়ার ঠিক কোন গোপন নোংরা অতীতের কথা লেখা আছে তা জানার জন্য মনে প্রচুর আগ্রহ হয়।
বাসায় গিয়েই ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসে চিঠি টি,আর চিঠিতে যা লেখা আছে তা পড়ে গা শিউরে ওঠে ওর।এতো যন্ত্রণা সহ্য করে এসেছে ওর কেয়া?চোখের কোণে জমা হয় অশ্রু।,,,,,,,,,,
চলবে,,,,,,,