এ_কেমন_ভালোবাসা #পর্ব_৪৩,৪৪ শেষ

0
1519

#এ_কেমন_ভালোবাসা
#পর্ব_৪৩,৪৪ শেষ
#মাসুরা_খাতুন
৪৩

অপ*রাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেয়া। মাথা টা যথাসম্ভব নিচের দিকে নোয়ানো।সূর্যের অবস্থান তখন মাথার ওপর থাকায় তার কিছু তেজ জানালার কাচ ভেদ করে ও ঘরে ঢুকছে। কোলাহল পূর্ণ এ শহরে চারদিকে শুধু ব্যস্ততা।ব্যস্ততা নেই শুধু দুটি মানুষের, তারা কেয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কেয়ার উত্তর জানার অপেক্ষা করছে।কেয়ার নিস্তব্ধতায় বাঁধনের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চোখ দুটোও লাল হয়ে আছে।শ্যামলা ছেলেটা রাগের কারণে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে।শেষমেশ কথা বলে বাঁধন,

“এই মেয়ে, তোমার সমস্যা টা কি? আর সময় তো খুব বকবক করো,এখন চুপ কেন? কি শুরু করেছ তুমি? তুমি কি আমার ভালোবাসা কে বাজারের সস্তা পণ্য মনে করেছ? যে ইচ্ছে হলো না নর্দমায় ছুড়ে ফেলে দেব? কি কি ভেবেছ,আমি তোমার এসব অতীতের কথা শুনে দৌড়ে লেজ গুটিয়ে পালাব? এমনই মনে হয় তোমার? কি এসব পাগলামি শুরু করেছ, খুব তো ওপরে ওপরে সাহসীর অভিনয় করো,এই তোমার সাহস? এই তোমার মনোবল? আমি ভালোবাসি তোমায়,একটু না,অনেক ভালোবাসি। এই সামান্য অতীতের জন্য পালাব বলে নয়,তোমার এই হাত ধরে সারাজীবন থাকব বলে।এমন হাজারটা অতীত ও তোমায় আমার কাছে থেকে দূরে সরাতে পারবে না,শুধু তুৃমি আমার হাত টা ধরে রেখ।আর তুমি জানো? তোমার এই অতীতের সাহসিকতা দেখে আমার ভালোবাসা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।আর কোন কষ্ট পেতে দেব না তোমায়,ট্রাস্ট মি।”

কেয়ার চোখে তখন ঘোর বরষা।বাঁধনের কথা গুলো শুনে ঝরঝর করে কাঁদছে কেয়া।ছোঁয়া গিয়ে কেয়ার কাঁধে হাত রাখে,সাথে সাথেই কেয়া ছোঁয়া কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে।

“দেখ কেয়া,এমন কান্না তোর মানায় না।কতো সাহসী মেয়ে তুই,আমি তো তোকে আমার আইডল মানতাম,কিন্তু এখন দেখছি তুই তো একটা মস্তবড় ভীতুর ডিম।আমরা সবাই আছি তোর পাশে,বাঁধন ভাইয়া তোকে কোন দুঃখকে ছুঁতে ও দেবেনা কেয়া।অনেক কষ্ট সহ্য করেছিস তুই বোন।এতোটুকু বয়সে তুই এতোটা যু*দ্ধ করেছিস।আর আজ,আজ কেন তুই এমন ভেঙে পড়ছিস,বল আমায়”

“আমার খুব ভয় করে ছোঁয়া, আমি ভয়ে সবসময় মিইয়ে থাকি,যদি ঐ লোকটা আবার আসে আমার জীবনে? যদি আবার স্বামীর দাবী নিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে লাগে আমায়,যদি বাঁধনের কোন ক্ষতি করে দেয়? ও ওরা খুব খারাপ ছোঁয়া। আমার ভয় করে।”
এতোটুকু বলতেই রেগে ওঠে বাঁধন।টেবিলে জোরে একটা লাথি মে*রে বলে,

“ওহ্! স্টপ দিস ননসেন্স! ডোন্ট ক্রাই,এন্ড ডোন্ট টক এ্যাবাউট এ্যানি ইউজলেস টপিক।কি বলছ কি তুমি? কিসের স্বামী? আর কিসের দাবী করবে? আর ভুলে যেও আমি একজন সিআইডি অফিসার। ঐ স্কাউন্ডেল টা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আগে তুৃমি বলো আমায় ভালোবাসো কি না?উইল ইউ ম্যারি মি?”

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কেয়া।বাঁধনের এমন রেগে যাওয়া দেখে ছোঁয়া ও কিছু টা শ*ঙ্কিত।সবসময় হাসিখুশি থাকা ছেলেটা যে এমন রেগে যেতে পারে তা ছোঁয়া আর কেয়া দুজনেই হয়তো ভাবতে পারে নি।কেয়া চুপ করে থাকায় আবারও ধম*ক দেয় বাঁধন।

“কি হলো,চুপ কেন? বলো,ভালোবাসো আমায়? শুধু তুমি বলো ভালোবাসো কি না? তুমি ভালোবাসলে এমন হাজারো অতীত পেছনে ফেলে হাজার বছর সামনে এগোতে পারি আমি, হাজার জনের সাথে ল*ড়াই করতে পারি তবে তোমায় বলতে হবে ভালোবাসো কি না? চুপ থেকো না,উত্তর দাও।ছোঁয়াআআ, আনসার দিতে বলো ওকে,কথা বলতে বলো। ”

কেয়া৷ শুধু মাথা নিচু করে কাঁদছে।

“ওকে ফাইন,আমি যা বোঝার বুঝে গেছি,আমারই ভুল কারও মনে কি চলছে না জেনে ভালোবাসা। আ’ম সরি,আর কখনও ডিস্টার্ব করব না তোমায়,তুমি তোমার জীবন তোমার মতো গুছিয়ে নাও।অল দ্যা বেস্ট। ছোঁয়া, আমি গেলাম বাই,আর হয়তো কয়েকদিন আছি এ শহরে, আমার পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা চলছে, যাওয়ার আগে তোমার সাথে দেখা করেই যাব।ভালো থেকো।”
বলেই বাধন দরজার দিকে পা বাড়ায়, এমন সময় কাঁদতে কাঁদতে কেয়া বলে,

“দাঁড়ান”

বলেই দৌড়ে যায় বাঁধনের কাছে।তারপর সামনাসামনি গিয়েই বলে,

“ভালোবাসি আমি আপনাকে। অনেক অনেক ভালোবাসি।এতটা ভালো কখনও কাউকে বাসিনি।বাবা মা তো ভালোবাসা কি জিনিস বোঝার আগেই চলে গেলো,তাই তো ভালোবাসা কেমন আমি বুঝতাম না।কিন্তু এই কয়দিনে বার বার,প্রতি মূহুর্তে আমি একটু একটু করে অনুভব করেছি ভালোবাসা কি?ভালোবাসার মানুষ কেমন হয়।প্রতিবার হারানোর ভয়ে কেঁপে ওঠেছে আমার মন।এটায় বুঝি ভালোবাসা? যদি এটায় ভালোবাসা হয় তাহলে অনেক ভালোবাসি আমি আপনাকে। ”

বলেই হাম*লে পড়ল কেয়া বাঁধনের বুকে।বাঁধন ও নিজের দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল প্রিয়তমাকে।

“বোকা মেয়ে, তুমি ভাবলে কি করে এসব ঠুনকো কারণে আমি তোমায় ছেড়ে যাব।এতোটা হালকা নয় ম্যাডাম,এই বাঁধনের ভালোবাসা। সাতাশ বছর জীবনে প্রথম ভালোবাসছি কাউকে,এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাব না,তবে সাতাশ বছর পর ছেড়ে যেতে পারি।”
কেয়া কে রাগানোর জন্য বলল বাঁধন। সাথে সাথেই বাঁধনের বুক থেকে মাথা তুলে এলোপাতাড়ি কি*ল ঘু*ষি মা*রতে লাগল কেয়া।দুজনেই হেসে উঠলো সাথে সাথে।

এতোক্ষণ ধরে এদের প্রেম কাহিনি দেখে চলা ছোঁয়া এবার মুখ খুলল,

“উহু,আমার জামাই টা যে কই? এদের এমন রোমান্স দেখে আমার নিজেরই তো জামাইয়ের অভাব ফিল হচ্ছে। আমার মাষ্টারমশাই জানি কই,কোন মেয়েরে দেখায় ব্যস্ত আছে। ”

ছোঁয়ার মুখ ভাজ করে বলা কথায় বাঁধন কেয়া দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো। কেয়া এসে ছোঁয়ার কানে ধরে বলল,

“আমরা রোমান্স করছি না? তোরা যা করিস আল্লাহ গো আল্লাহ! বাথরুমে আঁট*কে থেকে দেখে দেখে আমার হার্টফেইল হওয়ার জোগাড়,তাহলে ওগুলো কি ছিল? হুম ”

“দেদেখ কেয়া, একদম আজেবাজে কথা বলবি না,কিকিই করেছি আমরা।শয়তান মেয়ে। চুপ কর।”

“কিছুই করো নি না? দুজনের চুমুচামা লজ্জায় আমি পটল তুলতে গেছিলাম তার বেলায় কি?”

ছোঁয়া এবার সত্যিই লজ্জা পায়,
“ভাইয়া,তুমি ই শয়তান মেয়ের কথা বিশ্বাস করো না তো।একদম বাজে কথা।”

“হুম বোন,একদম বিশ্বাস করব না।আরে দূর,কি যে বলে ঐ উগান্ডা? এসব চুমু চামা হয় নাকি? এগুলো একদম আজাইরা। তোমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ,অথচ তোমাদের মাঝে কোন কোন চুমু চামা হয়নি,এটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।কারণ হলে আরও অনেক কিছু হয়েছে, শুধু চুমুচামা কেন,তাই না?”

বাঁধনের ঘুরিয়ে বলা কথা প্রথমে ছোঁয়া বুঝতে না পারলেও একটু পর ঠিকই বুঝতে পারে,

“এ্যা্! ভাইয়া তুমিও।যাও তোমরা দুজনেই খারাপ। ”

কেয়া বাঁধন দুজনেই হেসে ওঠে ছোঁয়ার বেহাল দশা দেখে।

ছোঁয়া ও ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে ওদের একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দিলো।এতোদিনে কেয়া ভরসা করার একটা ছায়া,একটা বুকের আশ্রয় পেয়ে আবার ও বাঁধনের বুকে আবদ্ধ হয়ে ভয়*ংকর অতীতের যাতনার চিহ্ন গুলো মুছে নিল।বাঁধন কেয়ার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে সারাজীবন এই দুঃখিনী মেয়ে টাকে আগলে রাখার ওয়াদা করল।অতীতের কষ্ট গুলো এক মুহূর্তে কেয়া ও ভুলে গেল প্রিয় মানুষটির স্পর্শ পেয়ে।

আজ ছোঁয়া পাতল বেগুনি রঙের একটা শাড়ী পড়েছে।চুলগুলো হাত খোপা করে রেখে রান্না করছিল।আঁচল কোমড়ে গোঁজা। রাতের রান্না টা বেশির ভাগ ছোঁয়াই করে।রান্না বলতে আলম চৌধুরীর জন্য কয়টা রুটি আর সবার জন্য একটু ভাত।তরকারি রান্নার প্রয়োজন খুব একটা হয়না।দুপুরে তো এমনিতেই দু তিন রকমের রান্না হয়, সেটায় গরম করে রাখলেই হয়।সাহানা বেগম আজ মাগরিবের নামাজ পড়ে আর নীচে আসেন নি,তিনি খুব মনোযোগ দিয়েছেন উলের সোয়েটার টা বুনায়।বাসায় এসে স্বাধীন কেবলই উপরে যাচ্ছিল,এমন সময় চোখে পড়ে রান্না ঘরে এক তরুণী পাতলা শাড়ী পড়ে কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্না করছে।নারী দেহের এক অপরূপ সৌন্দর্য্য মোহঘোরে অবলোকন করল স্বাধীন। শাড়ীর ফাঁকে বের হওয়া ফর্সা মেদহীন উদর দেখে স্বাধীনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নব যৌবনের সৌন্দর্য খেলা করছে।আধখোলা হাত খোপা টা উন্মুক্ত ঘাড়ে পড়ে আছে, কাঁধের কিছু নীচে ছোট্ট কালো তিলটা এখানে থেকেও জ্বল*জ্বল করছে। নারী দেহের এমন আদুরে ভঙ্গিমা ঠিক কোন সাধু পুরুষের এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে স্বাধীনের জানা নেই। লতানো শরীর টা যে ওকে চুম্বকের মতো টানছে তা বুঝতে পারছে স্বাধীন। ছোঁয়ার জন্য আনা চকলেটের বাক্সটা টেবিলে রেখেই রান্না ঘরে চলে গেলো ও।সরাসরি আঁচলের ফাঁক দিয়ে উন্মুক্ত উদরে হাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ছোঁয়া কে। কাঁধে থুতনি রেখে গভীর একটা চুমু বসিয়ে দিলো কাঁধে। হটাৎ এমন স্পর্শে কেঁপে উঠল ছোঁয়া। পারফিউমের গন্ধে বুঝতেই পেরেছে জড়িয়ে ধরা পুরুষ টি ওর প্রাণভমরা।

“কি করছ কি? ছাড়ো।দেখছ না রান্না করছি। ”

“উঁহু, ছাড়বো না।আমি এমন জড়িয়ে ধরেই থাকব,তুই রান্না করবি।”

“আজ্ঞে নাহ্। এখনই বড়মা এসে যাবে বড় আব্বুর জন্য খাবার নিতে।ছাড়ো তো আমায়।বেশরম পুরুষ মানুষ। খালি মেয়ে মানুষ দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে?”

“উহু,সব মেয়ে দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে না,খালি আমার বউকে দেখলেই। আমার বউয়ের মতো আবেদনময়ী আর কেউ হতেই পারেনা।”

“ছিহ্! কি সব বলছ? একটু লজ্জা করছে না।খচ্চর ছেলে।”

“ফের খচ্চর বললি? আচ্ছা দেখাচ্ছি খচ্চরগিরি কাকে বলে।”

বলেই ছোঁয়ার গলায় মুখ ডুবায় স্বাধীন। অগোছালো চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগে ছোঁয়ার গলদেশ। স্বাধীন যে নিজের কন্ট্রোল হারাচ্ছে বুঝতে পারে ছোঁয়া। তাই তো এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে সোজা করতে বলে,

“হ্যাঁ বড় মা।কিছু বলবে?”

সাথে সাথেই চমকে ওঠে ছোঁয়াকে ছেড়ে দেয় স্বাধীন। হো হো করে হেসে ওঠে ছোঁয়া। ছোঁয়ার চালাকি বুঝতে পেরে ছোঁয়ার মাথায় চাটি মা*রে স্বাধীন।

“আমায় জ্বা*লানো না? আমি তোর কোন জন্মের শত্রুরে? আয় আজ ঘরে,স্বাধীন কি জিনিস বুঝাবো।সারারাত ঘুমাতে দেবো না আজ তোকে।আমার উত্তাপ সহ্য করার জন্য তৈরী থাকিস।”

বলেই ঘরের দিকে পা বাড়ায় স্বাধীন,,,,,,,

চলবে,,,,,

#এ_কেমন_ভালোবাসা

#পর্ব_৪৪(শেষ পর্ব)

#মাসুরা_খাতুন

শীত পেরিয়ে বসন্তের আবির্ভাব।প্রায় দু মাস আগের কেয়া এখন অনেক টায় সাহসী। পুরোটা সময় ও পাশে বাঁধন কে আর ছোঁয়ার পুরো পরিবারকে পেয়েছে । সুরুজ এখনও ওমন জুয়াড়িই আছে তবে আর বিয়ে টিয়ে করেনি।ওর বদঅভ্যাস গুলোর কারণে ডিভোর্স পেতেও খুব একটা সমস্যা হয় নি কেয়ার।তারওপর বাঁধন সবটা সামলিয়েছে।প্রথমে ঐ গ্রামে যেতে কেয়া একদমই রাজি ছিলো না।ও খুব ভয় পাচ্ছিল,রাতের আধারে একজন কে আহ*ত করে ও সেদিন যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল,সেখানেই দিনের আলোয় যাওয়ার কথা হতেই ও ভয়ে আত*ঙ্কিত হয়ে পড়ে।কিন্তু বাঁধন কেয়া কে সাহস জোগায় ওখানে গিয়ে সবার সাথে মোকাবেলা করার জন্য মনোবল তৈরী করায়।ওরা প্রথমেই ওর চাচা হাশেম মিয়ার বাড়ি যায়।কিন্তু ওখানে গিয়ে ও বুঝতে পারে কারো ওপর অন্যায় করে কেউ সুখি হতে পারে না।ও চলে আসার পরপরই ওর চাচার প্যারালাইসিস হয়ে যায়। চাচার চিকিৎসা করতে ওদের সম্পত্তি বেশির ভাগই বিক্রি করতে হয়।বর্তমানে শুধু কেয়ার নামে ওর বাবার সম্পত্তি যেগুলো ছিল ওগুলোই আছে।ওগুলো আর ওরা বেচতে পারেনি।চাচী এখন মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে চাচার ওষুধ আর সংসার চালায়।হাফসার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তাকে পাশের গ্রামে বিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু ওর মা, অর্থাৎ কেয়ার চাচী খারাপ হওয়ায় ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দেয় নি।আর সবথেকে নোংরা যে লোকটা,যে আপন র*ক্তকেও ছাড়ে নি নিজের নোংরা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সেই হারুন এখন সুরুজের দলে।সারাদিন কি সব নে*শার জিনিস খেয়ে পড়ে থাকে,আর জু*য়া খেলার জন্য এসে মায়ের সাথে চোটপাট করে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।প্রথমে কেয়ার চাচী কেয়া কে দেখে লজ্জায় মাথা তুলতে পারে না।সেই দুঃখী কেয়ার শহরে থেকে এমন উজ্জ্বল পরিপাটি জীবন দেখে অবাক হয়ে যান উনি।নিজের করা অপকর্মের সাজা এমন ভাবে পেয়ে চোখ তুলে তাকাতে পারে না কেয়ার চোখে। আসলে আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরাই নারীদের বেশী ক্ষতি করে। কি হতো কেয়ার চাচী যদি বাবা মা ম*রা অনাথ মেয়ে টাকে নিজের মেয়ে হাফসার মতো গ্রহণ করতেন।শুধু উনি মেনে নিলেই আর কেয়ার এমন একটা নোংরা অতীত তৈরী হতোনা,যা বারবার দ*গ্ধ করে কেয়া কে।

কেয়াও খুব একটা পাত্তা দেয়নি উনাকে।চাচা হাসেম আলী কেয়া এসেছে শুনে ওর সাথে দেখা করার জন্য ছ*টফট করছিল শুনে শুধু গিয়ে একটি বার দেখা করে এসেছে উনার সাথে। খুব একটা কথা না বাড়িয়ে শুধু কেমন দিনকাল যাচ্ছে তাই প্রশ্ন করেছে। মুখে মাফ করেছি, মাফ করেছি বললেও এই বাড়ির মানুষ গুলোর প্রতি কেয়ার দারুণ ঘৃণা,কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না এদের। এদের জন্য কেয়া কে জীবনে কতোটা সংগ্রাম করতে হয়েছে তা কেয়া জানে।

ওরা গিয়ে ওর বিউটি আপার বাড়িতে উঠেছিল। বিউটি ও একজন ভালো মানুষ পেয়ে দ্বিতীয় বারের মতো জীবন শুরু করে।আর কেয়ার পাশে বাঁধন কে দেখে এবং বাঁধনের পরিচয় জেনে উনিও খুব খুশি হন।এতোদিনে কেয়া ওর যোগ্য একটা মানুষ পাওয়ায়,আর একা লড়াই করা মেয়ে টার একজন ছায়া হওয়ায় বিউটি ও চরম খুশি।

সুরুজ নামের নোংরা লোকটার মুখোমুখি ও হয় কেয়া।সে তার অভ্যাসবশত কেয়া কে আর বাঁধন কে নোংরা গা*লিগালাজ করে।কিন্তু পরোক্ষনেই যখন ওদের থানার পুলিশ কে ও দেখল বাঁধন কে সমাদর করতে তখন বাঁধনের পরিচয় জেনে ভয় পেয়ে যায় সুরুজ। আর বাঁধন যখন বলে যে ভালোই ভালোই ডিভোর্স না দিলে ওর নামে বধূ নির্যা*তনের কে*স করবে তখন সুরুজ রাজি হয়ে যায় ডিভোর্স দিতে।বাঁধন জানতো এতোদিন পর কেয়া গ্রামে গেলে সুরুজ ঠিক কোন ঝা*মেলা করার চেষ্টা করবে তাই তো আগেই ফোন দিয়ে ওখানকার পুলিশ কে ডেকে নিয়েছিল।

____________

বাঁধন একমাস হলো সিলেট এ আছে। ওর পোস্টিং এখন সিলেটের এক প্রত্যন্ত এলাকায়।তাই তো ও নিজেও চায় নি কেয়াকে ওখানে নিয়ে যেতে। আর কেয়া ও চাচ্ছিল এখনে থেকে ছোঁয়ার সাথে অনার্স টা কমপ্লিট করতে।তবে ছোঁয়ার বড় মা সাহানা বেগম নিজে ছোঁয়া কে সাথে নিয়ে কেয়ার মেসে গিয়ে ওকে নিয়ে এসেছেন উনাদের বাড়িতে। এখন ছোঁয়া আর কেয়া একসাথেই থাকে সারাদিন। দুজনে মিলে রান্না করে,ঘর গোছায়,ঝগড়া করে আবার সাহানা বেগমের কাছে বিচার নিয়ে যায়।একেকজন বিচারের রায় নিজের দিকে নেওয়ার জন্য চুপিচুপি সাহানা বেগমের ঘরে গিয়ে পা টিপে, তেল মালিশ করে আসে।যাতে সাহানা বেগম তার দিকে রায় দেন।দুজনেরই সেবা নেওয়া হয়ে গেলে সাহানা বেগম দুজনেরই কান দু হাতে ধরে আদুরে ভঙ্গিমায় বকে দেন দুজনকে,যাতে আর দু-জনের মধ্যে ঝগড়া না করে।পরে তিনজনই একসাথে হেসে ওঠে। মাঝে মাঝে কেয়া মেয়েদের সাজের সব জিনিস গুলো এনে সাহানা বেগম কে জোড় করে মেকআপ করিয়ে দেয়,একদম ভারী মেকআপ করায়।আর ছোঁয়া গিয়ে জোড় করে আলম চৌধুরী কে পাঞ্জাবী শেরওয়ানি পরায়।তারপর উনাদের দুজনকে রুমে পাঠিয়ে ওরা দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে,উনারা যখন একটু একে অপরের দিকে দেখেন তখনই হো হো করে হেসে ওরা বেড়িয়ে পড়ে।সাহানা বেগম দুজনেরই কান ধরে বাইরে রেখে আসেন।মোটামুটি সুখে উনাদের সংসার চলতে থাকে, এমনিতেই উনাদের সংসারে সুখ ছিল,কিন্তু দু দুটো কিশোরী মেয়ের খুনসুটিটে আরও যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে উনাদের আনন্দ।

এতোকিছুর মাঝে ও সুখ নেই শুধু একটি মানুষের মনে।সে হলো আমাদের গল্পের হিরো স্বাধীন। বিয়ের এতোদিন হতে চলল তবুও বউ তাকে ভাইয়া ডাকে।বেচারা এমনিতেই একটু বেশি রোমান্টিক, বউকে একা পেলেই ওর খালি রোমান্স পায় আর তখনই ওর একমাত্র বউ, শয়তানি মহিলা ছোঁয়া ওকে ভাইয়া ডাকে। ওর রোমান্স গুলোর বারোটা বেজে মনে আরমান আলিফের গান বাজে “মাইয়ারে মাইয়ারে তুই অপরাধী রে।”

কলেজের ক্যান্টিনে ছোঁয়া আর কেয়া বসে বসে সিঙাড়া খাচ্ছিল,সাথে রঙ চা।খাওয়ার এক পর্যায়ে কেয়া ওদের পাশে বসা এক জুনিয়র ছেলে তারিফ কে বলে,

“এই ছেলে, কোন ইয়ার যেন তুমি?”

“জ্বি আপু আমি ফ্রাস্ট ইয়ার।”

“আমরা কোন ইয়ার জানো? ”

“না আপু।”

“আমরা তোমার সিনিয়র। আর সিনিয়রের সাথে পাশাপাশি বসে খাচ্ছ তোমার কি একটু সাহস বেশিই মনে হচ্ছে না? তুৃমি কি আমাদের সালাম দিয়েছো? বেয়াদ্দপ ছেলে।”

“সরি আপু আমার ভুল হয়ে গেছে। আসসালামু আলাইকুম। আর এমন হবে না।”

“ওয়ালাইকুম সালাম। ”

বলে কেয়া একটা জ্ঞানীদের ভাব নিয়ে তাকায় ছেলেটার দিকে।

পাশে ছোঁয়া এতোক্ষণ এদের কান্ড দেখছিল,কিন্তু এখন বুঝতে পারে ও আরও ভোগাবে ছেলেটাকে দিয়ে, তায় কেয়ার কানে কানে বলে,

“থাক না কেয়া,বাদ দে না ছেলেটাকে।খুব ভদ্র সদ্র মনে হচ্ছে। স্টপ ইয়ার।”

মুচকি হাসে কেয়া ছোঁয়ার কথা শোনে।

“ওহ্ হ্যাঁ,এই ছেলেটাকেই বলতে বলছিস? আচ্ছা সমস্যা নেই। ও আমাদের জুনিয়র, আর ওকে আমরা কিছু বললে অবশ্যই করবে।আমি ওকেই বলছি।”

অবাক হয়ে যায় ছোঁয়া। কি বলছে কি এই মেয়ে টা,ও কখন এই ছেলেকে কিছু বলতে বলল? ও তো থামতে বলেছে।কি সব বলছে এই মেয়েটা।মনে মনেই ভাবে ছোঁয়া।

“তো হ্যাঁ ছোট শোন,তোমায় একটা শর্তে মাফ করতে পারি,তা হলো আমাদের একটা কাজ করে দিতে হবে বুঝলে।আর যদি না করো,তোমায় হারে হারে বোঝাবো এই কেয়া কি জিনিস।এই কলেজের ভিপি আমার বয়ফ্রেন্ড বুঝলে? পুরো গ্যা*ং এনে তুলে নেব তোমায়।”

“ও নাউজুবিল্লাহ! কিসব বলে এই মেয়ে টা।ভিপি ওর বয়ফ্রেন্ড ছিলো কোন জন্মের? ও তো বাঁধন ভাইয়ার রেজিস্ট্রিকৃত বউ।”

মনে মনেই দোয়া দরূদ পড়ে ছোঁয়া।

ছেলেটা ও থতমত খেয়ে যায় নিজের ভুলের জন্য।

“কি কাজ করতে হবে আপু? আমায় বলেন,আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি। ”

“ওকে গুডবয়।আচ্ছা আমাদের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের সাহারিয়ার স্যার কে চেনো তো?”

“হালকা চিনি আপু।তবে খুব বেশি না।”

“ব্যাপার না।আমিই চিনিয়ে দেবোনে।তো শোন আসল কাজ টা।ঐ সাহারিয়ার স্যার কে গিয়ে তোমার বলতে হবে এই যে ছোঁয়া এ আমার বান্ধবী এ স্যারকে খুব ভালোবাসে।তো স্যার কে বলবে যে স্যার সেকেন্ড ইয়ারের ছোঁয়া আপু আপনাকে খুব ভালোবাসে,আর আপনার সাথে প্রেম করতে চায়,আপনি কি রাজি?”

অবাক হয়ে চার ইঞ্চি মুখ ফাক করে হা করে থাকে ছোঁয়া । এ মেয়ে বলছে টা কি এগুলো?

“আপু কি বলছেন এগুলো? স্যার যদি রেগে যায়? ”

“সেটা তুমি বুঝবে।আমি বলেছি তোমায় করতে হবে এবার স্যারকে কি করে হ্যান্ডেল করবে সেটা তুৃমি জানো।তবে হ্যাঁ,আমার মনে হয় না উনি তোমার ওপর রাগবেন। ”

“আপু,কাজ টা কি করতেই হবে? বলছি যে না করলে হয় না?”

“আলবাত করতে হবে।হ্যাঁ মানে হ্যাঁ।”

“আচ্ছা ঠিক আছে আপু, আমি এখনই যাচ্ছি। ”

বলে ছেলেটা চলে যায় স্বাধীনের রুমে।

“এই মেয়ে, এবার অন্তত মুখ টা বন্ধ কর।ও অলরেডি চলে গেছে। ”

“এ্যা? কি করছিস কি তুই দোস্ত? এসব কেমন পাগলামি? উনি ঠিক রেগে যাবেন।”

“রেগে গেলে সামলাবি তুই।উনি যতোই রাগুক,তোর আদরের কাছে আসলে যে একেবারে ভেজা বেড়াল তা আমি জানি। কতো রোমান্স তোদের দেখলাম। ”

মুখ উল্টিয়ে বলল কেয়া।

“এ্যাঁ? তারমানে তুই আমাদের বেডরুমে উঁকি দিয়েছিস? দাঁড়া, আজই বাঁধন ভাইয়াকে বলে দেবো তুই দিন দিন লুচু হয়ে যাচ্ছিস। ”

“উহ্,তোদের রোমান্স দেখতে বুঝি বেডরুমে উঁকি দিতে হয়? তোর রোমান্টিক বর তো একটু আড়াল পেলেই হয়।কত্তো রান্নাঘরে, ব্যালকোণিতে,ছাদে তোদের রোমান্স দেখলাম।”

এবার সত্যিই লজ্জা পায় ছোঁয়া। কেয়ার বলা কথা গুলো যে ঠিক ও তা জানে।তাই তো এই বিষয়ে ওর সাথে তর্ক করে লাভ নেই বলে চুপ থাকে।

এদিকে ছেলেটা ও গিয়ে সত্যি সত্যি প্রপোজ করে স্বাধীন কে।

“স্যার একটা কথা বলার ছিল।প্লিজ যদি কিছু মনে না করেন।”

“হুম,বলো।”

“আসলে স্যার আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ছোঁয়া আপু আপনাকে খুব পছন্দ করেন,ভালোবাসেন।উনি আপনার সাথে রিলেশন করতে চান যদি আপনি রাজী থাকেন।”

এবারে ছেলেটার মুখের দিকে তাকায় স্বাধীন। ভদ্র গোছের ছেলেটিকে যে চরম বোকা বানিয়েছে ওরা দুজন মিলে তা বুঝতে পারে স্বাধীন।

“কে এসব বলতে বলল তোমায়?”

“ছোঁয়া আপু, আর উনার বান্ধবী। আমি উনার নাম জানি না।ছোঁয়া আপু ঐ আপুকে বললেন বলতে আর উনি আমায় বললেন। ”

“ওও আচ্ছা, এখন তুমি যাও।আমি দেখছি বলে বিষয় টা।”

“ওকে স্যার।আসসালামু আলাইকুম। ”

বলে চলে যায় ছেলেটি।মুখ টিপে হাসে স্বাধীন।

রাতে বাড়ি ফিরেই ছোঁয়া কে ঘুমানো অবস্থায় দেখতে পায়।এটা যে ওর আসল ঘুৃম নয় তা ঠিক বোঝে স্বাধীন। ঘুমন্ত ছোঁয়া কেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরেই চুমু খায় গালে।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে

“তুই তো আজকাল খুব নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস।কলেজে গিয়ে স্মার্ট টিচারদের প্রপোজ করতে শুরু করেছিস।”

“তো কি করবো? বাড়ির টিচার যদি ঠিক মতো সময় না দেয়, তো কলেজেই খুঁজতে হয়।”

“ওও আচ্ছা, সময় কম দেয় তাই না? আচ্ছা, আজ দেখাচ্ছি সময় দেওয়া কাকে বলে।”

আস্তে আস্তে ছোঁয়া স্বাধীনের ভালোবাসার দিনগুলো কেটে যেতে লাগে।রাগী বদমেজাজি মানুষ স্বাধীন ও এখন আর অতোটা রাগতে পারে না ছোঁয়ার ওপর।একটু মাথা গরম হলেই ছোঁয়ার নিষ্পাপ মুখ টা দেখলেই গলে জল হয়ে যায়। তখন নিজেই উঠে পড়ে লাগে মহারাণীর রাগ ভাঙাতে।

বাঁধন আর কেয়া ও খুব সুন্দর সময় কাটায় ফোনে মাঝে মাঝে। তবে ওদের কথা খুব কমই হয়,কারণ কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বাঁধন ফোন নিয়ে যেতে পারে না।তবে যতোটুকু সময় পায় চেষ্টা করে ওর রাগী উগান্ডাবাসী কন্যার সাথে সময় কাটাতে।সারাদিন রাত এতো ঝুঁ*কি নিয়ে কাজ করা শেষে যখন ভিডিও কলে একটুখানি ওর উগান্ডাবাসীর মুখ দেখে সমস্ত ক্লান্তি ওর দূর হয়ে যায়। তবে কেয়া ছোঁয়া দের বাসায় থাকায় বাঁধন ও কিছু টা চিন্তা মুক্ত। মন দিয়ে কাজ করতে পারে।

দিনশেষে ভালোবাসা সুন্দর। প্রিয় মানুষের ভালোবাসার অনেক শক্তি। সবথেকে ভরসা যোগ্য, প্রিয় মানুষটি পাশে থাকলে হাজারও যু*দ্ধ জেতা যায়।ভালোবাসা মানুষ কে বদলে দিতে পারে,ভালোবাসার টানে মানুষ নিজস্ব আদল ভাঙতে বাধ্য। ভেঙেছিল স্বাধীন ও,নিজের ক*ঠোর সত্তা টাকে বিলীন করে প্রেয়সীর প্রেমে ধরা দিয়েছিল,ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছিল ওর কঠোরতা।যা ছিল,তা হলো নিষ্পাপ পবিত্র ভালোবাসা। তেমনই বাবা মা মা*রা যাওয়ার পর থেকে অবহেলায়, অনাদরে বড় হওয়া কেয়া ও নিজের সাহস,বুদ্ধিমত্তার জোরে নিজের জীবন কে সুন্দর করতে পারে,আসলে ওর কপালে ছিল এক মহান প্রেমিকের ভালেবাসা।ও কি করে হেরে গিয়ে ওই অন্ধকারে জীবন কাটাতো।তাই তো পেয়েছিল আলোর দেখা।

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here