ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১

0
5165

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১
অরিত্রিকা আহানা

চারদিকে লাইটের আলোয় ঝলমল করছে বিয়ে বাড়ি। মেহমানদের আনাগোনায় বাড়ির প্রতিটি কোনা মুখরিত! কেবল দোতলার একটা ঘর ছাড়া! হৈ-হট্টগোল ভিড়ভাট্টার মাঝে দোতলার ঐ ঘরে নিবিষ্ট মনে পড়াশোনা করছে নির্ঝর। আগামীকাল থেকে তার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু। সুতরাং বিয়ে বাড়ির আনন্দউল্লাস তাকে একদম টানলো না। ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র সে। প্রফেসরদের চোখের মনি! তার ইমেজ ধরে রাখতে হলে এসব হাসি ঠাট্টা বিসর্জন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। এবং তাই করছে সে।

গানবাজনা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ নিচের ঘরগুলোর তুলনায় উপরের এই ঘরটার কম পৌঁছায়। তাই পড়াশোনার জন্য ছোট খুপরির মত এই ঘরটাকেই বেছে নিয়েছে নির্ঝর। পরিত্যক্ত ঘর বিধায় এই ঘরে লোকজনের আসা যাওয়াও কম। নিরিবিলি, নির্ঝঞ্ঝাট! তবে সমস্যা একটাই, প্রচুর মশা। অত্যাধিক মশার কামড়ে মাঝেমাঝেই পড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে তাঁর। কয়েল নিয়ে আসার কথা একদম মনে ছিলো না। এইমুহূর্তে নিচে গিয়ে কয়েল জ্বালিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতিও নেই। নিচে গেলেই কাজিনরা সব ঘিরে ফেলবে। নির্ঝর উপরে আছে এখনো টের পায় নি কেউ। সবাই যখন বর বউকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত ছিলো তখন একফাঁকে চোরের মত লুকিয়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এসেছে সে। তাই কোনমতে যদি একবার দেখে ফেলে সর্বনাশ! হিড়হিড় করে টেনে আবার নিচে নিয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং মায়ের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত। ততক্ষনে নাহয় কষ্ট করে চালিয়ে নেবে নির্ঝর! মা এলে তাকে কয়েল দিয়ে যাওয়ার কথা বলা যাবে।

অবাক হয়ে চেয়ে আছে নির্ঝর। চশমার ফ্রেমটা ঠিক করে নিয়ে চেনার চেষ্টা করলো সামনের দণ্ডায়মান নারীমূর্তিটিকে। কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। আদৌ দেখেছে কি না তাও মনে পড়ছে না!

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ভ্রমর। তার হাসির তরঙ্গ যেন সারাঘরে উথালপাতাল হয়ে বইতে শুরু করলো। অপ্রস্তুত চেহারা নির্ঝরের। সে যখন খুব মনযোগ দিয়ে ব্যাকটেরিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে পড়াশোনা করছিলো আচমকাই ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে অষ্টাদশী এই রূপসী তরুণী। কানের কাছে অদ্ভুত রকমের একটা শব্দ করতেই চেয়ার ছেড়ে উলটে পড়ে যাওয়ার দশা নির্ঝরের। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই পলকের জন্য বুকের ভেতরটা অদ্ভুত রকমভাবে কেঁপে উঠলো তাঁর। এ কোন আশ্চর্য রূপিণী! বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বহু রূপসী রমনীরদের দেখেছে কিন্তু এমন লাবণ্যময়ী, সহাস্য, সরল প্রতিমার ন্যায় মুখ যেন এই প্রথমবার দেখলো। জীবননান্দ দাশের অদৃশ্য, সেই রহস্যময়ী বনলতা সেন যেন নির্ঝরের সামনে দণ্ডায়মান।

-‘ভয় পেয়েছিলেন?’

মুচকি হেসে উপরোক্ত প্রশ্নটি করলো ভ্রমর। গলা খাঁকারি দিলো নির্ঝর। চশমার ফ্রেম ঠিক করে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,’আচমকা ভুতের মত ঘাড়ে চেপে বসলে ভয় তো পাওয়ারই কথা!’

-‘আপনি ভূতে ভয় পান?’

-‘পাই!’

আবার ঝনঝন করে হাসির শব্দ বয়ে গেলো পুরো ঘরজুড়ে। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো সে হাসির ঢেউ। হাসতে হাসতে ভ্রমরের কামনাময়ী শরীরখানা এদিকে ওদিক দুলছে। পুনরায়! আর একবার চশমা ঠিক করে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো নির্ঝর। মেয়েটির নির্বুদ্ধিতায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো সে। এই বয়সী মেয়েদের চলনেবলনে সবসময়ই সতর্ক থাকা চাই! কিন্তু মেয়েটির সেসবের বালাই নেই-ই বললেই চলে! নিজের মত হেসে যাচ্ছে সে।

-‘আপনি খুব আঁতেল তাই না?’

-‘খানিকটা।’

-‘আমিও শুনেছি। এখানে আসার আগে মা বলছিলো আপনার কথা।’

-‘ওও!’, ছোট করে জবাব দিলো নির্ঝর। অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে ঠিক কি দিয়ে কথাবার্তা এগোবে বুঝতে পারছিলো না সে। কি বলতে কি বলে ফেলে। শেষে আবার খিলখিলিয়ে হাসবে। তার চেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলো।

-‘এই ঘরে তো প্রচুর মশা। আপনাকে কামড়াচ্ছে না?’

-‘হুম।’

-‘তাহলে বসে আছেন কেন? মশার কয়েল নেই?’

-‘আছে নিচের ঘরে।’

-‘তবে জ্বালান নি কেন?’

-‘এখন নিচে গেলে আর আসতে পারবো না। আমার পড়া বাকি আছে।’

-‘আশ্চর্য মানুষ তো আপনি! নিচে এত লোকজন এত আনন্দ করছে আর আপনি এখানে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছেন?’

-‘শুধু মশার কামড় খাচ্ছি না। পড়ছি!’

-‘কেন পড়ছেন?’

-‘কালকে আমার পরীক্ষা!’

-‘আগে পড়েন নি?’

-‘পড়েছি। এখন আবার পড়ছি।’

-‘আপনার ব্রেন কি খুব ডাল?’

মেয়েটার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো নির্ঝর। ইউনিভার্সিটির সেরাছাত্র সে! ডিপার্টমেন্টে একনামে সবাই নির্ঝর রহমানকে চেনে। প্রফেসররা মাঝে মাঝেই গর্ব করে বলেন বিগত একযুগ ধরে নাকি ডিপার্টমেন্টে নির্ঝরের মত ট্যালেন্টেড ছাত্র আর আসে নি। হাইয়েস্ট সিজিপিএ ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ এবং এক্সস্ট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিজ গুলোতে সবসময় অগ্রগামী পদক্ষেপ তাঁর। এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছাত্র সে। এতকাল যাবত নিজের সম্পর্কে এসবই শুনে এসেছে নির্ঝর। তাই ভ্রমরের সরাসরি প্রশ্নের জবাবে আত্মবর্ণনা হিসেবে নিজের সম্পর্কে কি বলবে তা নিয়ে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো। প্রতিউত্তরে একটু মুচকি হাসলো কেবল।

-‘আপনার হাসি তো দারূণ সুন্দর! আচ্ছা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?’

-‘না।’

-‘নেই?’ যেন খুব অবাক হলো ভ্রমর! ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ বেঁকে গেলো তাঁর। বিস্মিত কন্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করলো সে,’নেই! কেন? আপনি তো ভালোই হ্যান্ডসাম! ইনফেক্ট ভালোর চাইতে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম!’

এবার নির্ঝর হাসলো। একটা মেয়ে এত সহজে অচেনা একজন পুরুষমানুষকে হ্যান্ডসাম বলতে পারে এটা যেন তাঁর ভাবনার বাইরে। মুচকি হাসিটা বজায় রেখেই বললো,’না থাকাটা কি খুব দোষের?’

-‘না তেমন বলছি না। অবশ্য আমারও বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি কিন্তু সুন্দরী! আচ্ছা থাক। আমি যাই, আপনি পড়ুন!’

আচমকা ঝড়ো হাওয়া হয়ে যেমন ভেসে এসেছিলো তেমনি আচমকাই বেরিয়ে গেলো। নির্ঝর হতভম্ভ হয়ে চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষন। খানিকক্ষণ ভাবলো। কে এই মেয়ে! কি তাঁর পরিচয়? মেয়েটা কি সত্যিই এসেছিলো নাকি পুরোটাই নির্ঝরের কল্পনা? কল্পনা এত সুন্দর হয়? মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলো সে। কল্পনা হতে যাবে কেন? নির্ঝর রহমান আজ পর্যন্ত আর যা-ই করে থাকুক না কেন, কোন মেয়েকে নিয়ে মিথ্যে কল্পনা করে নি! সুতরাং এটা ভ্রম হতেই পারে না! মেয়েটা হয়ত বিয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজনদের কেউ হবে। পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দিলো সে। কিন্তু কোথায় যেন তালগোল হারিয়ে যাচ্ছে! বইয়ের পাতায় কি কোন ডাগর চোখের হরিণী কিংবা মায়াবীনি কুহকিনীর চেহারা ভেসে উঠছে? বই বন্ধ করে ফেললো নির্ঝর! এ তো আচ্ছা মুশকিল! মেয়েটাকে ডেকে এনে বেশ করে একটু বকে দিতে মন চাইছে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিলো সে। ঘোর লেগেছে তাঁর! ভয়ানক ঘোর! এইমুহূর্তে নিজেকে শান্ত করার চাই। চোখে জোড়া বন্ধ করর নিলো সে। ঠিক তখনই কানের কাছে ‘বনলতা সেন’ যেন ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো ,
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;
অতিদূর সমুদ্রের’পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে
দারুচিনি-দ্বীপের ভেতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে
এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে চাওয়া নাটরের বনলতা সেন।”
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here