ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৫
অরিত্রিকা আহানা
ভ্রমরের প্রফের বাকি আর বেশিদিন নেই। এতদিন যেহেতু পড়াশুনা ভালো করে নি তাই এখন গাধার মত খাটুনি যাচ্ছে তাঁর। রাতদিন চব্বিশঘণ্টা বই নিয়ে পড়ে আছে। বিকেল বেলা নিজের ঘরে বসে পড়ছিলো সে। হঠাৎ রেহানা একগাদা শুকনো কাপড় নিয়ে এসে তাঁর ঘরে ঢুকলো। এইমাত্র ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে এসেছে। ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বললো,’খবর শুনেছিস ভ্রমর? এইমাসের ত্রিশতারিখে নির্ঝরের বিয়ে।’
পড়ার দিকে মনোযোগ থাকায় প্রথনে কানে নিলো না ভ্রমর। হঠাৎ করে কথাটা বোধগম্য হতেই অবাক হয়ে রেহানার দিকে চাইলো সে। রেহানা মুচকি হেসে বললো,’হুম। পাত্রীকে তুই চিনবি। তোদের কলেজেই পড়তো। নাম শিউলি! নির্ঝরের মামার আপন শ্যালকের মেয়ে! এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স নিয়ে পড়াশুনা করছে।’
রেহানার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারলো না ভ্রমর। রেহানা কি তাঁর সাথে মজা করছে? নির্ঝরের বিয়ে? কোনরকম কথাবার্তা ছাড়াই? এদিকে রেহানা তাঁর রিয়েকশন দেখার আশায় বসে আছে বুঝতে পেরে নিজেকে সংযত করে নিলো সে। গম্ভীর গলায় বললো,’ভালোই তো। এই কথা আমাকে বলছো কেন?’
-‘এখনো সময় আছে ভ্রমর। নির্ঝরকে একবার ফোন করে সরি বল। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
-‘জীবনেও না। আমি কেন সরি বলবো?’
-‘কারণটা ভুলটা তুই করেছিস।’
-‘আমি মোটেও ভুল করি নি। যা বলেছি ঠিক বলেছি। তোমাকে বলেছিলাম না নাফিসা রহমান আমাকে সহ্য করতে পারেন না? এবার তাঁর প্রমাণ পেয়েছো তো? এতদিন কি বলেছেন তিনি? আগামী তিনচারবছরের আগে তাঁর ছেলের বিয়ে ধরার কোন পরিকল্পনা তাঁর নেই। এখন যেই আমি বিয়ের জন্য বারণ করে দিলাম ওমনি ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। স্বার্থপর একজন মহিলা!’
রেহানা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’সবসময় তো মানুষের মন মেজাজ একরকম থাকে না ভ্রমর? হয়ত এতদিন সত্যিই ভেবেছিলেন এত তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দেবেন না। কিন্তু এখন ছেলের চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে দেখে খারাপ লাগছে। হতেই তো পারে? তাই হয়ত ছেলের বিয়ে ঠিক করেছেন।’
-‘মোটেও না ভাবি। ঐ মহিলার চালাকি তুমি বুঝবে মা। তিনি খুব ধূর্ত। ইচ্ছে করেই এখন বিয়ে ঠিক করেছেন যেন আমি পড়াশুনা শেষ করলেও উনার ছেলের কাছে যেতে না পারি।’
-‘তুই তো নিজেই বলেছিস তুই নির্ঝরকে বিয়ে করবি না। তবে এখন এত রাগ করছিস কেন?’
‘কই রাগ করছি?’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো ভ্রমর। চোখের পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়লো! অন্তর্বেদনাটুকু স্পষ্টত ফুটে উঠলো মুখে! রেহানা মুচকি হাসলো। যাক এতক্ষনে ডোজ কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। এবার নির্ঝরকে সন্তোষ জনক একটা উত্তর দেওয়া যাবে! তথাপি মুখে করুণ একটা ভাব বজায় রেখে বললো,’তোকে আগেই বলেছিলাম কারো সম্পর্কে ভালোকরে না জেনে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করিস না! তুই শুনলি না! নির্ঝরকেও খেপিয়ে দিলি! এখন লাভটা কি হলো নিজেই তো কষ্ট পাচ্ছিস!’
-‘আমি কি উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেছি ভাবি? কোন কথাটা ভুল বলেছি? তুমিই বলো তাহলে কেন নাফিসা রহমান প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন? আমার বাবা আর ভাইদেরকে ইনসাল্ট করার জন্যই তো?
-‘না। তোর বাপ ভাই কেউ পড়াশুনা করে নি বলে নাফিসা রহমান বিয়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছেন এই কথাটা আংশিক সত্য। শুধুমাত্র পড়াশোনা না জানার কারণে নয় তোদের পরিবারে তো পড়াশোনার কোন গুরুত্বই নেই সেটাও একটা কারণ। তুই-ই ভেবে দেখে কোন মা তার পিএইচডি করতে যাওয়া মেধাবী ছেলেকে এমন একটা পরিবারে বিয়ে দিতে যাবে যেই পরিবারে শিক্ষার কোন গুরুত্বই নেই? তোর ভাইয়েরা কেউ পড়াশুনায় তো খারাপ ছিলো না? শুধুমাত্র বাবা গা করেন নি বলে সবাই হাইস্কুলে উঠতে না উঠতেই গোল্লায় গেছে। শেষমেশ ছেলেরাও সব হলো বাপের মত। আদনান পেটে আসায় তোর ভাইয়া আমাকে অনার্সটা শেষ করতে দিলো না। যাইহোক,এসব কথা এখন থাক। তোর বেলায় এসে যে তাদের বুদ্ধি একটু হলেও খুলেছে তাতেই আমি খুশি ছিলাম। কিন্তু দেখ এবারেও বাবা কিন্তু তোকে পড়াশুনা করানোর চাইতে, পড়াশুনা জানা একটা ছেলের কাছে বিয়ে দিতেই বেশি আগ্রহী! তবে? তুই দিতি তোর ছেলেকে এমন জায়গায় বিয়ে?’
ভ্রমর জবাব দিলো না। কথাগুলোর বিপরীতে উত্তর দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পেলো না সে। সুযোগটা কাজে লাগালো রেহানা। নরম, মোলায়েম কন্ঠে একে একে নির্ঝরদের পারিবারিক ইতিহাস সব খুলে বললো। নির্ঝরের বাবা মারা যাওয়ার পর নাফিসা রহমানের সাথে কি কি হয়েছে, কি করে তিন একা হাতে নির্ঝরকে মানুষ করেছেন সব খুলে বললো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’পৃথিবীতে সব সন্তান একরকম হয় না ভ্রমর। কোনকোন সন্তানের কাছে তাদের বাবা মা কেবল নামে মাত্রই। আবার কোন কোন সন্তানের কাছে তাদের সমস্তপৃথিবীটাই তাদের বাবা মা। নির্ঝর তাদেরই একজন। হয়ত ব্যপারটা তোর কাছে একচোখা মনে হতে পারে কিন্তু নির্ঝরের কাছে নাফিসা রহমান তাঁর মা! এমনই একজন মা! যার মত মা পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। নির্ঝর তোকে ভালোবাসে জানার পর আর একবারের জন্যেও তিনি তোকে মেনে নিতে দ্বিধা করেন নি। তাঁর ছেলে যাকে ভালোবেসেছে তিনি নির্দ্বিধায় তাকে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য রাজী হয়ে গেছেন। তবে এমন মায়ের অসম্মান কোন ছেলে সহ্য করবে? একটা কথা, এতদিন আমি পরিষ্কার বুঝে গেছি, নির্ঝর তাঁর মাকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসে। তুই যদি নির্ঝরকে সত্যিই ভালোবেসে থাকিস তবে এই সত্যিটা মেনে নিয়েই তাঁকে তোর ভালোবাসতে হবে। অন্যথায় নির্ঝরের কথা বাদ দে।’
এতক্ষনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে নির্ঝর। নাফিসা রহমানের ওপর তাঁর যতই রাগ থাকুক না কেন, কোন ছেলেই তার মায়ের অপমান সহ্য করতে পারবে না। নির্ঝরকে সেদিন অনেক বেশি বলে ফেলেছে সে! আফসোস হতাশায়, চোখের পানি টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে। সবসময় সব বোকামি সে-ই কেন করে? রেহানাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’কি করতাম বলো ভাবি? অপমান তো উনিও(নির্ঝর) আমাকে কম করেন নি? বারবার আমাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছেন! আমার রাগ উঠে গিয়েছিলো। বারবার প্রত্যাখানের আঘাত আমি নিতে পারছিলাম না।’
-‘তুই তাকে অপমান করতি। তাঁর মাকে টানলি কেন?’
ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো ভ্রমর। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,’এখন কি করবো ভাবি?’
-‘ফোন দে।’
-‘আমি পারবো না। আমার ভয় করছে!’
রেহানা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সেদিন ফোনে এতগুলো বেদরকারি কথা বললো। অথচ আজকে দরকারে ফোন করতে পারছে না? তবে আজকে আর সে নিজে ফোন কথার ঝুঁকি নিলো না। নিজের কথা ভ্রমরকে নিজেরই বলতে হবে।
★
ঘড়িতে রাত দুটো। নির্ঝর বারান্দায় ফোন হাতে নিয়ে গেমস খেলছে। মূলত ভ্রমরের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে সে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ভ্রমর তাঁকে ফোন করবে। বিকেলে রেহানার কাছ থেকে সব শুনেছে সে। অতএব প্ল্যান কাজে দিয়েছে। আর প্ল্যান যেহেতু কাজে দিয়েছে সুতরাং ভ্রমর নিশ্চয়ই ফোন করবে।
পড়াশেষ করে, ফোন হাতে নিয়ে নিজের ঘরে পায়চারি করছে ভ্রমর। নির্ঝরকে ফোন দেওয়া উচিৎ হবে কি না বুঝতে পারছে না। নির্ঝরের নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছে সে। আনব্লক করতে গিয়েও করলো না। নাহ! কেন ফোন দেবে ভ্রমর? নির্ঝর যদি ভ্রমরকে ভুলে গিয়ে আবার বিয়েতে মত দিতে পারে তবে ভ্রমর কেন তাঁকে ভুলে থাকতে পারবে না? যত কষ্টই হোক। ভ্রমর সহ্য করে নেবে। কিন্তু সত্যিই কি উনি বিয়েতে রাজী হয়েছেন? তবে কি ভ্রমরকে একটুও ভালোবাসেন নি তিনি? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
.
.
.
চলবে