ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৯

0
2741

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৯
অরিত্রিকা আহানা

আজকে ভ্রমরের ফাইনাল প্রফের রেজাল্ট বেরোনোর কথা। পরীক্ষা শেষ হয়েছে তিনমাসের মত হয়েছে। বয়সের সাথে সাথে নাকি সময় দ্রুত পেরিয়ে যায়! কিন্তু ভ্রমরের তো সময় কাটতেই চায় নি। নির্ঝর চলে যাওয়ার পর পার্মানেন্টলি এই বাড়িতে শিফট হয়েছে সে। এই বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছে। বউ শাশুড়িতে খুব একটা খারাপ কাটে নি বলা যায়। কারণ তার যেই দশা নাফিসা রহমানেরও একই অবস্থা। নির্ঝর চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়ি ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। উপরতলায় উঠলেই ছেলের কথা মনে পড়ে। বস্তুত নির্ঝরের অনুপস্থিতিই তার এবং ভ্রমরের অপ্রকাশিত বন্ধনটাকে বেশ কাছাকাছি এনে দিয়েছে। দুজনেই ভেতরে ভেতরে মিস করে নির্ঝরকে। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কাউকে বলে না। পাছে অন্যজনের খারাপ লাগে। দুজনের অপেক্ষার ধরণটাও একই। দুজনেই অপেক্ষা করছে কবে ভ্রমরের এমবিবিএস শেষ করবে, কবে নির্ঝর দেশে ফিরবে? কারণ হিসেব অনুযায়ী, ভ্রমরের এমবিবিএস শেষ হলেই দেশে ফিরে আসবে নির্ঝর। ছুটিতে অবশ্য মাঝখানে দুএকবার এসেছিলো সে কিন্তু সেই আসাতে কি মন ভরে? সুতরাং ভ্রমরের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করছে সব কিছু।

নির্ঝরের পিএইচডি শেষে। চারবছরের মাথাতেই কম্পপ্লিট! ইংল্যান্ডের একটা ইউনিভার্সিটিতে সাময়িকভাবে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে সে। ভ্রমরের পড়াশুনার যাতে কোন ক্ষতি না হয় তারজন্যই বাড়তি আরো একটা বছর অপেক্ষা। তাই আজকে ভ্রমরের রেজাল্ট বেরোবে শুনে সকাল থেকেই ফোন হাতে বসে আছে সে। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই বুকটা দুরুদুরু করছে। ভ্রমরের কাছে শুনেছে নির্ঝর, ফাইনাল প্রফে পাশ করাটা নাকি অনেক টাফ। ভাগ্য খারাপ হবে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও ফেল করে বসে। তাই আরো বেশি করে ভয় হচ্ছে। সকালে ফজর নামাজ পড়ে মুনাজাতে অনেক্ষন ভ্রমরের জন্য দোয়া করেছে সে। তার পিএইচডি নিয়েও এতটা টেনশন হয় নি যতটা ভ্রমরের রেজাল্ট নিয়ে হচ্ছে। একটাই চাওয়া ভ্রমরকে যেন আল্লাহ শেষবারের মত উদ্ধার করে দেয়।

এদিকে আজকে সকাল থেকেই অন্যদিনের চাইতে বেশি কথাবার্তা বলছে ভ্রমর। আসলে উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টা করছে সে। টেনশন বুক কাঁপচগে কিন্তু মুখে এমন ভাবে করে আছে যেন রেজাল্ট নিয়ে কোন টেনশনই নেই তাঁর।
নাফিসা রহমানও চিন্তায় আছেন। তবে প্রকাশ করছেন না। বাসায় বোরহান সাহেব, ভ্রমরের মা, ভাইয়েরা,ভাবিরা সবাই এসেছে ভ্রমরের সাথে দেখা করতে। সবার ভেতরেই উত্তেজনা।
ভ্রমরের মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছে,’আল্লাহ মানসম্মান রেখো তুমি।’


দুপুরের দিকে যোহরের নামাজ শেষ করে সবে সালাম ফিরিয়েছে ভ্রমর তখুনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। তাঁর এক বান্ধবী ফোন করেছে। ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করতেই ঐ পাশ থেকে বান্ধবীর উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেলো,’হ্যাঁ। ভ্রমর রেজাল্ট নাকি বেরিয়েছে? তুই পেয়েছিস?’

-‘না।’

-‘ও!…আমিও পাই নি। রাবেয়া বললো এইমাত্র নাকি বেরিয়েছে, সে পাশ করেছে।’

রাবেয়া ভ্রমরের সহপাঠী! সে কোন ভুয়া খবর দেবে না। বুকের ভেতরটা খচ করে উঠলো ভ্রমরের। রেজাল্ট তবে সত্যিই বেরিয়েছে! ভয়ে আতংকে ফোন কেটে দিয়ে গলা চড়িয়ে তাঁর ভাই রবিনের নাম ধরে ডাক দিলো। ভ্রমরের একবছরের বড় রবিন। দুজনে পিঠাপিঠি রবিনের এখনো বিয়ে হয় নি। তবে পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। ভ্রমর ফোনটা তাঁর হাতে দিয়ে বললো,’রেজাল্ট নাকি বেরিয়েছে! একটু দেখতো গ্রুপে কেউ কোন পোস্ট করেছে কি না? আমার ভয় করছে।’

-‘রোল বল।’

-‘আগে দেখ রেজাল্ট দিয়েছে কি না।’

ভ্রমরের চিৎকার শুনে নাফিসা রহমানও ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পাশে রেহানা সহ পুরো গুষ্ঠির সবাই একে একে হাজির হলো। রবিন গ্রুপে ঢু মেরেই বললো,’রেজাল্টের ছবি তো গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছে। দেখতো এটা কি না?’ ভ্রমর তখনো জায়নামাজেই বসে ছিলো। ভয়ে তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ে ভয়ে ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,’হ্যাঁ।’ পেটের ভেতরে গুড়গুড় করছে। মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার। রবিন বোনের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বললো,’রোল নাম্বার বল। আমি দেখছি।’

ভ্রমরের তাঁর রোল বলার পর রবিন পুরো রেজাল্ট শীটটা ভালো মত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো,’কই তোর রোল নাম্বার তো খুঁজে পাচ্ছি না।’ পেটের ভেতরে জোরেশোরে মোচড় দিয়ে উঠলো ভ্রমরের। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো হৃদপিন্ডটা! কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,’নাম?’ মিনিট খানেক খোঁজাখুঁজির পর রবিন করুণ, অসহায় কন্ঠে বললো,’নেই!’

হতভম্ভ, শব্দহীন হয়ে ভ্রমর কিছুক্ষন তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থেকে আচমকা হাউমাউ করে কান্না শুরু দিলো। নাফিসা রহমানের সহ বাকি সবারই মুখ কালো হয়ে গেলো। এইমুহূর্তে তাদের কি করণীয় কারোরই মাথায় না। নাফিসা রহমান গম্ভীর গলায় রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ভালো করে দেখেছো?’.

-‘জি মামী। এই যে আপনি দেখুন।’

দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন নাফিসা রহমান। ভাগ্যের ওপর প্রচন্ড বিরক্তি হচ্ছে তাঁর। ভ্রমরের পরিশ্রম তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। মেয়েটা রাত দিন এক করে খেটেছে। নিজে চোখে না দেখলে হয়ত মনে মনে ভ্রমরকেই দোষ দিতেন তিনি। কিন্তু সব তো তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছে। প্রফের আগে বিগত একবছর কি অমানুষিক পরিশ্রমটাই না করেছে ভ্রমর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

নাফিসা রহমান বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই ভ্রমরের ফোনটা বেজে উঠলো। নির্ঝর ফোন করেছে। জায়নামাজের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে তখনো দিশেহারা হয়ে কাঁদছিলো ভ্রমর। নির্ঝরের ফোনটা রবিন ফোন রিসিভ করলো। বলাটা অত্যন্ত জরুরীভাবে উল্লেখযোগ্য, ভ্রমরের ফেলের মিথ্যে খবরটা নির্ঝরকেও দিলো সে। নির্ঝর কিছুক্ষন চুপ করে থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন কেটে দিলো।


নাফিসা রহমান নিজের ঘরে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। ভ্রমরকে কি সান্ত্বনা দেবেন তিনি! তাঁর নিজেরই তো অসহ্য লাগছে। ‘পরিশ্রমের ফল অবশ্যম্ভাবী !’ এতদিন ধরে মনে মনে এইটা বিশ্বাস করে এসেছেন তিনি! তবে ভ্রমরের সাথে কেন এমন হলো? মেয়েটা তো চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখে নি! তার সাথে কেন আল্লাহ এমন করলো! পরোক্ষনেই আবার মনে পড়লো, আল্লাহ যা করেন মানুষের ভালোর জন্যই করেন। বিপদে ধৈর্যহারা হলে চলবে না। নিজেকে শান্ত করার জন্য কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।

ঘোর ভাংলো ফোনের আওয়াজে। টেবিলের ওপর তার ফোন বাজছে। স্ক্রিনের নির্ঝরের নাম ভেসে উঠেছে! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন রিসিভ করতেই নির্ঝর সালাম দিয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,’এমন কেন হলো বলতো মা? ভ্রমরের ভাগ্যই কেন সবসময় এত খারাপ? সব সময় কেন ওর সঙ্গেই এমন হয়?’
নাফিসা রহমান সালামের জবাব নিয়ে ধীরেসুস্থে শান্ত গলায় বললেন,’এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন বাবা? একবার ফেল করেছে তো কি হয়েছে? পরীক্ষা কি আর দেওয়া যাবে না নাকি? সাপ্লিমেন্টারী সিস্টেম তো আছে! ছয়মাসেরই তো ব্যপার। ছয়মাস পরে আবার পরীক্ষা দেবে ভ্রমর।’

নির্ঝরও জানে ছয়মাসের ব্যপার। কিন্তু ভ্রমরের মনোবলটা যে ভেঙ্গে গেলো? মায়ের কাছে তাঁর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা সব শুনেছে নির্ঝর। সেজন্যই এত কষ্ট লাগছে। সবকিছুতে ভ্রমরের সাথেই কেন এমন হয়। নাফিসা রহমান ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’এখন ফোন রাখ বাবা। ভ্রমর কাঁদছে, আমারও মাথা ঠিক ছিলো না। ওকে কিছু না বলে চলে এসেছি। ব্যপারটা ভালো হয় নি।’

নির্ঝর চুপচাপ ফোন রেখে দিলো। নাফিসা রহমানও কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে নিরবে উঠে দাঁড়ালেন। দরজায় কাছে আসতে না আসতেই রেহানা ছুটে এসে বললো,’ভ্রমর পাশ করেছে মামী। রবিন অসভ্য, ইতরটা ফাইজলামী করেছে সবার সঙ্গে।’

আচমকা কথাটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন নাফিসা রহমান! একসঙ্গেই উৎফুল্ল, বিস্মিত, বিরক্ত মুখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড় রাগতস্বরে বললেন,’আশ্চর্য! এটা কোন ধরনের মজা? ও কি বাচ্চা নাকি? এতবড় ছেলে এমন কান্ড করলে কেমন লাগে?’

রেহানাও সায় দিয়ে বললো,’বাবা তো হাতের কাছে পেলে মেরেই ফেলতো। ছুটে পালিয়েছে! কোন পাগলে পেয়েছিলো তাঁকে কে জানে!’
নাফিসা রহমান সময় নষ্ট করলেন না। ছুটে ভ্রমরের ঘরের দিকে গেলেন। দরজায় আসতেই দেখলেন বোরহান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ভ্রমর। বোরহান সাহেব কাঁদছেন আবার হাসছেনও। মেয়ের মাথায় হাত রেখে কখনো হো!হো করে হাসছেন আবার খানিকবাদে চুপিসারে চোখ মুছছেন। নাফিসা রহমানকে দেখে লজ্জিত মুখে হাসলেন। ভ্রমরকে ইশারা করে বললেন,’তোমার শ্বাশুড়িকে সালাম করো মা।’

নাফিসা রহমান মুচকি হেসে বাধা দিয়ে বললেন,’আমাকে পরে আগে তোর বাবা মাকে সালাম কর।’ তারপর রেহানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’নির্ঝরকে একটা ফোন করে খবরটা জানিয়ে দাও তো। মন খারাপ করে আছে নিশ্চয়ই। ‘


দুবার রিং হতেই মৌনমুখে রিসিভ করলো নির্ঝর। সবকিছু বেকার, নিরর্থক মনে বচ্ছে তাঁর! কি লাভ হলো এতগুলো বছর ভ্রমরকে দূরে সরিয়ে রেখে। এর চেয়ে দেশে ফিরে গেলেই ভালো হতো। এসব ভাবতে ভাবতেই নিরস কন্ঠে ‘হ্যালো’ বললো সে। রেহানা কোন রকম ভনিতা ছাড়াই চেঁচিয়ে উঠে বললো,’খুশির খবর আছে প্রফেসর সাহেব! তোমার বউ পাশ করেছে!’

আচমকা কথাটা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না নির্ঝর। একটু আগে রবিন কি বললো? ভ্রমর ফেল করেছে! ফোনের ওপাশ থেকে ভ্রমরের কান্নার আওয়াজও শুনেছিলো নির্ঝর! কিন্তু এখন রেহানা আবার কি বলছে? এরা একেক বার একেক কথা বলছে। দ্বিধান্বিত, অধৈর্য, কাতর কন্ঠে বললো,’প্লিজ ভাবি! সত্যি করে বলুন মজা করছেন না?’

-‘ধুর! মজা করবো কেন?’

রেহানার মুখের দিকে চেয়ে ফোনের ওপাশে নির্ঝরের সন্দেহের আভাস পেয়ে গেলেন নাফিসা রহমান। রেহানার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে তিনি নিজেই হাসিমুখে বললেন,’শুধু পাশ করেনি,প্লেস করেছে। সেভেন্থ পজিশন।’

নির্ঝর খুশিতে সজোরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’উফ মাআআআআ!’
নাফিসা রহমান হাসলেন। ফোনটা ভ্রমরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,’কথা বল।’

ভ্রমর ফোন নিয়ে লাজুক মুখে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নির্ঝর উল্লাসিত কন্ঠে হেসে উঠে বললো,’কংগ্রাচুলেশন ডাক্তার জিনাত রহমান ভ্রমর!’

-‘থ্যাংক ইউ।’

নির্ঝর দুষ্টুমির স্বরে বললো,’আমি তো ভেবছিলাম আর দেশেই ফিরবো না। বিদেশেই বিয়েশাদী করে সেটেল হয়ে যাবো!’

ভ্রমরকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। রেহানা তো ভ্রমরের কানের কাছে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করছে ওপাশ থেকে নির্ঝর কি বলছে। এভাবে কথা বলতে ভীষণ লাগছে ভ্রমরের। নির্ঝরের ঠাট্টায় প্রতিউত্তর না করে কিঞ্চিৎ অনুরোধের সুরে লাজুক, কন্ঠে বললো,’সবাইকে সালাম করতে হবে। এখন রাখি?’

নির্ঝর হাসিমুখে বললো,’আচ্ছা, ঠিক আছে। আর সময় নষ্ট করবো না। আল্লাহ হাফেজ!’


একে একে মা, বাবা, শাশুড়িসহ সবাইকে সালাম করলো ভ্রমর। কিছুক্ষন আনন্দ উল্লাস শেষে নাফিসা রহমান, বোরহান সাহেব সহ মুরুব্বিরা ভ্রমর এবং নির্ঝরের রিসেপশনের তারিখ ঠিক করার আলোচনায় বসে গেলো, যেন এতদিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলো তারা।
নিচতলার ড্রয়িংরুমে এসে রবিন দেখেই জুতো নিয়ে সারা বাড়ি তাড়া করলো ভ্রমর। এতক্ষন সবার সামনে কিছু বলতে পারে নি। ভ্রমরের এলোপাথাড়ি কিলের হাত থেকে বাঁচতে রবিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করলো। শেষে হাঁপিয়ে গিয়ে ভ্রমরের ধরাশায়ী হয়ে হেসে উঠে বললো,’আমি দেখতে চাইছিলাম তুই ফেল করেছিস শুনে তোর শাশুড়িমা কি করেন?তাঁর একমাত্র ছেলের বউ ডাক্তারিতে ফেল! ঠুস!’ আবারো হো হো করে এসে উঠলো রবিন। ভ্রমর সজোরে কিল বসিয়ে দিতেই কঁকিয়ে উঠে বললো,’বিশ্বাস কর আর কোন উদ্দেশ্য ছিলো না। আমি শুধু ভদ্রমহিলার মনের কথা সব বের করতে চাইছিলাম। কিন্তু মেজোভাবি সব ভেস্তে দিলো।

নাফিসা রহমান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর রবিনকে মিটিমিটি হাসতে দেখে সন্দেহ হলো রেহানার। সিউর হওয়ার জন্য সেই রবিনের হাত থেকে ফোন নিয়ে পুনরায় রেজাল্ট চেক করে সত্যিটা জানতে পারলো। রেজাল্ট শীটে ভ্রমরের নাম রোল সবই আছে। পাশে পজিশনও দেওয়া আছে! রবিন মিথ্যে বলেছে।
ভ্রমর ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পশুপাখির নামে যতরকম কুৎসিত গালি আছে সব দিয়ে বললো,’তোর ভাগ্য ভালো আমার হাতের কাছে তখন ছিলি না! সামনে থাকতে খুন করে ফেলতাম তোকে! তুই জানিস আমার কতটা কষ্ট হয়েছে? আমার মন চেয়েছে মরে যাই। এত কষ্ট করেও পরেও পাশ করতে পারি ভাবতেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো।’ বলতে বলতেই আবার কেঁদে দিলো ভ্রমর। অনেক সময় ঠাট্টা অনেক জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই কারো স্পর্শকাতর বিষয়ে কখনোই ঠাট্টা করা উচিৎ নয়। রবিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বোনের কাছে এগিয়ে এসে অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,’ইচ্ছে হলে আরো মার। কিন্তু আর কাঁদিস না প্লিজ! ভুল হয়ে গেছে। আর কোনদিন এমন করবো না।’

দুহাতে নিজের কান ধরলো সে। ভ্রমর হেসে ফেললো। অন্যসময়ের চাইতে অনেক বেশি জোরাল হাসি। বস্তুত অত্যাধিক খুশিতে তাঁর পাগল পাগল অবস্থা। এই হাসি, এক কান্না! তার এতদিনের কষ্ট আজকে স্বার্থক হয়েছে। বোনের হাসিমুখের দিকে চেয়ে রবিনও হাসলো। কি জানি হয়ত তাঁর ভেতরটা এখন সামান্যতম হলেও আফসোস করছে কিনা! পড়াশুনা করলো হয়ত এমন একটা দিন তো তাঁর জীবনেও আসতে পারতো? সবাই কত খুশি ভ্রমরকে নিয়ে! কতলোক ভ্রমরের রেজাল্টের জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলো!

ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে ভ্রমর। অপেক্ষা নির্ঝরের ফোন কলের! একটু পর পর ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে সে। সে জানে যত রাতই হোক নির্ঝর আজকে তাঁকে ফোন করবে। কিন্তু ফোন করলে বলবে কি ভ্রমর? লজ্জায় তো কথাই বলতে পারবে না।

তাঁর ভাবনার মাঝখানেই বাংলাদেশি সময় ঠিক রাত বারোটার দিকে ফোন করলো নির্ঝর। স্ক্রিনের নির্ঝরের নাম দেখে উত্তজনায় বুক কাঁপতে শুরু করলো ভ্রমরের। ফোন রিসিভ করে নির্ঝরের হ্যালো বলার অপেক্ষাটুকু পর্যন্ত করলো না। মধুর কণ্ঠে তড়িঘড়ি করে বললো,’ভালোবাসি!’

হ্যালো বলতে গিয়ে থমকে গেলো নির্ঝর! নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। বেশ লম্বা চওড়া হাসি। হাসিমুখেই মিষ্টুমধুর কন্ঠে বললো,’আবার বলো।’

-‘ভালোবাসি!’

নিচের ঠোঁটটা সজোরে কামড়ে ধরলো নির্ঝর। হৃদপিন্ডটা অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজেকে স্থির হওয়ার সময় দিলো সে। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে ভ্রমর আবদারের সুরে বললো,’আপনি বলেছিলেন আমি এমবিবিএস পাশ করলে আপনার কাছে যা চাইবো আপনি তাই দেবেন!’

-‘হুম বলেছি তো। বলো না তুমি কি চাও?’

-‘দেবেন তো?’

-‘দেবো।’

-‘সত্যি দেবেন?’

-‘দেবো।’ ছোট্ট শান্ত জবাব নির্ঝরের।

ভ্রমর কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললো,’আপনি স্বেচ্ছায় আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন।’

-‘রোজ জড়িয়ে ধরবো।’

-‘কমপক্ষে পাঁচমিনিট!’

-‘দশমিনিটের আগে ছাড়বোই না।’

লজ্জায় লাল হয়ে গেলো ভ্রমর। ইশ! ওপাশ থেকে তাঁর সাড়া না পেয়ে নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’আর?…আর কি চাই?’

-‘আপনাকে।’, এবারে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ভ্রমর। অত্যাধিক খুশিতে অকারণেই হাসছে সে। তাঁর হাসি চোটে নির্ঝরও শব্দ করে হেসে উঠে বললো,’ওমা! আপনি আপনি এত হাসির কি আছে?’ কিন্তু ভ্রমরের হাসি তো থামছেই না। নির্ঝর থেমে গেলো। চুপ করে ভ্রমরের হাসির শব্দ শুনে গেলো সে। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি। ভ্রমরের হাসি থামতেই মোলায়েম কন্ঠে বললো,’দেখেছো ভ্রমর আজকে কত খুশি লাগছে তোমার? পড়শুনা করে রেজাল্ট ভালো করলে কত খুশি লাগে এবার বুঝেছো?’

ভ্রমর হাসি থামিয়ে লাজুক কন্ঠে বললো,’থ্যাংক ইউ!’

-‘থ্যাংক ইউ পরে। তুমি যেন কি বলছিলে? কাকে চাই তোমার?’

-‘আপনাকে।’ লাজুক কন্ঠে ফের জবাব দিলো নির্ঝর।

নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’ঠিক আছে আমিটাও তোমাকে দিয়ে দিলাম।’

-‘এখনো শেষ হয় নি কিন্তু?’

-‘হ্যাঁ। আর?’

-‘অনেক ভালোবাসতে হবে আমাকে।’

-‘অনেক অনেক অনেক ভালোবাসতে হবে আপনাকে। আর?’

-‘আর কিছু লাগবে না!’

-‘না, আরো কিছু বলুন।’

ভ্রমর আরো কিছুক্ষন চিন্তাভাবনা করে বললো,’সবসময় আমার জন্য দোয়া করবেন। ব্যস! আর কিছু লাগবে না।’

নির্ঝর প্রশান্ত স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,’এই কথাটা আমি রোজ তোমাকে বলবো বলবো করে ভুলে যাই।’

-‘বলতে হবে না আমি রোজই আপনার জন্য দোয়া করি।’

নির্ঝর হাসলো। ভ্রমর এখনো আগের মতই আছে। একটুও বদলায় নি। এখন তাঁর ভালোবাসার নিবিড়তা,গভীরতা আগের মতই অনুভব করতে পারে নির্ঝর। বেশ জোরালো ভাবেই পারে! কিন্তু আজকের এই মুহূর্তটা ভীষণভাবে মিস করছে সে। ভ্রমরের এতবড় একটা খুশির দিন অথচ দুজন দুই জায়গায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম গলায় ভ্রমরের নাম ধরে ডাক দিলো সে,’ভ্রমর?’

ভ্রমরও বাধ্য মেয়ের মত জবাব দিলো,’জি?’

-‘আমাকে মিস করছো না?’

-‘করছি তো।’

-‘তাহলে একবার একটু নির্ঝর বলে ডাকো না।’

ভ্রমর হেসে ফেললো। লাজুক কন্ঠে বললো,’পারবো না।’

-‘বলো, নির্ঝর আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

-‘আমি আপনাকে ভালোবাসি।’

-‘আপনি নয় বলো তুমি!’

-‘না আপনি।’

-‘তবে আমিও তোমাকে আপনি বলে ডাকবো।’

-‘যাহ্‌!’

-‘এইতো আরেকটুখানি এগোও, বলো তুমি।’

-‘হবে না। আমি আপনাকে আপনি করেই বলবো।’

-‘তবে আমিও আপনাকে আপনি করে বলবো।’

-‘আমি কিন্তু ফোন রেখে দেবো?’

-‘আমিও আবার ফোন করবো।’

-‘ধুর! এমন শুরু করেছেন কেন আপনি?’

-‘কি করেছি আমি?’

-‘ধ্যাৎ!’

নির্ঝর হাসলো। হতাশ কন্ঠে বললো,’আচ্ছা থাক! সম্বোধনে আর কি আসে যায় বলো। আসল কথা হচ্ছে, তুমি আমাকে ভালোবাসো। ঠিক বলেছি না?’

-‘হ্যাঁ। আপনিই তো খামোখা তর্ক করছেন।’

-‘আমি খামোখা তর্ক করছি?’

-‘করছেনই তো।’

-‘ঠিক আছে। তবে আপনি আমাকে বেশ করে একটু বকে দিন, আমি মাইন্ড করবো না।’

-‘আবার?’

-‘আচ্ছা সরি!… এবার বলো, তুমি ইন্টার্ন ডক্টর হিসেবে জয়েন হস্পিটালে জয়েন করছো কবে?’

-‘আপনি আসার পরে।’

-‘কেন আমি আসার পরে কেন?’

-‘ওমা, তা নাহলে আপনার সাথে হবে কি করে?’

-‘বোকা মেয়ে। আমি কি চাইলেই এখনি চলে আসতে পারবো নাকি। চাকরী ছাড়তে হবে, নানান রকম ফর্মালিটিজ আছে সেগুলো ফুলফিল করে তবে না দেশে ফিরতে পারবো! তুমি এককাজ করো যত তাড়াতাড়ি পারো জয়েন করে ফেলো করো। তাহলে আমি আসার আগেই অনেকটা এগিয়ে যাবে। নতুবা আমার এসে লাভটা কি হবে? তোমাকে তো কাছেই পাবো না। তুমি থাকবে হস্পিটালে আমি থাকবো বাসায়।’

ভ্রমরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। নিজের মন খারাপের কথা বাদ দিয়ে নির্ঝরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’আপনি একদম মন খারাপ করবেন না। একবছরই তো,দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।’

হেসে ফেললো নির্ঝর। ভ্রমরের ছেলেমানুষি সান্ত্বনায় স্বস্তি না পেলেও শান্তি পেলো। মন ভরে গেলো। ভ্রমরের কথা সমর্থণ করে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে। আমি একদম মন খারাপ করবো না। এবার রাখি?’

-‘এক্ষুনি ফোন রেখে দেবেন?’

-‘হ্যাঁ। একটা সেমিনারে অ্যাটেন্ড করতে যে।’

-‘ও আচ্ছা। তাহলে রাখি!’

-‘খোদা হাফেজ!
ফোন কেটে গেলো। দুপক্ষই ফোন হাতে নিয়ে নিরবে কিছুক্ষন হাসলো। তারপর নির্ঝর বেরিয়ে পড়লো সেমিনারের উদ্দেশ্যে আর ভ্রমর ব্যস্ত হয়ে পড়লো নির্ঝর ফিরলে কি কি করবে সেসবের ভাবনায়!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here