ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ২

0
1934

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ২
অরিত্রিকা আহানা

‘কতবারো ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া,
তোমারও চরণে দেবো হৃদয়ও খুলিয়া
ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গেরও দেবতা
কেমনে তোমারে কব প্রণয়েরও কথা;’
হারমোনিয়ামের তালে তালে রবীন্দ্র সংগীতের মিষ্টিমধুর সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসছে উপরতলার দরজা ভেদ করে। নিশিরাতে ইন্দ্রিয় মায়াজাল বিছিয়ে কোন এক জাদুকরী কন্ঠস্বর যেন মনোরম সুরের মূর্ছনায় এক আঁজলা প্রেম নিবেদন করছে নির্ঝরের দুয়ারে! রেজিস্ট্যান্স মেকানিজম পড়ার মাঝখানে থমকে গেলো নির্ঝর। অন্তঃকরণে প্রবেশ করলো গানের সুর। বিমোহিত হলো সে। নিচতলা থেকেই কোন এক রমনী কন্ঠে একরাশ আবেগ, ভালোবাসা এবং মায়া জড়িয়ে গেয়ে চলেছে অপূর্ব সুন্দর এই গানটি। বিয়ে বাড়ির হৈচৈরত শ্রোতারা মুহূর্তেই সব নিরব হয়ে গেলো।
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠলো নির্ঝরের। মুগ্ধ হলো সে! এত সুন্দর কন্ঠ! কোন মায়াবিনী মোহিনীর কন্ঠে এমন অদ্ভুত মাদকতা! মন দিয়ে গানের কথাগুলো শুনলো সে,’চরণে ধরিয়া তব কহিবো প্রকাশি; গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি!’

তারপর কেটে গেলো মুহূর্ত!..হঠাৎ করেই থেমে গেলো গান। আকস্মিক সুর ভঙ্গে উল্লাসিত শ্রোতাদের হাত তালির শব্দ অত্যন্ত কর্কশভাবে কানে এসে বিঁধলো নির্ঝরের। ধ্যান ভাঙলো! তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে গান পরিবেশনকারীনি-মেয়েটিই কিছুক্ষন আগে তাঁর ঘরে এসেছিলো। যথাযথ কোন কারণ ছাড়াই বিরক্ত হলো সে! এ-কি বিপদ! এই মেয়েতো তার মনমস্তিষ্কে একেবারে গেঁথে বসার পরিকল্পনা করছে। এ তো হতে দেওয়া যায় না? বলতে দ্বিধা নেই, ঐ মেয়ে আগুন, একেবারে জলন্ত আগুন! বার্নাডস বাবুর সতর্কবাণী মনে পড়ে গেলো নির্ঝরের,’প্রেম একটি জলন্ত সিগারেট, যার শুরুতে আগুন এবং শেষ পরিনতি ছাই!’ নিজেকে বোঝালো সে,’ নির্ঝর রহমান, পড়াশোনায় মন দাও বাবা। মনে রাখবে প্রেম মানেই ছাই!’

নির্দোষ নিচতলাবাসিনীকে শাস্তি দেবার প্রয়াসেই যেন এবার পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন উৎসাহে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিলো সে। গোল্লায় যাক ঐ মেয়ে আর তাঁর গান! এসব নির্বোধ চিন্তাভাবনাকে মোটেও প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলই নির্ঝরের একমাত্র লক্ষ্য!

সে-রাতে সারারাত জেগে পড়াশোনা করলো সে।ঘুমালো কেবল ভোররাতের দিকে মাত্র দুঘন্টা। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার ঘুমঘুম চোখে বই নিয়ে বসলো। ক্ষ্যান্ত দিলো একেবারে পরীক্ষার একঘন্টা আগে। গোসল সেরে, নাশতা করে বেরিয়ে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য। রাতের সেই মায়াবী কুহকিনীর কথা একবারের জন্যেও মনে করার চেষ্টা করলো না। মনে করলেই যেন সর্বনাশ!

পরীক্ষা শেষে ইচ্ছেকরেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে একেবারে বিকেলবেলা বাড়ি ফিরলো সে। বিয়ে বাড়ির আত্মীয়স্বজনরা সব নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে! কিন্তু সদরদরজা পেরিয়ে নিচতলার বসার ঘরে পা রাখতেই একখানা ঘুমন্ত, কোমল, স্নিগ্ধ মুখশ্রী নজরে পড়লো তাঁর। সোফার হাতলে কনুই ঠেকিয়ে আড়ভাবে ঘুমাচ্ছে রাতের সেই মেয়েটি। বিস্মিত নির্ঝর পলকহীন ভাবে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। তারপরই কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বললো,’সাবধান নির্ঝর, প্রেম মানেই ছাই!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেলো সে।


ডাইনিং টেবিলে ছেলের মুখোমুখি বিপরীতে চেয়ারে বসে আছেন নাফিসা রহমান। নির্ঝর খেতে খেতে ফোন স্ক্রল করছে। নাফিসা রহমান তার প্লেটে আরেকচামচ ভাত তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,’পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস?’

-‘ভালো।’

-‘কবে শেষ হবে?’

-‘তেইশ তারিখ!’

নাফিসা রহমান মনে মনে হিসাব করলেন। আজকে ঊনিশ তারিখ তারমানে আরো চারদিন। তিনি ভেবেছিলেন ছেলের পরীক্ষা শেষ হলে তাঁকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাবেন। ইদানীং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তাঁর। কোন কাজ ঠিক মত করতে পারছেন না। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এখন তো মনেই হচ্ছে তাঁকে একাই যেতে হবে! শরীরের যেই অবস্থা তাতে আরো চারদিন অপেক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে তাঁর জন্য!
নির্ঝর খাওয়া শেষ করে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছিলো তখনি এঁটো থালা হাতে নিয়ে রাতের সেই মেয়েটা তার পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। অবাক হলো নির্ঝর! ডাকিনী এখনো যায় নি? নাফিসা রহমান টেবিল থেকে উঠে নামাজ পড়তে চলে গেলেন। মেয়েটা সিংকে ময়লা প্লেট ভিজিয়ে রেখে নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে সহাস্যমুখে বললো,’আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে নির্ঝর সাহেব?’

‘সাহেব’ সম্বোধনটা স্পষ্টত কৌতুকের। মেয়েটা তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে! অপ্রস্তুত ভাবে নিজেকে সামলে নিলো নির্ঝর! মুচকি হেসে বললো,’সারারাত পড়াশোনার ডিস্টার্ব করে এখন জিজ্ঞেস করছেন পরীক্ষা কেমন হয়েছে? মানবতার বহর আছে দেখছি!’

ভ্রমর হেসে ফেললো। কিঞ্চিৎ অভিমানী গলায় বললো,’সে তো আর আমি একা করি নি। সবাই মিলে গানবাজনা করেছে। আপনিই বরং সমাজচ্যুত হয়ে ছিলেন। বিয়েবাড়িতে বিদ্যাসাগর! একি আর মানায়?’

নির্ঝর হাসলো। এই বিষয়ে কোন তর্কে জড়ালো না সে। এমনিতেই এই নিয়ে সমবয়সী কাজিনদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। নির্ঝর তাদের কোনরকম যুক্তি দিয়েই বোঝাতে পারে নি এই পরীক্ষাগুলো তাঁর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ! তাই চুপচাপ সবার খোঁটা সহ্য করে গেছে সে। ভ্রমরের খোঁটাটাও সহ্য করে গেলো! এমনিতেই তো রোজ শুনছে আজকে নাহয় একটু মধুর ভাবেই শুনলো! ক্ষতি কি! বেসিনের পাশে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে একেবারে আন্তরিক ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করলো,’আপনাকে তো জিজ্ঞেস করার হয় নি। কোন পক্ষ ছিলেন আপনি?’

-‘আমি? আমি দুপক্ষেরই। কনে আমার বান্ধবী। আর বর আমার খালাতো ভাই। আপন নয় অবশ্য দুঃসম্পর্কের! কিন্তু আপনি তো মেয়েপক্ষ তাই না?’

-‘জি। নায়লা আমার খালাতো বোন।’, তারপর চুপ করে গেলো নির্ঝর। বোধকরি কথোপকথন খুব বেশি এগোতে চাইলো না সে। যত আলাপন ততই প্রেম নামক ছাইয়ের দিকে পতন। অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়!

নায়লা নির্ঝরের ছোট খালা নিহাল বানুর মেয়ে। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ার নাফিসা রহমান নিজ খরচে বোনঝির বিয়ে দিয়েছেন। নির্ঝরের বাবার অঢেল সম্পত্তি। একমাত্র ছেলে নির্ঝর। ছেলের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ধনসম্পত্তি রেখে গেছেন সাইদুর রহমান সাহেব। তাই দানধ্যানে কৃপণতা করেন না নাফিসা রহমান। দুহাতে টাকা পয়সা খরচ করেন মানুষের পেছনে। নির্ঝোরের অবশ্য টাকাপয়সা, বিষয়সম্পত্তির দিকে এখনো ঝোঁক গড়ে উঠে নি। সে ব্যস্ত তাঁর পড়াশোনা, ক্যারিয়ার নিয়ে। নির্ঝরের বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর রেখে যাওয়া যাবতীয় ব্যবসায়িক দায়দায়িত্ব সব নাফিসা রহমানই সামলাচ্ছেন। অবশ্য, এই নিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ নেই। ছেলে মানুষের মত মানুষ হলেই তিনি খুশি।

নিজের সম্পর্কে নির্ঝরের অপ্রকাশিত অনিহা ভেতরে ভেতরে হতাশ করলো ভ্রমরকে। নির্ঝর যেচে পড়ে একটা কথাও জিজ্ঞেস করছে না তাঁকে। বাধ্য হয়ে সে নিজেই বললো , ‘মেহমানরা সবাই চলে গেছে অথচ আমি কেন গেলাম না সেটা জিজ্ঞেস করলেন না যে?’

নির্ঝর গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে ছোট করে বললো,’কেন?’

-‘কারণ, এখন থেকে আমি এখানে থাকবো।’

বিস্ময়ে চক্ষু কোটরগত নির্ঝরের! এই মেয়ে এখানে থাকবে? মানে কি? তাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রমর কুণ্ঠিত গলায় বললো,’কি ব্যপার আপনি এত চমকে উঠলেন যে?’

-‘না। মানে আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারি নি।’

-‘আমি এবার এইচএসসি দিয়েছি। বাবার খুব ইচ্ছে আমাকে ডাক্তার বানাবে। ছয়ভাইয়ের পরে একবোন তো, তাই। কিন্তু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় হয় নি। তাই নিরুপায় হয়ে বাবা বেসরকারিতে ভর্তি করিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বাসা থেকে কলেজ অনেক দূর। এদিকে হোস্টেল আবার আমার সহ্য হয় না। ভর্তি পরীক্ষায় আগে তিনমাস ছিলাম জন্ডিস হয়ে গেছিলো। তাই আপনাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করবো। আপনার বাবা এবং আমার মায়ের চাচাতো ভাই ছিলেন। মামী বলছিলো আপনাদের সবগুলো ঘর খালি-ই পড়ে আছে। আমার থাকার কোন অসুবিধে হবে না, তাই বাবাও রাজি হয়ে গেলেন।’

দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ভ্রমরের চোখের সামনে থাকলে যে নির্ঝরের পড়াশোনার যে বারোটা বাজবে সেটা ভেবে মনে মনে আতংকিত হয়ে পড়লো নির্ঝর। মনে মনে মায়ের ওপর রুষ্ট হলো সে। বাড়িতে এতবড় ছেলে থাকতে মা কি করে এমন একটা বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে বাড়িতে রাখতে রাজি হলেন? বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে নাকি তাঁর? ঢকঢক করে গ্লাসে ঢেলে রাখা পুরো পানিটা খেয়ে তাড়াহুড়া করে উপরে চলে গেল সে। মায়ের সাথে এক্ষুনি কথা বলতে হবে!

ভ্রমরের বাবা বোরহান উদ্দিন সাহেবের প্রচুর টাকাপয়সা কিন্তু শিক্ষাদীক্ষার তেমন বালাই নেই বললেই চলে। নিজে পড়ালেখা না জানায় ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহও ছিলো না। ভ্রমনের ছয় ভাইদের কেউ-ই ইন্টারমেডিয়েট অব্দি পৌঁছাতে পারে নি। সবকজনই মেট্রিক ফেল। কিন্তু এত টাকাপয়সা থাকার পরেও শুধুমাত্র শিক্ষা না থাকায় অনেকেই যে প্রত্যক্ষ এ এবং পরোক্ষভাবে তাঁদের পরিবার কে সুনজরে দেখেন না সেটা তাদের আচরণ দেখে বুঝতে বাকি নেই বোরহান সাহেবের। তাই দেরীতে হলেও শিক্ষার মর্যাদা তিনি বুঝতে পেরেছেন। সেই থেকেই তাঁর একান্ত ইচ্ছা একমাত্র মেয়ে ভ্রমরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন তিনি। শিক্ষিত একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন।
মূলত মেয়েকে শিক্ষিত করে, ভালো বংশের একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে জাতে উঠতে চাইছেন তিনি। সভ্যসমাজে নিজের জায়গা তৈরী করতে চাইছেন।

আত্মীয়তার সুবাদে অনেকের মুখেই নির্ঝরের কথা শুনেছেন তিনি। নির্ঝরের বাবা পেশায় আর্কিটেক্ট ছিলেন, বেশিরভাগ সময়ই দেশের বাইরে কেটেছে তাঁর। নির্ঝরের চাচারা, মামারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। এমনি নাফিসা রহমানও। পেশায় তিনি গৃহিণী হলেও বিয়ের আগেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। অতএব, বলা বাহুল্য, বোরহান সাহেব যে মনে মনে নির্ঝরের সঙ্গে তাঁর একমাত্র মেয়ে ভ্রমরের বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন সেটা আর বলার অবকাশ রাখে না। সেই উদ্দেশ্যেই মেয়েকে এই বাড়িতে রাখতে রাজি হয়েছেন তিনি। ভ্রমর অবশ্য এত কিছু জানে না। বাবার দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবগত সে।

তবে এখানে আসার আগে এবং পরে সবার কাছে থেকে নির্ঝরের এত বেশি প্রশংসা শুনেছিলো সে যে কেবল শুনেই নির্ঝরের প্রতি মনে মনে আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সে। তাঁর সদ্য প্রস্ফুটিত নারীহৃদয় ভেতরে ভেতরে নির্ঝোরের সঙ্গ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলো। তাই বিয়ে বাড়ির জনসমাগমের মধ্যেও নির্ঝরকে একটুখানি দেখার আকুলতা চেপে রাখতে পারে নি সে। সবার অলক্ষে ছুটে গিয়েছিলো নির্ঝোরের ঘরে।
মৃদু আলোতে নিবিষ্ট মনে পড়াশোনায় নিমিত্ত নির্ঝোরের টগবগে তরুণ মুখখানা দেখে নিমিষেই সংজ্ঞা হারিয়েছিলো সে। হায়! একি সর্বনাশ হলো ভ্রমরের! সমস্ত হৃদয় জুড়ে শুরু হলো কালবৈশাখী ঝড়! সেই ঝড় সামলাতেই গতকাল রাতে অত্যাধিক হাসির লহর ছুটিয়েছিলো সে। হাসির আড়ালে ঢাকতে চেয়েছিলো ভেতরের অস্থিরতা!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here