ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৫

0
1891

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৫
অরিত্রিকা আহানা

ঐ বাড়িতে ফিরে এসেছে ভ্রমর। গতকালই আসার কথা ছিলো, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে কিন্তু রেডি হতেও মেজো ভাইয়ের ছেলে আদনান ফুপি, ফুপি করে কান্না জুড়িদিলো। কিছুতেই ছাড়ছিলো না তাই গতকাল আর আসা হয় নি। আজকে সকালে ভ্রমরের বড় ভাই খালেদ উদ্দিন এসে দিয়ে গিয়েছে। নির্ঝর তখন বাড়িতে ছিলো না। কিসের একটা রেজিস্ট্রেশন নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি চলছিলো তাঁর। বন্ধুরা সবাই মিলে আলোচনা করে ফর্ম ফিলাপ করবে বলে সকাল বেলাই ক্যাম্পাসে চলে গেছে সবাই। ফিরতে ফিরতে দুপুর হলো। ফিরে এসে ডাইনিং টেবিলে ভ্রমরকে দেখে রীতিমত চমকে উঠলো সে। ভ্রমরের চোখমুখের অবস্থা খুবই করুণ। একসপ্তাহে যেন শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছে। গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে। নির্ঝর অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো,’তোমার এই অবস্থা কেন ভ্রমর? শরীর খারাপ ছিলো নাকি?’

ভ্রমর তাঁর দিকে চাইলো না। চাপা অভিমানে মাথা নিচু করে ফেললো। নির্ঝরকে যেদিন ফোন করেছিলো তারপর দিন থেকেই টানা দুদিন জ্বর ছিলো তাঁর। তারওপর রাগে দুঃখে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে নি। সেইজন্যই স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছ। মাথা নিচু করেই গম্ভীর গলায় জবাব দিলো সে,’জ্বর ছিলো।’

নাফিসা রহমান নির্ঝরের প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন,’আমিও প্রথমে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় কি মেয়ে গেলো আর ফিরে এলো কি মেয়ে! চোখমুখ বসা! চোখের নিচে কালি। শুকিয়ে যেন আধখানা হতে গেছে।’ তারপর ভ্রমরকে উদ্দেশ্য করে খানিকটা ধমকের সুরে বললো,’এই, তোর মা তোকে জোর করে খাওয়াদাওয়া করাতে পারে নি? এই অবস্থা করেছিস কেন শরীরের?’

ভ্রমর জবাব দিলো না। চুপচাপ মুখে ভাত তুলে নিলো। হঠাৎ করেই ওকে চুপচাপ থাকতে দেখে নাফিসা রহমান মনে মনে ধারণা করে নিলেন , বাসা থেকে এসেছে তাই মন খারাপ। মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’বাসার জন্য মন খারাপ করছে?’ জবাবে ভ্রমর উপরে নিচে মাথা দোলালো। নাফিসা রহমান আর বেশি ঘাটালেন না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের এঁটো প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি। নির্ঝর কিন্তু বিশ্বাস করলো না। সূঁচালো দৃষ্টিতে ভ্রমরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। বোধকরি, ভ্রমরের এই দুরবস্থার কারণ কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে সে। তবে নিজের ধারণা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারলো না সে। হতে পারে নাফিসা রহমানই ঠিক। বাসার জন্যই মন খারাপ ভ্রমরের। তবুও মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেলো তাঁর। খাওয়া শেষ করে দ্রুত উপরে উঠে গেলো। ভ্রমর তাঁর যাওয়ার দিকে চেয়ে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো একবার।


সদ্য স্নাতকে পা দিয়েছে ভ্রমর। ইতোমধ্যেই মেডিকেল কলেজের বান্ধবীরা সবাই নতুন নতুন প্রেম শুরু করে দিয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকারা একে অন্যকে চোখে হারাচ্ছে! একজন আরেকজনকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। জোড়ায় জোড়ায় প্রেমালাপ করছে। একে অন্যের কেয়ার করছে।
এসব দেখে হাঁসফাস লাগে ভ্রমরের। নির্ঝর কেন এতটা বেরসিক! বোধহয় বেরসিক বলেই তাকে এতটা ভালোবাসে ভ্রমর!

সুন্দরী হওয়ার মেডিকেল কলেজে আসার পর থেকে সেও কম প্রেমের প্রস্তাব পায় নি। সিনিয়র হতে আরম্ভ করে ব্যাচমেটরাও তার পেছনে লাইন মারার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঐ যে রবীঠাকুর বলেছিলেন,’যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না!’ ভ্রমরের ক্ষেত্রেও তাই। রোজ রোজ তাঁর কাছে নিবেদিত ভালোমন্দ সকল প্রেমের প্রস্তাবই মূল্যহীন, নিরর্থক! সে মত্ত নির্ঝরের ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়!

কলেজের বান্ধবীরা কিছুদিন নির্ঝরকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলো। তাদের ভাষ্যমতে, ‘কিছুদিন পাত্তা না দিলে ঠিকই লাইনে এসে যাবে চান্দু!’ বুদ্ধিটা পছন্দ হলো ভ্রমর। বান্ধবীদের পরামর্শ মোতাবেক নির্ঝরকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। কিন্তু আশানুরূপ কিছুই ঘটলো না। নির্ঝর বুঝতেই পারে নি ভ্রমর তাঁকে এড়িয়ে চলছে। অবশ্য বুঝবে কি করে, দিনে ক-বারই বা দেখা হয় ভ্রমরের সাথে তাঁর! কিন্তু তবুও ভ্রমর চেষ্টা চালিয়েছিলো। নির্ঝর যখন দেখা হলেই হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতো,’কি অবস্থা ভ্রমর?’ ইচ্ছে করেই দুদিন তাঁর প্রশ্নের জবাব দেয় নি ভ্রমর। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলো না। ভ্রমরের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে, পরের দিন নির্ঝর কিন্তু ঠিকই রোবটের মত ঐ একই প্রশ্ন করতো,’কি অবস্থা ভ্রমর? কলেজ কেমন চলছে!’ সব শুনে বান্ধবীরা হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,’এই ছেলে বড় কঠিন চিজ ভ্রমর। তুই আশা ছেড়ে দে।’ এসব শুনে ভ্রমর মনে মনে হতাশ হয়। কিন্তু আশা ছাড়তে পারে না! কি করে পারবে? নির্ঝরকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যে তাঁর প্রতিটা শিরায় শিরায় বইছে! ভ্রমর কি করে তাঁর আশা ছাড়বে?

বুধবার! জরুরী একটা প্রজেক্টের কাজে ক্যাম্পাসে গিয়ে ছিলো নির্ঝর। কাজ শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো। ক্লান্ত হয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখলো নিচতলার বসার ঘরে মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলার বসে আছে। তাঁর সঙ্গে অনুচ্চস্বরে, খুব হেসে হেসে কথা বলছেন নাফিসা রহমান। মহিলার বয়স নাফিসা রহমানের চেয়ে দুএক বছর বেশি কিংবা সমবয়সীও হতে পারে দুজনে। সালাম দিলো নির্ঝর। ভদ্রমহিলা সালামের উত্তর দিকে নাফিসা রহমানের দিকে চাইলেন। নাফিসা রহমান মুচকি হেসে বললেন,’আমার ছেলে, নির্ঝর!’ তারপর নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’উনার ছেলে ভ্রমরের মেডিকেল কলেজের সিনিয়র। পাশ করে বেরিয়ে গেছে অবশ্য। এখন এফসিপিএস করছে। ছেলের জন্য ভালো পাত্রী খুঁজছেন।’

ভদ্রমহিলার ছেলের নাম রাকিব। তিনবছর আগে ভ্রমরদের মেডিকেল কলেজ থেকেই পাস করে গেছে সে। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে এফসিপিএস করছে। বায়োডাটাতে বয়স দেওয়া আছে একত্রিশ।
ভ্রমরদের আরেক সিনিয়র বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ভ্রমরের খোঁজ পেয়েছেন ছেলের মা। ছবি দেখেই ভ্রমরকে তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। তাই ঠিকানা জোগাড় করে সরাসরি দেখতে এসেছেন।

নাফিসা রহমান মিষ্টি হেসে বললো,’আপনি তো দেখেছেনই, ভ্রমর মাশাআল্লাহ্ খুব লক্ষ্মী মেয়ে। আমার এখানে আছে চারমাসের মত হয়েছে। অন্যকিছু না অবশ্য, তবে পড়াশোনা নিয়ে মাঝেমধ্যেই বকাবকি করি কিন্তু আমার মুখের ওপর কোনদিন রা করে নি! একেবারে শান্ত শিষ্ট!’
ভদ্রমহিলা হাসলেন। বোঝাই যাচ্ছে ভ্রমরকে বেশ পছন্দ হয়েছে তাঁর। খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বোরহান উদ্দিনের ঠিকানা চাইলেন। নাফিসা রহমান ভেতরের ঘর থেকে একটা কার্ড এনে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,’এটা ওর বাবার ফ্যাক্টরির ঠিকানা। সাভারে ওদের নিজস্ব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে।’ ইচ্ছে করেই বাসার ঠিকানা দিলেন না তিনি। আগে বোরহান সাহেব ছেলে দেখুক! তারপর যদি পছন্দ হয় তবে না ঘরবাড়ি দেখার প্রসঙ্গ আসবে।
নির্ঝর আর দাঁড়ালো না, সৌজন্যমূলকভাবে মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে চলে এলো। কিন্তু উপরতলায় উঠে, তাঁর ঘরের দরজার ভ্রমরকে দাঁড়ানো দেখে চমকে উঠলো। পেছন দিক থেকে দরজার হাত চেপে ধরে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভ্রমর। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেললো নির্ঝর। ভ্রমরের এইসময়ে, এইভাবে, এইখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা স্বাভাবিকই নির্ঝরের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে! এবার সন্দেহটাকে বেশ পরিষ্কার হয়ে গেলো নির্ঝরের। তাঁ ধারণাই তবে ঠিক!
আর ঠিক হবেই বা না কেন? এই বয়সটা তো নির্ঝরও পার করে এসেছে। এই বয়সে একটা মেয়ে আর একটা ছেলের আচরণে হয়ত বিস্তর তফাৎ থাকতে পারে কিন্তু চিন্তাধারাগুলো একই হয়, কল্পনা গুলো একই হয়! কিন্তু ভ্রমরের চিন্তাধারাগুলোকে প্রশ্রয় দিতে চাইলো না নির্ঝর। তাতে দুই পরিবারেরই বিপদ! কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে, ভয়ার্ত গলায় বললো,’কি ব্যপার ভ্রমর? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন?’

জবাবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো নির্ঝরের মুখের দিকে ভ্রমর। তার চোখভর্তি পানি টলমল করছে। নির্ঝর কি এখনো বুঝতে পারে ভ্রমর কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছে? কান্না যেন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ভ্রমরের। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে কান্না চাপার চেষ্টা করলো সে। বিমর্ষ কন্ঠে বললো,’ঐ মহিলা আমাকে দেখতে এসেছেন!’

কথাটা শেষ করার সময় জোর করে চেপে রাখা কান্নাটা যেন আরো বেশি করে বেরিয়ে আসতে চাইলো। কান্না ঠেকাতে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে ফেললো ভ্রমর। কিন্তু তবুও খানিকটা ফোঁপানোর মত শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। ভ্রমরের শত চেষ্টার পরে বেরিয়া আসা সেই শব্দ, সেই আর্তনাদ আচমকাই তীব্রভাবে আঘাত করলো নির্ঝরের বুকের ঠিক মাঝখানটায়! দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে! অপরাধী মনে হলো নিজেকে! এই দুর্বলতা কি নির্ঝরেরও ছিলো না? ছিলো তো!
হ্যাঁ! নির্ঝর সামলে নিয়েছে। ভ্রমর সামলাতে পারে নি। কারণ ছেলেরা যত সহজে সব কিছু সামলে নিতে পারে মেয়েরা তত সহজে পারে না। আর সামলানোর মত উপযুক্ত কারণও নির্ঝরের ছিলো। কিন্তু ভ্রমর? সে তো না জেনেই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে! হয়ত এখন সেটা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে! কিন্তু নির্ঝর কি করবে? সেও তো রক্তমাংসে গড়া মানুষ! আর কতটা পাথর করে রাখবে নিজেকে? মেয়েটা তাঁর জন্য কাঁদছে! ঠোঁট দুটো চেপে ধরে নিজেকে স্থির হওয়ার সময় দিলো নির্ঝর! তারপর ভ্রমরের কান্নারত মুখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গম্ভীর গলায় বললো,’মেয়েরা বড় হলে তাদের বিয়ের কথাবার্তা চলে, দেখতে আসে এটাই স্বাভাবিক। এখানে অবাক হওয়ার মত কিছুই নেই! তুমি এসব চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে বরং পড়াশোনায় মন দাও। এমনিতেই তোমার পড়াশোনার অবস্থা ভালো না।’ তারপর ভ্রমরকে জবাব দেওয়ার সুযোগ টুকুও দিলো না সে। কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বললো,’দেখি দরজা দেখে সরো। আমি ভেতরে ঢুকবো।’

টুক করে চোখের পানি পড়ে গেলো ভ্রমরের! মাথা নিচু করে ফেললো সে। নিরবে দরজা থেকে সরে নির্ঝরকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। নির্ঝর ভেতরে ঢোকার সময় নিঃশব্দে একবার তাঁর শরীরটা কাঁপনটা দৃষ্টি এড়ালো না নির্ঝরের। এ যেন নির্বোধ অভিমানিনীর কান্নার চাপার বৃথা চেষ্টা! এবারেও উপেক্ষা করলো নির্ঝর! ভেতরে ঢুকে খুব সাবধানে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিলো সে। অসহায়, হতবিহ্বল ভ্রমর হাতের উল্টোপিঠ দিকে চোখ মুছলো কেবল! তারপর আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না নিষ্ঠুর পাষাণটার দরজায়। বাঁধভাঙা ক্রন্দন নিয়ে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো।

ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে তাঁর নিচে বসে আছে নির্ঝর। ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকার পরে দরদর করে ঘামছে সে। গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে এক অবস্থা হয়েছে তাঁর। মাথা থেকে আগুন বেরোচ্ছে যেন। কপালের শিরাগুলো দপদপ করছে। হঠাৎ করে কেন এত ঘামছে নির্ঝর নিজেও বুঝতে পারছে না।
নাফিসা রহমান খুব সন্তর্পণে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেও বাইরে থেকে ছেলের নাম ধরে ডাক দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন। তারপর হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে একটা ছবি। ছবিটা নির্ঝরকে দেখিয়ে বললেন,’একটু আগে যিনি এসেছিলেন উনার ছেলের ছবি। আমি রাখতে চাই নি জোর করে দিয়ে গেছেন। দেখতো কেমন?’

নির্ঝর ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো। বায়োডেটায় মিথ্যে লিখা আছে, ছেলেটার বয়স একত্রিশের চাইতে বেশি হতে। তেত্রিশ কিংবা চৌত্রিশও হতে পারে। ছবিতে গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা মনে হচ্ছে। তবে চেহারাসুরুত ভালোই। মায়ের হাতের আবার ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো,’ভ্রমরকে এত তাড়াতাড়ি এসব ছবিটবি দেখানোর দরকার নেই। ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও। সবদিক বুঝমত হলে তারপর ওকে ছবি দেখানো যাবে। নইলে পড়াশোনার বারোটা বাজাবে।’

নাফিসা রহমান ছেলের কথা সমর্থন করে বললেন,’না। আমি কি অতো পাগল নাকি! এমনিতেই তো বারবার করে জিজ্ঞেস করছিলো ঐ মহিলা কেন এসেছে? আমি কেন ওকে ঐ মহিলার সামনে নিয়ে গিয়েছি, আরো কত প্রশ্ন! আমি অবশ্য বলি নি।’

-‘ও জানে।’, গম্ভীর গলায় জবাব দিলো নির্ঝর।

নাফিসা রহমান চমকালেন না। ছেলের কথা জবাবে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,’হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা যেভাবে প্রশ্ন করছিলেন তাতে আমিও ধারণা করে করছিলাম ও বুঝে গেছে। তোকে কিছু বলেছে?’

নির্ঝর নিরবে বসে রইলো কিছুক্ষন! তারপর মায়ের প্রশ্নের জবাবে ধীরে ধীরে জবাব দিলো,’তুমি ওকে ওদের বাসায় পাঠিয়ে দাও মা। আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে। ওর বয়স অল্প! এই বয়সে মাথায় নানারকম চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খায়। কখন কি করে বসে?
নাফিসা রহমান গম্ভীর হয়ে গেলেন। নির্ঝর কিসের ইঙ্গিত দিয়েছেন তাকে? ভয়ার্ত গলায় বললেন,’কি বলেছে ও তোকে?’

মায়ের কাছে কিছু লুকানোর প্রয়োজন মনে করলো না নির্ঝর। এখন সে লুকিয়ে রাখবে কিন্তু পরে যদি ভ্রমর উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তখন কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে নির্ঝর। তবুও মায়ের ভয়ার্ত মুখ দেখে হঠাৎ করেই শক দিতে চাইলো না। ধীরেধীরে শান্ত গলায় বললো,’তেমন কিছুই বলে নি। কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হলো ছেলে যতই ভালো হোক ও বিয়েতে রাজী হবে না। কারণটা আমি তোমাকে বলতে চাইছি না। আমার ধারণা তুমি বুঝতে পেরেছো।’

নাফিরা রহমান থমকে গেলেন। এ কি সর্বনাশ করলো ভ্রমর? বিশ্বাস করে মেয়েটাকে এই বাড়িতে এনেছিলেন তিনি! কিন্তু ভ্রমর তো তার বিশ্বাসের কোন মূল্যই রাখলো না?
নাফিসা রহমানও ভ্রমরকে ভালোবাসেন। মেয়েটার চেহারার আলাদা একটা মায়া আছে! কিন্তু তাই বলে কি ভ্রমর যা ভাবছে তা আদৌ সম্ভব? মেয়ে যতই সুন্দরি হোক না কেন তাতে নাফিসা রহমানের কিচ্ছু যায় আসে না। তার একমাত্র ছেলের বউকে অবশ্যই চালচলনে, শিক্ষাদীক্ষায় ছেলের সাথে মানানসই হতে হবে। ভ্রমরকে নির্ঝরের বউ করার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি! প্রথমে ভেবেছিলেন মেয়েটার হয়ত পড়ালেখায় আগ্রহ আছে তাই নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে ভ্রমরের পড়ালেখার প্রতি অনিহা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন তার ধারণা ভুল ছিলো। ভ্রমর ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছে ঠিকই কিন্তু এতগুলো দিনেও পড়াশোনায় প্রতি ওর তেমন কোন আগ্রহ কিংবা অগ্রগতি নাফিসা রহমান চোখে পড়ে নি! তাছাড়া ভ্রমরের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও যে খুব ভালো তাও নয়। সেটুকু হলেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু নাফিসা বেগম তো সবই জানেন, ওর বাপভাইয়েদের সবাই অশিক্ষিত। এদিকে তাঁর ছেলে কদিন বাদে পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাবে। এর পরেও কি ভ্রমরের এসব চিন্তাধারাকে প্রশ্রয় দেওয়া সত্যিই সম্ভব? না! কখনোই না। নাফিসা রহমান জেনেশুনে কিছুতেই এমন ভুল করতে পারেন না। তার একমাত্র ছেলে! অনেক আশাভরসা ছেলেকে নিয়ে! সেই ছেলের বউ হবে কি না একটা অর্ধশিক্ষিত মেয়ে যার পুরো ফ্যামিলিতে কেউ লেখাপড়া জানে না। এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here