ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৬

0
2261

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৬
অরিত্রিকা আহানা

নাফিসা রহমান এবং নির্ঝরের কথোপকথন আড়াল থেকে সব শুনেছে ভ্রমর। নির্ঝরের ঘরের সামনে থেকে বেরিয়ে আসার নাফিসা রহমানকে রাকিবের ছবি হাতে নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখে কৌতূহল দমন করতে পারে নি সে। ছবিটা দেখার পর নির্ঝরের রিয়েকশন কি হতে পারে তা জানার জন্য ভেতরটা উদগ্রীব হয়ে ছিলো। পুনরায় নির্ঝরের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো সে।
মাঝসমুদ্রে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দিশেহারা নাবিক যেমন এক টুকরো ভেলাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয় তেমনি মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে নির্ঝরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো ভ্রমর। প্রতিটা মুহূর্তে আকাঙ্ক্ষা করেছিলো, হয়ত এখন নির্ঝর কিছু বলবে, এবার হয়ত কিছু বলবে, না এবার নিশ্চয়ই বলবে, নিশ্চই বলবে ভ্রমরকে সে ভালোবাসে!
অতঃপর? নির্ঝর বললো! ভ্রমর শুনলো! কিন্তু সমস্তটাই নিরর্থক!

ভ্রমরের বুঝতে আর বাকী রইলো না যে এই বাড়িতে তাঁক্স আর বেশি দিন রাখবেন না নাফিসা রহমান। হয়ত কালই বোরহান উদ্দিনকে ডেকে পাঠাবেন ভ্রমরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

অসহায় ভ্রমর হতাশা, ক্ষোভ, জ্বালা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। বাঁধভাঙা অশ্রুতে বিছানা, বালিশ ভিজিয়ে ফেললো কিন্তু এত কিছুর পরেও, এত হতাশার পরেও, চারদিকে এত নিরাশা থাকার পরেও তাঁর মনটা কিছুতেই নির্ঝরের দিক থেকে সরাতে পারলো না। ঐ বিষাক্ত, সুন্দর মুখ ভ্রমরের ভেতরটাকে যেন সাপের দংশন করছিলো। ভ্রমর মনে প্রাণে চাইলো তাকে ঘৃণা করতে কিন্তু হায়! তাতে যেন কামনার পাল্লাটা আরো বেশি করে ভারি হলো!


রাত দেড়টা! নাফিসা রহমান যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিছানা ছেড়ে পা টিপেটিপে ঘর ছেড়ে বেরোলো ভ্রমর। নিঃশব্দে দরজা খুলে দেখলো উপরতলায় সিঁড়িপথ অন্ধকার। নির্ঝরের ঘরে বাতি জ্বলছে কেবল। চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে উঠলো ভ্রমর! দরজায় দাঁড়িয়ে আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে মৃদু টোকা দিলো সে!

মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান জনাব হারুণ-উর রশিদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক নির্ঝরের। তাঁর আন্ডারেই থিসিস জমা দিয়েছে নির্ঝর। রাত জেগে গভীর মনোযোগের সহিত স্যারেরই দেওয়া কিছু কাজ করছিলো নির্ঝর! আচমকা দরজায় টোকার আওয়াজ পেয়ে থমকে গেলো। কান খাড়া করে আবার শোনার চেষ্টা করলো সে।
দরজায় নক হলো আবারো! অজানা আশংকায় বুকটা ধক করে উঠলো নির্ঝরের। এত রাতে নাফিসা রহমান কখনোই তাঁর ঘরে নক করেন না। অধিকাংশ দিনই বেশ তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যান। তবে কি ভ্রমর? দ্বিধান্বিত কন্ঠে পড়ার টেবিলে থেকেই সাড়া দিলো নির্ঝর,’কে?’

উত্তর করলো না কেউ! দরজায় আবারো ঠকঠক হলো! এবারে নির্ঝর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেলো দরজায় বাইরে ভ্রমরই দাঁড়িয়ে আছে! এই মুহূর্তে নির্ঝরের কি করা উচিৎ বুঝতে পারছিলো না সে। তাই চুপ করে রইলো। পরপর আরো দুবার নক করলো ভ্রমর। নির্ঝর সাড়া দিলো না দেখে অনুচ্চস্বরে ফিসফিস করে বললো,’দরজাটা একটু খুলুন না?’

নিজের বিস্ময় ভাব সামলানোর চেষ্টা করে টেবিলের রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেলো নির্ঝর। হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,’তুমি নিচে যাও ভ্রমর। এত রাতে আমার ঘরে কেন এসেছো?’

-‘আপনাকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি, খুলুন না প্লিজ!’

স্বপ্নের কথাটা ভ্রমর মিথ্যে বলেছে। নির্ঝরকে নিয়ে কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেনি সে। যা দেখেছে তা হচ্ছে ভ্রমরের আধোঘুম, আধোজাগরণ অবস্থার কল্পনা। শুয়ে শুয়েই সে ভাবছিলো নির্ঝরের সাথে কালকের পর থেকে আর দেখা হবে না তাঁর। হয়ত কোনদিন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলা হবে না,’আমি আপনাকে ভালোবাসি!’ এসব ভাবতে ভাবতেই মনটা অস্থির হয়ে গেলো তাঁর। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। শেষমেশ ছুটে এলো নির্ঝরের ঘরের দরজায়!
নির্ঝরের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে অধৈর্য কন্ঠে বললো,’আমি শুধু একটা কথা বলতে এসেছিলাম। বলেই চলে যাবো। খুলুন না দরজাটা!’

-‘যা বলার বাইরে থেকেই বলো।’

-‘না। আপনি দরজাটা খুলুন!’ মুহূর্তেই ভ্রমরের কন্ঠটা অস্বাভাবিক শোনালো! অত্যাধিক হতাশায় তাঁর সমস্ত বিবেক, বুদ্ধি, চেতনা যে সর্বান্তঃকরণে তাঁর নবযৌবনের উদ্বেলিত আবেগের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো তাঁর পরের সর্বনাশী কথাগুলোর মাধ্যমে।
হতাশায় পরিপূর্ণ তাঁর সেই আবেগ এতটাই অপ্রতিহত যে মান সম্মান হারানোর ভয় পর্যন্ত করলো না। মান সম্মান হারানোর ভয় ছাড়িয়ে যুক্তিতর্কের অনেক উর্ধে চলে গিলো নির্লজ্জ আবেগ। দরজাটা বেশ জোরে জোরে দরজা ধাক্কানো শুরু করে দিয়ে বললো,’কেন খুলছেন না? দরজাটা খুলুন না প্লিজ! কালকে তো আমি চলে যাবো। আজকের রাতটা অন্তত আমাকে দিন! এত নিষ্ঠুর কেন আপনি?’

কান ঝাঁঝাঁ করে উঠলো নির্ঝরের। শরীরের প্রতিটা রক্তকণিকা যেন ফুটতে আরম্ভ করলো। মাথা দিয়ে আগুন বেরোনো শুরু হলো! ভ্রমর কি পাগল হয়ে গিয়েছে? নতুবা এমন জঘন্য চিন্তাভাবনা তাঁর মাথায় এলো কি করে? কি এমন স্বপ্ন দেখেছে সে, যারজন্য এতটা বিকারগ্রস্ত হতে হবে তাঁকে? আর যাই হোক এই পাগলামি কখনো ভালোবাসা হতে পারে না! ভালোবাসা হবে পবিত্র! নিজেকে শক্ত করে দৃঢ়,থমথমে গলায় বললো,’নিচে যাও ভ্রমর! সকালে তোমার সাথে কথা হবে!’

ভ্রমর তখন পুরোপুরি মরিয়া হয়ে গিয়েছে। রাগত কন্ঠে বললো,’না। আমি এক্ষুনি বলবো। আপনি দরজা খুলুন। কি খুলুন বলছি?…ঠিক আছে খুবলেন না তো? তবে আমি এখানেই বসে থাকবো! এই যে ওড়না খুলে ফেললাম কিন্তু!’ গা থেকে সত্যি সত্যি ওড়না খুলে ফেললো ভ্রমর। ছুঁড়ে ফেলে দিলো সিঁড়ির দিকে। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’দরজা খুলুন বলছি।’

রাগ, বিরক্তি, বিস্ময় ভাব কাটিয়ে এবার তীব্র ব্যথার ছাপ দেখা দিলো নির্ঝরের সুন্দর,শান্ত, স্নিগ্ধ মুখখানায়। এসব কি করছে ভ্রমর? করুণ হয়ে এলো কন্ঠস্বর। অসহায়, বিষণ্ণ গলায় বললো,’কেন নিজেকে এতটা ছোট করছো ভ্রমর? কেন তুমি এতটা অবুঝের মতন আচরণ করছো? প্লিজ ভ্রমর! নিচে যাও। আমি রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে, এভাবে চেঁচিয়ো না।’

ভ্রমর গেলো না। দরজার হাতল চেপে ধরে মেঝে বসে পড়লো। বিড়বিড় করে বললো,’আপনি দরজা না খুললে আমি কোথাও যাবো না। সারারাত এখানেই বসে থাকবো।’ নির্ঝর কিন্তু দরজা খুললো না। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল রইলো সে! কোন কিছুই তাঁকে নিজের সংকল্প থেকে টলাতে পারলো না। ভ্রমরের ক্রমাগত চিৎকারে উদ্ভ্রান্তের মতন নিজের ঘরের দরজার দিকে চেয়ে রইলো ঠিকই কিন্তু দরজা খুলে দেওয়ার কথা বিন্দুমাত্রের জন্যেও মন কিংবা মস্তিষ্ক কোনটাতেই ঠাঁই দিলো না।


নাফিসা রহমানের কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো ভ্রমর। অবাক হয়ে তাঁর দিকেই চেয়ে আছেন নাফিসা রহমান। জোর ধাক্কা খেলো ভ্রমর! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো সে। এইমুহূর্তে নাফিসা রহমানের উপস্থিতি সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত ছিলো তাঁর জন্য! নাফিসা রহমান সিঁড়ি থেকে ওড়নাটা তুলে তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললেন,’কি ব্যপার ভ্রমর? তুই এখানে বসে আছিস কেন?’

নির্ঝর তখনো দরজা খোলে নি। মায়ের গলা শুনে উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে বন্ধ করে বেশবড় একটা দম দিলো সে। বলা বাহুল্য নাফিসার রহমানকে ফোনটা সেই করেছিলো নতুবা মাঝরাতে নাফিসা রহমানের এই ঘরের আসার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। কিন্তু এই ধাক্কাটা ভ্রমরের প্রয়োজন ছিলো! নাফিসা রহমানের প্রশ্নের জবাবে কাঠ হয়ে বসে রইলো সে। নির্ঝর দরজা খুলে মায়ের কথার জবাবে বললো,’ও স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। তুমি ওকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও।’

ভ্রমর পূর্বের ন্যায় শক্ত হয়ে বসে রইলো! ছেলের ফোন পেয়েই নাফিসা রহমান উপরে ছুটে এসেছেন। মাঝরাতে একটা মেয়ে কিসের ভয়ে একটা ছেলের ঘরে ছুটে যায় সেটা না বোঝার মত বোকা তিনি নন! নিমিষেই চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেলো তাঁর!
কিন্তু এতকিছুর পরেও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তিনি কোনরকম খারাপ ব্যবহার করলেন না ভ্রমরের সাথে। ভ্রমরের চোখমুখ দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন মেয়েটা ঘোরের মধ্যে আছে! এইমুহূর্তে বকাবকি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে! তাছাড়া পরের মেয়ে তাঁর বাড়িতে আছে, উল্টোপাল্টা কিছু করে বসলে, তিনি কি জবাব দেবে বোরহান সাহেবের কাছে? মাথা ঠান্ডা করে সস্নেহে ভ্রমরের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন,’বেশি ভয় পেয়েছিস? আমাকে ডাকলি না কেন? আয় ঘরে চল, আমার সাথে শুবি।’

ভ্রমরের পড়াশুনার যেন ক্ষতি না হয় সেইজন্য তাকে আলাদা একটা ঘর দিয়েছিলেন নাফিসা রহমান। তিনি যেহেতু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন তাই রাতজেগে ভ্রমরের যেন পড়াশুনা করতে কোন অসুবিধে না হয় সেসব ভেবেই ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর, সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে ভ্রমর! নতুবা নাফিসা রহমানকে ফাঁকি দিয়ে নির্ঝরের ঘরে আসার সুযোগ কিংবা সাহস হতো না তাঁর!

নাফিসা রহমানের বারবার করে বলার পরেও ভ্রমর পাথর হয়ে বসে রইলো। শূন্য দৃষ্টিতে নির্ঝরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো কেবল! কিন্তু টুঁশব্দটিও পর্যন্ত করলো না। প্রত্যাখানের তীব্রযন্ত্রণায় তার বুকটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো,’নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর! আপনি একটা পাষাণ! নিষ্ঠুর! আমি আপনাকে ঘৃণা করি।’ কিন্তু অতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনায় মুখ দিয়ে কিছুই বেরোলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইলো কেবল! নির্ঝর মুখ ফিরিয়ে নিলো! নাফিসা রহমান হালকা ঝাঁকি দিয়ে বললেন,’এই ভ্রমর? ওঠ। চল শুবি!’

উঠলো না ভ্রমর! যেমনি বসে ছিলো তেমনি বসে রইল! নাফিরা রহমান টেনে তুলতে গেলে আচমকাই তাঁকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। এরপর শুরু হলো তীব্র আর্তচিৎকার! কিছুতেই তাঁকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না। অবস্থা বেগতিক নাফিসা রহমান অসহায়ভাবে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। নির্ঝর হতভম্ভ!
ইশারায় কিছুক্ষন সময় দিতে বললো ভ্রমরকে। নাফিসা রহমানের রাগে দুঃখে কাঁদতে মন চাইছে! এমন জানলে তিনি কখনোই ভ্রমরকে এই বাড়িতে রাখার কথা বলতেন না। ভুলটা তাঁরই হয়েছে! কেন যে তখন ছেলের কথা শুনলেন না? এদিকে ভ্রমর তাঁর পা চেপে ধরে কাঁদতেই বললো,’আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে মামী। আপনি আমাকে মাফ করে দিন।আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিন। আমি আর এখানে থাকবো না!’
নাফিসা রহমান ওকে শান্ত করতে করতে হাঁপিয়ে গেছেন। পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,’সব কথা পরে হবে। এখন উঠ তুই! ঘরে যাবি চল।’
নির্ঝরের দিকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো ভ্রমর। নিষ্ঠুর, পাষন্ডটার কাছ থেকে চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছে সে। এই ধাক্কাটার বাস্তবিকই প্রয়োজন ছিলো তাঁর!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here