ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৭

0
1811

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৭
অরিত্রিকা আহানা

ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে আছে ভ্রমর। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেই বোরহান সাহেবকে ফোন করেছিলো তাঁকে নিতে আসার জন্য। বোরহান সাহেব বারবার করে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি হয়েছে কিন্তু ভ্রমর কিছুই বললো না। শুধু বললো তাঁর শরীর খারাপ। মেয়ের শরীর খারাপ শুনে বোরহান সাহেব কথা বাড়ালেন না। দেরী না করে, ছেলেদের না পাঠিয়ে তিনি নিজেই নিতে চলে এসেছেন ভ্রমরকে।

নির্ঝর বাসায় নেই। স্যারের দেওয়া কাজটা শেষ করে বিকেল তিনটার মধ্যে জমা দিতে হবে তাকে। কিন্তু কাল সারারাত জেগে কাজ করার পরেও প্রজেক্টটা সে কমপ্লিট করতে পারে নি। মাথা আউলে গেছিলো। ভুলভাল টাইপ করছিলো। অবশ্য, রাতে যা ঘটেছে তারপরে আর মাথা ঠিক থাকার কথাও নয়। কিন্তু কাজটা তো কমপ্লিট করতেই হবে তাই সকাল হতে না হতেই ইউনিভার্সিটিতর উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেছে সে। লাইব্রেরিতে বসে নিশ্চিন্ত মনে কাজ শেষ করা যাবে।

নিচে বসার ঘরে বসে কথা বলছেন নাফিসা রহমান এবং বোরহান উদ্দিন সাহেব। আলোচনা বিষয়বস্তু তেমন কিছুই না। খোঁজখবর আদান প্রদান। ভ্রমরের বিষয়টা ইচ্ছাকৃত ভাবেই বোরহান সাহেবের কাছে চেপে গেলেন নাফিসা রহমান। সবে মাত্র এসেছেন ভদ্রলোক এখনই এইসব আলোচনা করতে অস্বস্তি লাগছিলো তার। তাই রাতের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন।

এদিকে ভ্রমর চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে নির্ঝরের ঘরে ঢুকলো। এই হয়ত শেষ! আর কখনো এই বাডিতে আসা হবে না ভ্রমরের! নাফিসা রহমান অবশ্য এই ব্যপারে পরিষ্কার করে কিছুই জানান নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ভ্রমর যখন বলেছিলো সে বাসায় ফোন করেছে তাকে নিতে আসার জন্য নাফিসা রহমান তেমন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,’ভালো হবে, যা দুদিন বাসা থেকে ঘুরে আয়। মনটা একটু স্থির হোক, ফিরে এসে ভালো করে পড়াশোনায় মন দিতে পারবি।’ কিন্তু ভ্রমর জানে আর কখনো তাঁর ফিরে আসা হবে না, ফিরে এলেও নির্ঝরের দেখা সে পাবে না। নির্ঝর পিএইচডি করতে দেশের বাইরে চলে যাবে। হয়ত বা এই ফাঁকে ভ্রমরের বিয়েও হয়ে যাবে! আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা হবে না ভ্রমরের! বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছলো সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো নির্ঝরের সুন্দর গোছানো, পরিপাটি ঘরটা।

একেবারে প্রথম যেদিন দেখেছিলো এখনো ঠিক তেমনই আছে! কোন পরিবর্তন হয় নি। ধনী পরিবারের পড়ালেখা করা একটা ছেলের কামরা যেমনটা থাকে নির্ঝরের কামরাটাও তেমনি শৌখিন কিছু জিনিসপত্র আর বই দিয়ে সাজানো। শৌখিনতা বলতে দেওয়ালে কিছু মা ছেলের কিছু যুগলবন্দী ছবি টাঙানো আছে।

নির্ঝর কখনো শীট কিংবা নোটবুক ফলো করে না। মেইন বুক পড়তেই ভালোবাসে সে বুক শেলফের অধিকাংশ বিদেশী রাইটারদের লিখা মোটা মোটা পাঠ্যপুস্তক দিয়ে ভরা। এছাড়াও কামরায় ছিমছাম একটা ড্রেসিংটেবিল, সুন্দর একটা বক্স খাট, একটা কাঠের আলমারি আর যেটার কথা না বললেই নয়, নির্ঝরের একটা বিখ্যাত পড়ার টেবিল আছে। ভ্রমর একটুখানি ছুঁয়ে দেখলো টেবিলটা। এখানে বসেই রাতদিন পড়াশুনা করে নিষ্ঠুর পাষাণটা!
তারপর ভালো করে দেখলো ভ্রমর, উল্লেখ করার মত বিশেষ কিছুই নেই। সাধারণের দৃষ্টিতে কামরার বর্ণনাটা হয়ত খুব সাধারণ কিংবা অসাধারণ হতেও পারে। কিন্তু তবুও ভ্রমরের মনে হলো সাধারণ কিংবা অসাধারণ বাদ দিয়েও কোথায় যেন একটা অন্যরকম বিশেষত্ব আছে । আসলে বিশেষত্বের ব্যপারটা জোরপূর্বক! কামরাটা নির্ঝরের বলেই হয়ত ভ্রমরের দৃষ্টি বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছে? ভ্রমর হাসলো! রাত পোহাতেই সে নির্ঝরের দেওয়া আঘাতের কথা ভুলে গেছে! অথচ পাষাণটা সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে গেছে। একটাবার দেখাও করে গেলো না! তীব্র হাহাকারে বুকের ভেতরটা পিনপিন করে উঠলো ভ্রমরের। আর দাঁড়ালো না সে! চোখের পানি মুছে নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে!’


বোরহান সাহেব ভ্রমরের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভ্রমর এখনো নিচে নামে নি। এদিকে অনেক্ষন কথাবার্তা বলার পরে নাফিসা বেগম অনেকবার রাতের ব্যপারে বোরহান সাহেবকে কিছুই জানাতে পারেন নি। অজানা সংকোচ, অস্বস্তিবোধ ঘিরে ধরছিলো তাঁকে বারবার। তারপর ভাবলেন যা বলার ভ্রমরই নাহয় বলবে। আগে তো সে ঐ বাড়িতে যাক, তারপর দেখা যাক কি হয়!
এইমুহূর্তে ভ্রমরের বাসায় যাওয়া মানে কলেজ কামাই হওয়া। বোরহান সাহেব চিন্তিত মুখে বললেন,’মেয়েটার হঠাৎ কি হলো বলুন তো? এখন বাসায় গেলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না?’

কণ্ঠনালী পর্যন্ত এনেও রাতের কথাটা মুখ দিয়ে বের করতে পারলেন না নাফিসা রহমান। মুচকি হেসে বললেন,’কাল রাত থেকেই যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছে। তাই ভাবলাম, দুদিন থেকে আসুক। মন ভালো না থাকলে পড়াশোনায়ও মনোযোগ দিতে পারবে না।’ নাফিসা রহমান এড়িয়ে গেলেও অভিজ্ঞ বোরহান সাহেব মনে মনে ঠিকই আঁচ করে নিলেন কিছু একটা হয়েছে এই বাড়িতে। আর সেটা ভ্রমরকে কেন্দ্র করেই! নতুবা হুট করে ভ্রমর বাসায় যাবার জন্য এতটা উতলা হবে কেন? আর নাফিসা বেগমই বা এতসহজে তাকে যেতে দিতে রাজি হলেন কেন? অন্যসময় তো তিনি নিজেই ভ্রমরের বাসায় যাওয়ার বিপক্ষে হাজারটা যুক্তি দাঁড় করেন।পড়াশোনার ক্ষতি হবে তাই ভ্রমরকে ঘনঘন বাসায় যাওয়া নিয়ে ঘোরতর আপত্তি ছিলো তাঁর। অথচ আজকে বোরহান সাহেব বলার পরেও ভ্রমরের বাসায় যাওয়াটাকে সমর্থন করছেন তিনি? কিছু তো একটা নিশ্চয়ই হয়েছে! নতুবা নাফিসা রহমানের এমন পরিবর্তন?

বোরহান সাহেবের চিন্তিতমুখের দিকে তাকিয়ে নাফিসা রহমান আন্তরিক হেসে বললেন,’ভ্রমরের জন্য যেই প্রস্তাবটা এসেছিলো তাঁর কি হলো ভাই সাহেব?’
ধ্যান ভাংলো বোরহান সাহেবের। তড়িঘড়ি করে বললেন,’ছেলের বয়স বেশি। ভ্রমরের মায়ের মত নেই।’

নাফিসা রহমান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললেন,’আমি আর নির্ঝরও তাই ভাবছিলাম। তবুও ভদ্রমহিলা বাসার ঠিকানা দেওয়ার জন্য বারবার করে বলছিলেন বাধ্য হয়ে আমি আপনার কার্ড দিয়েছি। ফ্যাক্টরিতে কি গিয়েছিলো?

-‘ন। ছেলের ছবি আর বায়োডেটা সহ তাঁর মামাকে পাঠিয়ে ছিলো। বাসায় কেউ রাজি না থাকায় বারণ করে দিয়েছি।’

কথা শেষ করে বোরহান সাহেব ইতস্তত করলেন,তাদের পক্ষ থেকে মত ছিলো না এই কথা সত্য হলেও বারনটাও কিন্তু আগে ছেলেপক্ষই করেছিলো। ছেলের মামা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, মেয়ের বাপভাই কেউ পড়াশোনা জানে না। ছয়ভাইয়ের একজনও মেট্রিক পাশ করে নি অতএব এমন পরিবারে সম্বন্ধ এগোবেন না তাঁরা। সরাসরি অবশ্য বলেন নি তবে ঘটকের মারফতে সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
তাই এইমুহূর্তে বোরহান সাহেব নির্ঝরের সাথে ভ্রমরের বিয়ের কথাটা পাড়বেন কি না বুঝতে পারছেন না। নাফিসা রহমান যদি মুখের ওপর না বলে দেন তাহলে মানইজ্জতও শেষ। তাই ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন আগে অন্য কারো মারফরে প্রস্তাব দেওয়াটাই নিরাপদ হবে। সেরকম কোন হ্যাঁসূচক ইঙ্গিত পেলে নাহয় তিনি নিজে সরাসরি কথা বলবেন। আপাতত চেপে যাওয়াটাই ভালো। হাসিমুখে মেয়ের নাম ধরে ডাক দিয়ে বললেন,’ভ্রমর! এসো মা।’

ভ্রমর সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবার গলা শুনে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালো। তাঁর সুন্দর মুখখানায় সমস্ত পৃথিবীর অন্ধকার নেমেছে! বুকের ভেতর চাপ দিয়ে কান্না চেপে রেখেছে সে। ধীরে ধীরে বাবার কাছে এগিয়ে এলো। বোরহান সাহেবও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’মামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাও।’
ভ্রমর মলিনমুখে নাফিসা রহমানকে সালাম করে বললো,’আসি মামি!’ তাঁর দৃষ্টি ছলছল! নাফিসা রহমান মনে মনে ব্যথিত হলেন।
কাল রাত থেকেই তিনি ভাবছিলেন ভ্রমরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের বাড়িতে পাঠানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কালরাতের ঘটনার পরে তাঁকে এই বাড়িতে রাখা কোনভাবেই নিরাপদ নয়। যে কোন মুহূর্তে যেকোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে ভ্রমর। পরের মেয়েকে কোনরকম রিস্ক নিতে চাইলেন না নাফিসা রহমান। কিন্তু এখন যখন ভ্রমর চলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন উনার মনটা খারাপ হয়ে গেলো! হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে। মেয়েটা যতক্ষণ বাসায় থাকতো নাফিসা রহমানের সময়টা বেশ ভালোই কাটতো। কত সময় গল্প করে পার করেছেন দুজনে একসঙ্গে বারান্দায় বসে! আশ্চর্য হলেন নাফিসা রহমান! হঠাৎ করেই তাঁর এমন খারাপ লাগছে কেন? নারীহৃদয় মানেই কোমল, স্পর্শকাতর বস্তু । কোন বিরক্তি বস্তুও অনেকদিন এদের কাছে থাকলে এরা খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই বস্তুটার মায়ায় পড়ে যায়। বিরক্তিকর বস্তুটা তখন আর তাদের কাছে বিরক্তিকর থাকে না, স্নেহের জায়গা দখল করে নেয়! কিন্তু হঠাৎ করেই যদি কোনদিন সেই বস্তুটা তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় তখন প্রতিটা মুহূর্তে তারা যেই বস্তটার কিংবা মানুষটার শূন্যতা অনুভব করে। হয়ত একসময় ভুলেও যায় কিংবা শূন্য জায়গাটা নতুন কিছু দিয়ে পরিপূর্ণ করে নেয়! কিন্তু কোথাও না কোথাও যেন একটা বন্ধন থেকেই যায়। বস্তুত কথাগুলো কেবলই নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমন নয় কিছু কিছুক্ষেত্রে পুরুষদের জন্যেও প্রযোজ্য!

নাফিসা রহমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভ্রমরের মাথায় হাত বুলিয়ে,’জীবনটা অনেক বড় ভ্রমর। সময়কে কাজে লাগাতে শিখ! তাহলে আর দুঃখ পাবি না। নিজেকে সময় দে, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।’
ভ্রমর জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। নাফিসা রহমান হতাশ হলেন। উলুবনে মুক্তো ছড়াচ্ছেন তিনি! এইমুহূর্তে এসব কথা সম্পূর্ণ নিরর্থক! ভ্রমর বুঝবে না। আরেকটু সময় দিতে হবে তাঁকে। আবারো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মলিনমুখে বোরহান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’মেয়ের দিকে খেয়াল রাখবেন ভাইসাহেব! আমি আসবো একদিন ওর সাথে দেখা করতে।’


ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ নিয়ে বিকেল বেলা বাড়ি ফিরলো নির্ঝর। আজকে সারাদিন স্যারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। দুপুর খাওয়ার সময়টুকুও পায় নি। এখন পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে! এসেই ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে গেল। নাফিসা রহমান রান্নাঘরে ছিলেন। সাড়া পেয়ে ডাইনিংয়ে এসে দেখলেন ছেলে নিজে নিজে ভাত বেড়ে খাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন,’সারাদিন না থেকে এখন আর তর সইছে না? একটা কিছু বাঁধালে তুই শান্তি পাবি। কতবার করে বলেছি ফিরতে দেরী হলে বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিবি। কে শুনে কার কথা?’

-‘সময় পাই নি!’ সংক্ষিপ্ত জবাব নির্ঝরের।

নাফিসা রহমান সুচালো দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষন! গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,’কাজ শেষ হয়েছে?’

নির্ঝর ভাতের লোকমা মুখে তুলে নিয়ে বললো,’মোটামুটি কমপ্লিট। লে আউট জমা দিয়েছি। স্যারের পছন্দ হলে ফাইনাল কপি জমা দেবো।’

-‘আর কয়দিন লাগবে?’

-‘কি জানি। স্যার আবার কবে ডাক দেন। তবে আর বোধহয় বেশি দেরী হবে না।’

নাফিসা রহমান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তাঁর ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। ছেলের খাওয়া শেষ পর্যন্ত চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসে রইলো। নির্ঝরের খাওয়া শেষ হলে টেবিল গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করলেন,’কফি দেবো?’ নির্ঝর হাসলো। এই মুহূর্তে একমগ কফির খুব প্রয়োজন তাঁর।মাথাটা খুব ধরেছে!’ সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে উপরে চলে গেলো! যাওয়ার সময় মায়ের অলক্ষ্যেই একবার ভ্রমরের ঘরের দিকে চাইলো। আজকে তো ভ্রমরের চলে যাওয়ার কথা ছিলো? চলে গেছে নিশ্চয়ই? সেইজন্যই মায়ের মন খারাপ! বেচারী পড়েছে বিপাকে! অন্যদিকে ছেলের ভবিষ্যত অন্যদিকে ভ্রমর! আফসোসের হাসি হাসলো নির্ঝর। তারপরই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো ।

রুমে ঢুকে চশমাটা খুলে খাটের পাশে রাখলো সে। লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই কালরাতের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। ভ্রমর যাওয়ার আগে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলো নির্ঝরের প্রতি! আকুতিভরা কন্ঠে বারবার একটা রাত ভিক্ষে চাইছিলো তাঁর কাছে! মুখ ফুটে না বললেও অসংখ্যবার ভালোবাসার দাবি নিয়ে ছুটে এসেছিলো নির্ঝরের দোরগোড়ায়! দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নির্ঝর ! এসব সে ভাবতে চায় না। কি লাভ এসব ভেবে? ভ্রমর হয়ত কোনদিনই জানতেও পারবে না তাঁর ছুঁড়ে দেওয়া তীরটা ঠিক নিশানা বরাবরই লেগেছে। নির্ঝর নামক নিষ্ঠুর কঠিন পদার্থটাও প্রেম নামক ছাইয়ে ফেঁসে গেছে! ভ্রমরের প্রতিটা কান্না, প্রতিটা আকুতি, প্রতিটা দুঃখ কতটা গভীরভাবে স্পর্শ করেছে নির্ঝরকে? কোনদিন এসব জনতে পারবে ভ্রমর? পারবে না। কোনদিন পারবে না!

নাফিসা রহমান কফি নিয়ে এসে ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। সোজা হয়ে বসলো নির্ঝর! মায়ের হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে তাঁকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো,’কি হয়েছে তোমার মন খারাপ কেন?’
নাফিসা রহমান জবাব দিলেন না। মৌনমুখে বসে রইলেন। নির্ঝর বাম হাত দিয়ে চোখ কচলে নিয়ে বললো,’কি হলো? বলছো না যে?’

-‘বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সারাদিন আমি একা থাকি।’

নির্ঝর হাসলো। বললো,’চলো দুজনে মিলে বাইরে থেকে কোথায় ঘুরে আসি। তোমার ভালো লাগবে। হঠাৎ করে ভ্রমর চলে গিয়েছে তো তাই তোমার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দুচারদিন গেলে দেখবে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নাফিসা রহমান খুব বেশি আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। মৌনমুখেই জিজ্ঞেস করলেন,’কোথায় যাবি?’

নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’ঢাকা শহরে জায়গার অভাব আছে নাকি?’

-‘সে তো আমিও জানি কিন্তু যাবি কোথায়?’

-‘দেখি না কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় তোমাকে?’ নাফিসা রহমান বিরক্তমুখে তাঁর দিকে চাইতেই মুচকি হেসে বললো,’মামার বাসায়। এখনো ওঠো রেডি হও।’
নাফিরা রহমান বেরিয়ে গেলেন। নির্ঝর কিছুক্ষণ চুপ করে দরজার দিকে চেয়ে থেকে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বিখ্যাত আমেরিকান লেখিকা এ্যাশলি স্মিথ এর ইংরেজিতে বলা কিছু উপদেশ বানী বিড়বিড় করে বাংলায় অনুবাদ করলো সে,”জীবন সৌন্দর্যে পূর্ণ। মৌমাছিদের দিকে তাকাও, শিশুদের হাসি মুখের দিকে তাকাও। বৃষ্টির ঘ্রাণ নাও, বাতাসের স্পর্শ নাও। জীবনকে পূর্ণভাবে উপভোগ করো আর নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য প্রয়োজনে লড়াই করো।” আশ্চর্য হলো নির্ঝর! জীবন সম্পর্কে এত সুন্দর পথ দেখানো সেই লেখিকাই নাকি সুইসাইড করে মারা গেছেন। কি অদ্ভুত মানব জীবন! তারপর আবারো বিড়বিড় করলো সে,’মৌমাছিদের দিকে তাকাও!…মৌমাছি মানেই তো ভ্রমর। এইজন্যই ডুবেছে এ্যাশলি স্মিথ! কে বলেছে তাকে ভ্রমরের দিকে চাইতে? ভ্রমরের দিকে একবার যে চাইবে সে শেষ!’ হাসলো নির্ঝর! এ্যাশলি স্মিথ শেষ হতে যাবে কেন? ভ্রমরের রূপ দেখে? ঈর্ষায়? আবারো হাসলো নির্ঝর! কি সব আবোলতাবোল ভাবছে সে? হাসির মাঝে আচমকা বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস! গভীর দীর্ঘশ্বাস! বুকের ভেতরটা কি তীব্র শূন্যতায় একটুখানি ধক করে উঠলো তাঁর?
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here