#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব-০১
#মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
যে মানুষটার জন্য ধর্ষিতার তকমা গায়ে লেগেছিল সেই মানুষটার জন্যই আজ বউ সেজে বসে আছি। নিজেকে আরো একবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখে পরখ করে নিলাম। কোথাও কোনো কমতি নেই। মানুষটা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই সাজানো হয়েছে আমাকে। সকলের সামনে মহান সেজে ঘুরে বেড়ানো মানুষটাই যে আমার ধর্ষিতা হওয়ার জন্য দায়ী তা সকলেরই অজানা। ধর্ষিতা না হয়েও এই মানুষটার জন্য সবার চোখে ধর্ষিতা হয়েছিলাম আমি। তিনটি বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি এই অসহ্য যন্ত্রণা।
মানুষটা আর কেউ না, আমারই আপন ফুফাতো ভাই। সেদিনটার কথা কখনও ভুলতে পারবো না আমি। তখন আমি মাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর সেদিন ছিল আমার লাস্ট পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষা হওয়ায় খুব খুশি ছিলাম আমি। অনেক দিনের ছুটি কাটাতে পারবো ভেবেই মনটা নেচে উঠেছিল। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা শেষে যে যার নিজের পথে চলে গিয়েছিলাম। আমি ও আমার বাসায় যাওয়ার পথে পা বাড়ায়। সেসময় হুট করেই সেখানে ভাইয়া চলে আসে। তাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তবে ভাইয়া আমাকে খুব ভালোবাসতো। তাই ভাইয়াকে সম্মান করতাম। ভাইয়া সেদিন আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমি যেতে না চাইলেও তার কথা রাখতে যায়। সেখানে যাওয়ার পরে ভাইয়াকে বাসার কথা বললে ভাইয়া জানায় ভাইয়া নাকি বাসায় বলে দিয়েছে আমি আজ এখানে থাকবো। সকাল হলে ভাইয়া আমাকে দিয়ে আসবে। আমার কাছে ফোন না থাকায় বাবা মার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়না। তাই ভাইয়ার কথা মেনে সেখানেই থেকে যায়। তবে ভাইয়া সেদিন বিকালে আমাকে নিয়ে ঘুরতেও যায়। সন্ধ্যায় ফুসকা আর আইসক্রিম ও খাওয়ায়। এই দুটো জিনিস ছিল আমার দূর্বলতা। তারই সুযোগ নিয়েছিল ভাইয়া। সন্ধ্যার পর বাসায় আসতেই ঘুমে চোখ লেগে আসে। ভাইয়া আমাকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমি রুমে যেয়ে শুয়ে পড়ি। একসময় পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
কিন্তু পরেরদিন সকালটা ছিল আমার জন্য ভয়াবহ। কিছু চাপা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। মাথাটা ভার ভার লাগে। উঠে আসেপাশে দেখতেই থমকে যায় আমি। আমি তখন আমারই রুমে ছিলাম। আমার বেডের পাশে মা, কাকী সহ আরো অনেকে আছে। মা মুখে আঁচল পুরে দিয়ে কান্না করছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারি বাইরে থেকে যখন বার বার কানে ধর্ষিতা শব্দটা আসতে থাকে।
আশেপাশের প্রতিবেশীরা আমাকে আমার নামে না, ধর্ষিতা বলে ডাকতে থাকে। পরে মায়ের কাছে জানতে পারি কাল পরীক্ষা দিয়ে বাসায় না আসায় খুব চিন্তায় ছিল সবাই। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমাকে খোজা হয়নি। কিন্তু আমার খোজ মেলেনি। তখন সবার ধারনা আমাকে কেউ অপহরণ করেছে। নয়তো আমি পালিয়ে গেছি। তখন আমার মাথায় একটা কথায় ঘুরছিল “আমি তো ভাইয়ার ওখানে ছিলাম। ভাইয়া বলল ভাইয়া বাসায় বলেছে। তাহলে এসব কি? আর আমিই বা এখানে এলাম কি করে?” শেষ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় মায়ের কাছেই। সারারাত টেনশনে ঘুম হয়নি কারোরই। ভোরের দিকে বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ কানে আসতেই সবাই ছুটে বাইরে আসে। ততক্ষণে গাড়িটা চলে যায় সবার চোখের আড়ালে। কিন্তু ফেলে যায় আমাকে। তাও অজ্ঞান অবস্থায়। আমার ড্রেস ছিল এলোমেলো। কয়েক জায়গা ছেড়াও। সবাই ধরে নিল আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি। তখনও সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। কি হচ্ছিল এসব কিছুই বোধগম্য হলো না আমার। মা কাকিকে ভাইয়ার কথা বলতেই সবাই আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। মা একটা থাপ্পড় ও মারে আমার গালে। ভাইয়া নাকি আগেরদিনই দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। আর আমি মিথ্যা বলছি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তখন, যখন মাকে বললাম ভাইয়াকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে। ভাইয়ার ফোন লাগে না। পরেরদিন ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যায়। আর তা সত্যিই দেশের বাইরের নাম্বার। আর ভাইয়া বেমালুম মিথ্যা বলে দিল আমার নামে। ভাইয়ার সাথে নাকি দেখাই হয়নি আমার।
সবাই বুঝে নিল আমি মিথ্যা বলছি। লেগে গেল ধর্ষিতার তকমা। ধর্ষণের শিকার না হয়েও আমি হয়ে গেলাম ধর্ষিতা।
ওই ঘটনার কিছুদিন পর জানতে পারি আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। অথচ এই বিয়ের কথা জানতামই না আমি। পরিবারের বড়রাই ঠিক করেছিল পরীক্ষার পর বিয়ে আমার। আগে জানাইনি পরীক্ষা খারাপ হবে বলে। এরপর আর কোনো প্রস্তাব আসেনি আমার জন্য। কেনই বা আসবে? কে চাইবে একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে? কে চাইবে এমন মেয়ে? এর মাঝে কেটে গেল আরো দুটি বছর৷ সময় পার হলেও আমার অবস্থা পরিবর্তন হয়নি তখনও। তবে তার মাঝে সবার জন্য সুখবর নিয়ে এলো আমার ফুফু। ভাইয়া আমাকে বিয়ে করতে চায়। পরিবারের সবাই খুশি হলেও খুশি হলাম না আমি। যার জন্য আমার এই অবস্থা তাকে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারবো না আমি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। ঠিক করল আমার বিয়ে। ফুফুর আদরের হওয়ায় আমাকে মেনে নিতে তার অসুবিধা হলো না। তারপর আর কি! আজকের এই দিন।
বউ সাজে সেজেছি আমি তার জন্য। তারই ঘরের ফুলের সাজানো বাসরে বসে সেই মানুষটারই অপেক্ষা করছি। যে আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। বিয়েটা খুব বেশি জাঁকজমক ভাবে হয়নি। তাই বিয়ের রাতে যেসব হাসি মজা হয় তার কোনোটাই নেই আমার বিয়েতে। যদিও তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। যেখানে এই বিয়েটা আমার কাছে একটা অভিশাপ, সেখানে কীসের মজা আর কীসের আনন্দ!
কিছু সময় পার হতেই দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ পেলাম। বুঝতে বাকি নেই তার আগমন হয়েছে। সবটা বুঝতে পেরেও নির্বিকার হয়ে বসে থাকলাম। কোনোরুপ রেসপন্স করিনি আমি। তার স্থির দৃষ্টি যে আমাতে নিবদ্ধ তা তার দিকে না তাকিয়েও খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। একসময় দৃষ্টি সরিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
“চেঞ্জ কর ফ্রেস হয়ে এসো, প্রিয়তা। রাত অনেক হয়েছে। ”
আমি কোনো প্রতুত্তর না করে সুটকেস থেকে সুতির থ্রি-পিস বের করে ওয়াসরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রেস হয়ে বাইরে আসতেই চোখ পড়ল মানুষটার উপর। এর মধ্যে নিজেও চেঞ্জ করে নিয়েছে। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। একটুপরেই আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শুয়ে পড়ো, প্রিয়তা।”
সেসময় তার চোখে কিছু একটা ছিল। সেটা ঠিক কী ছিল তা বুঝতে পারলাম না। বুঝার চেষ্টা টাও করিনি। তবে তাকে অনেক কিছু বলার ছিল আমার, অনেক কথা জানার ছিল যার কোনোটাই করে উঠতে পারিনি। যেখানে মানুষটাকে দেখতেই বিতৃষ্ণা কাজ করছে আর তো সেখানে কথা! চুপচাপ শুয়ে পড়ি আমি। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তার গভীর চাহনি। আরো কুছু সময় কেটে যাওয়ার পর ও যখন চোখে ঘুম নামক বস্তু নামল না, তখন তাকাতেই দেখতে পারলাম রুমে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ এরই মাঝে টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় কিছু একটা লিখতে দেখলাম মানুষটাকে। বাসর রাতেও মানুষ পড়ে ভাবতেই হাসি পেল। একসময় সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
নিয়মিত গল্প পেতে আমাদের লিংকে দেওয়া গ্রুপে জয়েন হয়ে সাথে থাকুন।?
https://www.facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa
সকালের মৃদু আলোয় ঘরটা আলোকিত হতেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ মেলে তাকাতেই নিজের অবস্থানের কথা স্বরণ হতেই ইষৎ কেঁপে উঠলাম। মানুষটার বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছি আমি। তার প্রতি রাগ আর ঘৃণার জন্ম নিতে শুরু করে৷ কিন্তু ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলাম সে নয়, আমি নিজের তাকে জরিয়ে রেখেছি। ঘুমের মাঝে এমনটা কখন করেছি ভাতেই রাগটা নিজের উপর হলো। সেই সাথে লজ্জা এসে জমা হলো আমার চোখেমুখে। ভাগ্যিস এখনও জাগে নি মানুষটা। নয়তো কি কেলেংকারীই না হতো। খুব দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে ফ্রেস হতে চলে যায় আমি। একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখি মানুষটা তখনও গভীর ঘুমে। আমি রুম থেকে বের হতেই মুখোমুখি হলাম ফুফাতো বোন পুনমের সাথে। ওর বয়স খুব বেশি না, এবার নয়তে পা দিবে। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। আমাকে দেখেই তার দুহাত মেলে ধরল কোলে নেওয়ার জন্য। এত বড় হয়ে যাওয়ার পর ও আমার কোলে তার উঠা লাগবেই৷ কোলে উঠতেই বললাম,
“আমার বার্ডটা কি স্কুলে যাচ্ছে?”
“ইয়েস আপি, ইয়েস। ”
“বাট এতো আরলি কেন? হ্যুয়াই?”
” লুক, ইট’স নট আরলি, ইট’স টেন এ এম।”
পুনম ওর হাতের ঘড়ি দেখিয়ে বলল। টাইম শুনে কিছুটা চমকে উঠলাম। এত বেলা করে উঠেছি ভাবতেই অবাক লাগছে। যে মেয়ে সূর্য উঠার সাথে সাথে উঠে সে আজ এত লেট। অবশ্য যে উঠিয়ে দেয় সেই মানুষটা তো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমাকে কিছু বলতে না দেখে পুনম আবার ও বলল,
“ইউ আর লেইট, আপি।”
“ইয়াপ, আই ম লেট।”
“তুমি কি তাহলে যাবে না?’
” নো, ফ্লাওয়ার, আপি যাবে না। ভাইয়া যাবে।”
পেছন থেকে আওয়াজ হতেই আমরা পেছনে তাকালাম।
চলবে..??