#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব ৬,৭
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ৬
বিকালের মৃদু রোদ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমি, প্রিয়ক আর আমাদের ছোট বার্ডটা। পুনম আশপাশ দেখছে আর হৈ-হুল্লোড় করছে। আমার কোলেই বসেছে ও। কতবার পিছনে বসতে বললেও শোনে নি। তাই বাধ্য হয়েই বসেছি৷ আমাদের আর মামনিদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। মামনিদের বাড়ি শহরের ভিতর পড়লেও আমাদের বাড়ি পুরো গ্রামীন পরিবেশে পড়েছে। আর দূরত্বটা মাত্র ১ঘন্টার৷ প্রযুক্তির ছোয়ায় আর আধুনিক বাংলাদেশ তৈরীর কল্যানে আমাদের গ্রামের মেঠো পথ আর এখন নেই। কাঁচা পাকা মেঠো পথের পরিবর্তে তৈরী হয়েছে কনক্রিটের পাকা রাস্তা। তবুও বছর বা ঘুরতেই রুপ নিয়েছে এবড়োখেবড়ো রোডে। আশপাশে মোটামুটি ভালো আকারেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট৷ ক্রেতা বিক্রেতার জমে উঠেছে সেই পরিবেশ। হুট করেই গাড়িতে ব্রেক কষতেই সামনের দিকে হেলে পড়ি৷ আঘাত পাওয়ার আগেই প্রিয়ক তার হাত দিয়ে আমাদের দুজনকে ঠেকিয়ে নেয়। নয়তো ভালোই আঘাত লাগত আমাদের। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টির মানে বুঝতে ব্যর্থ আমি। শুধু এখন নয়, কলেজ থেকে আশার পর থেকেই তার দৃষ্টি আমার অচেনা লাগছে৷
“নেমে এসো, প্রিয়তা।”
হঠাৎ ডাকে ঘোর কাটে আমার। প্রিয়কের কথায় আশে পাশে তাকালাম। না এখনও তো আসিনি আমরা। তাহলে এখানে কেন নামবো? প্রিয়ক আবারও নামতে বললে নেমে আসি আমি আর পুনম। প্রিয়ক পুনমকে একটা চকলেট আইসক্রিম কিনে দিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানের সামনে এসে থামতেই সামনে তাকাই আমি। একটা ফোনের দোকান। আমাকে নিয়ে ভিতরে যেতে চাইলে বাঁধা দিয়ে গাড়িতে চলে আসি আমি। প্রিয়ক আমার দিকে নিরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভিতরে ঢুকে যায়। সেই সাথে পুনম ও। প্রায় ১৫মিনিট পর এসে আমার হাতে ফোন দিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে। আর পুনমকেও বসায়। গাড়ি চলতে শুরু করে।
“প্রিয়তা’স ড্রিম” লেখা বাড়িটার সামনে নামতেই মনটা কেমন করে উঠল। মনে হচ্ছে বহুবছর পর এসেছি আমি এখানে। অথচ মাত্র আড়াই দিন হয়েছে আমার এখান থেকে যাওয়ার। তাও সেখানে যেখানে আমার রোজ আশা যাওয়া হয়। তবুও মনে হচ্ছে একটা শূন্যতা যেন পূরন হচ্ছে খুব গোপনীয় ভাবে। মা, চাচী আম্মু, ছোট চাচ্চু আর বড় চাচ্চু এগিয়ে আসে আমাদের দিকে৷ মাকে দেখেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ি। যেন কতদিনের অভুক্ত আমি৷ চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে কিছু তরল পদার্থ। মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। একসময় চাচি আম্মুও আমাকে বোঝালেন। মা বললেন,
“পাগল মেয়ে আমার, এভাবে কাঁদে নাকি কেউ?”
“ওদেরকে ভিতরে নিয়ে বসতে দাও।”
পিছন থেকে ভারী গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারলাম আব্বু এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে ছেড়ে সেদিকে ফিরতেই দেখলাম আব্বু আমাদের দিকেই আসছে। আব্বু কাছে এসে প্রিয়ককে জরিয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি আমি৷ আমাকে যেমন ওই বাসার সবাই খুব ভালোবাসে প্রিয়ককেও তেমন এবাসার সবাই খুব ভালোবাসে৷ প্রিয়ক এর মাঝেই সবার খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছে। আমাদের দুজনকে আমারই রুমে পাঠিয়ে ফ্রেস হয়ে নিতে বলে। আমারই রুম! যা একসময় আমার সকল ক্লান্তি মেটানোর উৎস ছিল। কত কত স্মৃতি যে জরিয়ে আছে তা বলার বাহিরে। কত নির্ঘুম রাতের নিরব কান্নার সাক্ষী যে এই ঘর, ঘরের প্রতিটি বস্তু। ওরা যদি কথা বলতে পারত তাহলে এই মুহুর্তে প্রিয়ককে নিজেদের মাঝে আসতে দিত না। চিৎকার করে জানাতো সবাইকে। বাট আফসোস।
নিষুতি রাত। কিছু রাত জাগা পাখি ব্যতীত আর কোনো কিছুর আওয়াজ নেই। এর মাঝে খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু করুন সূর। মনে হচ্ছে কান্না করছে কেউ। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। পাশ ফিরতেই দৃষ্টি যায় প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আজও তার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ আমি। খুব সন্তর্পণে নিজেকে তার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে উঠে বসি আমি। তৃষ্ণা মেটাতে টেবিলের উপর থাকা বোতল থেকে পানি খেয়ে নেয়৷ বোতলটা রাখার সময় চোখ যায় টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে একটি ডায়রী। প্রিয়কের ডাইরী। এর সাথেও জরিয়ে আছে একটি মধুর স্মৃতি। যা ভেসে উঠল চোখের পাতায়।
ডিসেম্বর মাস। ইংরেজি মাসের শেষমাস হলেও বাংলা মাসের নবম মাস। পৌষ মাস। জে এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। তার পুরো ক্রেডিট না গেলেও অর্ধেকের বেশি ক্রেডিট ছিল ভাইয়ার। আমাকে একস্ট্রা ভাবে এত সুন্দর আর সহজ করে সব পড়া বুঝাতো যা সহজেই বুঝতাম আমি। আর মনেও থাকতো। তাই ঠিক করেছিলাম ভাইয়াকে একটা গিফট দিবো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাট কী দিবো? তখনই মাথায় এলো ডায়রীর কথা। ফ্রেন্ডের সাথে গিয়ে কিনেছিলাম এটা দোকানটার পাশেই ছিল ঘড়ির দোকান। একটা ঘড়ি ও কিনেছিলাম সেদিন। ভাইয়াকে তা দিতেই এতটা খুশি হয়েছিল তা বলার বাহিরে। কেঁদে ফেলেছিল ভাইয়া। সেদিনই প্রথম ভাইয়াকে কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। আমাকে সেদিন খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরেছিল ভাইয়া।
ডায়রীটা হাতে নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলাম আমি। খুব যত্ন করে রেখেছে ডায়রীটা। একটুখানি দাগ পড়তে দেয়নি তাতে। হুট করেই মাথায় এলো ভাইয়ার আমার সাথে করা অন্যায় গুলোর কারন লেখা নেয় তো এখানে! জানতে হবে আমাকে। যা ভাবা তাই কাজ।
বাইরের অতিরিক্ত শব্দে চোখ মেলে তাকালাম আমি। মাথাটা ভার ভার লাগছে আমার। তবুও উঠে বসলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বেলা অনেক হয়েছে। পাশে প্রিয়ক নেই। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে নিলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাড়ির সবাই ভীষণ ব্যস্ত। মা চাচীরা রান্নাঘরে হরেক রকম খাবারের আয়োজন করায় ব্যস্ত। বাড়ির নতুন জামাই বলে কথা! জামাই! হাসি পেয়ে গেল কথাটা ভাবতেই। আমাকে একা একা হাসতে দেখে এগিয়ে এলো আমার দাদীমা। এসেই বলল,
“কিলো নাতিন, এত হাসছ ক্যান?নাতজামাইয়ের সোহাগের কতা মনে পরল নি?”
“তোমার মতন না গো বুড়ি আমি। ”
“হ্যারে বু। তোগো মদ্যে সব ঠিক আছে লো? পিয়ক কিছু কইছে নি লো?”
দাদীর আদর মাখা কন্ঠশুনেই বুঝতে পারলাম আার জন্য কতটা চিন্তিত ছিল। দাদীর কথায় এক পলকের জন্য দৃষ্টি প্রিয়কের দিকে চলে যায়। মামাদের সাথে কাজে ব্যস্ত সে। সেই সাথে ছোট বাচ্চাদের সাথে চলছে দুষ্টামি। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দাদীকে বললাম,
“সব ঠিক আছে গো, দাদীমা। তুমি এত চিন্তা কইরো না। শরীর খারাপ করবো তোমার। ”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। ”
সকাল পেরিয়ে দুপুর ঘনিয়ে আসে। প্রকৃতি তীব্র রোদের তাপে গরম হতে থাকে। এসময় একটু শীতল বৃষ্টির ছোয়া পেতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে প্রকৃতির কোণে কোণে থাকা ক্লান্ত শরীর। সেই ছোয়া দিতেই যেন নেমে আসে বৃষ্টির ধারা। বৃষ্টির কণা মাটিতে স্পর্শ করার আগে স্পর্শ করছে আমাকে। বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জলের ধারা। এমনও দিন দেখতে হবে তা জানা ছিল না আমার। কষ্টটা যে এত পরিমানে হতে পারে তা কখনই ভাবতে পারিনি। চোখের নোনা জল যেমন বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাচ্ছে তেমন যদি কষ্ট গুলোকেও ধুতে পারতাম! বাট আফসোস!
কাল রাতের কথা মনে পড়ল। ডায়রীর প্রথম পৃষ্টায় খুব সুন্দর করে লেখা
“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”
চলবে..??
#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব-৭
“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”
তার পরের পেইজে লেখা.
আজ একটা মিষ্টি মেয়ের গল্প বলবো তোকে। মেয়েটার প্রজাপতি খুব পছন্দের। তাই তোর নাম দিলাম প্রজাপতি। জানিস প্রজাপতি, আজ থেকে ১৩বছর পূর্বে একটি ছোট পুতুল এসেছিল এই ধরনীতে। তার ছোট ছোট কোমল হাত, তুলতুলে গাল, তুলার মতো নরম শরীর। তাকে একটি ছুলেই রক্তজবার মতো লাল হয়ে যেত। মনে হত শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অথচ ওই ছোট পুতুলটা ছিল আমার খেলার সঙ্গিনী।
এতটুকু পড়ে থমকে যাই আমি। এটা আমাকে নিয়ে লেখা। প্রজাপতি খুবই প্রিয় আমার। আর সেই প্রজাপতি নামই রেখেছে ডায়েরির। একপলক প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও পড়ায় মন দেয়।
“পুতুলটার যখন দুমাস। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করতো সে। যা কেউ বুঝত কিনা জানিনা আমি। কিন্তু আমি আমার মত করে বুঝে নিতাম। ওর একটু কান্না সহ্য হতো না আমার। খাবারের জন্য কান্না করলে পুতুলটার মাকে বারবার বিরক্ত করতাম। তার মা বলতো পুতুলটা এমনিই কান্না করছে। এরকমটা নাকি সবাই করে। তবুও স্থির থাকতে পারতাম না আমি।”
আর পড়তে পারি না আমি। ডায়েরীটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখি। বুকের মাঝটা কেমন যেন ভার ভার লাগে। যে আমাকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারে সে কখনই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিছুতেই না। কিছুটা ধাতস্থ হতেই আবারও পড়া শুরু করি। কিন্তু পরের পেইজ পড়তে নিলেই তীব্র আলোক রশ্মি চোখে পড়ে। হকচকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি আমার হাতে যেতেই ডায়েরিটা নিয়ে নেই। কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“এসব কি প্রিয়তা? তুই কবে থেকে অন্যের জিনিসে না বলে হাত দিতে শুরু করলি?”
প্রিয়কের এই কথায় কিছুটা নয়, অনেকটা অবাক হই আমি। তার কোনো জিনিসে হাত দিতে হলে আমাকে অনুমতি নিতে হবে তা ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। কেন জানি চোখের কোণে জমা হয় কিছু নোনা তরল। আর তা প্রিয়কের দৃষ্টিতে ধরা দিল কিনা জানা নেই আমার। তবে সে ওই সময় আমার দিকে আর একবারও না তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আর আমি! সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবতে থাকি এরকমটা করার কারন কী? কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। এমনিতেও এভাবে আর কতদিন! যত সময় যাচ্ছে প্রশ্নেরা তাদের ডালপালা মেলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এত এত প্রশ্নের ভীরে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। তাই বাধ্য হয়েই আমিও বের হয়ে আসি। চারপাশ নিরবতায় ছেয়ে আছে। এর মাঝে সামান্য নিঃশ্বাসের আওয়াজ ও যেন কম্পন তুলছে৷ আশপাশে দেখে বুঝতে পারলাম প্রিয়ক ছাদে গিয়েছে। আমিও উঠে যায় সেদিকে। ছাদের সিঁড়ি ঘরে প্রবেশ করতেই কিছুটা আওয়াজ করেই একটা শব্দ হলো। তাড়াতাড়ি সেদিকে যেতেই দেখলাম প্রিয়ক তার হাত মুঠো করে অনবরত দেয়ালে আঘাত করছে। ছুটে গিয়ে ভাইয়ার হাত ধরতেই আমার হাত থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নেয়। দুহাতে আমার কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
“এখানে কেন এসেছিস? হ্যা কেন এসেছিস?”
বলেই ছুড়ে ফেলে আমাকে। কিছুটা হেলে পড়ি আমি৷ ততক্ষণে প্রিয়ক নিজের মাথা নিজেই চেপে ধরে রেখেছে। হুট করেই অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,
“আমার কাছে তোর অনেক প্রশ্ন আছে, তাই না? জানতে চাস কেন করেছি আমি? ”
“হুম জানতে চাই। কেন করেছিলে সেদিন ওই করম? কেন ভাইয়া? কেন কলঙ্কিত করেছিলে আমাকে? তুমি তো জানতে আমি তোমার সাথেই ছিলাম। তাহলে মিথ্যা কেন বললে? ”
“জানিস প্রিয়তা। তোর যখন বিয়ে ঠিক হয় আমি জানতাম ও না। অথচ এই বাড়ির সব কিছুতে আমাকে রাখা হতো। ছোট বড় সবকিছুতে আমার মতামতের গুরুত্ব ছিল। অথচ সবচেয়ে বড় ব্যাপারটাই কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ পর্যন্ত করলো না। মানে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে। এমনকি তা ফাইনাল পর্যন্ত হয়ে গেছে তবুও আমি জানতাম না। কবে জেনেছিলাম জানিস? তোর দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন। সেদিন এখানে আসি সবাইকে আমার জবের খবর দিতে। যখন জবের কথা বললাম তখন বড় মামা কি বলেছিল জানিস? ”
আমি শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছি ভাইয়ার কথা। আমার কিছু বলার আগেই আবারও একটু থেমে ভাইয়া আবারও বলতে লাগল।
“বলেছিল ” এটা তো খুবই ভালো খবর। একসাথে দুই দুইটা ভালোখবর এলো তাহলে। ”
আমি অবাক হয়ে মামা কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘আরেকটা কি মামা? ‘ মামা হাসতে হাসতে বলেছিল আরে সামনেই তো প্রিয়র বিয়ে। কেন তুই জানিস না?’ বিশ্বাস কর। এ কথাটা বারবার বুকের মাঝে আঘাত করছিল। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোর বিয়ে! আমার প্রিয়তার বিয়ে! যে পুতুলটাকে নিজ হাতে বড় করলাম, সবসময় যাকে সামলে রাখলাম সেই পুতুলটার নাকি বিয়ে! ভাবতে পারছিস তোকে ছাড়া থাকতাম কিভাবে আমি? তুই যে আমার কাছে কি? তা আর কেউ জানুক বা না জানুক আমি তো জানি। পারতাম নারে তোকে ছাড়া থাকতে। কারন আমি যে তোকে..”
এতটুকু বলে প্রিয়ক থেমে যায়। ততক্ষণে প্রিয়কের গলা ধরে আসে। কণ্ঠস্বর আগের থেকেও ক্ষীণ হয়ে যায়। কান্না চেপে রেখেছে সেটাও বুঝতে পারছি। কেন জানি সেই মুহুর্তে প্রিয়কের উপর যত রাগ অভিমান ছিল সব হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল। প্রিয়ক জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করে আবারও বলতে শুরু করলো,
“তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম জানিস। বুঝিয়েছিলাম আমিও তো বাইরে যাচ্ছি ২বছরের জন্য। এমনিতেও তোকে ছাড়া থাকতে হবে সেখানে। তাই সবকিছু মেনে নিয়ে তোর বিয়ের যাবতীয় কাজে সাহায্য করছিলাম। এরই মাঝে একদিন জানালো জবের জন্য তিনদিনের মধ্যে যেতে হবে। তখন মনে হলো সব ঠিক আছে কিন্তু ছেলেটার ব্যাপারে তো খোজ খবর নিলাম না। ১দিনের মধ্যে সব খোজ নিলাম। আর তারপরই জানতে পারি ছেলেটা ভালোছিল না রে। আমার প্রিয়তার যোগ্য সে ছিল না। সে তোর যোগ্য ছিল না রে প্রিয়তা। ছিল না। তারপর অনেক চেষ্ঠা করেছি বাট বিয়ে ভাঙতে পারিনি। মামাদেরকেও বলেছিলাম কেউ শোনেনি আমার কথা। আর দুদিন পরই আমার ফ্লাইট ছিল। কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোকে আমার যাওয়ার কথা আমিই জামাতে মানা করেছিলাম। তুই ভেঙে পড়তিস তাতে। তাই বাধ্য হয়েছিলাম ওই রকম করতে। বিশ্বাস কর আমি শুধু বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছিলাম। তোকে কলঙ্কিত করতে নয়। ”
“তাই বলে এভাবে? একটা বিয়ে ভাঙতে গিয়ে তুমি আমার জীবনটাই শেষ করে দিয়েছো ভাইয়া। আমি আর তুমি সত্যিটা জানলেও এই সমাজ প্রতিনিয়ত মিথ্যের আড়ালে থেকে আমাকে আঘাত করে গেছে। বারবার নিজের মৃত্যু কামনা করেছি আমি। ”
“চুপ কর প্রিয়তা। তোর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তোকে হারালে বাঁচতে পারবো না আমি। তাই নিজের মৃত্যুর সাথে আমার মৃত্যুর জন্য ও দোয়া করিস।”
বলার মতো আর কিছু খুজে পেলাম না আমি৷ তবে বুঝতে পারলাম না আমার মনে কি চলছে? প্রিয়ক আবারও বলল,
“আবীরকে বড্ড ভালোবাসিস, তাই না?”
প্রিয়কের এই কথায় তার দিকে তাকাই আমি। সে করুন চাহনীতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সেসময় কিছুই বলতে পারলাম না। তন্নির বলা কথাগুলো মাথায় আসে হুট করেই। এলোমেলো হয়ে যায় এতো দিনের ভালোবাসি ভেবে আসাটা। চুপ হয়ে যাই আমি। প্রিয়ক আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস প্রিয়তা।”
“ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে। যদি আমার ২টা কথা মেনে নাও। ”
“রাজি আমি। বল কি করতে হবে? ”
“বাড়ির সবাইকে সব সত্যিটা জানাবে তুমি। ”
আমার এই কথায় প্রিয়ক আমার দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে হাসলো। সেটা কষ্টের হাসি নাকি সুখের বুঝতে পারলাম না।
“এই প্রিয়তা, এভাবে ভিজছিস কেন? জ্বর আসবে তোর। ”
কারো ভাবী কন্ঠের আওয়াজে ঘোর ভাঙে আমার। সামনে তাকিয়ে দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভিজছি কেন জিজ্ঞাসা করলেও নিজেও যে ভিজে যাচ্ছে তা হয়তো বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ ভেজার কারনে মাথা ভার ভার লাগে। একসময় ঢলে পড়ি আমি প্রিয়কের বুকে। প্রিয়ক আমাকে ধরে পাগলের মত করছে তাও বুঝতে পারছিলাম। পুরোপুরি জ্ঞান না হারালেও দূর্বল ছিলাম আমি। প্রিয়ক আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাকে ডাকতে গেলে আমি হাত ধরে নেই প্রিয়কের। তার অদ্ভুত চাহনিকে অগ্রাহ্য করে তাকে বিছানায় ফেলে তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকি আমি। নিজের শরীরের উষ্ণতা কখন যে প্রিয়কের মাঝেও ছড়িয়ে গেল তা আর বোঝা হলো না আমাদের কারোরই।
পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেলে তাকাই আমি৷ সকাল হয়ে গিয়েছে। উঠে বসতে নিলেই বুঝতে পারলাম কারো শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আমি। তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসতে নিলেই নিজের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠি আমি। কাল সন্ধ্যার পরের মুহুর্তটা ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। এমনটা হওয়ার কি খুব দরকার ছিল। এমনটা তো না হলেও পারত। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কিছু নোনা তরল। ততক্ষণে প্রিয়ক ও উঠে যায়। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে বলে,
“এই প্রিয়, কাঁদছিস কেন? খারাপ লাগছে? কি হয়েছে বল না?”
আমি বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকি তার পানে। এতবড় ঘটনা হওয়ার পরও কিভাবে এ কথা বলছে মানুষটা। আবারও ঘৃণা জন্ম নিতে শুরু করে। প্রিয়ক ও হয়তো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে কেন কাঁদছি আমি। প্রিয়ক আমাকে ওর বুকের মাঝে নিয়ে বলল, এই পাগলি, কাদছিস কেন? তুই যেরকমটা ভাবছিস সেরকম কিছুই হয়নি। প্লিজ কান্না করিস না। ”
আমি সেভাবেই ফুফিয়ে বললাম,
“তাহলে এসব কি?”
“মামি চেঞ্জ করে দিয়ে গেছে। ভেজা থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়তি। এমনিতেই কাল জ্বর ছিল। তাই মামিকে ডেকেছিলাম। আমি কিচ্ছু করিনি। শান্ত হ। ”
কিছুটা শান্ত হতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম তার বাহুডোর থেকে। তবে এবার খুব লজ্জা লাগছিল। কি ভাবছিলাম আমি! তাড়াতাড়ি নেমে বাইরে চলে আসি আমি। পিছন থেকে প্রিয়কের মৃদু হাসির আওয়াজ হৃদমাঝারে আঘাত হানে।
সকালের নাশতার পর্ব একটু আগেই শেষ হয়েছে। এখন আয়োজন চলছে আর এক অতিথিদের আপ্যায়নের। আমার বড় চাচ্চুর মেয়ে রিক্তা আপু আর তার স্বামী তুহিন ভাইয়া আসছে তাদের ছোট পরী রিহিকে নিয়ে। আমরা এসেছি শুনেই তাদের আগমন। তাদের।জন্য চলছে আয়োজন। দুপুর না হতেই আগমন ঘটে তাদের। রিক্তা আপু আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে। সেই সাথে প্রিয়ককেও। রিক্তা আপু আমার ২বছরের বড়। এক বছর আগেই বিয়ে হয়েছে আপুর। প্রিয়ক ও আপুকে ভীষণ ভালোবাসে। কোনোরুপ বিপদ আমাদের ছুতে দেয় নি। তাদের ছোট পরীটা ও হাসছে। কোনো কিছু না বুঝলেও হাসিতে মেতে থাকে। তুহিন ভাইয়া আর প্রিয়ক যেন এক নতুন সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে। আর সেটা আমার সাথে প্রিয়কের বিয়ের কারনেই হয়েছে। কিন্তু এতো সব আনন্দ যেন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই যেমন প্রকৃতি কালো আঁধারে ঢাকা পড়তে থাকে ঠিক তেমনি কালো আঁধারে ঢেকে গেল সবকিছু। আর সবকিছুর মূলে অপরাধী একজন। সে হলো প্রিয়ক!
.
.
চলবে…???