#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব ১১,১২
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১১
দরজায় করাঘাতের আঘাতে নিজেকে স্থির করে নিই। চোখ মুখ ভালো করে মুছে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই প্রিয়ক ভিতরে এসে ডোর লক করে দেয়। তারপর আমাকে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে। তার হৃৎস্পন্দনের তীব্র আওয়াজ আমার হৃদয়েও ঝড় তুলছিল। বুঝতে বাকি নেই মানুষটার জন্য নিজের মনের মাঝেও সুপ্ত অনূভুতি সৃষ্টি হচ্ছে। কথায় আছে সৃষ্টিকর্তা বিয়ে নামক সম্পর্কে নিজে থেকেই বরকত ঢেলে দেন। দুটি মানুষকে অদৃশ্য এক মায়ায় বেঁধে দেন। ফলে না চাইতেও একে অপরের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। যা হয়তো আমাদের মাঝেও হচ্ছিল। কিন্তু এই মায়ার বাঁধন কি চিরস্থায়ী হবে?
কিছুসময় পার হতেই প্রিয়ক আমাকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে গিয়ে বলল,
“কেন করলি এমন, প্রিয়? কেন পিছিয়ে গেলি? কেন বিশ্বাস ঘাতকতা করলি আমার সাথে? ”
“কারন আমি আবিরকে ভালোবাসি৷ তোমাকে না।”
আমার কথায় থমকে যায় প্রিয়ক। হয়তো বিশ্বাস হয় না আমার কথা। সে বলল,
“মিথ্যা বলছিস তুই। এমন হলে কাল ওসব কি ছিল? ”
আমি প্রিয়ককে রাগি গলায় বললাম,
” ভুল ছিল। ভুল। আবেগ ছিল আমার। তোমার কথার মায়াজালে পড়ে আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম। আর কিছু না। আর তুমি আমার সাথে যা করেছো তারপর ভাবলে কি করে তোমার সাথে থাকবো আমি?”
আমার উত্তরে আরো রেগে যায় প্রিয়ক। আমার সামনে এসে আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে রেগে বলল,
“যদি নাই থাকবি তাহলে কাল কেন কাছে আসতে দিয়েছিলি? কেন গিয়েছিলি আমার সাথে? কেন বলেছিলি থাকবি আমার সাথে। কেন বলেছিলি ডিভোর্স চাস না তুই? বল কেন করলি?”
“বললাম তো আবেগ ছিল আমার৷ আর দুবছর আগে তুমি যেমন আমার বিশ্বাস ভেঙেছিলে আমিও তাই করেছি। আর কিছুনা।”
আমার কথায় প্রিয়ক স্তব্ধ হয়ে যায়। শব্দ যেন তার কণ্ঠনালীতে আটকে যায়। করুন কণ্ঠে বলল,
“প্রতিশোধ নিলি?”
“মনে করো তাই।”
আমার কথায় নিজের মাথা ধরে বেডে বসে পড়ে প্রিয়ক। আমি আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকি। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের রাগ সংবরণ করতে চাইল প্রিয়ক। তারপর কিছু একটা ভেবে হুট করে উঠে আমাকে ধরে বলে,
“মামী। মামী তোকে এসব বলতে বলেছে তাই না। এখানে আসার পর শুধু মামীই তোর সাথে কথা বলেছে। আর কেউ একা কথা বলেনি৷ তোকে মামী কিছু বলেছে। তাই না রে?”
আমি শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে আছি মানুষটার দিকে। এতকিছু বলার পরও মানুষটা কিভাবে এ কথা বলতে পারে? কিভাবে আমাকে বিশ্বাস করতে পারে? কেন তার মনে হচ্ছে আমাকে জোর করা হচ্ছে? ভালোবাসলে কি এমনটা হয়? কোনোটার উত্তর নেই আমার কাছে। তবে মনে হলো মন বলছে’ হ্যা হয়’।
আমি আগের মত করে বললাম,
“এত কিছু জানিনা। শুধু এতো টুকু জেনে রাখ আমি যেতে পারবো না তোমার সাথে।”
প্রিয়ক শুধু অবাক চোখে চেয়ে থাকে। হয়তো এই প্রিয়তা তার অচেনা। তার সেই ছোট পুতুলটা নয়। বরং অন্য কেউ। প্রিয়ক তখন আমার চোখে চোখ রেখে বলে,
“শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি প্রিয়তা। সত্যিই কী তুই ডিভোর্স চাস? চাস আমাদের সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে? আর হ্যা সত্যিটাই বলবি। মিথ্যা না। নয়তো এর পর যা হবে তার জন্য তুই দায়ী থাকবি।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। কথা যেন সব হারিয়ে ফেলেছি। কণ্ঠস্বর যেন বসে গিয়েছে। সে কোনোরূপ শব্দ করতে নারাজ। তাকে কিছু বলতে পারছিলাম না। নিরবে চোখ নামিয়ে নিই আমি। কয়েক ফোটা নোনা তরল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। প্রিয়ক আমার জবাব না পেয়ে আমাকে তার বুকের মাঝে ভরে নেয়। মাথায় আলতো হাত রেখে বলে,
“থাক আর কিছু বলতে হবে না। আমি আমার উত্তর পেয়ে গিয়েছি। ”
আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না। প্রিয়ক একটু থেমে আবার বলল,
“তুই এখন আমার স্ত্রী। আমি না চাইলে তোকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। কেউ না। তবে হ্যাঁ তোর এই মুখে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসিস এ কথাটা যেন আর উচ্চারিত না হয়। নয়তো জানে মেরে ফেলবো এবার। হয় তোকে না হয় নিজেকে। ”
প্রিয়কের এবারের কথায় ওকে শক্ত করে ধরে রাখলাম। কত সময় কেটে গিয়েছে তা জানা নেই আমার।
মা! পৃথিবীতে একটুকরো স্বর্গের নাম মা। মা তো সেই, যে দশমাস একটা প্রানকে নিজের অস্তিত্বে ধারন করে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে পৃথিবীতে একটা নতুন জীবন নিয়ে আসে৷ কতগুলো মুখের হাসির কারন হয় একজন মা। সেই মা যখন কষ্ট পায় তখন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। যেমনটা এখন আমার মনে হচ্ছে৷ আমি আমার মাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি। সেই মায়ের দেওয়া কসমের কাছে দায়বদ্ধ আমি। আম্মি প্রিয়কের মুখে আমাকে ওর সাথে যাওয়ার কথা শুনে রাগের সাথে কষ্ট ও পায়। তার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রিয়ক যা বলেছে সত্যি বলেছে। আমি যেতে চেয়েছি তার সাথে। আর আম্মি যখন আমাকে নিতে রুমে আসে মায়ের চোখে কাঠিন্যতা দেখি আমি। যা এর আগে আমার প্রতি কখনই দেখি নি আমি। আম্মি এসেই আমার গালে খুব জোরে একটা চড় বসায়।
“এতটা বেহায়া কবে হলি তুই? আমাদের কাউকে কিছু না বলে প্রিয়কের সাথে ওর ফ্লাটে চলে গেলি। একটা রাত পার করে এলি ওখানে। এখন আবার একসাথে এসে বলছিস আমরা রাজি না হলে দেশ ছেড়ে চলে যাবি? কিছুদিন আগেও যার নামে নালিশের ঝুলি খুলে বসতিস, যাকে সবথেকে বেশি ঘৃণা করতিস। আজ তার জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যেত চাস? ”
আমি আম্মিকে বিছানায় বসিয়ে বলি,
“আম্মি তুমি শান্ত হও প্লিজ। প্রিয়ক ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। অনুতপ্ত ও। আমার কথায় সব সত্যি সবাইকে জানিয়েছে। তারপর ও কি করে ক্ষমা না করি? আর আমার কোনো ক্ষতি করবে না তা যেমন আমি জানি, তেমন তুমিও জানো আম্মি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও প্রিয়ককে।”
“বাহ! এক রাতে এতটা উন্নতি! আমার মেয়ে এখন আমাকে বুঝাচ্ছে? তুই শুনে রাখ তোর বাবা কখনই মানবে না ওকে। তারপর ও যদি ওর সাথে যেতে চাস তাহলে আর কখনই তোর এই মাকে দেখবি না তুই। ”
“আম্মি এসব কি বলছো? ”
“যা বলছি ঠিক বলছি। আমি চাই না তুই প্রিয়কের কাছে যাস। ”
“তাহলে বিয়েটা কেন হতে দিয়েছিলে, আম্মি? সবটা তো তুমি জানতে। বিশ্বাস ও করেছিলে আমার কথা। তাহলে কেন সেদিন বাঁধা দেও নি?”
এবার আমার কথায় আম্মি চুপ হয়ে যায়। তবে তা কিছু সময়ের জন্য। তারপর আমার হাত তার মাথায় রেখে বলে,
“তোকে আমার কসম দিলাম। বাইরে যেয়ে সবাইকে এটাই বলবি তুই ডিভোর্স চাস। নয়তো আমার মরা মুখ দেখবি। ”
“আম্মি!”
“চিৎকার করবি না। আমি চাই না তুই নিজের অস্তিত্ব হারাস। নিজেকে সস্তা বানিয়ে ফেলিস। আজ তোর প্রিয়কের সাথে যাওয়ার মানে এটাই ওর সকল অন্যায় অবজ্ঞা করা। যা তুই করতে পারবি না। ওর তোকে পেতে হলে ঠিক ততটাই কষ্ট করতে হবে যতটা তুই পেয়েছিস। আর কষ্টটা তোদের ডিভোর্স থেকেই হবে।”
বলেই আম্মি আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। আমার আর কোনো কথা শোনে না। আসার আগে আবারও তার কসমের কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি আমি। সবার সামনে প্রিয়কের সাথে ডিভোর্স চাই বলা ছাড়া আম্মি আমার কাছে আর কোনো উপায় রাখে নি। প্রিয়কের বুকের মাঝারে থেকেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।
আজ আমার ছোট পুতুলটার জন্মদিন। পুতুলটা যে আজ কতটা আনন্দিত তা বলার বাহিরে। পাগলীটা অল্পতেই অনেক বেশি খুশি হয়৷ সামান্য কেক দেখে যে এতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তার জন্য আর কি চাই? পুতুলটা আজ আরো একবছর বড় হয়ে গেল। হেই প্রজাপতি, তুই কি উইস করেছিস আমার পুতুলটাকে? না করলে করে দে। রাগ করবে কিন্তু। আচ্ছা বাদ দে। তোর হয়ে না হয় আমিই করে দেবো। জানিস প্রজাপতি, মেয়েটা বড্ড অবুঝ। বুঝতেই চাইনা আমার ভালোবাসাটা। কবে বুঝবে বল তো। জানিস আজ পাগলীটা মিষ্টি রঙের গাউন পরেছিল। এই রঙটা ওকে এতটা মানাবে তা ভাবতেই পারিনি। আগে জানলে মিষ্টি রঙে মুড়িয়ে রাখতাম পাগলীটাকে। এতো মিষ্টি কেন মেয়েটা। দেখলেই মনে হয় টুপ করে খেয়ে ফেলি।”
আজ একমাস হলো প্রিয়ক বাংলাদেশে নেই। প্রিয়কের ডায়েরির একটি পাতার অংশ এটি। মানুষটার ভালোবাসা কতোটা ছিল তা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি। প্রিয়ক বাইরে চলে যাওয়ার পূর্বে খুব সাবধানে তার ডায়েরিটা আমি রেখে দেয়। মূলত সে রাতেই রেখেছিলাম আমার কাছে যে রাতে তার বউ হয়ে গিয়েছিলাম তারই ফ্লাটে। তবে তা লুকিয়ে। আমাকে নিয়ে লেখা তার গল্পটা জানার ইচ্ছা ছিল খুব। হয়তো সে জানতেও পারেনি। যখনি মন খারাপ থাকে ডায়েরি পড়তে ভালো লাগে আমার। নিমিষেই মনটা ভালো হয়ে যায়। অনেক কিছুই জেনেছি আমার সম্পর্কে। যা আমি নিজেও জানি না। এতটা নিখুঁত ভাবে কি করে দেখত মানুষটা আমাকে?
ক্লাস শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। হল রুমের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি মুনি, হাসি আর তন্নির জন্য। ওরা ক্যান্টিনে গিয়েছ খাবার খেতে। আমার ভালো না লাগায় যায়নি আমি। প্রায় ১৫মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পর ও ওদের না আসায় সামনে যেতে চাই আমি। কিন্তু তখনি সামনে এসে বাঁধা দেয় আবীর। আমার পথ আগলে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছিলে?”
“ক্যান্টিনের দিকে।”
“খাবা কিছু? চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
“আমি একাই যেতে পারবো। তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আর আমি কিছু খাবো না। ”
” তাহলে আমার সাথে চলো। তোমাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে।”
আমি আবীরকে বাধা দিয়ে বলি,
“তুমি যাও। আমার ভালো লাগছে না আবীর। ”
তবুও আবীর আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল,
“আরে চলোতো। ”
“আবীর আমার হাত ছাড়ো।”
অনেকটা রেগে গিয়ে বলি আমি। এসব হাত ধরাধরি কোনো কালেই পছন্দ নয় আমার। তবে প্রিয়ক চলে যাওয়ার পর থেকে আবীর আজ কাল একটু বেশিই কাছে আসার চেষ্ঠা করে। বেশ কয়েকবার মানা করা সত্বেও শোনে নি। তবে ইদানিং আমার প্রতি আবীরের কেয়ার বেড়েছে। আমার সামান্য সমস্যার কথা শুনলেই হয়ছে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে যেন আমার পিছনেই পড়ে থাকে। বন্ধুদের সাথে আড্ডাও কমে এসেছে তার। আমাকে বেশি সময় দেওয়ার চেষ্ঠা করে। তবুও এসব অযথা মেলামেশা আমার পছন্দ নয়। আমার জোর আওয়াজে আশেপাশের বেশ কয়েকজন কিছু পলকের জন্য চেয়ে থাকে আমাদের দিকে। ততক্ষণে হাসি ওরাও চলে এসেছে। হাসি এসেছেই বলল,
“কি হয়েছে প্রিয়? রেগে আছিস কেন?’
ততক্ষণে আবীর আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
” আই ম সরি প্রিয়তা। প্লীজ রাগ করো না। ”
আমি রাগী কন্ঠে হাসিকে বললাম,
“কিছু হয়নি। চল তোরা ” বলেই ওদের নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পিছনে ফিরে তাকানোর ইচ্ছা ছিল না আমার। ক্যাম্পাস থেকে বাইরে আসার সময় হাসি ওর বিভিন্ন উদ্ভট কথায় আমাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। রিয়ন আজ আসে নি। দুদিন আগে খেলতে গিয়ে বাজে ভাবে ব্যথা পেয়েছে। যার ফলস্বরূপ বেড রেস্ট নিতে বলা হয়েছে ওকে। সবাই মিলে ঠিক করা হলো ওকে একবার দেখে তারপর যে যার বাড়ি ফিরব। বাইরে বেরিয়ে তন্নি বলল,
“আর কতদিন এভাবে থাকবি?”
“যতদিন না তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি বুঝিয়ে দিতে পারি ততদিন।”
তন্নি আবারও বলল,
“ফোন রিসিভ করেছিল?”
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম,
না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সবার ভিতর থেকে
.
.
চলবে..??
#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১২
গোধূলী বেলা। আমার আর মামনির একটা প্রিয় সময়। এসময়টা একান্ত আমাদের। সকল কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আমি আর মামনি গল্প করতে বসি। সারাদিনের সমস্ত কথা শেয়ার করি একে অপরের সাথে। আর আমাদের সঙ্গি হয় দু কাপ গরম চা। চায়ের অভ্যাস মামনির থাকলেও আমার ছিল না। তবে ইদানিং মামনির পাল্লায় পড়ে অভ্যাসটা আমারও হয়েছে। মামনির রুমের বারান্দায় বসে ব্যস্ত পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখতে দেখতে চাপের কাপে এক চুমুক দিয়ে মামনি বলল,
“কথা হয়েছে ওর সাথে? ”
“না, মামনি। ”
“এতটা রাগ কেন করলো? কি করেছিস সত্যি করে বল তো?”
“মামনি তুৃমিও। ”
এমন সময় মামনির ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার নাম্বার দেখে বুক কেঁপে উঠে। মামনি মৃদু হেসে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“যা কথা বলে আয়।”
আমিও আর কিছু না বলে ফোন নিয়ে আমাদের রুমে চলে আসি। রিসিভ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো মানুষটার ক্লান্ত মুখটি। আমাকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আমি বলে উঠলাম,
“আর কতদিন রাগ করে থাকবা? দুদিন তো হলো। এবার তো কথা বলো।”
“দেখ প্রিয়তা, ফোনটা মাকে দে। তুই কেন ফোনটা রিসিভ করেছিস? মা কই?”
“ঠিক আছে দিচ্ছি আমি। আর ফোন দিবে না আমাকে। কখনোই না।”
বলে ফোন কাটতে নিলেই ও পাশ থেকে প্রিয়ক বলল,
“সাহস বেশি হয়ছে তাই না। এবার আসি। দেখবো কোথায় আছে এতো সাহস? ”
আমি শুধু মৃদু হাসলাম। প্রিয়ক তা দেখে বলল,
“একদম হাসবি না। জানে মে*রে ফেলব।”
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম,
“আসছো কবে?”
“খুব শীগ্রই। কলেজে গিয়েছিলি? ক্লাস কেমন চলছে?”
“গিয়েছিলাম। আর সামনের মাসে এক্সাম। ”
“চিন্তা করিস না। তার আগেই চলে আসবো। ”
এরপর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে নিচে মামনির কাছে চলে আসি। ততক্ষণে মামনি রাতের রান্নার ব্যবস্থা করছে। আমিও কিচেনে যেয়ে মামনিকে সাহায্য করতে লাগলাম। গল্প কথায় রাতের রান্না শেষ করে ফ্রেস হয়ে পুনমকে পড়াতে বসি আমি। পুনমকে পড়ানো শেষ হলে রাতের খাবার সবাই একসাথে খেয়ে যে যার রুমে চলে যায়। একসময় প্রকৃতিতে নেমে আসে নিরবতা।
এতগুলো বছর ধরে যে দিনটার অপেক্ষায় থেকেছি, প্রতিটি প্রহর গুনেছি আজ সেই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। ছোট পুতুলটাকে আজ কনের সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। কনের সাজে কাউকে এতোটা মোহময়ী লাগে তা আগে জানা ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল চোখের পলকে পুতুলটা বড় হয়ে গিয়েছে৷ কাজল কালো আখিতে যেন ভর করেছে রাজ্যের সব মায়া। এই মায়ার সাগরের অতল গহ্বরে প্রতিনিয়তই নিমজ্জিত হচ্ছি আমি। এতটা মায়া কি আসলেই থাকতে আছে কারো? না নেই৷ তবে তা আমার প্রেয়সীর আছে৷ পুরোটাই মায়ায় জড়ানো আমার প্রেয়সী। যাকে ভালোবেসে মরতেও রাজি আমি। তার মিষ্টি কন্ঠে যখন তিন অক্ষরের একটি শব্দ পরপর তিনবার উচ্চারিত হল তখন মনে হচ্ছিল আমার ভালোবাসা সার্থক। আমার প্রেয়সী শুধুই আমার। ছোট পুতুলটা সারা জীবন আমার বুকের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে। আর আমি তাকে আগলে রাখবো সারাজীবন। তার মায়াভরা আঁখিতে পেতে দেব না কোনো কষ্টের ছোয়া। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তাকে এনে দিতে না পারলেও তার ভাগ্যের সবটুকু সুখ তাকে দিবো। আমি আর কিছু চাই না। শুধু আমার প্রেয়সীকে বলতে চাই, ‘#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি’। একবার নয়, বারবার। হাজার বার।
গভীর রাত। প্রতিটা মানুষ ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেও কিছু রাতজাগা পাখির মতো জেগে আছি আমিও। আর আমার সঙ্গি প্রিয়কের ডায়েরি। ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় রয়েছে আমার প্রতি তার সমস্ত অনুভুতি। এই ডায়েরী পড়েই জেনেছিলাম প্রিয়কের সেদিনের বলা কথাগুলো মিথ্যা। আমার বিয়ে ভাঙার যে কারন প্রিয়ক আমাকে এবং বাকিদের বলেছিল তা ছিল অসম্পূর্ণ। কিছুটা সত্য থাকলেও বেশিরভাগটাই ছিল মিথ্যা। এই ডায়েরীরই একটা পাতায় খুব সুন্দর করে লেখা ছিল দুবছর আগের সেই রাতের কথা।
“জানিস প্রজাপতি। আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। তোকে সবসময় যে পুতুলটার গল্প বলি সেই পুতুলটার নাকি বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। অথচ আমি জানিই না। এই এটা ভাবিস না আমার সাথে হয়েছে। অন্য কারো সাথে হয়েছে। যেই পুতুলটাকে ছোট থেকে ভালোবেসে আসলাম, সেই পুতুলটা নাকি অন্যকারো বুকের মাঝে নিজের লজ্জা লুকাবে? ভাবতে পারছিস? যাকে নিয়ে হাজারও স্বপ্ন সাজিয়েছি আমি, সে আমার স্বপ্ন ভেঙে অন্যকারোর স্বপ্নচারিনী হবে। বুঝতেই পারলাম না কবে পুতুলটা এতো বড় হয়ে গেল যে তাকে আমার কাছ থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার ভালোবাসার মানুষটার উপর আমার আর কোনো অধিকার থাকবে না৷ তার উপর নাকি অন্য কারো অধিকার থাকবে। এই প্রজাপতি, এমনটা হলে আমি বাঁচবো কী করে বলতে পারিস? ওকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিবো কি করে? আমার তো এখনি এসব ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কি করে সইবো ওকে অন্য কারো সাথে? বল না রে প্রজাপতি। তুই কেন কথা বলতে পারিস না হ্যা৷ তাহলে ওকে বলত পারতিস। জানিস পাগলীটা কখনই নিজের বাবা মায়ের অবাধ্য হয় না। আচ্ছা যদি পাগলীটা জানে যে তার প্রিয়ক ভাইয়া তাকে কতটা ভালোবাসে, কতটা পাগল তার জন্য তাহলে কি সে তার বাবা মায়ের অবাধ্য হবে? আমি না আর কিছু ভাবতে পারছি না। আচ্ছা যদি পাগলীটা অন্য কারোরই হবে তাহলে আমার মনে এতটা জায়গা কেন দখল করে নিলো? কেন নিলো কেন?”
নিজের অজান্তেই চোখের কোনে এসে ভীর করে কিছু নোনাপানি। কয়েক ফোঁটা চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়ে। এটা ওই দিন লেখা যেদিন প্রিয়ক আমার বিয়ের কথা জেনেছিল। ঠিক কতটা ভালোবাসতো আমাকে তা হয়তো সে নিজেও জানতো না। কতটা কষ্ট পেয়েছিল তা একমাত্র সে আর সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কেউ হয়তো জানতেও পারেনি। কিন্তু এখন বুজতে পারি তার ভালোবাসার গভীরতা। তবে তাকে হারিয়ে নয়, বরং পেয়ে বুঝেছি। না সেদিন আমাদের বিয়ে ভাঙে নি। ভাঙতে দেয়নি প্রিয়ক। তবে সেদিনের পর থেকে দুবাড়ির সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বাবা মায়ের সাথে খুব কম কথা হয় আমার। বাবার প্রতি অভিমানের পাহাড় জন্ম নিয়েছে মনের মাঝে। বাবানামক ব্যক্তিটার কাছে কখনই প্রিয় ছিলাম না আমি। বাবা সবসময় চাইতেন তার একটা ছেলে হোক। কিন্তু জন্ম নিলাম আমি। আমার জন্মের পর বাবা নাকি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু আমার জন্মের পর পাঁচটি বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন আম্মি আর কনসিভ করলেন না তখন বাবার চিন্তা হয়। আম্মিকে ডাক্তার দেখালে জানা যায় আম্মি আর কখনই সন্তান ধারন করতে পারবেন না। তখন জানা আমাকে জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের অসুস্থতার আরো একটি কারন ছিল আম্মি তার পরবর্তী সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারিয়েছিল। সেই থেকেই বাবার রাগ আমার আর মায়ের উপর। ছোট থেকেই দেখতাম বাবা মায়ের মনোমালিন্য। তবে তা কেন তখন বুঝতে না পারলেও এখন জানি। আমার প্রতি বাধ্য হয়ে যতটা ভালোবাসা যাই ততটাই বাসতেন তিনি। সবার সামনে বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল কঠোর। যার ফলে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। শুধু বাবা নয়, আমার বড় চাচ্চুও কঠোর প্রকৃতির মানুষ৷ ছোট চাচ্চুই কেবল নরম মনের। যার ফলে বাবা বা বড় চাচ্চুর কথার পিঠে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। আমাকে করা অবহেলা সবার চোখে পড়লেও তারা ভাবত বাবা তো এমনি। তাই খুব বেশি কিছু মনে করতেন না।
বাবা তার বন্ধুর ছেলে রায়ানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল ও শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য। উনারা শুধু যে বন্ধু ছিল তা নয়, বরং ছিল ব্যবসায়ের অংশীদার। যার ফলস্বরূপ বড় একটা প্রোজেক্ট পেতে চলেছিল বাবা। সেটাও আমার আর রায়ানের বিয়ের মাধ্যমে। তাই তো সবকিছু ঠিক করার পর বাবা বাসায় জানায়। আম্মিকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেন নি। আর পরিবারের বাকিরাও বাবার উপর কথা বলেন না, তাই তারাও মত দিয়ে দেয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরই রায়ানের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রিয়কের কারনে তা হয়নি। ওই মিথ্যা বদনামে তারা ভেঙে দেয় তাদের ছেলের সাথে আমার বিয়ে। তারা কোনো ধর্ষিতা মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ করতে রাজি না। ফলে বাবার কাছ থেকেও প্রোজেক্টটা হাতছাড়া হয়ে যায়। বাবার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয় তারা। যার ফলস্বরূপ বিশাল বড় ক্ষতি হয় আমাদের ব্যবসায়ের। যার জন্য বাবার রাগ আমার উপর আরো বেড়ে যায়। তাই তো সেদিন বাবা আমার গায়ে হাত পর্যন্ত উঠিয়েছিল। আমার জন্য সব হারানোই আমার একটি কথাও সেদিন তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। আর যখন জানতে পারল এতকিছু হয়েছিল প্রিয়কের জন্য। তখন আমার উপর জমানো সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল প্রিয়কের উপর। তাই সেদিন সবটা জানার পর পুরোনো সমস্ত ক্ষতির কারন প্রিয়ককে করে তা থেকেই আমাদের ডিভোর্স। মা এক্ষেত্রে বাঁধা দিলে অত্যন্ত কঠোর কন্ঠে বাবা আম্মিকে বলেছিল,
“হয় ওদের ডিভোর্স হবে এবং তোমার মেয়ে তোমার কোলে থাকবে। নয়তো তোমাকে আমি তালাক দেবো আর তোমার মেয়েকে মে*রে ফেলবো। আর তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি যা বলি তাই করি। তোমার ওই মেয়েকে মারতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না। তাই যেকোনো একটা বেঁচে নেও।”
আর এটা সত্যি। বাবার আমাকে মা’র’তে খুব বেশি কষ্ট হতো না। খুব বেশি কেন হয়তো একটুও হতো না। কারন শুনেছিলাম আমার জন্মের আগে আম্মি আরো একবার কনসিভ করেছিল। কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে যখন জানতে পারে সেটা মেয়ে ছিল, তখন বাবা আম্মিকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবোর্শন করিয়ে এনেছিল। তাছাড়া বাবার নির্মমতার শিকার আরো একজন হয়েছিল। সে হলো আমার ছোট ফুফি। তাকে দেখেনি আমি। এবাড়িতে আসার পর মামনির কাছে শুনেছিলাম, ছোট ফুফি আমাদের এলাকার একটি ছেলেকে ভালোবাসত। কিন্তু আমার দাদা ছোট ফুফির বিয়ে অন্যত্র ঠিক করে। তাতে ছোট ফুফি রাজি হয় না। এবং সবাইকে তার পছন্দের কথা জানায়। রাগে ফেটে পড়ে আমার দাদা, বড়চাচ্চু আর বাবা। নিজের সম্মান রক্ষা করতে ফুফিকে মে*রে ফেলে। খুবই নির্মম মৃত্যু হয়েছিল ফুফির। অথচ সবাই জানে ফুফি দূর্ঘটনায় মা*রা গিয়েছে। সেটা বাড়ির বড়রা জানলেও জানা ছিল না আমাদের। তাই আম্মির ভয় ছিল সত্যিই যদি আমাকে মে*রে ফেলে। সে জন্য বাধ্য হয়েই আম্মি আমাকে দিয়ে ডিভোর্সের কথা বলায়। নিজের সংসার বাঁচাতে নয়, বরং আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে মায়ের কঠিন রুপ ছিল আমার প্রতি।
.
.
চলবে..?