#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব ১৩,১৪
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১৩
আজ থেকে দেড় মাস আগের ঘটনা। তখন মাঝ রাত। চারপাশে ছেয়ে আছে নিস্তব্দতা। প্রকৃতি ধারন করেছে শান্ত আর নির্মল রুপ। বাড়ির সবাই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেও ঘুম ছিল না আমার চোখে। হয়তো আরো একটি মানব শরীরও জেগে ছিল। সে আর কেউ নয়, প্রিয়ক। আমি যখন নরম তুলার বিছানায় শুয়েও ছটফট করছি তখনি আমার রুমের দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ পায়। যা শান্ত প্রকৃতিতে ঝড় আওয়াজ তোলে। কেউ একজন দরজা ভেদ করে খুব সন্তর্পণে এগিয়ে আসে আমার নিকটে। একসময় তার হাতের কোমল ছোয়া পড়ে আমার মাথায়। ধীরে ধীরে স্পর্শ বৃদ্ধি পায়। বুঝতে বাকি থাকে না আম্মি এসেছে। আম্মির প্রতি সেসময় খুব বেশি অভিমান জমা ছিল মনে। তাই আমার মাথা থেকে আম্মির হাত সরিয়ে দিতে নেই। তখনি আম্মির কিছু কথা শুনে থমকে যাই আমি। আম্মি মৃদু কন্ঠে বলল,
“মায়ের উপর খুব রাগ হয়েছিস তাই না রে মা। কিন্তু বিশ্বাস কর তোর মা যে নিরুপায়। আর কোন উপায় যে নেই আমার কাছে। আমার সবচেয়ে বড় ধন তুই। তোকে বাঁচাতে যা করা লাগে সব করবো রে মা। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও তোকে রক্ষা করবো রে।
আম্মির কথা শেষ হতেই উঠে বসি আমি। আমাকে উঠতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায় আম্মি। আম্মি হয়তো ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আম্মি তাড়াতাড়ি চলে যেতে নিলে আমি আম্মির হাত ধরে নেই। আম্মিকে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
“আমাকে বাঁচাতে মানে কি আম্মি? কে মারবে আমাকে? কার থেকে ভয় পাচ্ছো তুমি?”
আম্মি আমতা আমতা করে বলল,
“কি সব বলছিস প্রিয়। তোকে আবার কে মারবে। উল্টা পাল্টা শুনেছিস তুই।”
“উল্টা পাল্টা শুনিনি আম্মি। ঠিকই শুনেছি। প্লিজ আম্মি, সত্যিটা বলো। আমাকে কসম দিয়ে তুমি আটকে রেখেছো। কেন আম্মি? ”
“দেখ প্রিয়৷ বাড়াবাড়ি করিস না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়। আর কাল ডিভোর্স পেপার আসলে তাতে সুন্দর মতো সাইন করে দিবি। কোনোরুপ পাগলামী করবি না৷ ”
বলে আম্মি চলে যেতে নিলে আমি বললাম,
“প্রিয়ক ডিভোর্স হতে দিবে না আম্মি। কিছুতেই হতে দিবে না। ”
“দিতে হবে ওকে। দেখ প্রিয়তা, মা আমার। পাগলামী করিস না। তুই না আমার লক্ষী মেয়ে। আমার সব কথা শুনিস। তাহলে এখন এমন কেন করছিস? আমি আমার এক মেয়েকে হারিয়েছি। তোকে হারাতে পারবো না রে মা। ”
মায়ের শেষ কথায় অবাক হয়েছিলাম আমি। কারন আমার জানা মতে আমার কোন বোন কখনই ছিল না। তাহলে আম্মি এ কথা কেন বলল? আম্মিকে বললাম,
“আর এক মেয়ে মানে কি আম্মি? আমার আর একটা বোন ছিল? ”
নিয়মিত গল্প পেতে আমাদের লিংকে দেওয়া গ্রুপে জয়েন হয়ে সাথে থাকুন।?
https://www.facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa
.
আম্মি হয়তো তখন বুঝতে পেরেছিল কথা বলতে গিয়ে গোপনীয় কথা বলে ফেলেছে। আম্মি কথা ঘুরাতে আমতা আমতা করে বলল,
“কি. কি সব বলছিস? কিসের বোন? ভুলভাল বলছিস।”
বলেই চলে যেতে নিলে আমি আম্মিকে আটকায়।
“আম্মি সত্যি করে বলো তো? কে মারবে আমাকে? আর আমার বোনের কি হয়েছিল?”
“আমি কিছু বলতে পারবো না। ছাড় আমায়।”
“বলতে তো তোমায় হবে মামী।”
হঠাৎ আগত কন্ঠে আমি আর আম্মি দরজার দিকে তাকায়। প্রিয়ক ভিতরে প্রবেশ করেছে। ভিতরে প্রবেশ করে সতর্কতার সাথে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। এসেই আম্মির এক হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি মামী। কিন্তু বুঝতে পারছি না কি এমন কারন আছে যার জন্য তুমি ভয় পাচ্ছো? কে মারবে প্রিয়তাকে? কারো এতটা সাহস হবে না যে এ পরিবারের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাবে। আর তো সেখানে প্রিয়তাকে আঘাত করা! তাহলে কেন ভয় পাচ্ছো মামী? কেন নিজের কসমের বেড়াজালে ওকে আবদ্ধ করছো? যদি আমার উপর রেগে থাকো তাহলে আমাকে শাস্তি দাও। কেন দুজনকেই শাস্তি দিচ্ছো? আর মামী আরেক মেয়ে মানে কি? প্রিয়তায় তো তোমার একমাত্র মেয়ে। তাহলে আরেক মেয়ে কোথা থেকে আসল? আর সে হারিয়ে গেল কি করে? প্লিজ মামী বলো আমাদের। এই তোমাকে ছুয়ে কথা দিলাম প্রিয়তার উপর কোনো রকম আঘাত আসতে দিবো না মামী। ওর শরীরে কোনো আঘাত লাগার আগে তা আমার উপর নিয়ে নিবো। বিশ্বাস করো আমায়।”
প্রিয়কের কথা শেষ হতেই নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে আমার আম্মি। খুব কম সময় আমি আমার আম্মিকে কাঁদতে দেখেছি। আম্মিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরি আমি। আম্মি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“জানিস ই তো তোরা। বাবা মাকে ছোট বেলায় হারিয়েছিলাম আমি। যেই চাচা চাচী আয়রা বলতে পাগল ছিল তারাই বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার সম্পত্তিতে জোর করে ভাগ বসালেন। আর আমাকে বের করে দিলেন। ঠাঁই হলো মামা বাড়িতে। সেখানেও থেকে দুবেলা ভাতের সাথে কিছু কটু কথাও গিলতাম। স্কুলের পড়া তো আগেই বাদ হয়ে গিয়েছিল। এর মাঝে তোর দাদা আমাকে তোর বাবার জন্য দেখতে এলেন। বয়স কম ছিল আমার। সেই সাথে সৌন্দর্য থাকার কারনে তারা পছন্দ করে। আর মামা মামীকেও আর আমার বোজা বইতে হবে না। তাই তারাও রাজি হয়ে গেল। বিয়ের তিনমাসের মাথায় নিজের ভিতর অন্য প্রানের অস্তিত্ব টের পেলাম। তখন তোর বাবা খুব খুশি ছিল। বদরাগী হলেও সেসময় আমার খুব খেয়াল রাখত। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল যখন পরীক্ষা করার পর জানতে পারে সেই ছোট প্রানটা ছেলে নয়, বরং মেয়ে। তখন শুরু হয় তার পরিবর্তন। এরই মাঝে একদিন এসে বলল ‘তৈরি হয়ে নাও। চেকআপের জন্য যেতে হবে।’ আমিও কিছু না ভেবে তৈরী হয়ে নিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর চেকআপের আগে তোর বাবা আমাকে পানি খেতে দেয়। আর সেটা খাওয়ায় ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল। তাতে ঘুমের ঔষধ দেওয়া ছিল। যার ফলে চেকআপ করার সময় ঘুমিয়ে যায় আমি। আর যখন ঘুম থেকে উঠি তখন নিজের ভিতর খালি খালি লাগে। বুঝতে পারি সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে তোর বাবার প্রতি রাগ ছিল আমার। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় যাবো বল। যাওয়ার জায়গা যে ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে থেকে যায়। এর পর কেটে যায় আর পাঁচ মাস। সেসময় আবারও নিজের ভিতর প্রানের অস্তিত্ব টের পায়। তুই এসেছিলি। এবারও পরীক্ষায় যখন দেখল মেয়ে, তখনও তোকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিল। অনেক কাকুতিমিনতি করার পর শুনেছিল আমার কথা। তুই যখন জন্ম নিলি ভয় হতো আমার। আমি তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তোর খেয়াল রাখতে পারতাম না। রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারতাম না। ভয় হতো। বারবার মনে হতো এই বুঝি তোকে মে’রে ফেলল। কিন্তু সেসময় তোর মামনি তোকে সামলালো। নিজের মেয়ের মতো সব সময় তোর যত্ন নিত। ”
একটু থেমে প্রিয়কের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেই সাথে ছিলি তুই প্রিয়ক। মাত্র সাত বছর বয়স তখন তোর। তবুও কত সুন্দর করে প্রিয়তার খেয়াল রাখতিস। যেন একটা পুতুল ছিল তোর কাছে ও। যত দিন গিয়েছে তোর ভালোবাসা বেড়েছে প্রিয়র প্রতি। ওর সামান্য আঘাতে অস্থির হয়ে পড়তিস তুই। এত কিছু করার পর তোর উপর রাগ করে থাকি কি করে? তুই যে অজান্তেই আমার মেয়েটার আরো একটা বিপদ হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলিস।”
আম্মির সব কথা আমরা নিরব শ্রোতার মত শুনছিলাম। এর মাঝে কখন যে আমাদের দুজনের চোখ ভিজে গিয়েছে তা টের পায়নি আমরা কেউই। প্রিয়ক বলল,
“কোন বিপদ মামী? কিসের কথা বলছো তুমি?”
আম্মি তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোর মনে আছে প্রিয়। এজবার স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিলি? সে কি কান্না তোর। তোকে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করলে বলেছিলি একটা ছেলে তোজে বাজে কথা বলেছে। অন্য মেয়েদের সাথেও বাজে ব্যবহার করেছে। মেয়েদের ওরনা নিয়েও টানাটানি করেছিল। সে আর কেউ নয়,রায়ান। যার সাথে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করছিল। সবটাই জানতো তোর বাবা। তবুও জেনে শুনে তোকে ওখানে দিতে চেয়েছিল। এবাড়ির কারো সাহস নেই তোর বাবা চাচ্চুর উপর কথা বলার৷ তাই প্রিয়কের সেদিনের কথাও কেউ শোনেনি। ”
এরপর আম্মি রায়ানের সাথে আমার বিয়ের মাধ্যমে যে ব্যবসার সম্পর্কের কথাও বললেন। সবমশোনার পর বলার মতো কিছু ছিল না আমাদের কাছে। প্রিয়ক ও চুপ করে শুনছিল। যে মামাকে সবসময় সম্মান করে এসেছে সেই মামার এই রুপ হয়তো তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
নিচু কন্ঠে প্রিয়ক বলল,
“মামা এইরকম করতে পারে বিশ্বাস হয় না। নিজের মেয়েকে কিভাবে মারার কথা ভাবতে পারে? আর তুমি এত কিছু কি করে সহ্য করছো মামী?
আম্মি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
“কি করবো বল। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই যে আমার। ”
একটু থেমে আম্মি আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সব তো শুনলি। এবার আর কোনো পাগলামি করিস না। ডিভোর্স এখন তোদের দুজনের জন্যই মঙ্গল। নয়তো কি হবে তা আমি আর ভাবতে চাই না। ”
“এসব জানার পর তো প্রিয়তাকে ছাড়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না মামী।
প্রিয়কের কথা শুনে আম্মি ওর দিকে তাকিয়ে রইল৷ প্রিয়ক আাবারও বলল,
” হ্যাঁ মামী। আমি কখনই ওকে ডিভোর্স দিবো না মামী। ওর জন্মের পর যেম একটা ছোট পুতুলের মতো খেয়াল রেখেছিলাম ওর তেমনি এখনও রাখবো। মামর সম্পর্কে আজ যা জানলাম তারপর তো ওকে এখানে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। মামা নিজের স্বার্থের জন্য প্রিয়তাকে নিয়ে যে কি করবে তা ভাবতে পারছি না।”
“কিন্তু..
আম্মির কথা কেটে প্রিয়ক বলল,
” কোনো কিন্তু নয় মামী। প্রিয়তার কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে। তুমি শুধু তোমার দেওয়া কসম প্রিয়তার উপর থেকে উঠিয়ে নাও। ”
প্রিয়কের কথায় ভরসা পায় আম্মি। আমার উপর থেকে উঠিয়ে নেই তার কসম। পরেরদিন সকালে খুব ঝামেলা হয়। ডিভোর্সের জন্য অস্বীকার করলে বাবা আমার গায়ে হাত তোলে। দ্বিতীয়বার আমাকে আঘাত করতে গেলে আমার ঢাল হয়ে থাকে প্রিয়ক। ফলে বাবা আমার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানাই। সেখান থেকে চলে আসি আমরা। মামনি আর ফুফাও আমাদের সাথে চলে আসে। এখানে আসার পর মামনি প্রিয়কের উপর রেগে থাকে খুব। তবুও তা খুব একটা প্রকাশ করে না। একসপ্তাহ কেটে যায় এভাবেই। এর মাঝে একদিন প্রিয়কের ফোনে ফোন আসে তার অফিস থেকে। মাস দুয়েকের জন্য তাকে বাইরে যেতে হবে। প্রিয়ক যেতে না চাইলেও আমি তাকে যেতে বলি। তবে যাওয়ার আগে আমাকে আবিরের সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় জানিয়ে যায়। আর সেই সাথে সতর্ক করে রেখে যায়। প্রিয়কের কথা মানতেই এখনও আবিরের সাথে কথা বলি আমি। কারন যা বলেছে তার পর প্রিয়কের এখানে অনুপস্থিতি আমার জন্য বিপদজনক। তবে দুদিন আগেই প্রিয়ক জানতে পেরেছে পর ডায়েরি আমার কাছে। ফলে রেগে যায় আমার উপর। দুদিন আমার সাথে কথা বলে না। তবে প্রিয়কের এখান থেকে যাওয়ার পর মামনির রাগ পড়ে গেছে। কারন মামনি ও সব সত্যিটা জানতে পারে। সেই সাথে মামনির কাছে শুনেছিলাম ছোট ফুফির কাহিনী।
ফোনের রিংটোনের শব্দে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজের প্রেরক আর কেউ নয়, প্রিয়কই। ছোট বার্তায় লেখা,
“ঘুমিয়ে পড়। রাত জাগা আমার পছন্দ নয়।”
এই ছোট কথাটাই আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট। যে মানুষটার আমার রাত জাগা পছন্দ নয়, অথচ সেই মানুষটাই রাতের পর রাত জেগে তার গল্পে আমাকে সাজিয়েছে। ফোনটা পাশে রেখে চোখ বুজে শুয়ে পড়ি। একসময় পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
.
.
চলবে..??
#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১৪
দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও দুই সপ্তাহ। আজ প্রিয়কের দেশে ফেরার দিন। সব থেকে খুশির দিন আমার জন্য। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা, তারপরই অপেক্ষার পালা শেষ। পুরো ব্যস্ত আমি আজ। প্রিয়কের পছন্দের খাবার রান্না করেছি নিজ হাতে। মামনিও হেল্প করেছে। আজ সময় যেন কাটছেই না। তবুও অপেক্ষার পালা শেষ হয়। আমারও হলো। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যার আভাস আসতেই প্রিয় মানুষটার দর্শন পেলাম। তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকাতেই সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই হারিয়ে গেল। তবে তার সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না আমার। কেমন যেন এক অনুভূতি। যা বলে বোঝানোর মত নয়। আড়াল থেকেই দেখে চলেছিলাম মানুষটাকে। এক সময় তার দৃষ্টিতে আবদ্ধ হই আমি। চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে লুকিয়ে নিই৷ তবে তার ওষ্ঠদ্বয়ের মৃদু হাসি নজর এড়ায় না৷ কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে নিজের রুমে চলে আসি। বুকের মাঝে এক অদ্ভুত অনূভুতির সৃষ্টি হলো। যা এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। গেট খোলার আওয়াজে বুঝতে পারি প্রিয়ক রুমে এসেছে। সে রুমে আসতেই আমি চলে যেতে নিই। তবে তা আর হয় না। হাত ধরে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। হঠাৎ এমন হওয়ায় ঘাবড়ে যায় আমি। লুটিয়ে পড়ি তার বুকের মাঝে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে মানুষটা তার শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় আমাকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
” আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
“কই পালাচ্ছি? ”
আমতা আমতা করে জবাব দিই আমি। প্রিয়ক তার চোখে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল,
“তাহলে লুকাচ্ছিস কেন নিজেকে? আর লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”
“ধ্যাত। কি সব বলো না তুমি। ছাড়ো তো। ”
বলে প্রিয়ককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসি। আসার সময় তার উচ্চ শব্দের হাসির আওয়াজ হৃদমাঝারে ঝংকার তুলে। বাইরে এসে সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে থাকি। কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? মানুষটা তো আর নতুন নয়। তাহলে?
“এই ভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন তুই?”
কথায় চমকে উঠি। খেয়ালই করিনি মামনি যে এখানে। এখন মামনি আমাকে কি ভাবছে কে জানে? কোনো মতে বলি,
“তাড়াতাড়ি নেমেছিতো। তাই।”
বলে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আছি। আঁড়চোখে পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম মামনি মিটমিট করে হেঁসে চলেছেন। আমি আর কিছু না বলে পুনমের কাছে চলে যায়।
মাঝরাত। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে সময় এখন তিনটার ও বেশি। শীতের আগমনী সূর আসতেই চারপাশ মৃদু শীতলতায় ছেয়ে গিয়েছে। সারাদিন গরম ভাব থাকলেও রাত নামতেই প্রকৃতিতে নেমে আসে শীতের ঠান্ডা আবহাওয়া। এরই মাঝে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলাম একজোড়া গভীর দৃষ্টিতে আবদ্ধ আমি। তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। অদ্ভুত শিহরন বয়ে যায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেকে প্রিয়কের বুকের মাঝে লুকিয়ে নিলাম। যেন মানুষটাও আমায় দেখতে না পারে। মামুষটা তার ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণ পরশ আঁকে আমার ললাটে। দিশেহারা হই আমি। আরো বেশি করে গুটিয়ে নিই নিজেকে।
সূর্যের সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠে প্রকৃতি। শীতের আগমনী বার্তাকে টেক্কা দিয়ে রবি নিজের উত্তাপে ধরনিতে ছড়িয়ে দিতে থাকে উষ্ণতা। পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয় চারপাশ। কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটে চলে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে। আর আমাদের সারাবাড়িতে ছোটাছুটি করে চলেছে আমাদের ছোট বার্ডটা। আমার কাছে সে পাখির মত চঞ্চল হলেও প্রিয়কের কাছে সে ফুলের মতো স্নিগ্ধ আর পবিত্র। মানুষটার প্রান আমাদের পুনম। ওকে স্কুলের জন্য রেডি করতে প্রতিদিন সকালে আমাকে ওর পিছনে ছুটতে হয়। এক মিনিটও স্থির হয় না। প্রায় ১ঘন্টা ওর পিছনে ব্যয় করার পর রেডি করাতে পারি। ওকে রেডি করিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নিই। আগের মতোই প্রিয়কই আমাদেরকে ড্রপ করে দিবে। মামনির থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা দেই। প্রথমে পুনমকে স্কুলে দিয়ে তারপর আমাকে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের সামনে এসে আমাকে নামিয়ে দেয়। সেই সাথে প্রিয়ক ও নেমে আসে। ক্যাম্পাসের বাইরেই অপেক্ষা করছে হাসি, মুনিয়া, তন্নি আর রিয়ন। সেদিকে এগিয়ে যায় আমরা দুজন। প্রিয়ককে দেখে হাসি ফুটে উঠল সবার মুখে। বিভিন্ন কথা বার্তায় পার হয় বেশ কিছু সময়। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রিয়ক চলে যায়। আর আমরাও ক্লাসে চলে যায়। ক্লাস শেষ করে বাহিরে আসতেই দেখলাম আবির গেইটের বাইরে পায়চারি করছে। আমাদের দেখে এগিয়ে আসে। এসেই বলল,
“এসব কি প্রিয়তা। তোমাদের না ডিভোর্স হওয়ার কথা। তাহলে এখনো কেন ওই অমানুষটা তোমার সাথে?”
আবিরের কথা শেষ হতেই খুব জোরে থাপ্পড় মারলাম ওকে। যথাসম্ভব নিজের রাগ চেপে বললাম,
“অমামুষ প্রিয়ক নয়, অমানুষ তুমি।”
আমার কথা আর থাপ্পড়ে বিস্মিত হয়ে থাকিয়ে থাকে আবির। কিন্তু পরক্ষণেই চোখে মুখে ধরা দেয় রাগভাব। তবে তা খুব সাবধানে এড়িয়ে যায়। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া দেখে নেয়। যা দেখে হাসি পাই আমার। নিজের গালে হাত রেখে বলে,
“মাথা কি পুরোটাই গেছ তোমার। তুমি আমাকে মারছো। তোমার প্রিয়ককে মারা উচিত। তা না করে আমাকে! কি করেছি আমি? শুধু তো তোমাকে ভালোবেসেছি৷ আর তো কিছুনা। ”
আবিরের কথা শেষ হতেই আমি তাচ্ছিল্য স্বরে হেসে বললাম,
“ভালোবাসো? লজ্জা করে না এই কথাটা বলতে? তোমার মত ছেলেরা কখনই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। পারে শুধু মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করতে। আর তা ছাড়া তোমাদের কাছে তো মেয়েদের অনুভূতির কোনো মূল্যেই নেই। তোমরা তো মেয়েদের শরীরটা দেখো। নিজেদের কামনার সঙ্গী মনে করো৷ এছাড়া তো আর কিছু না। যেমনটা আমাকে করতে চেয়েছিলে৷”
“এসব কি বলছো প্রিয়তা৷ পাগল হয়ে গেছো তুমি? নিশ্চয় তোমার ওই ভাই তোমাকে আমার বিরুদ্ধে বলেছে তাই না। তুমি কি করে আমাকে এমন ভাবতে পারো?”
“কেন নিজের বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে অভিনয় করো নি? কলেজ প্রোগ্রামের দিন নিজের বন্ধুদের দিয়ে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে নিজেই তা থেকে বের করে এনে আমার সামনে ভালো সাজোনি? অস্বীকার করতে পারবে আমাকে নিজের কামনা.. ছিঃ আমার বলতেও বাঁধছে। ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। যে তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। নিজের একজন বন্ধু মনে করতাম। ভাবতাম তোমায় ভালোবাসি আমি। এসবের জন্য নিজেকেই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হয়। আর কত গুলে মেয়ের জীবন নষ্ট করবে তুমি? কম মেয়ের জীবন নিয়ে তো আর খেলো নি। আর কত?”
আমার কথা শেষ হতেই আবির আবার ও নিজের সাফাই দিয়ে বলতে লাগল,
“দেখো প্রিয়, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। যা ভাবছো তার কোনোটাই সত্যি না। আমি এরকম কিছু করিনি। বিশ্বাস করো। আমি..
” হে আবির। এতদিন এত কষ্ট করে কী লাভ হলো বলতো। সেই তো পাখি অন্য খাঁচায় বন্দি হয়ে গেল৷ তোর তো কোনো পাত্তাই রইলো না।’
কেউ একজন বলে উঠল। তার কথার প্রতিত্তোরে অন্য একজন বলল,
‘আসলেই আবির। এবারের বাজিটা বোধহয় হারতে চলেছিস তুই।’
বলেই হেঁসে উঠল সবাই।
‘ তাহলে তোরা এখনও আবিরকে চিনলিই না। আবির কখনও কোনো বাজিতে হারেনি। আর আগেও হারবে না। প্রিয়তাকে তো আমার বেডে আনবোই৷ আজ হোক বা কাল। ওকে আসতেই হবে।’
আবিবের কথা শেষ হতেই অন্য কারো কন্ঠে শোনা গেল,
‘আর কি করে আনবি বলতো? বিয়ে তো হয়ে গেল ওর। ‘
‘তাতে কি হয়েছে? আমি প্রিয়তার সামনে নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছি যে ও ভাবছে আমি ওকে এতটাই ভালোবাসি, ওর জন্য নিজের জীবন দিতেও রাজি৷ প্রিয়তা বড্ড ইমোশনাল বুঝলি। একটুতেই দূর্বল হয়ে পড়ে। ‘
‘দেখা যাক। তবে এবার কিন্তু আমাদেরও ভাগ দিতে হবে। একা একা খেলে চলবে না কিন্তু। ‘
‘সে আর বলতে। বেচারী। ধর্ষিতা না হয়েও তার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। এবার তা সত্যি সত্যিই হবে।’
শোনা গেল উচ্চস্বরে কিছু নোংরা হাসির আওয়াজ। ”
একটা ভয়েস রেকর্ড ছিল এটা৷ যা শোনার পর আর কিছু বলার থাকলো না আবিরের। তার কথা সেখানেই আটকে গেল। তবে বের হয়ে এলো তার আসল রুপ। যা সবসময় লুকিয়ে রেখেছিল আমার থেকে।
“ও তাহলে সব জেনে গেছিস৷ ভালোই হলো৷ আর নাটক করতে হবে না। আমিও বোর হয়ে গেছি এক নাটক করে করে৷ হ্যাঁ সবটাই আমিই করেছি। এরকম বাজি প্রায় প্রায় ধরি আমরা। তোকে নিয়েও বাজি ধরে ওরা। তাই প্রোগ্রামের দিন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমার বন্ধুদেরই বলেছিলাম তোর উপর আক্রমণ করতে৷ যাতে তোকে সেখান থেকে সেইফ করে তোর কাছাকাছি আসতে পারি৷ আর হলো ও তাই। তুই আমার কাছে শুধু মাত্র আমার বেড পার্টনার হওয়ার যোগ্য। আমার ভালোবাসার নয়৷ ”
আবিরের কথা শেষ হতেই আমি আবিরের গালে আরো একটা থাপ্পড় মারলাম। এবার আবির আমাকে মারতে নিলেই চোখ বুঁজে নিই। কিন্তু কিছুকাল পার হওয়ার পর ও কোনোরুপ আঘাত না পাওয়ায় চোখ মেলে তাকাই। প্রথমেই চোখ যায় প্রিয়কের উপর। আমার দিকে উঠানো আবিরের হাত শক্ত করে ধরে আছে মানুষটা। হাতে মোচড় দিতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠে আবির। প্রিয়ক বলল,
“জন্ম থেকেই প্রতিটা বিপদে ওর ঢাল হয়ে থেকেছি আমি। কোনো আঘাত ওর শরীরকে স্পর্শ করতে দেই নি। ওকে কেউ সামান্য আঘাত করলে তার অবস্থা এমন করেছি যে দ্বিতীয়বার ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয়নি। আর সেখানে তুই আমার প্রিয়তার এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছিলি। সেটা জেনেও চুপ ছিলাম শুধু মাত্র সঠিক সময়ের জন্য। আর আজ তুই ওকে আঘাত করতে নিয়েছিলি। ”
বলে আরো শক্ত করে মোচড় দেয়। আবিবের চোখমুখ তখন দেখার মতো ছিল। আমি প্রিয়ককে ছাড়িয়ে নিই। প্রিয়ক ওর হাত ছেড়ে বলল,
“এর পর যদি প্রিয়তার আশেপাশেও তোকে দেখেছি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আর প্রিয়তার ক্ষতি করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে যাইস না। তাহলে সেখানেই মরবি। মনে রাখিস যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন প্রিয়তার গায়ে কোনো রকম আঘাত আমি লাগতে দিবো না।”
প্রিয়কের কথা শেষ হতেই আমার হাত ধরে নিয়ে আসে। বাকিদের বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসি আমরা। গাড়ি চলতে শুরু করলে চোখ বুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিই। আবিরের ব্যাপারে এসব কথা প্রিয়ক আমাকে জানিয়েছিল বাইরে যাওয়ার আগে। সেদিন নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। আবিরের কথা জানার পর প্রিয়ক আবিরের সম্পর্কে সব খোজখবর নেয়৷ যখন এই সত্যিটা জেনেছিল তখন প্রিয়কের মাঝে ঠিক কী চলছিল তা বুঝতে বাকি থাকে না। আবির এরআগেও অনেকগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও জড়িত আছে অনেক খারাপ কাজে। ফলে প্রিয়কের এখানে না থাকার সময়ে যদি আবির জানতো আমি ওর ব্যাপারে সব জানি। তাহলে আমার ক্ষতি করতে পারতো। আর ভাবতে পারছি না। এতটা নিখুঁত অভিনয় মানুষ কিভাবে করে? প্রিয়ক হয়তো আমার অবস্থা বুঝেছিল। একহাতে আমাকে তার বুকের মাঝে নিয়ে নেয়। শক্ত করে জরিয়ে রাখে।
চলবে..??