#কনফিউশন,২১,২২,২৩
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২১
.
.
খন্দকার বাড়ির সবাই আজ বেশ খুশি কারণ কাব্য আজ অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে। তাদের যৌথ পরিবারের সবাই একসাথে বসে খায়। একমাত্র এই ছেলেটা থাকেনা। আজ অনেকদিন পর সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খাবে তারই আয়োজন চলছিলো। সবাই টেবিলে চলে এলেও কাব্য এলোনা বলে আফতাব খন্দকার নিজেই গেলেন ছেলেকে ডাকতে। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখেন কাব্য সেখানে নেই। শাহনাজের কাছ থেকে শুনেছেন সকালে কাব্য এসেছে, সে ঘুমুচ্ছে। এরমধ্যেই আবার কোথায় গেলো? স্ত্রীকে ডাকতে ডাকতে কাব্যর ঘর থেকে বের হলেন তিনি,
“শাহনাজ কোথায় তোমার ছেলে? ঘরে তো নেই।”
শাহনাজ বেগমের বুক কেঁপে উঠলো। তনিকার কথায় কাব্য কি রাগ করে চলে গেলো? তিনি বললেন,
“দাঁড়াও ফোন করে দেখি কোথায় গেলো!”
কাব্যর বাস তখন কুমিল্লা পার করছে। তখনই মায়ের ফোন এলো। সে ফোন ধরে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো,
“বলো মা।”
“তুই কোথায়?”
“কুমিল্লা।”
“ওমা কুমিল্লা কী করিস?”
“ঢাকা যাই।”
“কাব্য! এটুকুর জন্য তুই আমার সাথে রাগ করে চলে গেলি? তোকে শাসন করার অধিকার কি আমার নেই?”
“তুমি শাসন করোনি মা। আর শাসন করার অধিকার তোমার অবশ্যই আছে।”
“এভাবে চলে গেলি একবার ভাবলি না তোর বাবাকে আমি কি বলবো? তুই এসেছিস বলে বাড়ির সবাই আজ কতো খুশি ছিলো!”
“আমি খুশি ছিলাম সকালে।”
“ফিরে আয় বাবা, দুটো দিন থেকে যা। আমি তোর বাবাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করি আপাতত।”
“কেন? আমি চলে আসায় বাবা রাগ করলে আমার উপর করবে তোমার তাতে কী?”
“উফ কাব্য তুই সবার খুশি নষ্ট করছিস।”
“বাবা কল দিচ্ছে কথা বলি। তুমি রাখো।”
মায়ের কল কেটে বাবার কল ধরতেই আফতাব খন্দকার বললেন,
“কী ব্যাপার কাব্য? শুনলাম তুমি বাড়ি এসেছো। তা কোথায় তুমি? খেতে বসবো অপেক্ষা করছি।”
“সরি বাবা আমি ঢাকা যাচ্ছি।”
“এতোদিন পর এলে দেখা না করেই চলে যেতে হলো কেন?”
“আমার বস এক্সিডেন্ট করেছে। খবর পেয়ে হঠাৎ চলে যেতে হচ্ছে। আমি কিছুদিনের মধ্যে আবার আসবো বাবা। সরি ফর টুডে।”
“ঠিকাছে।”
বাবার ফোন কেটে কাব্য আবার চোখ বন্ধ করলো। তার কপালের দুপাশের রগগুলো লাফাচ্ছে। ভেঙে ফেলতে মন চাইছে সবকিছু!
“আমরা হানিমুনে যাবো না?”
যাদিদ টিভি দেখছিলো। তিরার এ কথায় টিভি থেকে চোখ সরিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হানিমুনে যাবো কীভাবে আমার ছুটি শেষের পথে।”
“এখনো তো শেষ হয়নি। চলোনা দুদিনের জন্য কোথাও যাই।”
“না তিরা আর মাত্র দুদিনই ছুটি আছে। তিনদিনের দিন আমি চলে যাবো। শেষ দুদিন আমি আমার ফ্যামিলির সাথে কাটাবো।”
“তার মানে আমাদের হানিমুন হবেনা?”
“হবে। এরপরের ছুটিতে যখন আসবো তখন হানিমুনে যাবো।”
তিরার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। তবে সে আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। শুয়ে পড়লো।
আরশি শুয়ে ছিলো। সে ইদানীং খুব দুর্বল অনুভব করে। গায়ে একফোঁটা শক্তি পায়না। সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। উঠে খেতে চায়না, গোসল করতে চায়না, ঘুমায় না৷ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আরশির যখন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা মনে পড়ে বা কেউ মনে করিয়ে দেয় তখন সে এমন হয়ে যায়। এই সময়গুলো রশ্নি একটু বেশি সময় দিতো আরশিকে, বেশি যত্ন করতো। কিন্তু এবার ছোটো বাচ্চা থাকায় অতটা পারছে না। সাহিল অফিস থেকে ফিরলে রশ্নি বললো,
“সাহিল বাবুকে একটু রাখবে আরশি সারাদিন কিছু খায়নি। বাবু যখন ঘুমিয়েছে তখন রান্নাবান্না করেছি। এরপর থেকে সে এতো জ্বালিয়েছে যে আমি আরশিকে খাওয়াবো সেই সুযোগটুকুও পাইনি।”
সাহিল বললো,
“আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে এসে বাবুকে রাখছি। কিন্তু তুমি একটু চাচীকে ডেকে নিতে।”
“আরশিকে এভাবে দেখলে চাচী বিরক্ত হয় সাহিল। নানান কথা বলে, ভালো লাগে না আমার ওসব। মাকে বলেছি কিছুদিন এখানে এসে থাকতে। মা কাল আসবে বলেছে।”
সাহিল রশ্নির পাশে বসে তার একটা হাত ধরে বললো,
“রশ্নি আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমাদের বিয়ের ৮ বছরেও আরশি ছোট বলে কখনো মা হতে চাওনি।”
“ধ্যাত আমি তো নিজেই ছোটো ছিলাম। একসাথে দুটো বাচ্চা কীভাবে সামলাবো তাই মা হতে চাইনি।”
“একই তো হলো! এখনো পর্যন্ত আরশিকে তার রক্তের সম্পর্কের আপনজনদের থেকেও তুমি বেশি বোঝো বেশি যত্ন নাও, কীভাবে পারো? গত ৮ বছরে সবাই ওর উপর বিরক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তোমার এতো ধৈর্য আসে কোথা থেকে?”
“আরশি আমার কাছে শুধু আমার ননদ নয় সাহিল। ও আমার মেয়ের মতো। ও আমাকে কতোটা ভালোবাসে কতোটা ভরসা করে তুমি জানোনা।”
“হয়তো জানিনা সত্যিই জানিনা তাই খুব অবাক লাগে।”
রশ্নি প্লেটে ভাত নিয়ে আরশির ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালো। লাইট জ্বলে উঠতেই আরশি উঠে বসলো। ভাতের প্লেট দেখে বললো,
“খেতে ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
“ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। নাহলে তুই অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি একা দুটো মেয়েকে সামলবো কী করে? নে হা কর।”
আরশি অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে শুরু করলো। খাওয়াদাওয়া, বেঁচে থেকে জীবনটাকে সামনের দিকে টেনে নেয়া এসব এতো কঠিন হয়ে পড়ে কেন মাঝেমাঝে? ভাত মাখতে মাখতে রশ্নির হঠাৎ সেই ছেলেটার কথা মনে পড়লো আরশি প্রায়ই যার কথা বলতো। তার কথা বলে যদি আরশিকে একটু হলেও সবকিছু থেকে দূরে রাখা যায় সে ভাবনা থেকেই রশ্নি বললো,
“আচ্ছা আমি আসার পর ওই ছেলেটার কথা তো আর একদিনও বললি না?”
আরশির হঠাৎ কাব্যর কথা মনে পড়লো। কী অদ্ভুত! একয়দিন কাব্যর কথা একদম মনে পড়েনি। কিন্তু কাব্যও তো কোনো মেসেজ বা ফোন দিলো না! সেই যে বাড়ি গেলো আর কোনো খোঁজ নেই! রশ্নি আবার বললো,
“কীরে কিছু বল।”
“মনে ছিলো না ভাবী।”
“কী মনে ছিলো না?”
“তার কথা।”
“তোদের নিয়মিত কথা হয় না?”
“না তো।”
“ছেলেটার সাথে পরিচয় হলো কোথায়?”
“পরে সব বলবো ভাবী যদি সত্যিই কিছু হয়। আমার কেন যেন মনে হয় কিছু হবে না।”
চলবে…
#কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২২
.
.
.
আরশি একটা লাল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলগুলো খোলা। কোনো
এক বনের ভেতর সে কাব্যর হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। আরশি
কি হাসছে নাকি বিষন্ন সেটা বোঝার জন্য কাব্য আরশির
দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু বুঝতে পারছে না কারণ আরশির
চুলগুলো তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মুখটা দেখার জন্য একটু
এগিয়ে যেতেই হঠাৎ সে একটা বিশাল গর্তে পড়ে গেলো।
আরশি কাব্যকে ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার দিলো। ঠিক
সেই মূহুর্তেই কাব্যর ঘুমটা ভেঙে গেলো। লাফিয়ে উঠে বসলো।
ঘাম হচ্ছে হঠাৎ! এ কী আজব স্বপ্ন দেখলো সে? এই স্বপ্নের অর্থ
কী?
অদ্ভুত এক ঘ্যার ঘ্যার শব্দে তিরার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রথমে ভয়
পেয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে সে আবিস্কার করলো তার
সেরা ক্রাশ বিকট শব্দে নাক ডাকছে। তিরা যাদিদের বুকে
হাত বুলিয়ে দিলো। সাথে সাথেই তার নাক ডাকা বন্ধ হয়ে
গেলো। তিরা আপনমনেই হেসে ফেললো। পরক্ষণেই আবার মনটা
খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে কাল থেকে ঘুম ভাঙলে এই
মানুষটাকে আর পাশে দেখতে পাবে না। কীভাবে কেটে গেলো
বিবাহিত জীবনের পাঁচটা দিন! এই পাঁচ দিন সময় এতো দ্রুত কেন
অতিবাহিত হলো?
স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে আর ঘুমোতে পারলো না কাব্য। প্রচন্ড
অস্বস্তি হচ্ছে তার, সাথে মাথাব্যথা। আরশি শাড়ি পরতে
পছন্দ করে না, পছন্দ করেনা কোনো রঙও। যদিও তার নিজের
শাড়ি খুব পছন্দ তবুও যেহেতু আরশির অপছন্দের কথা সে জানে,
তার মস্তিষ্কের কখনোই আরশিকে শাড়িতে কল্পনা করার কথা
নয়। সচরাচর আমরা যা ভাবি তাই নিয়েই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু
আমাদের ভাবনার বাইরের বিষয় নিয়ে যখন স্বপ্ন দেখি তার
একটা বিশেষ অর্থ থাকে। এই অর্থটা হয় কোনো বিশেষ ঘটনার
আগমনী ইঙ্গিত। কাব্য এটা বিশ্বাস করে কারণ একাধিক বার
সে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে।
সিগারেট ধরালো কাব্য। আপাতত সে এই স্বপ্নের অর্থ খোঁজার
চেষ্টা করছে। প্রথমে তারা বনের ভেতর হাত ধরে হাঁটছিলো,
এই দৃশ্য বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় তারা একই পথে হাঁটছে এটার
অর্থ হতে পারে আরশি এবং সে দুজনেই দুজনার প্রতি আগ্রহী।
স্বপ্নে সে আরশির মুখটা দেখতে চাচ্ছিলো সে কিন্তু চুলের
জন্য দেখতে পারছিলো না। এই দৃশ্যের অর্থ হতে পারে
আরশিকে এবং আরশির বিষন্নতার কারণ জানার তার প্রবল
আগ্রহ অথচ আরশি নিজের চারপাশে এমন এক দেয়াল তৈরি করে
নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে যার জন্য সে জানতে পারছে না।
স্বপ্নে সে নিজে আরশির চুল সরিয়ে দেখতে পারতো, কিন্তু
দেখেনি ঠিক যেমন বাস্তবে সে কখনোই আরশিকে জানার জন্য
নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করেনা।
আরশিকে দেখতে গিয়েই সে গর্তে পড়ে গেলো। গহীন জঙ্গলে
আরশি একা হয়ে পড়লো। এই দৃশ্যের অর্থ হতে পারে আরশিকে
জানতে গিয়ে তার নিজের সাথে বড়ো কোনো দূর্ঘটনা ঘটবে,
অন্যদিকে একই দূর্ঘটনায় আরশি গহীন জঙ্গলে একা হয়ে
যাওয়ার মতোই কোনো বিপদে পড়বে।
এইটুকু আপাতত ক্লিয়ার কিন্তু আরশির পরনের লাল শাড়ির
কোনো অর্থ এখনো খুঁজে পাচ্ছেনা কাব্য।
আসন্ন দূর্ঘটনা থেকে কাব্য যদি নিজেকে এবং আরশিকে
বাঁচাতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে আরশির চিন্তা মাথা থেকে
নামিয়ে ফেলতে হবে। অনেক দূরে থাকতে হবে তার থেকে।
কিন্তু ঢাকা ফিরে আসার পর গত চার-পাঁচ দিনে তার মস্তিষ্ক
এতোটাই উত্তপ্ত ছিলো যে আরশিকে নিয়ে ভাবার সু্যোগ
পায়নি সে। এ কদিনে সে একবারও আরশিকে দেখেনি কোথাও।
এমনকি একটা মেসেজ বিনিময়ও হয়নি। আগের থেকে দূরত্ব
বেড়েছে। তাহলে হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার কারণ কী?
মাথাব্যথায় মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে।
চলবে…..
#কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৩
. . . . . . . . . . . . . . .
যাদিদ চলে যাওয়ার সময় তিরা অদ্ভুত এক কান্ড করলো। সে সবার সামনে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো। ওদিকে এই ঘটনায় যাদিদ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। তিরার বয়স কম ঠিকাছে তাই বলে এমন অবুঝপণা করার মতো কম বয়স তো না। সে ডিফেন্সে চাকরি করে তাকে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হবে এমনটাই স্বাভাবিক। এসব জেনেই তিরা তাকে বিয়ে করেছে। তাহলে এখন কেন এসব অবুঝপণা? অন্যদিকে তিরার জন্য তার মায়াও হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই মেয়েটার আশেপাশেই থাকুক সারাক্ষণ! কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব না সেহেতু যাদিদ বাস্তবকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। তিরারও উচিৎ বাস্তবকে স্বীকার করে নেয়া।
আরশির ফোনটা বাজছে, তিরা ফোন করেছে। গতকাল থেকেই কিছুক্ষণ পরপর ফোন করছে কিন্তু আরশির এখন কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। তাই ফোন ধরছে না। কড়কড়ে দুপুরেও আরশি জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে রেখেছে। গত ৭ দিন ধরেই চলছে আরশির এই অন্ধকারবাস। সন্ধ্যা হলেও আরশি ঘরে আলো জ্বালায় না। এর মধ্যেই রশ্নি ঘরে ঢুকে বললো,
“আরশি ঘুমাচ্ছিস?”
আরশি তাকালো না, নড়লো না। যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবে থেকেই বললো,
“না ভাবী এসো।”
“তিরা ফোন করেছিলো আমাকে বলল তোকে নাকি অনেকবার ফোন করেছে? আমাকে বললো খুব নাকি জরুরি কথা আছে তোর সাথে!”
“কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
রশ্নি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ঠিকাছে তাহলে বলতে হবে না। আজকে আমার সাথে বের হবি একটু?”
“না, ভাল্লাগছে না।”
“বের হলে ভালো লাগতো, এভাবে বন্ধ ঘরে থাকলে কোনো চেঞ্জ আসবে না। এর আগেও তো প্রমাণ পেয়েছিস। তারচেয়ে চল কোথাও ঘুরে আসি।”
“ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
*নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”*
রশ্নি জানে আরশি নিজ থেকে এ অবস্থা থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে বের করতে পারবে না। তবুও চেষ্টা না করলে তো মনে শান্তি মেলে না!
“আচ্ছা রেস্ট নে, কিছু লাগলে আমাকে বলিস।”
রশ্নি চলে যাচ্ছিলো। আরশি ডেকে বললো,
“ভাবী শোনো..”
রশ্নি দাঁড়ালো। আরশি বললো,
“বাবুর ডাক নাম রেখেছি আমরিন, আমার নামের সাথে মিলিয়ে। ভালো নাম তোমরা রাখো।”
রশ্নি খুশি হয়ে বললো,
“বাহ খুব সুন্দর নাম তো! আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে।”
“আমরিনকে আমার কাছে দিয়ে যাবে কিছুক্ষণের জন্য?”
রশ্নি একথায় যে কতটা স্বস্তি পেলো তা বোধহয় সে ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না। সে সাথে সাথে গিয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে এলো।
রশ্নি আমরিন কে আরশির কোলে দিয়ে রান্নার অযুহাতে সামনে থেকে সরে গেলো। উদ্দেশ্য আরশিকে কিছুটা সময় নিজের মতো করে ভালো থাকতে দেয়া। কিন্তু রশ্নি অবাক হয়ে দেখলো আরশি আমরিনকে কোলে নিয়েই পর্দা সরিয়ে জনালা খুলে ঘর আলো করে দিলো। তারপর বিছানায় বসে চুপচাপ অনেকক্ষণ কোলে থাকা আমরিনের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলো। আরশির ভাবলেশহীন মুখ দেখে কারো বোঝার সাধ্য নেই সে আমরিনের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে বা আদৌ কিছু ভাবছে কিনা!
রাতেরবেলা আরশি তিরার ফোন ধরলো। তিরা জানে আরশি কেন ফোন ধরেনি। এমন পরিস্থিতিতে আরশি কারো সাথে কথা বলে না তাও সে জানে। আর এটাও জানে আরশির বর্তমান অবস্থার জন্য তার মা দায়ী। তাই ফোন কেন ধরেনি সেসব কথায় আর গেলো না। নিজের কথাই বললো।
“আরু প্লিজ হেল্প মি।”
তিরা কাঁদছিলো, কন্ঠ শুনেই বুঝলো আরশি। এবং প্রচন্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তা নাহয় করলাম কিন্তু তুই কাঁদছিস কেন?”
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। যাদিদকে ছাড়া এভাবে থাকতে পারবো না আমি। কী করবো আমি?”
“বুঝলাম না।”
“যাদিদ গত পরশু চলে গেছে। ওর ছুটি শেষ।”
“ছুটি শেষ বলেই তো এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলো, এটা তো তুই আগে থেকেই জানতি।”
“হ্যাঁ কিন্তু ও যাওয়ার পর এই দুটো রাত আমি একফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। দিনেও ঘুমাতে পারছি না।”
“কি বলছিস তোর তো কখনো ঘুমের সমস্যা ছিলো না!”
“ওকে ছাড়া আমি আর ঘুমাতে পারবো না।”
একথা বলে তিরা আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। আরশি অবাক হচ্ছে কারণ তিরা বড় হয়ে কখনো কিছুর জন্য কাঁদেনি। এতোগুলো ব্রেকাপ হয়েছে কখনো কোনো ছেলের জন্য দুদিনের বেশি আফসোস করেনি কান্না তো দূরের কথা আর আজ সে যাদিদের জন্য এভাবে কাঁদছে! আরশির তো এসব বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাই প্রথমে কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। পরে একটু ভেবে বললো,
“আচ্ছা শোন শান্ত হ, এতোদিন একসাথে ছিলি তো তাই খারাপ লাগছে, ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
“অভ্যাস হবেনা তার আগেই মরে যাবো। এভাবে একটানা না ঘুমালে মানুষ বাঁচেনা, জানিস আমার প্রেশার লো হয়ে কি অবস্থা হয়েছিলো গতকাল? আমি আর ঘুমাতে পারবো না বোন।”
“পারবি, আমি যখন ঘুমাতে পারি তখন তুইও পারবি। শুধু সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে!”
আরশির একথায় আচমকা তিরার কান্না থেমে গেলো। নিজেকে হঠাৎ ভাগ্যবতী মনে হলো কারণ ওর অবস্থা আরশির মতো নয়। সত্যিই তো আরশি ঘুমাতে পারলে তারও পারার কথা। তার মানে সত্যিই শুধু সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে! তিরা বললো,
“তুই ঠিকই বলেছিস। আমি জানতাম তোর কাছে কোনো না কোনো সমাধান থাকবেই। এজন্যই কাল থেকে তোকে জ্বালাচ্ছিলাম।”
“কোনো ঘুমের ওষুধ খাস না আবার। তিন-চার মাইল দৌড়া বা কয়েশো দড়িলাফ দে। ক্লান্ত হলে এমনিতেই ঘুম আসবে।”
“আচ্ছা।”
ফোন রাখার পর আরশি এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো। যে তিরা কখনো কাঁদে না সে যাদিদের জন্য পাগলের মতো কাঁদছে, সেই মানুষটার শূন্যতায় সে ঘুমাতে পারছে না। তার মানে তিরা যাদিদকে ভালোবেসে ফেলেছে। সত্যিকারের ভালোবাসা! এতোদিন শুধু সে প্রেমই করেছে, কাউকে সত্যি সত্যি ভালোবাসেনি। আরশি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেছে, ভালোবাসা কি এমনই উন্মত্ত? একজনের অনুপস্থিতিতে আরেকজনের ভেতর এমনই শূন্যতার সৃষ্টি হয়? কই কাব্যর অনুপস্থিতিতে তার ভেতরে তো কোনো শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি! এমনকি সেদিন ভাবী জিজ্ঞেস করার আগ পর্যন্ত মনেও পড়েনি কাব্যর কথা। তার মানে কি সে কাব্যকে ভালোবাসে তার এ ধারণাটা ভুল? তাহলে সে কাব্যকে এতো গুরুত্ব কেন দেয়? কাব্য তাকে ভালোবাসে বলে? অনেকক্ষণ চিন্তা করলো আরশি, এই প্রথম তার কোনো সমীকরণ মিলছে না!
সমীকরণে আরো গোলমাল লেগে গেলো পরেরদিন। যখন তার নামে একটা পার্সেল এলো। পার্সেলটা খুলতেই সে একটা বই পেলো, অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’। বইটির প্রথম পাতায় লেখা, ‘এক গুণমুগ্ধ নারীর জন্য আরেক গুণমুগ্ধ নারীর এই বইটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা।’
হাতের লেখাটা চিনতে কষ্ট হলো না আরশির। ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইটির ভেতরের বুকমার্কের লেখাগুলো পড়েছিল যে!
‘এক গুণমুগ্ধ নারীর জন্য আরেক গুণমুগ্ধ নারীর এই বইটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা।’
লেখাটায় বারবার হাত বোলাচ্ছে আরশি। এই দুটি বাক্যের ভেতর যেন অনেক না বলা কথা, বলতে চাওয়ার ব্যাকুলতা! না আসলে দুটি লাইনে নয়, দুটি শব্দে.. গুণমুগ্ধ নারী! মুহুর্তেই তার ফর্সা গালে লাল আভা জমে গেলো। কী ভীষণ লজ্জা যে লাগছে! এই মানুষটার সামনে কি আর কখনো যেতে পারবে সে? মানুষটা কি কক্সবাজার থেকে ফিরেছে? ফিরলে সে কি এতোদিন খুঁজেছিলো ওকে? খুঁজলে একবারো ফোন করেনি কেন?
চলবে..