কনফিউশন,২৮,২৯

0
419

#কনফিউশন,২৮,২৯
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৮

তিরা অসময়ে যাদিদের ফোন পেয়ে চমকে উঠলো। যাদিদের জন্য সে আলাদা রিংটোন ব্যবহার করে। এই রিংটোন বাজলেই সে যেখানেই থাকুক পাগল হয়ে ছুটে আসে। ফোন ধরে অবাক হয়ে বললো,
“তুমি এ সময়ে?”
“একটা ভালো এবং একটা খারাপ খবর দিতে ফোন করলাম। যদিও দুটো রিলেটেড।”
“খারাপটা আগে বলো।”
“আমাকে সাবমেরিনে পোস্টিং দিয়েছে।”
“সাবমেরিন না পানির নিচে থাকে?”
“হ্যাঁ, আমার একটু খোলা হাওয়া খাওয়া আর আকাশ দেখাও বন্ধ হয়ে গেলো।”
“কীভাবে থাকবে তুমি?”
“সবাই যেভাবে থাকে!”
“পারবে?”
“শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়। আমরা দেশের জন্য সব পারি।”
তিরা মনে মনে বললো,
“আর বৌয়ের জন্য কিছুই পারোনা। বিয়ে কেন করো তোমরা?”
কিন্তু মুখে এ কথা বলার সাহস নেই। বললো,
“এবার ভালো খবরটা দাও।”
“আমার প্রোমোশন হয়েছে। আর সেজন্যই সাবমেরিনে পোস্টিং হয়েছে।”
তিরা বললো,
“এটা! আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আসবে একবার।”
“কীভাবে আসবো? আমাদের কোনো ঈদ নেই, বাবা মা মারা গেলে বা সন্তান জন্ম নিলেও আমরা মুখ দেখতে ছুটে আসতে পারিনা। বিয়ের আগে এই সবকিছুর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছিলাম, তাই না?”
“তখন বুঝতে পারিনি এতোটা খারাপ লাগবে তোমাকে ছাড়া।”
যাদিদ হেসে বললো,
“ঠিকাছে তোমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হলো, এখন থেকে তুমি নিজেকে প্রস্তুত করো।”
তিরার খুব কান্না পেলো। কিন্তু কাঁদলে যাদিদ রেগে যায় তাই তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিলো। আজ হঠাৎ তিরার মনে হলো যাদিদের উপর ক্রাশ খাওয়া এবং এই বিয়ে তার জীবনের অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।
আরশি ছাদ থেকে চলে যাওয়ার আরো কিছুক্ষণ পর কাব্য নিচে গেলো। তার দেবে যাওয়া সোফাটায় অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে রইলো। কোনো বই পড়লো না, একটা সিগারেটও খেলো না। একা একা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলো শুধু। কাব্য কথাগুলো সামনাসামনি বলেছে যাতে আরশির অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারে যে সে ব্যাপারটা কীভাবে নিয়েছে। কিন্তু কথাগুলো শোনার সময় সে এতোটাই স্বাভাবিক ছিলো যে কারো বোঝার উপায় নেই তার মনের মধ্যে কী চলছিলো! শুধু একটা জিনিসই কাব্যর চোখে পড়েছে তা হলো লিভ টুগেদারের কথায় আরশি চমকে গিয়েছিলো তবে খুব সামান্য সময়ের জন্য। এটুকুতে কিছুই বোঝা যায় না। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। তবে সব কথা বলতে পেরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাগছে। এবার আরশি ওর জীবনে থাকুক বা দূরে সরে যাক, যেটা হবে সেটাকেই নিজের নিয়তি ভেবে নেবে কাব্য।
আরশি ছাদ থেকে ফিরতেই রশ্নি জিজ্ঞেস করলো,
“বাগানে গিয়েছিলি?”
“না ছাদে।”
“আজ কি সুন্দর জোৎস্না নারে?”
“হুম।”
“আমরিন ঘুমুচ্ছে, এই ফাঁকে নাস্তা বানিয়ে দেই। বল কী খাবি?”
“কিছু খাবো না।”
“শুধু চা খাবি?”
“চাও খাবো না।”
অবাক হলো রশ্নি,
“কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
এ কথা বলে আরশি নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো। রশ্নি বললো,
“কী হয়েছে?”
“কিছু না ভাবি। হঠাৎ ভাল্লাগছে না। আমার কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন।”
রশ্নি জানে বলার মতো কিছু হলে আরশি একবার জিজ্ঞেস করতেই তাকে বলে আর না বলার মতো কিছু হলে একশোবার জিজ্ঞেস করলেও বলে না। তাই আর জিজ্ঞেস করলো না। কাছে গিয়ে আরশিকে বুকে টেনে নিলো রশ্নি। আর সঙ্গে সঙ্গেই টের পেল আরশির শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে যা এতোক্ষণ ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছিলো না।! রশ্নি দরজা লাগিয়ে বের হয়ে গেলেও ভাবতে লাগলো এতো অস্থির হওয়ার মতো কী এমন ঘটেছে?
রশ্নি বের হয়ে যাবার পর আরশি আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলো ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্টে এতোক্ষণ কাব্যর সামনে স্বাভাবিক হয়ে বসে কথা বলছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্থির লাগছিলো তার। শরীরে শক্তি নেই। ভালো-মন্দ সব অনুভূতিগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
কাব্যর আগে গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে এবং তার সাথে শারিরীক সম্পর্কও থাকতে পারে এমনটা আরশি একরকম ভেবেই নিয়েছিলো। কিন্তু ঠিক লিভ টুগেদারের মতো একটা ব্যাপার হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে সে এইসব নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ এটা একে তো কাব্য-তনিকার ব্যক্তিগত ব্যাপার তার উপর অতীত। বরং সে চিন্তিত কাব্যর কনফিউশন নিয়ে। কাব্য কি তার ব্যাপারেও কনফিউজড? নাকি তার ব্যাপারটা আলাদা? যেরকম মেয়ে কাব্যর ভালো লাগে বললো, সেতো ওইরকম না। তার ধারেকাছেও না। তাহলে কাব্যর তাকে কী করে ভালো লাগলো? শুধু ভালো লাগাই না, কাব্যর শেষ কথাগুলো প্রমাণ করে যে কাব্য তাকে ভালোবাসে। তাহলে?
আরেকটা ব্যাপার নিয়েও চিন্তিত আরশি। সেটা হচ্ছে কাব্যর অভিমান। কাছের মানুষ ভুল বুঝলে ভুল ভাঙায় না! কাব্য যে কিছু ব্যাপারে এতোটা চাপা স্বভাবের সেটা এতোদিন বুঝতে পারেনি আরশি। সে নিজে চাপা স্বভাবের, সঙ্গীও যদি অমনই জোটে তাহলে তো ঝামেলা। দুজন দুজনকে ভুল বুঝে বসে থাকবে! তারপর মেটাবে কে?
তবে সব দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে প্রচন্ড রকমের এক ভালো লাগাও কাজ করছে। এক্স গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে এমন কেলেঙ্কারির কথা হবু গার্লফ্রেন্ডকে বলার মতো সাহস সবার থাকে না। কথাগুলো কাব্য নিজে না বললে কখনোই জানতে পারতো না আরশি। সবচেয়ে বড় কথা সে তনিকার দোষগুলো সামনে আনেনি। নিজের দোষগুলোই বলেছে। কাব্যর প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে আরশির। জীবনটা অনেক বড় এবং অনেক জটিল। একটা ভালো প্রেমিকের চেয়ে একটা ভালো মানুষ জীবনসঙ্গী হিসেবে অনেক বেশি শ্রেয়!
এতোদিন আরশি-কাব্যর যে একটা প্রেমবিহীন সম্পর্ক চলছিলো তাতে আরশির একটা সূক্ষ্ণ অপেক্ষা ছিলো, কাব্য কবে তাকে প্রপোজ করবে সেই অপেক্ষা। কিন্তু আজ আরশি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে কাব্য যদি প্রপোজ করে তবে সে তাকে সময় নিতে বলবে। কাব্য সময় নিয়ে সব কনফিউশন দূর করে তবে সামনে আগাক। তবে কাব্য বুদ্ধিমান ছেলে, সে হুট করে প্রপোজ নাও করতে পারে। তাই সে যদি নিজ থেকেই সময় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাতেও আপত্তি নেই। আরশির কোনো তাড়া নেই।

চলবে…

#কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৯
.
সেদিনের পর আরশি ও কাব্যর মধ্যে দূরত্ব মোটেও বাড়েনি বরং দুজনের ভেতরকার দুরত্ব যেটুকু ছিলো তারও খানিকটা যেন কমে এসেছে। তবে কয়েকমাস পর আরশির পরীক্ষা শুরু হওয়ায় কথাবার্তা কমে এসেছে। আরশি সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমানোর আগে একবার কথা হয় শুধু৷ আজ আরশি পড়তে পড়তেই হঠাৎ কাব্যকে খুব মিস করতে লাগলো। কয়েকদিন হয়ে গেছে দেখা হয়নি, এখন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। পড়ায় আর মন বসাতে পারছে না। এক্ষুনি একবার দেখা করতেই হবে। কিন্তু রাত বাজে ন’টা। এখন কীভাবে দেখা করবে! এতো রাতে কী বলে বাইরে যাবে ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো কিছু বলেই যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ভাবী আমরিনকে ঘুম পাড়াচ্ছে, ভাইয়া তাদের ঘরে টিভি দেখছে। এখন কাউকে না বলেই চলে যাওয়া যাবে, ঘর লক করা দেখলে সবাই ভাববে সে ভেতরে বসে পড়ছে। রাতের খাবারের আগে কেউ ডাকবে না। কাব্যকে দেখে ফিরে আসা ১০ মিনিটের ব্যাপার মাত্র। কেউ টেরই পাবে না। আরশি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো এবং চোরের মত বেরিয়ে চলে গেলো নিচে।
কাব্য অফিস থেকে ফেরার সময় বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েছে। মাথা ধুয়ে কাপড় পাল্টে এক মগ চা নিয়ে বসেছে, কয়েক চুমুক খেতেই কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে আরশিকে দেখে কিছুটা চমকে গেলো কাব্য।
“আরে এতো রাতে তুমি?”
“ভেতরে আসতে বলো আগে, তারপর জিজ্ঞেস করো। কেউ দেখে ফেললে মিথ্যে বলতে হবে।”
কাব্য সরে দাঁড়াতেই আরশি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর চায়ের দিকে চোখ পড়তেই বললো,
“চা খাচ্ছো, আমাকেও দাওনা একটু।”
“একটু বসো আমি বানিয়ে আনছি।”
“আরে বানাতে হবেনা। একটা কাপ নিয়ে এসো, এখান থেকেই একটু নেই।”
“এটা আমার খাওয়া চা।”
“তাতে কী? বিষাক্ত হয়ে গেছে ওটা?”
কাব্য হেসে কাপ আনতে চলে গেলো। কাপ আনতেই আরশি মগ থেকে অর্ধেক চা ঢেলে নিলো। এরপর বললো,
“এতো রাতে এসেছি একটা বিশেষ কারণে।”
“কী কারণ?”
“পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। এখন ব্রেক দরকার, ভ্যারিয়েশন দরকার। তাই একটা গল্পের বই নিতে এসেছি।”
“পরীক্ষার মধ্যে গল্পের বই পড়বে?”
“হ্যাঁ ছোটো কোনো বই যা দুই তিন ঘন্টায় শেষ করে ফেলা সম্ভব। আগামী দুদিন আমার কোনো পরীক্ষা নেই।”
“ও আচ্ছা। ঠিকাছে নাও যেটা পছন্দ।”
“উহু তুমি সিলেক্ট করে দাও, ভাবছি তোমার হিমু পড়বো। কোনটা পড়া যায় বলো তো।”
“সিরিয়াসলি তুমি হিমু পড়বে? হিমু না তোমার সবচেয় অপছন্দের চরিত্র?”
“হ্যাঁ কিন্তু তুমি তো জোর দিয়ে বলেছিলে আমি নিশ্চয়ই হিমুর ভালো কোনো বই পড়িনি বলে হিমুকে ভালো লাগেনি। অথচ হিমু নাকি হুমায়ুন আহমেদ স্যারের অসাধারণ একটা চরিত্র। দাও দেখি ভালো লাগার মতো একটি বই।”
কাব্য হেসে বললো,
“দিতে পারি তবে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“যদি তোমার হিমুকে ভালো লাগে তাহলে তোমার হলুদ রঙের শাড়ি পরে আমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে। আর আমি পরব নীল পাঞ্জাবি। তুমি হবে মেয়ে হিমু, আমি হবো ছেলে রূপা। রাজী?”
“না, আমি শাড়ি পরিনা।”
কাব্য মৃদু হেসে তাকিয়ে রইলো। আরশি চোখ ফিরিয়ে নিলো।
কাব্য হাসতে হাসতে বুকসেল্ফের কাছে চলে গেলো। আরশি পেছন থেকে অপলক চোখে দেখছে কাব্যকে। ইদানীং আরশির প্রায়ই মনে হয় কাব্যর চেয়ে হ্যান্ডসাম এন্ড কিউট ছেলে পৃথিবীতে আর একটিও নেই। কাব্যর কত ছবি যে আরশির ফোনে সেভ করা আছে এবং প্রতিদিন কতবার তা দেখা হয় তা যদি কাব্য জানতো লজ্জায় মরে যেতো আরশি।
কাব্য একটি বই এনে আরশির সামনে রাখলো। বইটির নাম ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’। আরশি বইটি হাতে নিলো, উল্টেপাল্টে দেখে আবার চায়ে মনোযোগ দিলো। এখন আর কাব্যর দিকে তাকানো যাবে না। কারণ সে এখন হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই ছেলেটাকে লুকিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই। দেখা হলেই সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে, যেন এই পৃথিবীতে আর কিছু দেখার নেই তার।
চা শেষ হতেই আরশি বললো,
“আমি এখন আসি কাব্য। কাউকে কিছু না বলে এসেছি।”
আরশি দরজার কাছে যেতেই কাব্য বললো,
“এই বইটা ভুলে রেখে যাচ্ছো।”
“ভুলে না ইচ্ছে করেই রেখে যাচ্ছি কারণ হিমুকে ভাল লেগে গেলে শাড়ি পরতে পারবো না।”
কাব্য হেসে বললো,
“তোমার অস্বস্তি হয় এমন কোনো কিছুতেই আমি কখনো জোর করি আরশি? আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম।”
আরশি বইটা নিতে নিতে বললো,
“তোমার শাড়ি অনেক পছন্দ তাইনা?”
কাব্য বইটা আরশির হাতে দিতে দিতে বললো,
“হুম। বাদ দাও ওসব। আপাতত এই বইটা পড়ো। পরীক্ষা শেষে হিমুর আরো কিছু বই দেবো।”
“আচ্ছা, এখন আসি।”
আরশি চলে গেলো। কাব্য দরজায় দাঁড়িয়ে আরশির চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। এতো মুগ্ধতা কেন এই মেয়েটার ভেতরে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here