#কনফিউশন,৩২,৩৩
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩২
.
রশ্নি রান্না করছিলো। আরশি পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাবি আমাকে একটা হলুদ শাড়ি কিনে দেবে? সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ বানিয়ে দিতে হবে।”
শাড়ি আরশি নিজেও কিনতে পারে। কিন্তু রশ্নিকে বললে সে যে খুশিটা হবে সেটা মিস করতে চায় না আরশি। ননদের কথা শুনে রশ্নি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“তুই শাড়ি পরবি?”
“হুম।”
“সত্যি! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।”
আরশি হাসলো৷ রশ্নি বলল,
“আজ বিকেলেই যাব শাড়ি কিনতে।”
“আচ্ছা।”
রশ্নির যেন তর সইছিল না। দুপুরে খাওয়ার পরেই তৈরি হতে লাগলো। আরশি বলল,
“এত তাড়া নেই তো ভাবি।”
“অবশ্যই তাড়া আছে। ব্লাউজ বানাতে হবে না?আমার কতদিনের শখ তোকে শাড়ি পরা দেখব! যা যা তৈরি হয়ে নে।”
আরশি একটা বাদামী পাড়ের হলুদ শাড়ি কিনলো। তারপর ব্লাউজ বানাতে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে ননদ ভাবি দুজনে মিলে শাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ঠিক তখন রশ্নি বলল,
“আমি কিন্তু আজও জানলাম না ছেলেটা কে?”
আরশি বুঝেও না বোঝার ভান করল,
“কোন ছেলেটা?”
রশ্নি হেসে বলল,
“যার জন্য অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে।”
আরশি হেসে বলল,
“হবে কেউ একজন।”
“আমি জানতে পারি না?”
“জানাব। যেদিন সে তার ভালোবাসার কথা আমাকে বলবে সেদিন আমি তোমাদের সবাইকে জানাব। তার আগ পর্যন্ত সে নাহয় শুধু আমার ভেতরেই থাকুক।”
“ঠিকাছে তোর যখন ইচ্ছে হবে বলিস। আমি অপেক্ষায় থাকব।”
তিরা আরো একটা নির্ঘুম রাত পার করে সকালে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই ফোনটা এলো। কাব্য ফোন করেছে। তিরা ফোন ধরে বলল,
“একী! এ কে ফোন করেছে আমাকে?”
“তোমার আব্বাজান।”
তিরা হেসে বলল,
“তা আব্বাজান হঠাৎ মেয়েকে মনে পড়ল?”
“আমি সুইডেন চলে যাচ্ছি।”
“ওমা তুমি আবার বিদেশে যাবে কেন?’
“পিএইচডি করতে।”
“বাবা রে এত পড়াশোনা করে কী করবে?”
কাব্য হেসে বলল,
“নাথিং।”
“আমার তো গ্রাজুয়েশন টাও আর করতে ইচ্ছা করে না।”
কাব্য আবারো হেসে বলল,
“আচ্ছা শোনো যে কারণে ফোন দিয়েছিলাম সেটা বলি।”
“বলো।”
“যাওয়ার আগে একবার দেখা হলে ভালো হতো না? এসোনা একবার ঢাকা। তুমি আমি আরশি আবার একসাথে, বেশ মজা হবে।”
“আরশিও অবশ্য অনেকবার আমাকে বলেছিলো ঢাকা যাওয়ার জন্য।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো, দুজন মানুষের কথা তো আর ফেলে দেয়া যায় না। চলে এসো।”
“কবে যাবে তুমি?”
“এই মাস এবাড়িতে আছি। এরপর বাসা ছেড়ে কক্সবাজার চলে যাবো। নেক্সট মান্থের লাস্ট উইকে ফ্লাইট। শেষ কদিন তো বাড়িতেই থাকতে হবে।”
“আচ্ছা তার মানে আসলে এই মাসেই আসতে হবে।”
“হ্যাঁ।”
“আমার অবশ্য কোনো পিছুটান নেই। গেলেই যেতে পারি। আমার স্বামী সংসার এসব হচ্ছে নামকোবাস্তে!”
*নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”*
আরশি সকালে গাছে পানি দিতে দিতে কাব্যর জানালায় উঁকি দিলো। কাব্য বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আজ অফিস নেই নাকি! আরশি হাতে পানি নিয়ে কাব্যর মুখে ছিটিয়ে দিলো। কাব্য সাথে সাথে চোখ মেলে তাকালো। ঘুম চোখে আরশিকে জানালায় দেখে হাসলো। বলল,
“গুড মর্নিং।”
“গুড মর্নিং। এখনো ঘুমুচ্ছো যে অফিস নেই?”
“আজ ছুটি নিয়েছি, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।”
“সেকী! জ্বর নাকি?”
“নাহ।”
“এদিকে এসো দেখি।”
কাব্য উঠে হাই তুলতে তুলতে জানালার কাছে গেলো। যেহেতু বাসাটা একটু উঁচু, ওদিকে আরশি দাঁড়িয়ে আছে বাগানে নিচুতে তাই কাব্য হাটু গেড়ে বসলো। আরশি জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে কপালে হাত দিল। এরপর বললো,
“জ্বর নেই তো।”
“আমি জানি।”
“ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।”
“তোমার বাগানের কাজ শেষ?”
“নাহ। শেষ করে আসছি, বই নেব।”
“ওকে।”
কাব্য ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। চা বসিয়ে প্যানকেক বানানোর প্রস্তুতি নিলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আরশিকে দেখা যায়। সে এখন বিভিন্ন গাছের মাটি নিড়িয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো একটা খোঁপা করা কিন্তু সামনে কিছু চুল বেড়িয়ে এসে বারবার চোখের উপর পড়ছে। আরশি বারবার মাটিমাখা হাতের উল্টোপিঠের সাহায্যে চুলগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। কাব্য একটা শিষ দিতেই আরশি তাকালো। ইশারায় জানালার কাছে আসতে বলল। আরশি ওই অবস্থাতেই জানালার কাছে এসে বলল,
“কী?”
কাব্য জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে অবাধ্য চুলগুলোকে আরশির কানের পাশে ভালো করে গুঁজে দিল। আরশি আচমকা কেঁপে উঠলো, সুড়সুড়ি লাগলো কিন্তু কিছু বলল না। ভাললাগাটা খুব বেশিই ছিলো। কাব্য বলল,
“যাও কাজ শেষ করে এসো।”
আরশি কাজ করতে করতে ভাবছিলো কাব্য এতো খেয়াল করে কীভাবে? সারাক্ষণই কি তাকিয়ে থাকে তার দিকে?
আরশি কাজ শেষ করে সোজা কাব্যর রান্নাঘরে চলে এলো। কাব্য বলল,
“আচ্ছা এইযে তুমি হুটহাট আমার বাসার ভেতরে চলে আসো তোমার ভয় করে না?”
“তোমাকে কীসের ভয়?”
“ভয় আমাকে না, ধরো ভাবি যদি দেখে ফেলে?”
“দেখে ফেললে কিছুই হবে না, বলে দেব সব। আর আমার আসাতে যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে সরাসরি বলতে পারো। আর আসবো না।”
কাব্য শেষ প্যানকেকের গোলাটুকু হাতের সাহায্যে প্যানে ঢেলে দিলো। তারপর মাখা হাতটা আরশির গালে মুছে দিয়ে বলল,
“আসতেই হবে। সকাল বিকেল বারবার।”
আরশির মনে হলো এক্ষুণি তার দমবন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আবার দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
“এহহে এটা কী করলে?”
কাব্য কেকের গোলাগুলো আরশির গালে লেপ্টে দিতে দিতে বলল,
“স্পেশাল গালকেক!”
আরশি এবার হেসে ফেলল। কাব্য বলল,
“অবশ্য বেক হওয়ার জন্য গালটাকে গরম করতে হবে।”
আরশি কাব্যর হাতের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বলল,
“অসভ্য কোথাকার।”
কাব্য হেসে বলল,
“কেন আমি কি বলেছি আমি গরম করব?”
“উফফ।”
আরশি এবার প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। বেসিনের সামনে গিয়ে গালটা ধুতে ধুতে ভাবছিলো,
“কি দারুণ হতো যদি এই স্পেশাল গালকেকটা ধুয়ে না ফেলতে হতো? যদি সারাজীবন রেখে দেয়া যেতো!”
কাব্য দুজনের জন্য চা ও প্যানকেক ট্রেতে সাজিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। আরশি তখন বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে গাল মুছছে। কাব্য বলল,
“এসো আমার সাথে খাও একটু।”
আরশি পিরিচ দিয়ে চা ঢেকে রেখে একটা প্যানকেক তুলে নিল। কামড় দিয়ে বলল,
“তুমি প্যানকেক জিনিসটা এতো ভাল বানাও কী করে বলোতো?”
“কাব্য খেতে খেতে বলল,
“প্রাকটিস। আচ্ছা আজ কী বই নেবে?”
“হিমুর বই, তুমি বেছে দাও। নীলপদ্মর মতো ভাল বই দেবে। কি পিচ্চি পিচ্চি বই! একসাথে কয়েকটা দাও।”
“যোহুকুম।”
কাব্য খেতে খেতেই বইগুলো বের করল। আরশি কোনোমতে চা শেষ করেই বলল,
“আচ্ছা আমি উঠি। বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আরশি বইগুলো নিয়ে চলে গেল। কিন্তু কাব্য তখনো আরশির গালে কেকের গোলা লেপ্টে দেয়ার মুহুর্তটায় বুঁদ হয়ে রইলো!
চলবে…
#কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৩
.
অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় কাব্য তিরা ও আরশির অপেক্ষায় ছাদে বসে ছিলো। আরশি যাওয়ার আগে তিনজনের জন্য চা করে নিলো সাথে থানকুনি পাতার বড়া। যখন তারা বের হবে ঠিক তখন রশ্নি বলল,
“মানুষ দুজন চা তিনকাপ কেন?”
আরশি হেসে বলল,
“কালা চন্ডীদাস আছেনা?”
ভাবি আঁৎকে উঠে বলল,
“এই তিরা তোর কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে।”
“উফ ভাবি। তুমি কী ভাবো আমাকে? কাব্যর এক্স গার্লফ্রেন্ডের আমার বয়সী মেয়ে আছে জানো তুমি?”
রশ্নি অবাক হয়ে বলল,
“মানে! কি বলে মেয়ে!”
তিরা আর দাঁড়ালো না। বের হয়ে ছাদের দিকে গেলো। আরশি বলল,
“পুরো কাহিনী আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব।”
আরশি তিরা ছাদে যেতেই কাব্য তিরার দিকে চেয়ে বলল,
“সুস্বাগতম মামনি!”
তিরা হেসে বলল,
“ধব্যবাদ আব্বাজান।”
আরশি চা বড়ার ট্রে কাব্যর সামনে রাখতেই
“ওহ কি দারুন জিনিস নিয়ে এসেছে আমাদের ডাক্তারা আপা!”
আরশি কিছু বলল না। চুপচাপ বসলো। কাব্যকে বলতে হলোনা নিজেই বড়া নিয়ে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতেই কাব্য বলল,
“তিরা ফোনে কথা বলার সময় তোমার শেষ কথার টোনটা যেন কেমন কেমন শোনাচ্ছিল। ভাল নেই তুমি? ডিপ্রেসড?”
তিরা বড়া নিতে নিতে বলল,
“আর বলোনা। ভালোটা থাকব কীভাবে একা একা?”
“তো নেভি অফিসারকে বিয়ে করেছো, একা একাই তো থাকতে হবে। সেটা আগে বোঝোনি?”
“ওর জন্য যে এত খারাপ লাগবে সেটা আগে কীভাবে বুঝব বলো?”
“হাজবেন্ডের জন্য মেয়েদের খারাপ লাগবেই এটাই স্বাভাবিক।”
“হ্যাঁ কিন্তু এত ব্যস্ত থাকা, এত খারাপ ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক না। যাদিদ যে এরকম করবে তা তো বিয়ের আগে জানতাম না।”
“কেন তোমাদের কি অনেকদিন পর পর কথা হয়?”
“না প্রতিদিনই কথা হয়।”
“প্রতিদিন খারাপ ব্যবহার করে?”
“না। শোনো তোমাকে ভেঙে বলি। আমাদের প্রতিদিনই অনেকক্ষণ করে কথা হয়। বেশিরভাগ দিন সব স্বাভাবিক থাকে তখন আমাদের মধ্যে কোনো প্রব্লেম হয়না। হঠাৎ দু একদিন এক মিনিটের জন্য কল দেয়, দিয়েই বলে তোমার হাতে এক মিনিট আছে, যা বলার এর মধ্যে বলো। আবার কোনোদিন কথা না বলেই ঘুমিয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে যাই আমার সাথে কথা না বললে ওর ঘুম আসে কীভাবে? আমার তো আসেনা। আবার কোনোদিন ২৪ ঘন্টায় সে এক মিনিটও বের করতে পারেনা আমার সাথে কথা বলার জন্য। এটা খুব আজব না? এরকম কিছু হলে আমি রিয়াক্ট করি। আমি খুব বেশি রিয়াক্ট করে ফেললে সে মাঝেমাঝে খারাপ ব্যবহার করে, মাঝেমাঝে আবার ফোন বন্ধ করে রাখে। আর সবচেয়ে বেশি যেটা করে সেটা হচ্ছে.. আমি চেঁচাতে থাকি কিন্তু সে কিছুই বলেনা, সাইলেন্ট হয়ে যায়। ড্যাম কেয়ার। কিছুই যায় আসেনা তার। আসলে কাব্য আমি ওর সাথে কথা বলার জন্য যতটা উতলা থাকি সে ততটা থাকে না।”
“হয়তো থাকে কিন্তু বোঝায় না।”
“উতলা থাকলে আবার বোঝাবে না কেন?”
কাব্য চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“এটাই হয়তো তার ন্যাচার।”
“সে উতলা থাকে না কাব্য। মাঝেমাঝে একটু কথা বলেই সে ঘুমানোর পায়তারা শুরু করে। সে কখনো আমাকে মিস করে না। কখনো তার আমাকে দেখতেও ইচ্ছে করেনা।”
“তুমি কী করে জানলে?”
“ভিডিও কলে কথা বলার কথা সবসময় আমিই আগে বলি।”
“একজন আগে বললেই তো হলো। তাছাড়া, তুমি আগে বলে হয়তো তার বলার আর সুযোগ রাখোনা।”
এবার তিরা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। কাব্যর শেষ কথাটায় যুক্তি আছে। আরশি চা নিয়ে তিরাকে বলল,
“চা নে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তিরা চা নিল। তিরাকে চিন্তিত দেখে কাব্য আবার বলতে শুরু করল,
“দেখো তুমি নিজেই বলছো প্রতিদিন কথা হয়। মাঝেমাঝে কম হয়। প্রতিদিন কথা হয় মানে সব ঠিকই আছে। হঠাৎ দুয়েকদিন তার অসুবিধা তোমাকেও বুঝতে হবে। হয়তো ডিউটি বেশি পড়ে যায়, হয়তো টায়ার্ড থাকে। যাদিদ হয়তো একটু বদরাগী তাই খারাপ ব্যবহার করে। এছাড়া আমি ওর আর কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছি না।”
“তুমি ছেলে মানুষ তো, ছেলেদের দোষ কীভাবে দেখবে?”
কাব্য তিরার কথা শুনতে শুনতে চায়ে আরেক চুমুক দিয়ে নিল। এরপর হেসে বলল,
“ব্যাপারটা একদমই এমন নয়। আমি কারো পক্ষ নিচ্ছিনা। দেখো তিরা আমার মনে হয় ভালোবাসা কোনো নিয়মের মধ্যে রাখার জিনিস না। তুমি যতো নিয়মের মধ্যে আনতে যাবে সম্পর্ক খারাপ হবে। সম্পর্ককে ফ্রিডম দাও।”
“সম্পর্ককে আবার ফ্রিডম দেয় কীভাবে?”
“ধরো তুমি একটা সম্পর্ক একভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছো তোমার নিজস্ব স্ট্রাকচারে। তখন তুমি সবকিছুকেই সেই স্ট্রাকচারে আনার চেষ্টা করবে। তখনই গন্ডগোলটা বাঁধবে। তারচেয়ে সম্পর্ককে যদি নিজের গতিতে চলতে দাও, কিছু জিনিস তোমার মনমতো না হলেও সম্পর্ক ভালো থাকবে। সম্পর্ক ভালো থাকলে তোমরা ভালো থাকবে। ইউ ক্যান ট্রাই ইট। উপরওয়ালা কিছু আমাদের হাতে দেননি। যেটা আমাদের হাতে দেননি সেটার কন্ট্রোল আমাদের না নেয়াই শ্রেয়। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সর্বপ্লাবী ভালোবাসা সবসময় সুখ এনে দেয় না।”
আরশি মুগ্ধ হয়ে শুনছে কাব্যর কথাগুলো। তিরা কিছুটা অবাক হচ্ছে, সে এভাবে কখনোই ভেবে দেখেনি। কাব্য বলল,
“যাদিদের কি পড়াশোনা শেষ?”
“না এখনো পড়ছে।”
“বোঝো তাহলে এতকিছুর মধ্যে ছেলেটার পড়াশোনাও আছে। পড়াশোনা না করলে তো সে ভালো পজিশনে যেতেও পারবে না।”
তিরা চুপ। কাব্য বলল,
“তুমি কি কখনো যাদিদকে জিজ্ঞেস করেছ সে সারাদিন কখন কি করে? তার ডেইলি রুটিন টা কেমন?”
“না ডিটেইলসে তো কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“একবার জিজ্ঞেস করে দেখো তো। আশা করি তার উত্তর শোনার পর বুঝতে পারবে সে কীভাবে তোমার সাথে কথা বলার সময় বের করে। কিছু কিছু সময় নিজের দিকটা কম ভেবে ওপাশের মানুষের দিকটা বেশি ভাবতে হয়।”
“আচ্ছা কাব্য সবসময় স্যাক্রিফাইস শুধু মেয়েদেরকেই কেন করতে হবে? কেন মেয়েদেরকেই সবকিছু বুঝতে হবে? কেন ছেলেরা কিছু বুঝবে না?”
“তাই তোমার মনে হয় শুধু তুমিই স্যাকরিফাইস করো? যাদিদ করে না?”
“একফোঁটা স্যাকরিফাইস যদি করতো নিজেকে ধন্য মনে করতাম।”
“যাদিদের স্যাকরিফাইস গুলো আমি বলি?”
“যাদিদ কোনো স্যাকরিফাইস করেনা। আর যদি করেও থাকে যাদিদের স্যাকরিফাইস গুলো তুমি কি করে বলবে?”
“বলি তারপর মিলিয়ে দেখো।”
“বলো।”
“প্রথমত, ছেলেটা বিয়ে করে মাত্র ৫ দিন পর নতুন বউকে রেখে চলে গেছে। এটা অনেক বড় একটা পেইন। ধরো একজন মানুষ কোথাও চলে যাচ্ছে। যাকে বা যাদেরকে রেখে যাচ্ছে তারচেয়ে বেশি পেইন যে চলে যাচ্ছে তার। যাদেরকে রেখে যাচ্ছে তাদের কাছে একটা শূণ্যস্থান তৈরি হচ্ছে। আর যে চলে যাচ্ছে সে নিজেই শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। এটা তার একটা স্যাক্রিফাইস।
তিরা চুপ। তার কাপের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কাব্য চা শেষ করে কাপটা রেখে আবার বলল,
দ্বিতীয়ত, সে প্রতিদিন তার বউয়ের অভিযোগ শোনে। এরচেয়ে বড় স্যাক্রিফাইস আর কী হতে পারে বলো? আমি যতদূর জানি ডিফেন্স অফিসাররা বিয়ের পর প্রথমেই তার স্ত্রীকে ধৈর্য ধরতে শেখায়। তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবসময় স্বামীকে কাছে পাবেনা এটা বোঝায়। যাদিদ কি এরকম কিছু তোমাকে বোঝায়নি?”
“বিয়ের পরেও বলেছে, আগেও বলেছিল।”
“তাহলে তো যাদিদ আরো এডভান্স। বিয়ের আগেই তোমাকে সব ধারনা দিয়ে রেখেছিল। তবুও তুমি রিয়াক্ট করো। তুমি বললেনা মাঝেমাঝে তুমি চেঁচাতে থাকো আর সে চুপ থাকে, ড্যাম কেয়ার?”
“হ্যাঁ।”
“যখন সে খারাপ ব্যবহার করে, সেটা তার নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে রাগ দেখানো। টিট ফর ট্যাট। কিন্তু যখন সে ফোন বন্ধ করে রাখে বুঝে নেবে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা, পাছে রাগ দেখিয়ে ফেলে তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। গিভ সাম রেস্পেক্ট যে সে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায় না। আর যখন চুপ থাকবে বুঝে নেবে সে তার রাগ কন্ট্রোল করে রাখছে, ফোন বন্ধ করে তোমাকেও টেনশন দিচ্ছে না। সো প্লিজ গিভ হিম লাভ। এটা তার একটা স্যাক্রিফাইস। এই স্যাক্রিফাইস টা শুধুই তোমার জন্য। তোমার বয়স কম বোঝো কম সেজন্য। সে কিন্তু এইক্ষেত্রে নিজের দিকটা একটু কম ভেবে তোমার দিকটা বেশি ভাবছে।”
কাব্যর কথাগুলো শুনে তিরা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কতবার সে এই বিষয়ে যাদিদকে ভুল বুঝেছে। আরশি তিরার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“আরে পাগল কাঁদিস না।”
কাব্য হাতের ইশারায় আরশিকে থামিয়ে বলল,
“ওকে কাঁদতে দাও।”
আরশি থেমে গেল। কাব্য তিরার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“তৃতীয়ত, যাদিদ সদ্যবিবাহিত একজন শক্ত-সামর্থ্য পুরুষ। তার একটা ফিজিক্যাল নিড আছে। তার সেটাকেও কন্ট্রোল করে রাখতে হয়, এটাও তার একটা স্যাক্রিফাইস।”
তিরার কান্না আরো বেড়ে গেল। কাব্য বলল,
“চতুর্থত, ডিফেন্স অফিসাররা জব করেন না, তারা সার্ভিস করেন। তারা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, নিজের বাড়ি, ভালোবাসার সবকিছু ছেড়ে নিজের জীবন বাজি রেখে তারা চলে যায় দেশের জন্য সার্ভিস দিতে। এটা তাদের সবচেয়ে বড় স্যাক্রিফাইস যেটা মানুষের চোখেই পড়েনা, যেটাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু এটা তাদের জন্য অনেক কষ্টের। টাকাপয়সা তো যেকোনো জবেই পাওয়া যায়, ব্যবসা করেও কামানো যায়। তাহলে তারা ডিফেন্স সার্ভিস কেন করতে যায় ভেবে দেখেছো কখনো? আমি নেভিতে দুবার ট্রাই করেছি দুবারই ট্রেনিং এর সময় বাদ পড়েছি। কী পরিমাণ কঠিন ট্রেনিং করানো হয় ইউ কান্ট ইমাজিন। শুধু নেভি কেন প্রত্যেক ডিফেন্সেই প্রচন্ড কঠিন ট্রেনিং দেয়া হয়। ডিফেন্স অফিসারদেরকে দেখলে আমার ভেতর থেকে একটা আলাদা সম্মান আসে। মনে হয় এরা তো ওই ট্রেনিং উতরে যাওয়া মানে নিজের আবেগ, অনুভূতি, মরার ভয় সবকিছুকে হার মানাতে পারা কোনো বীর। দে আর আওয়ার রিয়েল হিরো। শুধু এই জন্য হলেও প্লিজ রেস্পেক্ট হিম, লাভ হিম এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ড হিম। শুধু হাইট আর বডি দেখে ক্রাশ খেলেই হবেনা মিসেস তিরা মেহজাবিন। ধৈর্য সহকারে যাদিদের ছুটির জন্য অপেক্ষা করুন। ওই দিনগুলোতে দেখবেন এই বদরাগী মানুষটাই কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। স্বর্বপ্লাবী ভালোবাসা তখন আপনিও দেখাবেন।”
শেষ কথাটা বলে কাব্য হেসে ফেলল। তিরা এবার কাঁদতে কাঁদতেই ছুটে চলে গেল নীচে। আরশি উঠে পেছন পেছন যাচ্ছিলো, কাব্য হাত ধরে থামালো। ততক্ষণে আরশি সিঁড়িঘরের কাছে চলে গিয়েছিল। কাব্য বলল,
“এখন যাদিদকে কল করবে, সরি বলবে। এসবের মধ্যে তোমার থাকা লাগবে না। তুমি বরং অন্যকারো কাছে থাকো।”
আরশি সিঁড়িঘরে হেলান দিয়ে আশ্চর্য চোখে হেসে বলল,
“ইউ আর আ ম্যাজিশিয়ান।”
“ধুর।”
“সিরিয়াসলি কাল তিরা আসার পর থেকে আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু আমার বোঝানোতে কোনো কাজ হয়নি। এভাবে তো আমিও ভেবে দেখিনি।”
কাব্য আরশির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিঁড়ঘরের হেয়ালে একটা হাত রাখলো। আরশির খুব কাছে গিয়ে চোখে চোখ রাখতেই সে চোখ নামিয়ে নিল। আকাশে মেঘগুলো সরে যাচ্ছে। মেঘের কন্ট্রোলে চাঁদের আলো কখনো কম কখনো বেশি। কাব্য সেই আলোয় আরশির মুখ দেখে বিমোহিত। কাব্য ডাকলো,
“আরশি।”
“শুনছি।”
“আমার চোখে তাকাও।”
আরশি তাকালো এবং সবসময়ের মত আবারো নার্ভাস হয়ে পড়লো। কাব্য বলল,
“নার্ভাস অর ডিসকমফোর্ট?”
আরশি চোখ নামিয়ে ঢোক গিলে বলল,
“জাস্ট নার্ভাস।”
“কেন?”
আরশি মাথা নেড়ে বলল,
“জানিনা।”
আরশির আবার সেই দম বন্ধ করা অনুভূতি হতে লাগলো। কাব্য বলল,
“যদি তোমার কেউ দূরে চলে যায়, তুমিও বোনের মতো পাগলামি করবে?”
আরশি কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি করি?”
“তার যদি রাগ হয়? সে যদি ফোন বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে তখন কি বুঝতে পারবে নাকি ভুল বুঝে ভাববে তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য করেছে?”
“সে এমনটা করবেই না। সে আমাকে সবচেয়ে বেশি বোঝে। যতটা এই পৃথিবীর আর কেউ বোঝেনা।”
কাব্য মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,
“জানো কতবড় একটা কথা বলেছো? বুকটা ফুলে ফেঁপে এক আকাশ সমান হয়ে গেল।”
আরশি তাকিয়ে রইল। খুব খুশি লাগছে তার। কেন যেন অনেক অনেক দিন পর তার চোখ ভিজে আসতে চাইছে। সে হঠাৎ দ্রুতপায়ে নিচে নেমে গেল।
চলবে….