#কনফিউশন,৩৪,৩৫,৩৬
লেখকঃ #মৌরি_মরিয়ম
পর্ব ৩৪
.
“আমাকে মাফ করে দাও যাদিদ। সত্যিই আমি সবসময় শুধু নিজের কথা ভেবেছি। তোমার দিকটা কখনো ভাবিনি আমি।”
“আচ্ছা তিরা আর কতবার এক কথা বলবে? সন্ধ্যায় তো মাফ চাইলে। এখন আবার? আমি তোমার দূরের কেউ নই, এত মাফ চাইতে হবেনা আমার কাছে। তুমি যদি পাগলামি কমাও, ধৈর্য ধরে থাকো আর আমাকে একটু বুঝতে পারো তাহলে আমরা খুব সুখী হতে পারব।”
“আমি আর কোনো পাগলামি করব না। সবকিছু বুঝব দেখো।”
যাদিদ হেসে বলল,
“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন একদম কান্নাকাটি না। হাসো তো একটু।”
“হাসলেও তুমি দেখতে পাবেনা।”
“পাব। আমি তিরাকে সবসময় দেখি।”
তিরা হাসলো। যাদিদ বলল,
“এইতো সুন্দর লাগছে। এবার লক্ষী মেয়ের মত আমার কথা শোনো।”
“বলো।”
“তুমি আগামীকাল খুলনা চলে যাবে।”
“আর কিছুদিন থাকি যাদিদ। এখানে আরশির সাথে সময় খুব ভালো কাটে।”
“হ্যাঁ সেজন্যই তুমি যেতে চাওয়ামাত্রই আমি যেতে দিয়েছি। কিন্তু তিরা বাবা মা ওখানে একা। আমার আর কোনো ভাইবোন থাকলে হয়তো তোমার উপর এত চাপ থাকতো না। কিন্তু যেহেতু নেই, বাবা মায়ের সব দায়িত্ব তোমাকে আমাকেই নিতে হবে। দুদিন তো থাকলে। আবার কিছুদিন পর গিয়ে থেকো। এখন ফিরে যাও প্লিজ।”
তিরার আবার মন খারাপ হয়ে গেল। যাদিদ জানে সে বাবা মায়ের কোনো খেয়ালই রাখতে পারেনা, উল্টো তারাই তিরার খেয়াল রাখে তবুও যাদিদ জোর করছে। যাদিদ সবসময় নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। যাই হোক, মানুষটাকে বোঝার প্রতিজ্ঞা যখন নিয়েছ তখন যত কষ্টই হোক চেষ্টা সে করবে। পরদিন সকালের বাসেই তিরা খুলনা চলে গেল।
রশ্নি আরশিকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। ভালোভাবে পিনও মারা হয়েছে। আরশি ঘরের ভেতর কয়েকবার হেঁটে দেখলো হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা। অসুবিধা না হলেও অস্বস্তি হচ্ছে। আরশি হুট করে বলে বসলো,
“আচ্ছা ভাবি শাড়ি টা খুলে যাবে না তো আবার?”
রশ্নি হেসে বলল,
“এত নার্ভাস কেন তুই? কোনোদিন তো তোকে এত নার্ভাস হতে দেখিনি।”
“ভাবি লজ্জা লাগছে আমার। তার সামনে এভাবে গেলে চোখ দুটো দিয়ে গিলে খাবে আমাকে। তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই যদি?”
রশ্নি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল,
“বাসা চেনে তো? কোলে তুলে নিয়ে আসতে পারবে?”
“ধ্যাত ভাবি!”
“তুই একটা পাগল আরশি। ছেলেরা তো দেখবেই। এটাই তাদের ন্যাচার। সামনে যাবি প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগবে, পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ভাবি আমি না ওকে বলিনি শাড়ি পরব। আমি বরং খুলে ফেলি। জামা পরে যাই। শাড়ি পরা আমার কর্ম না। রাস্তার লোকজন কী ভাববে বলো?”
“কিছু ভাববে না। এমনকি কেউ খেয়ালই করবে না। শাড়ি ভিনগ্রহের পোষাক না সোনা। বাংলাদেশী পোষাক, সব মেয়েরাই পরে। এবার বেশি কথা না বলে গয়নাগুলো পরে নে।”
“না গয়না পরব না।”
“একটু সাজলিও না৷ গয়নাও পরবি না। একদম সাদামাটা লাগবে।”
“সেটাতেই আমাকে স্বাভাবিক লাগবে ভাবি। শাড়ি পরেছি এটাই অনেক।”
“তাহলে চুলটা অন্তত খোলা রাখ।”
“ঠিকাছে, তোমার এই কথাটা রাখলাম।”
রশ্নি হাসলো। কাব্যর ফোন আসতেই আরশি রশ্নির থেকে দূরে গিয়ে ফোন ধরল,
“বলো।”
“উবার ডেকেছি। গাড়ি অলরেডি বাসার নীচে পৌঁছে গেছে, আমি রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে উঠব। তুমি নামো।”
“আচ্ছা।”
রাস্তায় মাথায় যেতেই আরশি কাব্যকে দেখে ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলল। কাব্য বাইরে থেকে অতটা খেয়াল করল না। গাড়িতে উঠতেই হলুদ শাড়ি পরা আরশিকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। হা করে চেয়ে রইলো। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। আরশি আড়চোখে কাব্যকে দেখছে। কাব্য এবার চোখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। দুহাতে ঠোঁট চেপে ধরে হাসলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার নিজেই নিজের চুল টানলো। খুশিতে, উত্তেজনায় সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। আবার আরশির দিকে তাকালো। আরশি আড়চোখে তাকানো বন্ধ করল। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছে। ভাগ্যিস বসে আছে নাহলে যে কী হতো! কাব্য বলল,
“ধন্য আজ কাব্য।”
আরশি মুচকি হেসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তবে এটা পরে নিক।”
কাব্য প্যাকেট খুলে দেখে নীল রঙের পাঞ্জাবি। সাথে সাথে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো৷ আরশি অবাক হয়ে বলল,
“এখানেই?”
কাব্য হেসে বলল,
“সো হোয়াট! একজন অসম্ভব সম্ভব করল।”
“যদি তাই তাহলে সেই একজনটা তুমি।”
কাব্য আবার হাসল। আরশি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। কাব্য শার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরে নিল। তারপর আরশির একদম কাছে গিয়ে বসলো।
“আরশি।”
“বলো।”
“খুব খুশি হয়েছি, খুব। আমার মনে পড়েনা এত খুশি আমি শেষ কবে হয়েছিলাম!”
আরশি হাসলো। খুশিটা সে কাব্যর চোখেমুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কাব্যকে এত খুশি দেখে তার নিজেরও খুব খুশি লাগছে। কিছুক্ষণ পর কাব্য ফিসফিস করে বলল,
“তোমার হাতটা ধরতে দেবে?”
আরশি কাব্যর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“এমনভাবে অনুমতি চাইছো যেন আগে কখনো ধরোনি!”
“এখন যেভাবে ধরতে চাই সেভাবে ধরতে অনুমতি লাগে আরশি।”
আরশি এবারো তাকালো না। মুচকি হেসে বলল,
“অনুমতি দিলাম।”
কাব্য আরশির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর আরশির হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের হাতের আঙুলগুলো রাখলো। তারপর হাতটা ভালোভাবে ধরল। আরশির হাতটা উপরের দিকে রেখে সেই হাতে চেয়ে রইলো। তারপর বলল,
“কি অন্যরকম লাগছে না?”
“হ্যাঁ।”
“ভালো লাগছে?”
“হ্যাঁ।”
“কিরে ভাই সবকিছুতেই দেখি হ্যাঁ বলছো!”
আরশি হাসলো। কাব্য বলল,
“ধরে থাকব এভাবে?”
“হ্যাঁ।”
“ছেড়ে দেব?”
“না।”
“যাক তাহলে বোঝা গেল যে তুমি র্যান্ডমলি হ্যাঁ বলছিলে না!”
আরশি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল।
চলবে…
#কনফিউশন
লেখকঃ #মৌরি_মরিয়ম
পর্ব ৩৫
.
আরশি কাব্য ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক নদীতে ঘুরছে। বড় একটা নৌকায় উঠেছে। নদীর ঢেউগুলো নৌকার গায়ে লেগে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। আরশি সেদিকে চেয়ে আছে। কাব্যর মা ফোন করায় কাব্য নৌকার অন্যপ্রান্তে গুলুইয়ের উপর বসে সে তার সাথে ফোনে কথা বলছে। শাহনাজ বেগম বললেন,
“কোথায় তোরা?”
“ঘুরতে এসেছি, আপাতত নদীতে। জানো মা ও জীবনে প্রথম শাড়ি পরেছে তাও আমার জন্য। আমি পছন্দ করি বলে।”
“দেখেছিস তুই কত ভাগ্যবান? কুলাঙ্গার ছেলে তুই যদি ওকেও কষ্ট দিয়েছিস মেরেই ফেলব তোকে। আচ্ছা বাবা সত্যি করে বল তুই ওর ব্যাপারেও কনফিউজড না তো?”
কাব্য হেসে বলল,
“১% কনফিউশনও নেই মা। আমি ওকে সত্যি ভালোবাসি। ওর সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। ওর প্রতি আমার যে অনুভূতি এটাই ভালবাসা, এটা তনিকার বেলায় ছিল না মা।”
“তাহলে ভালোবাসার কথাটা এখনো বলে দিচ্ছিস না কেন?”
“সব সম্পর্কে ভালবাসি বলাটা জরুরি না মা। আমি যেমন জানি সে আমাকে ভালোবাসে, তেমনি সেও জানে আমি তাকে ভালোবাসি। এখনকার সম্পর্কটা যে কত মিষ্টি তুমি জানোনা। আর সবচেয়ে বড় কথা ওকে এখন ভালোবাসার কথা বলতে গেলেই সম্পর্কটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তখন দুজনের জন্যই আগামী ৫ বছর দূরে থাকাটা কষ্টের হয়ে যাবে।”
“জানিনা বাপু, তোদের আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার বুঝিনা।”
কাব্য হেসে বলল,
“আচ্ছা এবার রাখো। মেয়েটা একা বসে আছে। রাতে কল দিচ্ছি।”
“আচ্ছা রাখ।”
কথা বলা শেষ করে কাব্য আরশির কাছে যেতেই আরশি বলল,
“তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে তাইনা?”
“হ্যাঁ। সব মায়েরাই তো তাদের সন্তানদের খুব ভালোবাসে।”
আরশি আনমনা হয়ে বলল,
“ঠিক বলেছ, আমার মাও আমাকে খুব ভালোবাসতো। আর বাবাও।”
কাব্য টের পেল আরশির বাবা মার কথা মনে পড়ে মন খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা-মা হারানো মানুষের জন্য আসলে শান্তনা বানী কোনো কাজে লাগেনা। তাই কাব্য সেদিকে না গিয়ে চুপ করে রইল। আরশি বলল,
“জানো কাব্য আমি ছোটোবেলায় খুব চঞ্চল ছিলাম।”
“তাই!”
“হ্যাঁ যদিও ছোটোবেলা থেকেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলাম কিন্তু সারাক্ষণ শুধু খেলতে চাইতাম, একদম পড়তে বসতে চাইতাম না। বাবা মা দুজনেই আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। সেই আমিই কেমন শান্ত হয়ে গেলাম!”
কাব্য কিছু বলল না৷ শুধু তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে। আরশি হঠাৎ কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না আমি হাসি না কেন?”
“হুম।”
“আজকে তোমাকে বলব, শুনবে কাব্য?”
“অবশ্যই আরশি। তোমার সব কথা আমি শুনব যা যা বলতে চাও।”
“ছোটবেলায় আমরা কক্সবাজার থাকতাম। আমাদের বাড়ি ছিল চকরিয়াতে। সাহিল ভাইয়া পড়াশোনার জন্য এখানে থাকত। আমাদের ওখানে থাকার কারণ বাবা রাজনীতি করতেন।”
“শুনেছি আংকেল সংসদ সদস্য ছিলেন।”
“কার কাছে শুনেছ?”
“ভাইয়ার কাছে শুনেছি।”
“বাবা কীভাবে মারা গেছেন তা শুনেছ?”
“না।”
“আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। ঈদ করতে সবাই এক হয়েছি। ঈদের আগে আগে একদিন সবাই মিলে বাজারে গিয়েছিলাম। আমি খুব ছটফটে ছিলাম। বাবা মা যখন কেনাকাটা করছিলেন আমি দৌড়ে একটা খেলনার দোকানে ঢুকলাম। সাহিল ভাইয়া আমাকে ফেরাতে আমার পিছুপিছু এল। ভাইয়া আসতেই আমি বায়না করতে শুরু করলাম আমার এটা চাই, ওটা চাই। ভাইয়া তো আমার অনেক বড়, আমি যখন ফোরে পড়ি তখন ও পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতেও ঢুকেছে। ভাইয়া বলল যাওয়ার সময় আমার পছন্দের সব খেলনা কিনে দেবে। আমি কিছুতেই খেলনা না নিয়ে ফিরব না গো ধরে বসে থাকলাম। হঠাৎ দেখি বাজারের মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করেছে, অনেক চেচামেচি। ভাইয়া আমাকে নিয়ে দোকান থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম বাবাকে কিছু লোক কুপিয়ে মারছে।”
কাব্য আরশির কাঁধে হাত রাখলো। আরশি নীরবে কাঁদছে আর বলছে,
“চোখের পলকে ওরা বাবাকে কয়েক টুকরো করে ফেলল। হাত পা মাথা সব আলাদা। মা চিৎকার করছিলেন, ওরা মাকেও কুপিয়ে মেরেছে। আমি চিৎকারও করতে পারিনি! ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরে ছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই৷ অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হসপিটালে। ভয়ংকর এক ট্রমার ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। সাহিল ভাইয়া আমাকে ঢাকা নিয়ে আসে। আমি কাঁদতে পারতাম না, হাসতে পারতাম না। জগতের কোনো অনুভূতিই আমার ছিলো না। এত রক্ত দেখেছি যে রঙ আর দিনের আলো কোনোটাই সহ্য করতে পারতাম না। সারাদিন ঘর অন্ধকার করে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। কিছু খেতে পারতাম না। কত রাত যে কেটেছে আমার না ঘুমিয়ে তার কোনো হিসেব নেই। ভাইয়া বলল বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করলে তারা যেখানেই থাকুক সুখী হবে। তাদেরকে সুখী করার জন্য আমি দিন রাত পড়াশোনা করা শুরু করে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া শুরু করলাম। কারণ বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাকে ডাক্তার বানানো আর মায়ের আরেকটা স্বপ্ন ছিল আমাকে তিন বেলা ঠিকমতো খাওয়ানো।”
এ কথা বলে আরশি হাসলো। কাব্য চুপ। তারপর আরশিই আবার বলল,
“কিছুদিন পর ভাইয়া রশ্নি ভাবিকে বিয়ে করে আনে। ভাবি তখন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিল, ওকে খুব পছন্দ করতাম। আমার জন্যই ভাইয়ার অত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা। আমি সবার সাথে মিশতাম না।”
কাব্য এবার বলল,
“খুব কঠিন ছিল তোমার বড় হয়ে ওঠা।”
“হ্যাঁ খুব বেশি কঠিন, খুব বেশি বিষন্ন। যেখানে ভালোলাগার কোনো কিছুই নেই। যেখানে বেঁচে থাকাটাই অনেক কঠিন। মানুষজন আমাকে বুঝতে পারতোনা, এমনকি এখনো পারেনা। অন্য সব মেয়েদের মতো করেই আমার বয়স বেড়েছে, শারিরীক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু জীবনটা অন্যসব মেয়েদের মত কাটেনি। আমার বোন তিরা আমার একমাত্র বন্ধু, যে সম্পূর্ণই আমার উল্টো। এছাড়া কখনো কোনো বন্ধু তৈরি হয়নি, কেউ আমার সঙ্গ পছন্দ করতো না, আমারো কাউকে ভালো লাগতো না। আমার জীবনের একমাত্র আনন্দের ঘটনা হচ্ছে আমার ভালো রেজাল্ট করা। এই একটা জিনিস আমাকে আনন্দ দিত, কারণ বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের পথ সুগম হচ্ছিল।”
কাব্য চুপ। আরশি আবার বলতে শুরু করল,
“এরপর একদিন কীযে হলো! কখনো কারো চোখে না পড়া এই মেয়েটা একজনের চোখে পড়ে গেলো। জীবনে প্রথম কেউ মেয়েটার বিষন্নতার কারণ জানতে চাইলো। জীবনে প্রথম একটা মানুষ মেয়েটার খুব কাছে চলে এলো, মেয়েটাকে হাসালো, কাঁদালো। অনুভূতিহীন মেয়েটাকে পরিচয় করালো অনেক অনুভূতির সাথে। মেয়েটার বেঁচে থাকাটা এখন আর আগের মত কঠিন নেই।”
কাব্য আরশির চোখ মুছিয়ে দিয়ে হাত ধরলো। তারপর বলল,
“যেভাবে তোমার কাছে এসেছি, সেভাবেই আজীবন তোমার কাছে থাকব আরশি। অনেক হাসাবো, অনেক কাঁদাবো।”
আবারো আরশির দু’চোখ উপচে জল পড়তে লাগলো। ঠোঁটে হাসি।
তিরা খুলনা পৌঁছলো বিকেলবেলা। প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলো সে, সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যায় শাশুড়ি রেহানা আলমের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তিনি বললেন,
“তিরা ওঠো কিছু খেয়ে নাও।”
“মা আমার ভালো লাগছে না। পরে খাব।”
“এবাড়িতে এরকম না খেয়ে তো থাকা যাবেনা। ঠিকমতো না খেয়ে না খেয়েই অসুস্থ হয়েছিলে তুমি। ওঠো খেয়ে নাও।”
তিরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলো। খেয়েদেয়ে ঘরে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় কলিং বেল বাজলো। রেহানা বললেন,
“দেখো তো তিরা কে এলো।”
তিরা দরজা খুলতেই দেখে যাদিদ দাঁড়িয়ে। স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি বুঝতে পারছেনা। যাদিদ তিরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“সারপ্রাইজ!”
তিরা সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ঘটনাটা এত আচমকা ঘটলো যে যাদিদ ধরতেও পারলো না। রেহানা ছুটে এলেন। যাদিদ তিরাকে ধরে কোলে তুলে ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিতেই রেহানা বললেন,
“আগেই বলেছিলাম সারপ্রাইজের দরকার নেই, ওকে বলে দেই।”
“ধুর মা তেমন কিছু হয়নি।”
যাদিদ তিরার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিতেই তিরা চোখ মেলে তাকালো। যাদিদকে এবং শাশুড়িকে হাসতে দেখে সে প্রচন্ড লজ্জা পেল। সে যাদিদের দিকে তাকাতেই পারছে না। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। রেহানা বললেন,
“তুমি তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। সারাদিন কিচ্ছু খেতে চাওনা, মাথা ঘুরে তুমি পড়বে না তো কি আমি পড়ব?”
তিরা উঠে বসলো। যাদিদ মুচকি হাসছে। রেহানা বললেন,
“এখন তোমার জন্য এক মগ দুধ গরম করে আনব, পুরোটা খেতে হবে।”
রেহানা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই যাদিদ তিরার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“এই পাগল কাম টু মি।”
তিরা ঝাপিয়ে পড়ল যাদিদের বুকে। মুহুর্তের মধ্যেই কান্নায় ভাসিয়ে দিল তাকে। যাদিদ তিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু দিলো।
চলবে…
#কনফিউশন
লেখিকাঃ #মৌরি_মরিয়ম
পর্ব ৩৬
তিরার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যাদিদ সত্যি এসেছে। যাদিদের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে নিজের গায়ে নিজে চিমটি দিল। একাজ সে ইতিমধ্যে অনেকবারই করেছে। প্রতিবারই সে ব্যাথা পেয়েছে এবং স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছে। যাদিদ মাত্র ১০ দিনের ছুটিতে এসেছে। অথচ এই মানুষটা যদি সারাজীবনের জন্য কাছে থাকতো তাহলে তার চেয়ে বেশি সুখী এই পৃথিবীতে একজনও আর থাকত না। যাদিদ হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলো তার পাগল বউ ঘুম বাদ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। সে তিরাকে কাছে টেনে নিলো। বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ঘুমাচ্ছ না কেন?”
তিরা যাদিদের বুকে মাথা রেখে বলল,
“এই ১০ দিন আমি একদম ঘুমাবো না। শুধু দেখবো তোমাকে। দেখতে দেখতে মুখস্ত, চোখস্ত, আত্মস্থ করে ফেলব।”
“চোখস্থ শব্দটা আবার কোত্থেকে পেলে?”
“জানি না।”
যাদিদ তিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“এত দেখতে হবে না। এখন ঘুমাও।”
“তুমিও ঘুমিও না।”
যাদিদ এবার হেসে দিল। বলল,
“এতো ভালোবেসে ফেললে কীভাবে আমাকে? অ্যারেঞ্জ ম্যারজে কেউ স্বামীর জন্য এত পাগল হয় আগে দেখিনি।”
“সো ইউ শুড ফিল প্রাউড।”
যাদিদ হেসে ফেলল। তিরার মুখটা ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,
“হুম প্রাউড ফিল করি তো, আর..”
“আর কী?”
যাদিদ তিরার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
“অনেক ভালোবাসি তিরা।”
তিরা তৃপ্তির হাসি হাসলো। এমন করে কি আগে কখনো ভালোবাসি বলেছে যাদিদ? মনে করতে পারলো না সে। সত্যিই কাছে থাকলে মানুষটা একদম অন্যরকম, ঠিক মনের মতো।
আজ মাসের শেষদিন। কাব্যর বাসা ছাড়ার সময় এসে গেছে। আগামীকাল সে কক্সবাজার চলে যাবে। দুই সপ্তাহ পর সুইডেন যাওয়ার দিন ঢাকা এসে ফ্লাইট ধরবে। কাব্যরও গোছগাছ মোটামুটি শেষ। টুকটাক কিছু বাকি। সকালবেলা পিকআপ আসবে। কাব্য বইগুলো কার্টনে ভরছে, আরশি সাহায্য করছে। আরশি তেমন কোনো কথা বলছে না। কাব্য একাই বকবক করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কথা একেকটা বই নিয়ে। আরশিকে চুপচাপ দেখে কাব্য হঠাৎ বলল,
“তোমার মন খারাপ আমি চলে যাচ্ছি বলে?”
আরশি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
“নাহ। মন খারাপ কেন হবে?”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ।”
“আমি ৫ বছর পর আবার আসব। এর মধ্যে কিন্তু আর আসতে পারব না।”
“জানি।”
“তবুও মন খারাপ হচ্ছে না?”
“নাহ। কেন মন খারাপ হলে খুশি হতে?”
কাব্য হেসে বলল,
“না। আমি চাই তুমি সবসময় খুশি থাকো। তোমার হাসিটা অনেক শান্তি দেয়।”
এবার আরশি হাসল। খুশি হয়েই হাসলো।
যাদিদ তিরা পাঁচ দিনের জন্য হানিমুনে গেল নেপালে। সেখান থেকে ফিরে একদিন রেস্ট নিল। ঘটনাটা ঘটলো তার পরদিন। সারাদিন দুজনে শপিং করলো, বাইরে খাওয়া-দাওয়া করল। সন্ধ্যার পরে তিরা শাশুড়ির সাথে রান্নাবান্নায় সাহায্য করছিল। হঠাৎ যাদিদ তাকে রান্নাঘর থেকে ডেকে নিয়ে গেল। বেডরুমে গিয়ে বলল,
“তিরা তুমি কি আমাকে কখনো কোনো মিথ্যে বলেছো?”
তিরা খুব স্বাভাবিকভাবেই হেসে বলল,
“না তো। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“ভাল করে ভেবে দেখো। বিয়ের আগে বা পরে কোনো ছোটো বা বড় মিথ্যে?”
“আমি তোমাকে মিথ্যে কেন বলব?”
“বলোনি?”
“না।”
“ঠিকাছে।”
যাদিদ এ কথা বলে কোথাও বেরিয়ে গেল। তিরা ভাবতে লাগলো যাদির এরকম কেন জিজ্ঞেস করল? অনেকক্ষণ ভাবার পর তিরার হঠাৎ মনে হলো যাদিদ বিয়ের আগে জিজ্ঞেস করেছিল তার বয়ফ্রেন্ড ছিল কিনা। সে বলেছিল নেই। কিন্তু এই কথাটা এতদিন পরে উঠলো কেন? তিরা সাথে সাথে আরশিকে ফোন করে সব বলল। আরশি বলল,
“আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এসব নিয়ে মিথ্যে বলাটা ঠিক হবে না।”
“আমি তো ভয়ে সত্যিটা বলিনি যদি বিয়েটা না হতো?”
“সত্যিটা বললেও বিয়ে হতো তিরা। এখনকার যুগে বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড থাকাটা খুব অস্বাভাবিক না। ভাইয়ার যে গার্লফ্রেন্ড ছিল সেটা তো সে অকপটে বলে দিয়েছে। তোরও বলা উচিৎ ছিল।”
“এখন কি করব? সত্যিটা বলে দেব?”
“অবশ্যই এক্ষুনি বলে দিবি।”
“কার কথা রেখে কার কথা বলব? কত্তগুলা বয়ফ্রেন্ড ছিল আমার তুই ত জানিস।”
“স্পেসিফিক্যালি কারো কথা বলতে হবেনা। জাস্ট বলবি বয়ফ্রেন্ড ছিল।”
“যদি ডিটেইলসে জানতে চায়?”
“বলবি এসব তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব নিয়ে আলোচনা করতে চাস না।”
“যদি রেগে যায়?”
“রাগলে রাগবে। গাধা তুই এইটুকু বুঝতে পারছিস না হঠাৎ ভাইয়া কথাটা কেন জিজ্ঞেস করল?”
“কেন?”
“নিশ্চয়ই কোনোভাবে কিছু জানতে পেরেছে!”
তিরা ভয় পেয়ে বলল,
“কি বলছিস তুই!”
“হতেই পারে। আচ্ছা ভাইয়া কি কথাটা রেগেমেগে জিজ্ঞেস করেছে নাকি স্বাভাবিক ছিল?”
“স্বাভাবিক ছিল।”
“আচ্ছা যাই হোক এখন সব বলে দে। একটা মিথ্যাকে লুকিয়ে রাখতে আরো ১০০ মিথ্যা বলতে হয়। সেই ১০০ মিথ্যা হয় ১০০০ বিপদের ফাঁদ। তুই এক্ষুনি সব বলে দে।”
“ঠিকাছে ও বাসায় ফিরলে সব বলে দেব।”
“আচ্ছা টেনশন করিস না। তুই নিজ থেকে সব বললে ইজিলি নেবে ইনশাআল্লাহ।”
কিন্তু যাদিদকে বলার সুযোগ পেল না তিরা। যাদিদ বাসায় ফিরেই তিরার মুখের উপর কিছু কাগজপত্র ছুঁড়ে মারলো। তিরার মুখে ধাক্কা খেয়ে সেগুলো মাটিতে পড়ে গেল। তিরা তাকিয়ে দেখে তার এক এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে কাপল ছবি এবং তার নিজ হাতে লেখা অসংখ্য চিঠি।
চলবে…