কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব – ২)

0
655

#কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব – ২)

পুলিশের সাথে নীলাকে কথা বলতে দেখার পর দুটো দিন আবিরের আতঙ্কিত অবস্থায় কাটে। তার সারাক্ষণই মনে হতো এই বুঝি থানা থেকে ফোন করে তাকে ডেকে পাঠাল! দুদিনে যখন কিছুই হলো না তখন সে বুঝে গেল কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। সে ক্যাম্পাসে গিয়ে নীলাকে খুঁজে বের করল। নীলা ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল সাথে তার দুই বান্ধুবী। আবির তার টেবিলে গিয়ে খালি চেয়ারটায় বসে বলল- নীলা আপনাকে হেল্প করতে এলাম।

নীলা ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল- কি বিষয়ে?

-কবি বলেছেন “সিনিয়রদের মাঝেমধ্যে চায়ের দাওয়াত দিতে হয় তাতে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা যায়” তোমার রেজাল্ট ভালো হোক সে ব্যাপারে হেল্প আর কি…

-আচ্ছা? আপনার পেছনে আপনার চেয়েও সিনিয়র ভাইরা বসে আছে দাওয়াত তো তাহলে ওনাকেই দিতে হয়?

-তা যায় তবে তাতে ওই সিনিয়র ভাইদের জুনিয়র কারো হৃদয় ভাঙতে পারে। সেটা নিশ্চই চাও না?

-কেউ যেচে মন ভাঙতে চাইলে আমার কী করার আছে?

নীলার পাশে বসা একটা মেয়ে বলল- “ভাইয়া আমার তো রেজাল্ট ভালো করার খুব ইচ্ছে…”

-আবির তার দিকে তাকিয়ে বলল তোমার তো খুব বেশিই প্রয়োজন মনে হচ্ছে। যাও ওই সিনিয়র ভাইয়াকে চা খাইয়ে এসো।

-নীলা হেসে মেয়েটাকে বলল তুইও নাহয় আমার সাথে রেজাল্ট খারাপ করিস সমস্যা নেই। আর আপনি, চা খেতে চান খাওয়াচ্ছি এত বাহানা করার কি আছে?

-একটু বাহানা না করলে আলাপটা জমবে কীভাবে? তারপর বলুন সেদিন পুলিশের কাছে আমার নামে কি নালিশ করলেন?

-আলাপ জমাবার কারণ উদঘাটিত হলো। ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে?

-পুলিশকে ভয় পাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আপনার আত্মীয় হয় নাকি?

-বড় ভাই।

-ও… সে কারণেই কী আপনার সাহস সব সময় নাকের ডগায় উঠে থাকে?

-আমি সব সময় নিজের সাহসে চলি।

-গুড। তোমাকে কাল অনেক গুলো কল দিয়েছিলাম ফোন বন্ধ রেখেছিলে কেন?

-কোন নাম্বারে ট্রাই করেছেন?

-০১……..

-ওটা তো আমার নাম্বার নয়।

-তোমার নাম্বার কোনটা তাহলে?

-আসলে আমার নাম্বার আপনার কাছে নেই। আছে বলে যেটা বললেন সেটা আসলে নাম্বার চাইবার একটা টেকনিক মাত্র।

-তুমি ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে এইটুকু যে বুঝবে সেটা আমি জেনেই বলেছি। কই বলো?

-সিনিয়র ভাই হিসেবে আপনি “তুমি” বলছেন সেটা মেনে নিচ্ছি বলে নাম্বারটাও দিয়ে দিব সেটা ভাবা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে।

-তুমি না দিলেও তোমার নাম্বার কালেক্ট করা আমার জন্য কষ্টকর হবে তা কিন্তু না।

-আমার ক্লাস আছে যাচ্ছি ভাইয়া।

-আমার একটা সুন্দর নাম আছে। নাম ধরেই বলতে পারো।

-সেটা কী সবার জন্য প্রযোজ্য?

-সবাই তো নীলা না।

-আর নীলা সবার সয় না। বলে নীলা চলে যায়।

আবির বসে বসে ভাবল “I like this attitude”। যেখানে মেয়েরা আমায় দেখে পাগল হয়ে যায় সেখানে এই মেয়ে আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না! নাম্বার তো আমার চাই-ই চাই। সে নাম্বারের খোঁজে চলে যায়।

নীলা তার ভাইয়া ভাবির খুব আদরের। ভাইয়ের কাছ থেকে হাত খরচের জন্য যথেষ্ট টাকা পেলেও নীলা দুটো টিউশনি করে। নিজের খরচ নিজে চালাতেই সে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সে টিউশনি করে বাড়ি ফেরার পথে কিছু চকলেট, এক বক্স কালার পেন্সিল আর একটা চকলেট কেক নেয়। আজ তার ভাতিজি তাইয়্যেবার জন্মদিন। ৩বছর পূর্ণ হলা ওর। ভীষণ চটপটে আর কথা বলা একটা মেয়ে তাইয়্যেবা। নীলা ওকে আদর করে তুলতুলি ডাকে। তাইয়্যেবার জন্য গিফট কিনতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে নীলার একটু দেরি হয়ে যায়। তাই বাড়ি ফিরতেই তার বাবার মুখোমুখি হতে হল। বাবা কড়া গলায় দেরি হবার কারণ জানতে চাইলেন। নীলার বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। রিটায়ার্ড হলেও সব কিছুতে তার টাইমিং ঠিক রাখতে হয়। নীলা বাবাকে দেরি হবার কারণ বলে ভাইয়ার ঘরে গিয়ে তুলতুলিকে ডাকল। তাইয়্যেবা বিছানায় বসে ব্লক দিয়ে খেলছিল। ফুপিকে দেখেই দৌড়ে এসে তার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। তারপর তার গিফট গুলো দিতেই খুশিতে লাফাতে থাকে।

-ফুপি আমরা কেক কখন কাটব?

-বাবা এলেই কাটব।

-বাবা কখন আসবে?

-সেটা তো মা জানে। নীলা ভাবিকে বলল- ভাবি ভাইয়া কখন আসবে?

-বলল তো সন্ধ্যেবেলাতেই চলে আসবে। দাঁড়াও ফোন দিচ্ছি। সে তাইয়্যেবার বাবা এস আই সরফরাজকে ফোন দিলে তিনি জানান, ৩০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।

নীলা তখন তাইয়্যেবাকে নিয়ে কেক কাটার সব আয়োজন করতে চলে যায়।

বার্থডে সেলিব্রেশন শেষ হলে নীলা তার ঘরে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখে অপরিচিত এক নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে তাতে লিখা-

“এক লাইব্রেরী বইয়ের ভীড়ে “নীলা” নামক বইটাতেই নজর আটকেছে। নীলাকে জানার অদম্য এক ইচ্ছে মনের ভেতর তোলপাড় করে যাচ্ছে… নীলা নামক গল্পটায় নিজের নাম যোগ করতে চাই। তারপর নাহয় বই পাঠ চলতে থাকুক।”

ম্যাসেজ পড়ে নীলা ভ্রু কুঁচকে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। নাম্বারটা কার হতে পারে? ফোন করে দেখবে? পরে ভাবল “কী দরকার?” বই পড়ার যার এত সখ প্রয়োজনটা তো তার নিজেরই। সে ফোন নিয়ে শুয়ে পড়ে ফেসবুকে যায় দেখে আবির তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। নীলা সেটা এক্সেপ্ট না করে নিউজফিডে ঘুরতে থাকে। ওর বান্ধুবী ইলার সাথে কিছুক্ষণ চ্যাটিং করে। তখন আবিরের ম্যাসেজ আসে

“ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করছ না কেন?”

নীলা কিছু বলবে না বলবে না করেও ম্যাসেজ লিখল

“কারণ আপনাকে বন্ধু মনে করতে পারছি না”

আবির লিখল- “সেটা তো আমিও মনে করি না। বাহ, আমার মত করে ভাবতে শুরু করে দিয়েছ তাহলে?”

“আমার পেছনে কেন লেগেছেন বলুন তো? আপনার কী হঠাৎ করে “মেয়ে”র অভাব পড়ে গেল?”

“ব্যাপারটা ঠিক মেয়ের অভাব নয়, একজন নীলার অভাব।”

“ভুলে যান কেন নীলা সবার সয় না?”

“ভুলতে পারছি কই? ভুলতে পারলে নীলা নামক উপন্যাস নিয়ে আমার এত আগ্রহ কখনোই হত না।”

“ও… ম্যাসেজটা তাহলে আপনিই পাঠিয়েছেন? নাম্বার জোগাড় করে ফেললেই যে কিছু করে ফেলতে পারবেন তেমন আশা করবেন না।”

“কী “আশা” দিয়ে শুরু করব বলে দাও তাহলে?”

“আমি কাউকে মিথ্যে আশা দেই না। তাই ভালো ভাবে বলছি আপনি যা ভাবছেন তা কখনো হবার নয়। আপনি যেসব মেয়েদের সাথে ঘুরে বেড়ান আপনাকে তাদের সাথেই মানায়।”

কথাটা আবিরের বুকে এসে শেলের মত বিধঁল! সে লিখল- “মানুষকে বাইরে থেকে যা দেখা যায় ভেতর থেকেও যে তাই হবে এমনটা তো নাও হতে পারে?”

“আবির ভাই, আপনার সম্পর্কে আমি যে কিছুই ধারণা রাখিনি তা কিন্তু নয়। আর মানুষ বাইরে থেকে তেমনই যেমন সে ভেতরে লালন করে। আপনার মত ছেলেদের কাছে মেয়ে মানেই টাইম পাসের সাবজেক্ট। কখনোই আশা করবেন না আমিও তেমন একজন হব। আমি এখন পর্যন্ত আপনার সাথে ভালো আচরণ করছি তার মানে এই নয় যে আপনি এক সময় আপনার ইচ্ছে পূরণ করে ফেলতে পারবেন।”

এরপর আবির আর কথা বাড়াল না। নীলার কথাগুলো ভুল তো কিছু নয়… আবিরকে হয়ত এভাবে খুব সহজেই বিশ্লেষণ করা যায়। সে তো নিজেকে এভাবেই প্রকাশ করেছে। এই প্রথম আবিরের নিজের প্রতি করুণা হল। সে নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগল… ভাবল নীলাকে নিয়েও। নীলা মেয়েটা অন্যরকম। আর এই অন্যরকম হবার ফাঁদেই আবির আটকে গেছে। সে কী এই ফাঁদ থেকে বেরুতে পারবে?

নীলা দেখল আবির আর তাকে ম্যাসেজ করছে না। তার আশেপাশে দুম করে হাজির হয়ে যাচ্ছে না। ক্যাম্পাসেই আসে না, কারো সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত নেই। পুরো এক সপ্তাহ ধরেই আবির উধাও! হঠাৎ উধাও হওয়া প্রসঙ্গে নীলার ভেতরে আবিরকে নিয়ে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল… কিন্তু প্রশ্নগুলোকে প্রশ্ন রেখেই ভেতরে চেপে রাখল। কারণ আবির তার কোনো সাবজেক্ট নয়। ভালো হয়েছে অল্প কথায় হয়ত সব বুঝে গেছে। তবে আবিরের এত সহজেই চুপ হয়ে যাওয়া, উধাও হওয়াটা মনের মাঝে কোথায় যেন প্রশ্ন হয়ে আটকে রইল!

নীলা সেদিন ইলা আর তনুর সাথে ক্যাম্পাসের সামনের বড় আম গাছটার নিচে বসে গল্প করছিল। একটা ক্লাসের পর তার গ্যাপ ছিল। সেই সময়টা সে দুই বান্ধুবীর সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। সেই সময় আবিরের আগমন। তার চেহারায় এলোমেলো শুকনো রুক্ষ ভাব স্পষ্ট! সে এসেই দুম করে বলল-

-নীলা তোমার সাথে কথা আছে।

-কী কথা?

-আমার কথা শুধু তোমার সাথেই।

ইলা বুঝতে পারল আবির ভাই নীলার সাথে একা কথা বলতে চায়। সে নীলাকে বলল- “আমরা ক্যানটিনে আছি, তুই আয়।

নীলা আবিরের চোখে দৃঢ়ভাবে তাকিয়ে বলল- “আবির ভাইয়ের সাথে আমার এমন কোনো কথা নেই যা তোদের সামনে বলা যাবে না। বস তোরা।”

ইলা আর তনু কী করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল।

-আবির এক প্রকার ধমকের সুরে বলল “কী হলো তোমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছ যে? কী বললাম শুনতে পাও না?”

ইলা আর তনু কোন কথা না বলে চলে যায়।

নীলা বলল- কী সমস্যা আপনার?

আবির নীলার পাশে বসে বলল “কথা আছে আর সেটা তোমার সাথেই।”

-কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন। আমার ক্লাস আছে।

-আমি তোমার সময় নষ্ট করব না। রেখে ঢেকে বা ইনিয়েবিনিয়েও বলতে পারি না। তুমি সেদিন আমাকে কিছু কথা বলেছিলে, কথাগুলো সত্য। তবে এই সত্য কথাগুলোই আমার হজম হচ্ছিল না। আমি গত এক সপ্তাহ অনেক ভেবেছি, অনেক। আমি ঠিক মত খেতে, ঘুমাতে পর্যন্ত পারিনি! আগে কখনো আমার এমন অনুভূতি হয়নি। আমি বাউন্ডুলে টাইপ ছেলে। মেয়েরা আমায় ভীষণভাবে টানে। আমিও তাদের সাথে তাল মিলিয়েছি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমার যে অনুভূতি হয়েছিল সেটার সাথে আমি মোটেও পরিচিত নই। সেদিন তোমার কথা শুনে আমার দিন-রাত কোথা থেকে শুরু হচ্ছে আর কোথায় গিয়ে শেষ হচ্ছে আমি তা বুঝতে পারছি না। আমি যা বুঝেছি তার একটাই মানে- “আমি তোমাকে চাই, তোমার মত করে চাই” বিলিভ মি, আমাকে কোনো মেয়ে আর স্পর্শ করে না। নীলা নামক মেয়েটা আমাকে অসহায় করে ফেলেছে…

নীলা সব কথা চুপচাপ শুনছিল… বলল- আবির ভাই আপনার এখন এই কথাগুলো মনে হচ্ছে কারণ প্রথমবার কোনো মেয়ে আপনাকে রিজেক্ট করেছে আর সেটা আপনি মেনে নিতে পারছেন না। এটাকে কখনোই কোনো বিশেষ অনুভূতির নাম দেয়া যায় না। “নীলা” নামক মোহে পড়েছেন আপনি, এছাড়া কিছুই না। আমার ক্রমাগত করা সরাসরি উপেক্ষাটাকে আপনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছেন। আমি যখনই আপনাকে “হ্যাঁ” বলব আপনি ঠিক তখনই আপনার স্ব-মূর্তিতে চলে আসবেন। আর এক সপ্তাহ অনেক অল্প সময়। এক সপ্তাহে কোন মেয়ের সাথে যোগাযোগ করেননি বলে সেটা স্থায়ী হয়ে গেছে বলে ভাববেন না। আমি কী বলতে চাইছি নিশ্চই বুঝতে পারছেন?

নীলার কথায় আবির অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইল… তারপর বলল- এটাই কী তোমার শেষ কথা?

-হ্যাঁ।

-আর একবার ভেবে দেখো?

-ভাবার মত এখানে কিছুই নেই আবির ভাই। যা বলার আমি বলেই দিয়েছি।

-যা দেখতে স্বাভাবিক তুমি তাই বলেছ। কিন্তু জানো তো “ব্যাতিক্রম” বলেও একটা কথা আছে। আমি তোমাকে আর কিছু বলতে চাই না, কারণ তুমি হয়ত এখন এসব কিছুই বুঝবে না। মনে রেখো তুমি যা বুঝলে ভুল বুঝলে। সময়ের অপেক্ষায় থাকো, “Time will say.” বলে আর দেরি না করে আবির উঠে চলে যায়।

-আবিরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল নীলা। যেমন দুম করে এসেছিল তেমনি ঝোড়ো হাওয়ার বেগে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। আবিরের বলা শেষ কথাগুলো ওর কানে বাজতে লাগল… ছেলেটার আচরণ আজ সত্যিই অন্যরকম… এমন আবিরকে তো নীলা চেনে না! হলোটা কী ওর? সত্যিই কী তবে সে বদলে গেল?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here