কলঙ্কিত।চাঁদ #পর্বসংখ্যা ২ #ফাতেমা আক্তার মাইশা

0
33

#কলঙ্কিত।চাঁদ
#পর্বসংখ্যা ২
#ফাতেমা আক্তার মাইশা

চন্দ্রের যখন জ্ঞান ফিরে দেখল জাবেদা ওর পাশে বসে আছে। পাশে না ওর ঠিক সামনে, দু হাত দূরে ওর দিকে তাকিয়ে। ফুফুকে দেখে চন্দ্র কোনোরকম উঠে বসে। কতক্ষণ এভাবে পড়েছিল? ফুফু কই ছিল? বাবাকে কিছু বলে দেয়নি তো?

চন্দ্র ভয়ে ভয়ে কোনোরকম বলল,
– আব্বারে কিছু জানাও নাই তো?

চন্দ্রের ভীত স্বর। বাবা জানলে তার চাঁদের টুকরো মেয়েকে ঘৃণার চোখে দেখবে। সেই ভয় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে মেয়েটাকে।
জাবেদা চন্দ্রের ভীতু মুখশ্রী দেখেও কোনো জবাব দিল না। উঠে যেতে নিলে সহসাই চন্দ্র ওনার পা আঁকড়ে ধরে।

– তোমার পায়ে পড়ি ফুফু। আব্বারে কিছু জানায়ও না।আব্বা এসব সহ্য করতে পারব না। আল্লাহর দোহাই লাগে আব্বাকে কিছু বইল না।

চন্দ্র সব গুলিয়ে ফেলছে। কী থেকে কী বলছে নিজেই যেন জানে না। তার বাবার কানে এসব গেলে চন্দ্র নিশ্চয় কথা বলার অবস্থায় থাকত না। সেই কথা কী চন্দ্র জানে? না কি ভুলে গিয়েছে?

জাবেদা রা করল না। চন্দ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে কিড়বিড়িয়ে বলল,
– পেটে বাচ্চা আহে নাই তো?

এহেন কথার জবাবে চন্দ্র কিছু বলে না। পেটে বাচ্চা আসবে কেমন করে। বাচ্চা না আসার জন্য কত পন্থা অবলম্বন করা যায়। সে পন্থা তাকেও অবলম্বন করতে হয়েছে। তাহলে বাচ্চা কীভাবে আসবে।
চন্দ্রকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে জাবেদা কিছুটা শান্ত হলো। এখন মাথা গরম করলে চলবে না। যা হয়েছে তা তো আর বদলাতে পারবে না। এখন উচিত শান্ত মেজাজে সব সামাল দেওয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– যা হওয়ার হয়ছে। পোলারে কো ওর বাপরে দিয়া তোর বাইত প্রস্তাব পাঠাইত।

– ওর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে।

চন্দ্রের কণ্ঠ স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক শোনায়। এ কণ্ঠে অসহায়ত্বের ধাঁচ নেই, না কোনোরকম কাঁপল। শুধু কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল। খাপছাড়া, বেমানান যাকে বলে।

– বিয়া ঠিক কইরা রাখছে মানে? ঐ পোলা তোর কথা ওর বাপ মারে কয়সেনি? না কি তোর কথা জানায়ও নাই?

জাবেদার কণ্ঠে বিষ্ময়।

– জানিয়েছে। ওর পরিবারের কেউ আমাকে মেনে নিবে না। তাদের ঠিক করা মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিবে। অন্য কারো সাথে দিবে না, আমার সাথে তো আরও না।

– মানবো না মানে? কয়লেই হইল? বাপ মা মানবো না আগে জানত না। এহন জানছে সবকিছু করার পর। সব জাইনাও তুই ঐ পোলার কথায় ওর লগে…
তোর মাথা ঠিক আছে নাকি মাথাডাও গেছে। কেমনে করলি এসব। কইলজ্যাত ডর লাগে নাই। এক পোলার লাইগা ভয় ডর সব শেষ। ঐ পোলা তোরে ভালোবাসছে তো? না কি তোর এই শরীরডার লাইগা এতদিন ভালোবাসার নাটক কইরা গেছে? শরীর পাইয়া এখন তোরে ছুঁইড়া ফালাইয়া দিতাছে। আল্লাহ, চন্দ্র! এই ছেড়ি তুই কী অবুঝ না কি? পোলার মতলব বুঝলি না? ঐ পোলা কয়ল আর তুই নিজের এত বড়ো সর্বনাশ কইরা ফালাইলি।

জাবেদা বিলাপ শুরু করে। চন্দ্রের কানে এসব গেলেও সে উত্তর দিল না। এ কথার কোনো উত্তর নেই যে। এ প্রসঙ্গের কোনো কথার জবাব তার কাছে নেই। থাকলেও সে দিবে না। মানুষটাকে নিয়ে ভালো মন্দ কোনো কথায় বলতে চায় না চন্দ্র।

ঐ মানুষটা তাকে ঠকাতে পারে না, অসম্ভব! মানুষটার চোখের দিকে তাকালে যে তার জন্য ভালোবাসা দেখতে পায়, অবিচ্ছেদ্য মায়া দেখতে পায়। সে মানুষটা কি করে তাকে ঠকাতে পারে। মানুষটার আগাগোড়া সবটাই চিনে চন্দ্র। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে চন্দ্র মিশে গিয়েছে। না চেনার কোনো কারণ নেই। তার চোখের দিকে তাকালে যেন চন্দ্র সব কথা বুঝে যায়। চোখ কখনো মিথ্যে বলে না। ঐ চোখ চন্দ্রকে জানান দেয় সে তাকে কতটা ভালোবাসে, কতটা মায়া করে ভালোবাসে। নিশ্চয় পরিবারের কাছে দায়বদ্ধতার কারণে তাকে আপন করে নিচ্ছে না। নয়তো কী তাকে কোনোদিন ছেড়ে যেত? সে তো বলেছিল চন্দ্রকে সে ছাড়বে না। বাধ্য হয়ে চন্দ্রকে ছেড়েছে, বাধ্য হয়ে। আর মানুষটারই বা দোষ কী? সম্পর্কের শুরুতেই তো বলেছিল, পরিবার না মানলে তাকে বিয়ে করতে পারবে না। এ সম্পর্কের কোনো নাম দিতে পারবে না। মানুষটা তাকে ভালোবাসে। নিতান্তই পরিবারের চাপে পড়ে তাকে ত্যাগ করছে। মানুষটা তো তাকে বলেছিল, তাকে বা পরিবারের কাউকে ছাড়া সে ভালো থাকবে না। তার ভালোবাসায় কোনো লালসা নেই। আছে শুধু শুদ্ধতা। তাকে শরীরের জন্য ভালোবাসেনি।

ফুফু মিথ্যে বলছে নিশ্চয়। চন্দ্র কোনো কথা বলল না। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। জাবেদা চন্দ্রের এড়িয়ে যাওয়া দেখেও কিছু বলল না। যে বুঝেও না বুঝার ভান ধরে, তাকে বোঝানো কারো কাম্য নয়। খুব তাড়াতাড়ি চন্দ্রের ভুল ভাঙবে তিনি জানেন। যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, যার ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে দিল, সে চন্দ্রের মন ভাঙার কারণ হবে। তখন চন্দ্র কী করবে? তখনও কী এভাবে স্বাভাবিক থাকবে? এড়িয়ে যাবে সবকিছু? কী করবে চন্দ্র? মানতে পারবে তো সবটা?

চন্দ্র টেবিল থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি নিয়ে খেয়ে নিল। তার এখন ঘুম দরকার। একটু ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। কী আশ্চর্য! আজ চন্দ্রের চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। কতক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ছটফট করল। না, ঘুম আসছে না। ঘুম আসবে বলেও মনে হয় না।

কী অদ্ভুত তার কান্নাও আসছে না। সে কী অতি শোকে পাথর হয়ে গেল নাকি! মার খাওয়ার পর অন্তত তার চোখে পানি আসা উচিত ছিল। তাও আসেনি, এখনও আসছে না। এখন তো সে একা আছে। অন্য কেউ চোখের পানি দেখে নিবে এমন ভয় নেই। তাহলে?

চন্দ্রের অন্ধকার ভালো লাগে। দিন হোক বা রাত চন্দ্র দরজা, জানালা আটকে সারা ঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখে। তবে আজ যেন এ অন্ধকার চন্দ্রের ভালো লাগছে না। চন্দ্র চুপচাপ বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। সারা ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। চন্দ্র কতক্ষণ চোখ মেলে চেয়ে রইল। কিন্তু অন্ধকারে ছিটেফোঁটাও দেখার জো নেই। টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে যা একটু আলো আসছে। চন্দ্র উঠে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দিতে আকাশে ঝলমল করতে থাকা চাঁদের পানে নজর গেল। চাঁদের আলো এসে চন্দ্রের মুখবিবরে পড়ছে। কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। জোৎস্না রাতের আঁধারে মেঘে ঢাকা চাঁদটা যেমন লাগে চন্দ্রকেও তেমন লাগছে। চন্দ্র খানিকক্ষণ চেয়ে গুনগুনিয়ে গান ধরল।
আমি নিঃস্ব হয়ে যাব জানো না,
যখন তোমাকেই পাব না!

– মাইশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here