কলঙ্কিত‌ চাঁদ #পর্বসংখ্যা ৪ #ফাতেমা আক্তার মাইশা

0
29

#কলঙ্কিত‌ চাঁদ
#পর্বসংখ্যা ৪
#ফাতেমা আক্তার মাইশা

তিন ভাইবোনের মধ্যে চন্দ্র সবার বড়ো। চন্দ্র ছোটো থেকে বাধ্যগত সন্তান। কখনো বাবা মায়ের অবাধ্য হয়নি। বাবা মা যা বলেছে, চন্দ্র তাই করেছে। বাবার বড্ড আদরের। মায়ের সাথে খুব একটা ভাব নেই চন্দ্রের। সে তো বাপ পাগল। সে যখন ছোটো ছিল তার বাবা দেশের বাইরে থাকত। ছোটো চন্দ্র তখন দৌড়াতে শিখে গিয়েছে। বাবার ছবি হাতে নিয়ে সারা বাড়ি দৌড়াত আর চুমু খেত। ছোটো থেকে বাবাকে কাছে না পেয়েও কেন যে এত বাবার পাগল, মায়ের পাগল কেন হলো না? মা যে সর্বদা তার পাশে থেকেছে। মেয়েরা বুঝি বাবা পাগল হয়। তবে চন্দ্র যেন একটু বেশিই।

চন্দ্রকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি সব থেকে বেশি কাকে ভালোবাসো? চন্দ্র তখন নির্দ্বিধায় বলে দেবে সে তার বাবাকে ভালোবাসে। তাকে উত্তর দেওয়ার জন্য দু সেকেন্ডও ভাবতে হবে না। মা বাবাকে সমান ভালোবাসে না সে। বাবার প্রতি ভালোবাসা যেন সকল কিছুর উর্ধ্বে। তবে কী মাকে ভালোবাসে না? মাকে যে ভালোবাসে না ব্যাপারটা তেমন না। মাকেও ভালোবাসে। তবে বাবার প্রতি ভালোবাসাটা যেন একটু বেশি।

এত ভালোবাসলে কী হবে? একটা জায়গায় চন্দ্র ভীষণভাবে ব্যর্থ। সবার প্রতি নিজের অনুভূতি প্রকাশে সক্ষম হলেও বাবা মায়ের প্রতি তার অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ।
তাদের প্রতি ভালোবাসাটা জাহির করার ক্ষমতা হয়তো বা কখনো হবে না। এই যে এত ভালোবাসে তবুও কখনোই হয়তো জড়িয়ে ধরে বলতে পারবে না সে তাদের ভীষণ ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার প্রতিও চন্দ্র ভালোবাসা জাহির করতে পারে। কিন্তু তাদের বেলায় চন্দ্র যেন বাকহারা হয়ে যায়। এ যেন তার এক ব্যর্থতা। তবে এই ব্যর্থতা চন্দ্রকে আনন্দ দেয়।
অপ্রকাশিত কিছু অনুভূতি সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর!

_

চন্দ্রের জন্মের পর থেকে সে বাবাকে কাছে পায়নি। পাবে কী করে? তখন তার বাবার থাকা হতো সৌদি আরবে। মেয়ে হওয়ার খুশিতে চন্দ্রের বাবা দেশে এসেছিল বার কয়েক। তার প্রথম সন্তান বলে কথা। আর সে কিনা বহু দূরে। চাইলেই মেয়েকে দেখতে ছুটে আসতে পারে না। বাবার মন কী মানে? মন চায় মেয়ের কাছে ছুটে আসতে। তবে এত দূরত্ব ঘুচিয়ে কী করে আসবে?

চন্দ্রের বাপ চাচা তিন ভাই, জাবেদা তাদের একমাত্র বোন।
মায়ের পেটের বোন না হলেও সর্বদা জাবেদাকে তারা আপন বোন বলে মেনে এসেছে, জাবেদাও তেমন।

এখন আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও এককালে অভাব অনটনে সংসার চলত তাদের। কত না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে সে হিসেব নেই। চন্দ্রের বাবা পরিবারের বড়ো সন্তান। সেই সুবাদে অভাবের তোপে তাকেই বেশি পড়তে হয়েছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে মাঠে লেগে পড়েছে। পড়ালেখায় ছিল অত্যন্ত মেধাবী। এমন ছেলে শুধুমাত্র অভাবের তাড়নায় নিজের মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে না তা কী হয়। তাই মামারা তার দায়িত্ব নেয়। তারপর ঠাঁই হলো মামা বাড়িতে। মামারা আদর আহ্লাদে রাখলেও মামিরা খুব একটা চোখের দেখা দেখতে পারতেন না। তিনি তা বুঝেও পড়ে রইলেন। যদি পড়ালেখাটা শেষ পর্যন্ত করতে পারে সে আশায়।

আশায় বাঁধে বাসা! তাই তো আশা বেঁধে পড়েছিল। তবে লাভের লাভ হলো না। খুব বেশি পড়তে পারেনি। সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে কোনোক্রমে উচ্চ মাধ্যমিক অবধি পড়তে পেরেছে। তারপর আর পড়া হয়নি। তবে তখনকার আমলের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা যেন এখনকার স্নাতকোত্তরের সমান।

চন্দ্রের বাবা মায়ের প্রেমের বিয়ে। যদিও চন্দ্র তা লোকমুখে শুনেছে। তবে কথাটা খুব একটা মিথ্যা না। চন্দ্রের মামার বাড়ি আর তার বাবার মামার বাড়ি একই স্থানে। খুব একটা দূরত্ব নেই মাঝে, পাশাপাশি দুটো দালান। কলেজ জীবন থেকে তাদের প্রণয়। রাতের আঁধারে দুজন লুকিয়ে চুকিয়ে কত প্রেম করেছে। সেসব কথাও চন্দ্রের অজানা নয়। তার বাবা তার মায়ের জন্য কবিতাও লিখত। চন্দ্র লুকিয়ে বাবার ডায়েরিটাও পড়ে নিয়েছে। কত শত কবিতা, কত শত অনুভূতি লেখা সেথায়।

কন্যা সন্তান নাকি কল্যাণ বয়ে আনে! অথচ চন্দ্রের মনে হয় সে শুধু অভিশাপ নিয়ে এসেছে!

_

চন্দ্রের জন্মের পর ওর বাবার আয় রোজগারের পথ ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগল। ঠিকমতো কাজ পায় না। শরীর মন আর কোলায় না। স্ত্রী, সন্তান ফেলে ভিন দেশে পড়ে থাকতে মন সায় দেয় না যেন। শেষমেশ দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। ফিরে আসবে নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে, তার ছোট্ট চাঁদের কাছে। তবে টাকার এতটাই ঘাটতি পড়েছে যে দেশে ফিরতে হলে জেল খাটতে হবে। ভাইদের কাছে যখন সাহায্য চাইল তাদের হাতেও নাকি টাকা নেই। অথচ সকলে তখন প্রতিষ্ঠিত। বড়ো ভাইয়ের অবদান তারা ভুলে গেল যেন। তার বিপদে হাত গুটিয়ে বসে রইল সকলে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল না কেউ। অবশেষে লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেরার তাড়নায় জেল খাটতে বাধ্য হয়।

_

হাতে কোনো টাকা কড়ি নেই। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। সে তো এখন আর একা না। তার উপর বউ, বাচ্চার দায়িত্ব আছে। চাকরির খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমায়। বাড়িতে রেখে গেল বউ, বাচ্চা। তবে শান্তি মিলল না। মা, বউয়ের নিত্যদিনের কলহ তাকে শান্তি দিল না। একদিকে মা, অন্যদিকে নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী।

চার হাজার বেতনে একপ্রকার বাধ্য হয়ে স্ত্রী, সন্তানদের নিজের কাছে নিয়ে যায়। চন্দ্রের তখন নয় বছর। পাঁচ জন সদস্যের খরচ, ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। মাস শেষে টানাপোড়ন লাগলে লোকজনের থেকে ধার দেনা করে কোনোরকম দিন পার করত।

চন্দ্রের বাবার রোজগার আগের তুলনায় বেড়েছে।
গার্মেন্টসে ইনচার্জ পদে নিয়োগ হয়েছে। বেতন দশেক ত্রিশ।

চন্দ্রের বাকি দুই ভাইবোনের থেকে চন্দ্র সবদিক দিয়ে এগিয়ে। পড়ালেখায় তুখোড় মেধাবী। একদম বাবার মতো। বাবার সবটা যেন পেয়েছে সে। ক্লাসের সকলের সাথে টক্কর দিয়ে প্রতিবারই প্রথম স্থান অধিকার করে। যেন তেন নয় বেশ নামকরা প্রতিষ্ঠান। ভালো ঘরের ছেলেমেয়ে পড়ে সেথায়। তাদের সাথে টক্কর দিয়ে প্রতিবার প্রথম হওয়া সহজ কথা না।
পিএসসি, জেএসসি দুটো পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেল। চন্দ্রের বাবা তো খুশি হয়ে অফিসে তার অধীনে থাকা পুরো ফ্লোরে মিষ্টি বিলিয়েছে। আত্মীয় স্বজন এমন কাউকে বাদ রাখেনি নিজের মেয়ের পরীক্ষার খবর জানাতে। মেয়ের জন্য খুশিতে চোখে পানি আসে। টাকার অভাবে যে স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পারেননি, তার দৃঢ় বিশ্বাস তার চন্দ্র সে স্বপ্ন পূরণ করবে।

_

চাকরি ছেড়ে দেওয়াটাই যেন চন্দ্রের বাবার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা ফায় ফরমাশ খাটতে খাটতে তিনি ক্লান্ত। তবুও দিন শেষে কথা শোনাতে ছাড়ে না উপর মহল। শরীরটা আগের মতো চলে না, চোখেও কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই ভাবলেন অন্যের কটূ কথা না শুনে নিজের ব্যবসা দাঁড় করাবেন। ভাবনা অনুযায়ী কাজে লেগে পড়লেন। তবে হাতে পুঁজি ছিল না একদমই।
হাল ছাড়ে না, ব্যাংক থেকে লোন নেয়। প্রথম প্রথম ভালো চললেও শেষ দিকে বুঝল কত বড়ো ভুল করে বসে আছে। এ ভুলের খেসারত তাকে আজীবন টানতে হবে।

ব্যবসা দাঁড় করানোর পর মারাত্মক ধসের মুখে পড়তে হয়। এত লোকসান সামাল দেওয়াটা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে তার স্ত্রী চতুর্থবারের মতো সন্তান সম্ভাবা হলো। চন্দ্র যখন জানল খুব একটা খুশি হয়নি। তার কারণও আছে বটে। লোক সমাজের কথা ভেবে সে কিছুটা দেনামোনায় পড়েছিল। লোকে কী বলবে? তার মা এ বয়সে এসে মা হয়েছে। যার কিনা ইতোমধ্যে তিন তিনটা বুঝদার সন্তান রয়েছে। এটা তো আর গ্রাম নয় যে কেউ কিছু বলবে না। শহরের লোকজন এসব বিষয়গুলো খুব একটা ভালো চোখে দেখে না।

ফুটফুটে আরেক চন্দ্র এলো। এ যেন জান্নাতের হুর, চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য তার। চন্দ্র এমন রূপ খুব কম দেখেছে। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তার থেকেও হাজার গুণ এগিয়ে।
তবে সে সুস্থ নয়। মাথার পিছনে কিছুটা ক্রুটি। ডাক্তার জানিয়েছে বেশি দিন বাঁচবে না। খুব বেশি হলে এক মাস।

বোনকে পেয়ে যেন চন্দ্রের সব দোটানা কেটে গেল। লোকে যা বলার বলুক। তাতে তার কিছু যাই আসবে না। তবে ছোট্ট বাচ্চাটাকে যখন কোলে নিতে পারত না, চন্দ্রের তখন বুক ফেটে কান্না আসত। চন্দ্রের আঙুল ছোটো ছোটো আঙুল দিয়ে মুঠোয় পুরে রাখে। কেউ কাছে না থাকলে মুহূর্তে কান্না জুড়ে দেয়। সে কী কান্না তার! কিছু খেতে পারত না, ক্ষণে ক্ষণে শরীর খিঁচিয়ে ওঠে। চন্দ্রসহ সকলে ভয় পেয়ে যেত তা দেখে। বোনের কষ্ট সহ্য হতো না চন্দ্রের। কোলে নিতে না পারার কষ্টটা চন্দ্রের সারা জীবনের আক্ষেপ হয়ে রয়ে যাবে।

চব্বিশ দিনের মাথায় দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। চন্দ্রের মনে হলো এ বুঝি তার শাস্তি। ঐ যে সে প্রথমে খুশি হয়নি। এ জন্যই বুঝি বাচ্চাটা অভিমান করে দূরে চলে গেল। অভিমান শেষ হলেই নিশ্চয় ফিরে আসবে। তবে চন্দ্রকে ভুল প্রমাণ করে সে আর ফিরে এলো না। শাস্তি দিল চন্দ্রকে। তার ভুলের চরম শাস্তি। বাবাকে সেদিন প্রথম কাঁদতে দেখেছিল চন্দ্র। ছোটো শরীরটাকে কোলে নিয়ে তার বাবা কী অঝোরেই না কাঁদছিল। চন্দ্র শুধু সেদিন বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল।

মেয়েটা মারা গেল চন্দ্রের মা দেখতেও পেল না। প্রচণ্ড বুক ব্যথায় হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিল আগের দিন সন্ধ্যায়। পরেরদিন ভোরে ছোটো বাচ্চাটা সবাইকে ছেড়ে চলে যায়, মুক্ত করে দেয় সবাইকে। চন্দ্রের মা শেষ দেখাও দেখতে পারল না।
শেষ সময়টাই চাইলে চন্দ্র বাবার কোলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা দেহটাকে কোলে নিতে পারত। তবে সে নিল না। হয়তো কিছুটা অভিমানে। নয়তো কারণটা চন্দ্রের জানা নেই।

– মাইশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here