কলঙ্কিত চাঁদ #পর্বসংখ্যা ৫ #ফাতেমা আক্তার মাইশা

0
33

#কলঙ্কিত চাঁদ
#পর্বসংখ্যা ৫
#ফাতেমা আক্তার মাইশা

ব্যবসায় এতটাই লস হলো যে পুরো পরিবারকে আবার গ্রামে পাঠাতে হয়। চন্দ্র তখন মাধ্যমিক দিবে। তাকেও সকলের সাথে বাড়ি ফিরতে হলো।

টেস্টের জন্য চন্দ্রকে আবার শহরে যেতে হয়। থাকা নিয়ে খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি। খালার বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। সেখান থেকে টেস্ট পরীক্ষা দিবে সে। কিছুদিন থাকার পর চন্দ্র আপন মানুষগুলোর আসল চেহারা বুঝতে পারে। তারা অসন্তোষ চন্দ্রের থাকাতে। তার খালা তো সরাসরি বলেই দিল, দেখ চন্দ্র তুই তো জানিস তোর খালু কেমন। তোর এখানে থাকাটা খুব একটা পছন্দ করছে না। আর তাছাড়া একটা বাড়তি মানুষের খরচ চালানোটাও মুখের কথা না। তোর যেহেতু পরীক্ষা শেষ তুই এখন বাড়ি চলে যা। পরীক্ষার সময় না হয় আবার চলে আসবি।

চন্দ্র দ্বিমত করল না। চলে এলো তার বাড়ি। পরীক্ষার সময়টাতে একবার এ খালার বাড়ি তো আরেকবার ছোটো খালার বাড়ি গিয়ে থাকতে হলো। তার খালার মতে যেহেতু তার বাকি ভাইবোন পাশাপাশি এলাকায় থাকে, তবে চন্দ্রের দায়িত্ব সে একা কেন নিবে। দৌড়াদৌড়ি করে চন্দ্র হাঁপিয়ে যেত। এ সময় একেবারে ফ্রেশ মাইন্ড এ থাকতে হয়। আর তাকে কিনা দৌড়ের উপর থাকতে হচ্ছে। শেষে না পেরে চন্দ্র তার বাবার কাছে গিয়ে উঠল।

ছোটো একটা রুম। তাতে কোনো খাট নেই। মেঝেতে তোষক বিছিয়ে তাতেই রাত কাটাতে হতো। পরীক্ষা দিয়ে এসে চন্দ্র ড্রেস পাল্টানোর সময় অবধি পেত না। রান্নার জন্য ছুটতে হতো তাকে। বাবার জন্য রাঁধতে হবে যে। এমনিতেও চন্দ্রের পরীক্ষা শেষ হতো একটায়। রাঁধতে রাঁধতে দুটোর উপর বেজে যেত। কখনো কখনো বা রান্না শেষ করে খেতে খেতে তিনটা, চারটা। সব কাজ সামলে ঠিকমতো পড়ার সময়টুকু বের করতে পারত না। চন্দ্র কেমন একটু একটু করে ভেঙে পড়তে লাগে, পড়াশোনায়ও হয়ে উঠে অমনোযোগী।

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলই চন্দ্রের বাবাকে বুঝিয়ে দেয় চন্দ্র তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। যে মেয়ে সবসময় প্রথম স্থান দখল করে সে কিনা পেল ৪.৩৩। যদিও পয়েন্টে কিছু এসে যাবে না। তবুও মেয়ের অবনতি তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করছেন। মেয়ের তার আগের মতো পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। কেমন যেন খাম খেয়ালিপনায় মেতেছে।

_

মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে চন্দ্র সে বছর গ্রামে ফিরে এলো।‌করোনার প্রকোপে তখন স্কুল, কলেজ সব বন্ধ। সারা দেশে লক ডাউন করার কার্যকারিতা জারি করা হয়েছে। চন্দ্র তখন বসে বসে অবসর সময় কাটাত। গ্রামে ওর মন টিকে না। ও যে শহরের আলো ছায়ায় বেড়ে উঠেছে। জীবনের নয়টা বছর শহরে কাটিয়ে এসেছে। গ্রামে খুব একটা থাকা হয়নি। ঈদের ছুটিতে মাঝেমধ্যে শখের বশে বাবার সাথে গ্রামে বেড়াতে আসা হতো, তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য। দুই-তিন দিন থেকে আবার শহরে চলে যেত। এখন একেবারের জন্য গ্রামে এসে চন্দ্র নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। তবে কিছু করার নেই। না চাওয়া সত্ত্বেও যে তাকে এখানেই থাকতে হবে।

চন্দ্রের নানা বাড়িতে কেউ থাকে না। ওর মামারা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। নিজেদের বাড়ি আছে সেখানে, তারা শহরেই থাকে। চন্দ্রের নানি মারা গিয়েছে বছর দুয়েক আগে।
গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই বললেই চলে। বাড়িটা খালি পড়ে রয়েছে। যেহেতু শাশুড়ির সাথে বনিবনা হয় না তাই চন্দ্রের মা নিজের বাবার বাড়িতে থাকার কথা জানালেন। তাতে কেউ আপত্তি করেনি। খালি পড়ে থাকার চেয়ে এখানে কেউ থাকলে ভালো। তাছাড়া বাড়িতে কেউ না থাকায় গ্রামে এলে এর ওর বাড়ি থাকতে হয়। নিজের বোন থাকলে যখন তখন এসে থাকা যাবে। অন্যের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে না।

বাড়িতে কেউ না থাকায় বাড়ির পরিবেশ খুব একটা ভালো না। ইটের তৈরি দুটো ঘর, মেঝেটা মাটির, টিনের চাল। চন্দ্র হওয়ার পর তার নানা খুব শখ করে এ বাড়ি বানিয়েছিল। প্রায় ষোলো/সতেরো বছর আগের বাড়ি। খুব একটা নিখুঁতভাবে বানানো হয়নি। তখন বুদ্ধি করে মেঝেটা পাকা করে নিলে ভালো হতো। তাহলে এখন এত ঝামেলা পোহাতে হতো না। মাসে একবার হলেও কাদা, মাটি দিয়ে ঘরের মেঝে লেপতে হয়। গোসলখানাটাও খুব একটা সুবিধার না, একদম খোলামেলা। এই তো ডানে বামে, পিছন দিকে টিন, সামনে কাপড় টেনে পর্দার মতো দেওয়া। হুট করে এমন পরিস্থিতিতে চন্দ্র বড্ড বিপাকে পড়ল। নিজেকে এমন পরিবেশে মানানোর চেষ্টা করেও মানাতে পারে না।

মাস ছয়েক বাদে চন্দ্রের বাবাও গ্রামে চলে আসে। ব্যবসা একদম ধসের মুখে। এখান থেকে দাঁড়ানো আর সম্ভব না। তাই সব বাদ দিয়ে তিনিও চলে এসেছেন।

_

কলেজ খোলার পরদিন চন্দ্র প্রথম মানুষটার দেখা পেয়েছিল। আর প্রথম দেখায় নিজের মন দিয়ে বসে।
সে দুপুরটা চন্দ্রের বেশ মনে আছে, ভুলে যাওয়ার মতো নয় সে দুপুর। ভালোই তো চলছিল। তবে মানুষটা কেন এমন অচেনা হয়ে গেল। চেনা মানুষগুলো বুঝি এভাবে অচেনা হয়ে যায়। চন্দ্র চিনে না এ মানুষটাকে, এ মানুষটা যে তার নয়। এ মানুষটা তার হতেই পারে না। পুরো ভিন্ন অচেনা এক পুরুষ। সে চন্দ্রের প্রেমিক পুরুষ নয়। তবুও যে এ মানুষটাকে চন্দ্রের পেতেই হবে। চন্দ্র অনেক সাহস জুগিয়ে নিজের পছন্দের কথা মাকে বলে দিল। চন্দ্র ভেবেছিল তার মা হয়তো রাগ দেখিয়ে না করে দিবে বা চন্দ্রকে ভুল বুঝবে। কিন্তু এমন কিছুই করেনি। বরং বলেছিল, ছেলের পরিবারকে আসতে বলো।

এত সহজে মেনে নিবে চন্দ্র কল্পনাও করেনি। অবশ্য চন্দ্রের বাবা মা চন্দ্রকে সবসময় স্বাধীনতা দিয়ে এসেছে। কখনো নিয়মের বেড়াজালে মেয়েকে আটকে রাখেনি। সর্বদা চেষ্টা করেছে নিজেদের সিদ্ধান্ত মেয়ের উপর চাপিয়ে না দেওয়ার। তবে বাকি সব বিষয়ের মতো এ বিষয়টা তো এক নয়। বাবা মা হিসেবে তাদেরও একটা পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার আছে।
চন্দ্র তো ভেবেছিল মা বাবাকে রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। তবে তার কিছুই করতে হয়নি।চন্দ্রের এক কথায় তারা রাজি হয়ে গিয়েছিল। তাদের মতে মেয়ে ভালো থাকলেই হলো। তাই আর দ্বিমত করেনি।
চন্দ্রের মনে হলো আর কোনো বাধাই রইল না। এবার বোধ হয় মানুষটা তার হয়েই যাবে। একেবারে তার নিজের। নিজস্ব প্রেমিক পুরুষ। না, চন্দ্রের ব্যক্তিগত পুরুষ। একান্তই চন্দ্রের।

_

আসবে, আসবে বলেও এলো না। বলল তার ভাইয়ের নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যেহেতু বাবা দেশের বাহিরে থাকে সেহেতু বড়ো ভাই তার একমাত্র অভিভাবক। ভাইয়ের পছন্দ হলেই সে চন্দ্রকে তার ঘরে তুলবে। নয়তো না।
অজুহাত, অজুহাত দিল। চন্দ্র তবুও বুঝল না। বোকা চন্দ্র। প্রেমে পড়লে বুঝি এভাবে বোধবুদ্ধি লোভ পায়। ঠিক ভুল বুঝে উঠতে পারে না। নাকি বুঝেও অবুঝের ন্যায় চলতে থাকে মানুষটাকে পাওয়ার লোভে। চন্দ্র খানিকটা রেগে গেল। মানুষটাকে বলল, তার পরিবার নিয়ে যেন শুক্রবার এসে চন্দ্রকে দেখে যায়। চন্দ্র কত দেনামোনা করে মাকে সব জানিয়েছে। এও বলেছে যে তারা শুক্রবার আসবে তাকে দেখতে। এখন কোন মুখে বলবে ওরা আসতে পারবে না। কাজ আছে তাদের, ব্যস্ত সময় পার করছে। এসব ঠুনকো অজুহাত তো তার মা বুঝে যাবে। তাই তো অবুঝের ন্যায় মানুষটাকে বলতে লাগল যাতে তারা শুক্রবারে আসে। নয়তো চন্দ্র তার সাথে আর কথা বলবে না। বন্ধ করে দেবে কথা বলা।

অবুঝ চন্দ্রকে বুঝাতে গিয়ে মানুষটা বরাবর ব্যর্থ হলো। তার চন্দ্র তো অবুঝ না। তবে এমন অবুঝের ন্যায় আচরণ কেন।
তাকে নিজের করে পাওয়ার আশায়? না কি হারিয়ে ফেলার ভয়ে?

শেষে বাধ্য হয়ে চন্দ্রের মায়ের সাথে কথা বলল,
চন্দ্র পাগলামি করছে আন্টি। ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন।
এমন পাগলামি করার কোনো মানে নেই। তাছাড়া আমি ওরকম ছেলে না। বলেছি যেহেতু ঠিক আসব। ওকে পাগলামি করতে বারণ করেন।

চন্দ্র মায়ের কাছ থেকে এসব শুনে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকা ছাড়া বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। সে নাকি পাগলামি করছে। এসব কথা নির্লজ্জের মতো কেউ কাউকে বলে। মায়ের জায়গায় অন্য কেউ হলে চন্দ্র এতটা বিব্রত হতো না। মায়ের কাছে কীভাবে বলল এসব। সব দোষ চন্দ্রের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা। অথচ বিয়ের কথা নিজে তুলে ছিল প্রথমে। চন্দ্র বলেছিল এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু সে শুনল না। তার জন্য নাকি মেয়ে দেখছে। তাই আগে চন্দ্রের পরিবারকে জানিয়ে তারপর নিজের পরিবার নিয়ে আসবে। সেজন্য চন্দ্র সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে নিজের পছন্দের কথা মাকে জানিয়ে দেয়। এবার শুধু মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার পালা।

– মাইশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here