কলঙ্কিত চাঁদ #পর্বসংখ্যা ৮ #ফাতেমা আক্তার মাইশা

0
21

#কলঙ্কিত চাঁদ
#পর্বসংখ্যা ৮
#ফাতেমা আক্তার মাইশা

কোনো কারণ ছাড়াই চন্দ্র মানুষটার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। তারা ঘটা করে সম্পর্ক শেষ করেনি। এমনকি এত কিছু হওয়ার পরও সম্পর্ক থাকাকালীন কোনোকিছু নিয়ে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য পর্যন্ত হয়নি। আর না কেউ কাউকে কোনোরকম দোষারোপ করেছে। চন্দ্র চুপচাপ শুধু মানুষটার জীবন থেকে সরে গিয়েছে এই যা।

চন্দ্র চাইলেই মানুষটার করা নোংরামি সকলের সামনে তুলে ধরতে পারত। শুধু মানুষটার না, তার পরিবারের প্রতিটা মানুষকে অপদস্থ করতে পারে। তারা সকলেই তো চন্দ্রের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে অবগত। অথচ তাদের হাবভাব দেখে মনে হবে যেন কিছুই হয়নি। পরিবারের প্রত্যেকে ব্যস্ত ছেলের করা কুকর্ম আড়াল করতে। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিব্যি লোক সমাজে ভালো মানুষির মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ দেখলে আন্দাজ করতে পারবে না এ মানুষগুলোর আড়ালে থাকা নিকৃষ্ট রূপ।

দিনের পর দিন পার হতে লাগল। চন্দ্রের আর মানুষটার সাথে কথা হয় না। চন্দ্র কেমন যেন হয়ে গেল। সারাক্ষণ ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। সকাল নেই, রাত নেই বিছানায় পড়ে থাকবে। চোখে ঘুম ধরা দেয় না। কদিন বাদে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। অথচ চন্দ্র বই হাতে নিয়ে পর্যন্ত দেখে না। ও তো ভেবেই নিয়েছে আর পড়ালেখা করবে না, বন্ধ করে দিবে সব। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতেও নারাজ। সকলে বুঝিয়েও লাভ হলো না। সে পরীক্ষা দিবে না মানে দিবে না। ওর মনে ভয় ঢুকেছে যে ও এবার পরীক্ষায় নির্ঘাত ফেল করবে। ওর এহেন কথা শুনে সকলে হতবাক। যে মেয়ে সর্বদা ভালো রেজাল্ট করে সে কিনা ভাবছে ফেল করবে। এ ভয়ে পরীক্ষায় দিবে না।

পরীক্ষা দিবে না দিবে না করেও দিয়ে দিল। অবিশ্বাস্য হলেও চন্দ্রের জিপিএ ফাইভ আসে। এত ভালো ফলাফল করেও চন্দ্রের মাঝে কোনো ভাবাবেগ হলো না।

চন্দ্র ধীরে ধীরে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। তার নিজের একটা দুনিয়া হলো, ভিন্ন এক দুনিয়া। যেখানে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। তবে আগে তার দুনিয়া জুড়ে একটা মানুষেরই অস্তিত্ব ছিল। বাইরে থেকে তার হাবভাব বুঝার উপায় নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে। একদম স্বাভাবিক। সময়মতো খাচ্ছে দাচ্ছে সবকিছু করছে। নিয়মের বাইরে কিছু করছে বলতে গেলে শুধু ঘুমটা। আজকাল সব ছেড়ে ছুড়ে বিছানায় পড়ে থাকে। যেন বিছানায় তার একমাত্র সঙ্গী। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকলে কী হবে? চন্দ্রের চোখে ঘুম আসে না। কত চেষ্টা করে ঘুমানোর। কিন্তু ঘুম যেন ভেবে নিয়েছে সে চন্দ্রের চোখে ধরা দিবে না।

_

মাস কয়েক বাদে চন্দ্র খবর পেল মানুষটা তার বিয়ে করে নিয়েছে। তাতেও চন্দ্রের কোনো ভাবান্তর হয়নি। স্বাভাবিক ছিল সে। যেমনটা এ কয়েক মাস ছিল। তার কাজকর্মে তেমন কোনো পরিবর্তন এলো না। মানুষটা একেবারের জন্য অন্য কারো হয়ে গেল। চন্দ্র চাইলেও তাকে আর পাবে না।
মানুষটাকে হারানোর যন্ত্রণায় চন্দ্রের তো অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার কথা। তবে তার চোখ ভিজে এলো না কেন?
_

চন্দ্রের বাবা এখন আর দেশে নেই। আবার দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। কিছু একটা করার আশায়। এভাবে তো আর চলা যায় না। তার কাঁধে পাহাড় সমান ঋণের বোঝা। অথচ শোধ করার কোনো রাস্তা নেই। ঘরে আয় রোজগার করার মতো একমাত্র মানুষ সে। এত এত ঋণ যে তাকেই পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া তার চন্দ্র বড়ো হয়েছে। মেয়ের বিয়েরও তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। মেয়েকে তো আর সারা জীবন ঘরে বসিয়ে রাখতে পারবে না। বাকি দুটো ছেলেমেয়েও যেন চোখের পলকে বড়ো হয়ে গিয়েছে।
মেয়ে দুটো বুঝদার হলেও ছেলেটা একেবারে অবুঝ। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এটা ওটা আবদার করে বসে। না পেলে রাগারাগিও করে। ঘরের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে না একেবারেই।

চন্দ্রের বাবার মনে হলো এত বছরের কর্মজীবনে কিছুই করতে পারেনি। প্রথমে তো ভালোই ছিল, খেয়ে দেয়ে আরামসে জীবন পার করে দিতে পারত। তবে কেন ব্যবসার ভূত মাথায় চাপল। ব্যবসা দিয়েই তো আজ এ অবস্থা।
শেষ বয়সে এসে আবার ভিন দেশে যেতে হচ্ছে। তার দোষেই তো সংসারের এহেন হাল। নিজের আপন ভাইবোনেরা তো সেই কবেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সাহায্যের বালাই পর্যন্ত করে না। ভাইয়ের সংসার কীভাবে চলে সে খেয়াল কারো নেই। অথচ তারাই মাস গেলে লাখের উপর আয় করে। ভাই সাহায্য চাইলেই তাদের যত ছুঁতো। আত্মীয় স্বজন কম নিন্দা করে না। এত বছর বিদেশ করে কী করল?
কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। উপরন্তু ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে বসে আছে। ব্যাংকের ঋণ না দিতে পারলে তারা কী ছেড়ে দিবে? পুরো পরিবার নিয়ে টান লাগাবে। এত এত ঋণ কে দিবে?

চন্দ্র বাবাকে দেখে, বাবার বয়স হয়েছে। যুবক বয়সে কত সুদর্শন ছিল। বয়সের ভারে চেহারায় খুব একটা জৌলুস নেই, আগের মতো আকর্ষণীয়ও লাগে না, চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। তবুও চন্দ্রের চোখে যেন পৃথিবীর সব থেকে সুদর্শন পুরুষ তার বাবা।

_

চন্দ্রের বাবা বাহিরে গেল বছর পার হবে। এই তো গত ফেব্রুয়ারিতে গিয়েছে। আর এখন ডিসেম্বরের শেষ হতে চলল। কতদিন হলো চন্দ্র বাবাকে দেখে না। আজকাল চন্দ্রের কিছুই ভালো লাগে না। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথাও বলে না।

বছর পেরিয়েছে মানুষটার সাথে কথা হয় না। চন্দ্র যেন সেখানেই আটকে। অথচ মানুষটা তাকে ভুলে দিব্যি সংসার করছে। যে সংসারে চন্দ্রের থাকার কথা ছিল সে সংসারে, তার পুরুষটার মনে অন্য নারীর বাস। তার পুরুষ কী করে হলো? সে তো অন্য কারো পুরুষ।

দিন যেতে চন্দ্র অদ্ভুত আচরণ করতে লাগে। অনার্সে ভর্তি হলো। কিন্তু হুট করেই পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। সে পড়বে না মানে পড়বে না। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায় সামনে পরীক্ষা। অথচ একটা বইও কেনা হয়নি। তাছাড়া সপ্তাহে একদিনও ক্লাস করতে পারে না। চার, পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা জার্নি করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। এক বছর না গেলে হোস্টেলেও সিট পাবে না। এত এত কারণ। চন্দ্রের বাবা খুব একটা ঘাটল না। যে কারণে প্রবাসে এলো, তার কিছুই হয়নি। উল্টো আরও ঝামেলা যেন বাড়ছে। ঋণ বাড়ছে, বোঝা বাড়ছে। তার মন মেজাজ এখন চড়াও হয়ে থাকে। মেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিবে শুনেও ভালো মন্দ কিছু বলেনি। অথচ একসময় বলেছিল নিজের রক্ত বেচে হলেও মেয়েকে পড়াবে।

_

আজকাল ঘরে বাইরে সর্বদা চন্দ্রের বিয়ের কথা উঠতে থাকে। পাড়া প্রতিবেশী সকলে যেন চন্দ্রের পিছনে লেগেছে। চন্দ্রের মা এতদিন যাবৎ আসা প্রস্তাব নাকচ করলেও এখন মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি চিন্তায় আছেন। মেয়ের বয়স তো কম হয়নি। একুশে পা দিয়েছে। কয়েক মাস বাদে বাইশে পড়বে। আর তাছাড়া মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। বয়স বাড়লে খুব একটা ভালো সম্বন্ধ আসে না। এতকাল নিজেদের এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে কিছুটা দেনামোনা করে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিত। তার কারণও আছে। বিয়ে তো আর মুখের কথা না যে দিয়ে দিলেই হলো। কত খরচ। তাছাড়া তাদের বাড়িঘরের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার না। জামাই এলে তাকেই বা কই থাকতে দিবে। তারা নিজেরাই তো থাকে অন্যের বাড়িতে। তবে এসব ভেবে বসে থাকলে তো হবে না। মেয়ের বয়স তো আর থেমে থাকবে না। বেশি বয়স হলে পরে বিয়ে দেওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। তার মেয়ে রূপে, গুণে সবদিক থেকে এগিয়ে। এমন মেয়েকে এমনিতেই বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবে। বাবার আর্থিক অবস্থা কেউ দেখতে আসবে না। তাছাড়া ছোটো মেয়েটারও বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। বড়ো মেয়েটার মতো এত রূপ নেই। কিন্তু গুণের দিক দিয়ে চন্দ্রকে ছাড়িয়ে যাবে। চন্দ্রের বিয়ে দিয়ে তারও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

চন্দ্রের হাবভাব খুব একটা সুবিধার লাগছে না। আজকাল মেয়েকে বুঝে উঠতে পারেন না। তার চেনা মেয়েটা যেন চোখের সামনে কেমন বদলে যাচ্ছে। মেয়ের চিন্তায় তার ঘুম আসে না। মেয়েকে একটা ভালো ঘরে পাঠাতে পারলেই তার শান্তি।

চন্দ্র আজকাল মায়ের চিন্তিত মুখ খুব করে অবলোকন করছে।

– মাইশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here