কলঙ্কিনী,৪র্থ পর্ব

0
2355

কলঙ্কিনী,৪র্থ পর্ব
লেখনীতেঃ রাফিজা আখতার সাথী
,
থানাতে সারা এবং মিসেস রেহেনার কথোপকথন,
,
” আমার বাবা কে মা কে এসবের কিছুই জানতাম না।
যখন জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই নিজেকে অনাথ হিসেবেই জেনেছি।
একটা অনাথ আশ্রমে জীবনের ২০/২১ বছর পার করেছি।
আশ্রমটি ছিল আমার মা আশ্রমটিই ছিলো আমার বাবা।
,
কিন্তু এলাকার প্রভাবশালী এক লোকের ছেলে, নাম শিহাব, আমার উপরে কুনজর পড়ে। সে আমামে আমার মা-বাবার কাছে থাকতে দেয়না।
,
সে বারবার আমাকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা করে।
আমি অনেকবার পুলিশ কমপ্লেন করেছি এবং আশ্রমের পরিচালক কেও বলেছি, কিন্তু ক্ষমতা তাদের হাতে থাকায় আমার কোনো লাভ হয়নি।
,
,
একদিন রাতে আমার ঘরে বসে বসে কবিতা লিখছিলাম।
হঠাৎ দিয়া নামের একটা মেয়ে এসে বলল,
,
-সারাপু সারাপু তুমি এখনি পালিয়ে যাও, বিপদ আসছে।
,
মেয়েটার বয়স ছিল ৮/৯ বছর।
তার গালটা একটু টেনে দিয়ে আদর করে বললাম,
,
– আমার আবার কিসের বিপদ?
,
-জানো সারাপু! আমি যখন বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখন অফিস রুম থেকে কিছু মানুষের ফিসফিসানি শুনতে পাই। তএই রাতে অফিস রুমে তো কেও থাকে না। তাই আমি দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করি।
তাদের মধ্যে কেউ একজন বলে, ‘সারা মেয়েটার খুব সাহস হয়েছে। ওকে রেপ করে মেরে পুঁতে ফেলবো।’
জানো আপু কথাটা শুনে আমি খুব ভয় পেয়েছি। তাই বাথরুমে না গিয়েই তোমার এখানে কথাটা বলতে চলে এসেছি।
,
দিয়ার কথাটা শুনে আমার বুকটা কেঁপে ওঠ যেখানে এত বছর ভালবাসার সাথে বেড়ে উঠেছি আজ সেই জায়গা আমার থাকবেনা। নিষ্ঠুর দুনিয়ায় সব কষ্ট যেন আমার উপর লেগেই আছে।
,
দিয়া মেয়েটা জিজ্ঞাসা করে,
,
– আচ্ছা সারাপু রেপ জিনিসটা কি? আর সেটা করলে মেরে ফেলবে কেন?
,
ছোটো মেয়েটাকে এই বিষয়টা বুঝানোর মত কন্ডিশন ছিলো না। আমার হাত পা থরথর করে কাপছিলো। কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না। শেষমেশ মেয়েটাই বলল,
,
– তুমি তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও না হলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।
,
মাথায় তখন একটা জিনিসই কাজ করছিলো আর সেটা হলো, বাচতে হবে।
,
তখনই নিজের জামা কাপড় নিয়ে জীবনের মতো আশ্রম থেকে পালিয়ে বের হয়ে যাই।
,
রাতের বেলা কোথায় যাবো কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
হঠাৎ মনে পড়ে পরিচিত একটা বান্ধবী আছে তাই সেই রাতে তার কাছে চলে যাই।
,
সকাল বেলা আমি সেখান থেকেও পালিয়ে আসি। যেই জায়গায় আমি ২০/২১ বছর ধরে থেকে এসেছি সেই জায়গা আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো আর মাত্র দুইবছরের বন্ধুত্ব কিভাবে আমাকে রক্ষা করবে।
,
,
গন্তব্যহীন ভাবে সারাদিন ঘুরতে থাকি। কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
,
ক্ষুধার তাড়নায় একপা ফেললে সেটা তোলার ক্ষমতা ছিল না। কি করবো কোথায় যাবো এই ভেবে আমার পৃথিবী ভেঙে কান্না আসছিলো।
‘ আল্লাহ তুমি আমাকে কোন পরীক্ষায় ফেললে? এই পরীক্ষায় পাশ করব কিভাবে, টিকে থাকব কিভাবে? নাকি আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত চলে এসেছে?
,
হাটতে হাটতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই।
,
যখন চোখ খুলি নিজেকে হাস্পাতালে আবিষ্কার করি। একজন মহিলা পাশে বসে হাত পাখা দিয়ে আমাকে বাতাশ করছিল। তিনি আমাকে জানান যে তার ছেলে পাশের শহর থেকে ফেরার সময় রাস্তার মাঝে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না তাই সে নিজেই আমাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করে। তারপর ওনাকে খবর দেয় আমার সেবা যত্ন নেওয়ার জন্য।
,
মহিলাটি আমার কাছে আমার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু এতিমের যে একটাই ঠিকানা, খোলা আকাশ।
,
আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ওনাকে বলি।
,
আমার কথা শুনে আমার উপরে খুব মায়া হওয়ার কারণে আমাকে ফেলে যায়নি, তার বাড়িতে স্থান দিয়েছিলো তাও একজন আশ্রিতার জায়গায় না, তার পুত্রবধু করে। ভেবেছিলাম আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষায় হয়তো আমি পাশ করেছি। বাকি জীবনটা হয়তো প্রিয় মানুষটার সাথে সুখে কাটিয়ে দেবো। কিন্তু হাই!
হতভাগী সারাজীবন কষ্টই পেয়ে থাকে। তার জীবনে সুখ বলতে কিছুই নেই, শুধু স্বপ্নই সুখ পাবে, বাস্তবে শুধু দুঃখ আর দুঃখ।
,
বিয়ের ২ মাস পর আমান বাইরের দেশে যাবার তোড়জোড় লাগিয়ে দেয়। বলেছিল ৫ বছর বিদেশ থাকবে, কিন্তু একজন স্ত্রী জানে স্বামীর থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টের, তার ভালবাসার পরশ গুলো থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টের, তার বুকে মাথা না রেখে রাত কাটানো কতটা কষ্টের!
,
২ মাস পর আমানের সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়। যাওয়ার সময় আমার কপালে একটা ভালোবাসা দিয়ে বলেছিলো। মা বাবা আর নেহাকে দেখে রাখতে। আমি মুখ দিয়ে কিচ্ছু বলিনি কিন্তু আমার চোখ সেদিন আমার কথা শোনেনি।
,
এয়ার্পোরটে ওয়েটিং জোনে বসে ছিলো হঠাৎ এসে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায়। কেও ওর পাশের চেয়ারে একটা ব্যাগ রেখে ওকে একটু দেখে রাখতে বলে। সেটাই ওর কাল হয়ে দাড়াই। ৫ বছরের জেল হয়।
,
একজন পুলিশের সাহায্য ও বাড়িতে নিয়মিত কথা বলতো। ইন্টারনেট কল দেওয়াতে মাবাবা বা নেহা কেওই বুঝতে পারতোনা ও বিদেশ আছে নাকি দেশেই জেলে আছে। আর আমি অভিনয় করেই যেতাম সবার সাথে।
,
আড়াই বছর পর কুরবানী ঈদের একদিনের জন্য ওকে বাড়িতে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। কারণ এতো দিনে প্রমান ওর বিপক্ষে গেলেও পুলিশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলো ও দোষী না।
,
বাড়িতে আসার আগে আমাকে ফোন দেয়। এবং বলে যে রাতে যাবো আবার ভরে চলে আসবো। মাবাবা আর বোনটার ঘুমন্ত মুখ গুলো দেখেই চলে আসবো। আমি জেলে আছি ওরা মা জানলে তাকে বাচানো যাবে না।
,
সেদিন রাতেই বাড়িতে আসে আমান। প্রিয় স্বামীকে আড়াই বছর পর কাছে পেয়ে, আর তার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দেওয়ার ফলেই আমার এই সন্তান গর্ভে আসে।
,
ভোরে আমান চলে যায়।
,
আমি আমার প্রেগ্ন্যাসির কথা প্রায় ৪/৫ মাস লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। পেট একটু একটু বাড়তে থাকে তবুও যতটা সম্ভব নিজেকে লুকিয়ে রাখি।
,
কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার ফোনে কল আসে যে সর্টকার্টিকে আমানকে যেই জেইলে থাকবো সেখানে আগুন লেগে ৩ জন পুলিশ ও যে ৫ জন কয়েদি ছিলো তারা সবাই পুড়ে মারা যায়।
,
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। আমার পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে যায়। আমি কোনো রকম ভাবে বলি তার লাশ যেন বাড়িতে না পাঠানো হয়। মা দেখলে তাকে বাচাতে পারবোনা।
,
ফোনটা কোনোরকমে রেখেই আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। ডাক্তার এসে চেকাপ করে জানায় আমি প্রেগন্যান্ট।”
,
তারপর একে একে সারা সব কিছু ওসি মিসেস রেহেনাকে বলে।

-তুমি তোমার শ্বাশুড়ি কে কেন বলোনি আসল সত্যটা?
,
-তার যে সত্যটা হজম করার মত দেহের অবস্থা নেই। যদি বলি তাহলে তিনি মারা যাবে। আমি কি করে তাকে মেরে ফেলি? যেই বুকে আমাই আশ্রয় দিয়েছে আমি কিভাবে সেই বুকটাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিই?
,

,
,
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here