কলঙ্কিনী,৭ম ও শেষ পর্ব
লেখনীতেঃ রাফিজা_আখতার_সাথী
,
গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে সারা। একটু ভয় ভয় করছে তার। ভয় করারই কথা কারণ আমানের এক দিকে পুলিশের সাথে সম্পর্ক অন্যদিকে এই খারাপ লোক গুলোর সাথেও সম্পর্ক। যেন একটা গোলক ধাধার ভিতর আটকে গেছে সারা।
যার ভিতর থেকে বের হতে চাচ্ছে কিন্তু সেটা সারাকে বের হতে দিচ্ছেনা।
,
,
আমান এসে সারার পাশে বসলো আমানকে দেখে সারা যেন কুকড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমান সারা কে নিজের কাছে টেনে বললো,
,
-কি হয়েছে তোমার? এমন কেন করছো? মনে হচ্ছে কোন ভুত দেখেছো তাই ভয় পাচ্ছো।
,
সারা অবাক চোখে আমানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মনে মনে বলছে,
“তুমি কি আমান? তুমি ভালো নাকি খারাপ নাকি ভালো-খারাপ দুইটার মাঝে ঝুলে আছো।
আমি যে তোমাকে চিনতে পারছিনা। ”
,
আমান সারার চুপ করে থাকা দেখে তার মাথাটা বুকে নিয়ে বলল,
,
– কি হয়েছে কথা কেন বলছো না?
,
সারা ভাবনা থেকে বের হয়ে শুধু একটা কথায় বলল,
,
-আমি খুব ক্লান্ত। আমার ঘুম পাচ্ছে।
,
– ঠিক আছে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
,
গাড়ি আপন গতিতে চলছে সারা আমানের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। সবার কাছে এটা একটা প্রশান্তির ঘুম, প্রত্যেক স্ত্রী তার স্বামীর বুকে প্রশান্তির ঘুম দিতে চায়। সারাও ঘুমাচ্ছে, কিন্তু ঘুমের ভিতর কোন প্রশান্তি নেই সারার।
বারবার উসপিস করে উঠছে।
যেন মনে হচ্ছে ওর প্রশান্তি কোনদিন ছিল না কোনদিন আসবেও না।
সারা জীবন শুধু লড়াই করে বাঁচতে হবে।
,
,
আমানদের বাড়িতে পৌঁছাতে রাত প্রায় 11 টা বেজে যায় দরজায় টোকা দিতে কিছুক্ষণ পর নেহা এসে দরজা খুলে দেয়। আমানকে দেখে নেহা যেন চমকে ওঠে।
ভাইয়া বলে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে বলে,
,
-তুই কখন এলি ভাইয়া আমাদেরকে জানাস নি কেন? হঠাৎ চোখ যায় আমানের পিছনে, দেখে সারা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
,
-ওর সাথে তোর কোথায় দেখা হলো ভাইয়া? ওকে নিয়ে চলে আসলি? ভাইয়া তুই জানিস না ও কি করেছে? তোর সাথে কত বড় পাপ করেছে।
মুখে লাথি দিয়ে বের করে দে ভাইয়া।
,
নেহার কথা শেষ হতে না হতেই আমান নেহার গালে একটা চড় কষে দিলো।
,
-যেই মেয়েটাকে কলঙ্কিনী নাম দিয়েছে এই সমাজ তার গায়ে কলঙ্কিনী ছিটেফোঁটাও নেই। কিভাবে সহ্য করব আমি তুই বল?
আমার সন্তান ওর গর্ভে, ওর স্বামীর সন্তান ওর গর্ভে, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ওর গর্ভে।
,
-মানে কি বলছিস ভাইয়া। তুই তো তিন বছর দেশের বাইরে ছিলি। তাহলে কিভাবে কি?
,
-আমি কোনদিন বিদেশে যাইনি।
সরকারের একটা গোপন মিশনে আমাকে নেওয়া হয়। তাই বিদেশে যাওয়ার নাটক জেলে যাওয়ার নাটক সব করেছি। মরে যাওয়ার নাটক ও করেছি ভেবেছিলাম বাড়িতে এসে সারপ্রাইজ দেবো। কিন্তু তোরা আমার সারাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলি। তাই সব কিছু ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
,
-কি বলছিস ভাইয়া মরে যাওয়ার নাটক মানে?
,
এবার সারা মুখ খুললো,
-আমি অনেক আগেই জানতান আমান জেলে আছে। এর মাঝে নাকি একদিন পুলিশ ওকে ছুটি দিয়েছিলো তাই এখানে আসে।সবাইকে লুকিয়ে। সেই দিন আমার পেটে ওর বাচ্চা আসে। কয়দিন টিভিতে দেখালো বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে আগুন লেগে একটা জেলের কয়েদি মারা যায় সেদিন আমাকে জানানো হয় আমান ও মারা গেছে।
,
সারা কাদতে কাদতে কথা গুলো বলল। তাই আমান সারাকে থামিয়ে দিয়ে বলা শুরু করলো,
,
-তারপর তোরা আমার সারাকে ভুল বুঝে বাড়ি থেকে বের করে দিলি। তখন ফোন দিয়েই তোরা জানিয়েছিলি তাই হয়তো আমার সারাকে আমি জীবিত পেয়েছিলাম।
আমার কিছু বন্ধু ওকে কিডনাপ করে তারপর পুলিশ ওকে বাচায়। যার সব কিছুই ছিলো সাজানো। যাতে সারাকে একটু ভয় দেখানো যায়। কারণ ও ভয় পেলে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুজবে তাই ওসি মিসেস রেহেনা ওকে এই সুযোগে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।
কিন্তু এর আগে একটা বড় ভুল কিছু হয়ে যায়। কোনো একটা পুলিশ মিডিয়াকে খবর দিয়ে জানিয়ে দেয় যে…………….। সেদিনের ঘটে যাওয়া সব কথা নেহাকে বলে আমান।
,
নেহা সারার সামনে ধপ করে হাটু গেড়ে বসে পড়ে।
খপ করে পা জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাদতে লাগে,
,
-ভাবি আমি কোন মুখে তোমার কাছে মাফ চাবো জানিনা। কিন্তু নির্লজ্জএর মত বলছি আমাকে মাফ করে দাও। এই হাত দিয়ে আমি তোমাকে চড় মেরেছি। আমি তোমার কোনো কথায় বিশ্বাস করিনি।
,
সারা নেহাকে উচিয়ে বলে,
,
-তোমার কোনো দোষ নেই নেহা, তোমার জায়গায় আমি হলেও এমনই করতাম কারণ সত্যটা তুমি জানতে না।
,
নাসরিন বেগম ঘর থেকে বের হয়ে ছেলেকে দেখে খুব আশ্চর্য হলো। খবর না দিয়ে চলে আসলো এটা ভেবে। সারার দিকে চোখ পড়তেই তেড়ে গেলো ওর সামনে। নেহা মায়ের এমন আচরণ দেখে সারাকে আগলে দাড়ালো,
,
-মা, এতো বড় অন্যায় আর করো না।
,
-কিসের অন্যায়? এই কলঙ্কিনীকে তুই কোথায় পেলি আমান।
,
নেহা- মা, দয়া করে চুপ করো। আমার কথা গুলো শুনো আগে।
নেহা একে একে মাকে সব কথা জানালো।
,
নাসরিন বেগম আমানের সামনে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা চড় দিয়ে বলে,
,
-তোর কারণে ফুলের মত মেয়েটাকে আমি কি না কি বলেছি। ছিহ! ঘৃণায় আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। মন বলছে মরে যায়।
,
সারা মায়ের হাতটা ধরে,
,
-মা, সব কিছু ভলে যান। আপনাদের কাছে চলে এসেছিতো আর কোনো কষ্ট থাকবেনা। আমি সব ভুলে গেছি আপনিও সব কিছু ভুলে যান।
,
সারাকে বুকে টেনে নিয়ে নাসরিন বেগম সারার কপালে চুমু একে দিয়ে বলে আমিও সব ভুলতে চাই। আমার সারা আমান নেহাকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই।
,
,
সারা আমানের দিন খুব ভালোই কাটছিলো। সারাদিন সারার খেয়াল রাখে আমান।
,
কয়েক মাস পর,
,
সারা একটা ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দেয়। আমান আর সারার নামের সাথে মিল রেখে আয়রা নাম রাখা হয় মেয়ের। আমানের আ আর সারার রা দিয়ে।
,
কয়েকদিন পর,
,
সারা মেয়েকে খাওয়াচ্ছিলো। আমান বাইরের যাওয়ার সময় মেয়ে আর মেয়ের মায়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
,
-একটু বাইরে যাচ্ছি বিকালে ফিরবো।
,
-আচ্ছা নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।
,
আমান বাইরে গেলে সারা কোনোদিন আল্লাহ হাফেজ বলে না। বলে, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। এখন এসব ভাবার টাইম নেই আমানের তাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
,
সারা নিজের মেয়েকে বলে,
,
-আমার যুদ্ধ আবার শুরু হবে মা। তুই কি আমার সাথে থাকবি?
,
দুধের বাচ্চা মায়ের কোনো কথায় বুঝতে পারেনা। খিলখিল করে হাসতে থাকে শুধু।
,
,
বিকালে মানা বাড়ি এসে দেখে, নাসরিন বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, নেহার হাতে একটা কাগজ, সারা বাড়িতে কোথাও সারা নেই।
,
আমান নেহাকে জিজ্ঞাসা করে, যে
,
-সারা কোথায়?
,
নেহা আমানেদ হাতে কাগজটা দিয়ে দেয়।
,
প্রিয় আমান,
আদৈ প্রিয় আছো কিনা আল্লাহয় ভালো জানি। ভেবেছিলাম তুমি পুলিশের লোক। কিন্তু না তুমি তো একটা চোরাকারবারির লোক। তার সাথে মিসেস রেহেনাও জড়িত। সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। সেগুলো আমি কমিশনের কাছে দিয়ে তার পর চলে যাবো আমার আয়রাকে নিয়ে। ভাবছো আমি জানলাম কিভাবে। তুমি বাড়িতে আসার পর থেকে একটা ঘর তো তালা বদ্ধ করে রাখতে। আমি কয়েকদিন আগে ওই ঘরের তালা খুলে ঢুকেছিলাম। চাবিটা তুমি হয়তো ভুলে বাড়িতে ফেলে গেছিলে।
সেখানে কিছু বক্স দেখতে পায় সেগুলো খুলে দেখি তাতে অনেক বেআইনি অস্ত্র দেখতে পাই। একটা ফোন পায় তাকে কিছু অডিও রেকর্ড পাই আমি। যেগুলো শুনে বোঝাই যাচ্ছিলো তুমি পুলিশের লোক নও তাদের শত্রু, আর মিসেস রেহেনা তোমার সাহায্যকারী। যে পুলিশের পোশাক পড়েও তাদের সাথে বেইমানি করে যাচ্ছে।
,
যায়হোক, আমার মেয়েকে আমি একা মানুষ করতে চাই। এই চিঠি যতক্ষণে পেয়েছো ততক্ষণে আমি এলাকা ছেড়ে অনেক দুরে চলে এসেছি। আমি চাইনা তোমার ছায়া পড়ুক আমার নিষ্পাপ মেয়ের উপর। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ আবারো।
,
ইতি
কলঙ্কিনী
,
,
বাসের সিটে বসে আছে সারা মেয়েটা কোলেই ঘুমিয়ে আছে। সারা ঘুমন্ত মেয়ের সাথে কথা বলছে,
,
-তোকে আমি পাপ মুক্ত রাখতে চেয়েছি মা। তুই যেন আমার উপর রাগ করিস না। তোর বাবাটা ভালো না। তুই থাকবি তো আমার সাথে?
,
মেয়েটা ছোটো ছোটো হাত দিয়ে মায়ের হাতের একটা আঙুল ধরে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর মুচকি হাসছে মায়ের দিকে তাকিয়ে, যেন বলছে,
,
-মা, আমি তোমার সাথে সব সময় থাকবো। হারিয়ে যাবো না কোনোদিন।
,
,
সমাপ্ত
কলঙ্কিনী
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
,
গল্পটা কেমন হলো জানাবেন। ধন্যবাদ।