#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর,পর্ব_১৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
চাঁদ শূন্য গগনে অন্ধকারের বাস। নিস্তব্ধ, শুনশান ঘর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো বস্তুর স্থান নির্ণয় করা যাচ্ছেনা। ঘুম ভাঙতেই চোখে অন্ধকার পড়লো। পাশে হাতড়ে রাউফুনকে পাওয়া গেলোনা। অচেনা জায়গা, তার উপর অন্ধকার, ভীষণ ভয় লাগলো মনে। পুষ্প গলা ছেড়ে ডাকলো রাউফুনকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কি আশ্চর্য! পাশে দুজনের একজনের ফোন ও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ও রাউফুনের সাড়া না পেয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো পুষ্প। পায়ে ঠাওর করে এক পা বাড়িয়েছে এমন সময় “ভেউ” শব্দে চমকে উঠলো। আচমকা ভয় পেয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেললো পুষ্প।
রাউফুন পুষ্পকে বক্ষস্থলে চেপে ধরে ফোনের ফ্ল্যাশ অন করলো। আলো জ্বলতেই রাউফুনকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলো। রাউফুন নাছোড়বান্দা, সে ছাড়লোনা।
এখানকার হোটেলের মেইন কানেকশনে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তারা জানিয়েছে বিশ মিনিট সময় লাগবে। রাউফুনের ঘুম ভাঙলেও পুষ্প ততক্ষণে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। পুষ্পর নড়াচড়ার আভাস পেতেই রাউফুন একটু সরে বসলো মজা করার উদ্দেশ্য। অন্ধকারে পুষ্পর চোখে তো পড়লোইনা বরং দূরে সরে বসায় হাতড়েও খুঁজে পেলোনা। ফোন দুটোই রাউফুনের পকেটে। পুষ্পর ডাকেও সাড়া দিলোনা।
ভয় দেখিয়ে মনে হচ্ছে পস্তাতে হবে। সহজে কাছে ঘেষতে দেবেনা।
পুষ্পর বাড়াবাড়ি রকম মোচড়ামুচড়িতে রাউফুন আরেকটু ভয় দেখাতে বলল,
-“আজ আর কারেন্ট আসবেনা। সারারাত অন্ধকারেই কাটাতে হবে। দূরে গেলেই ভূত আসবে।”
পুষ্প শান্ত হলো। তবে ভূত ভয় দেখানো কথায় তেমন একটা পাত্তা দিলোনা৷ নিশ্চয়ই রাউফুন তাকে ভয় দেখাতে ভূতের কথা বলেছে। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
-“সরুন এখান থেকে। দূরে গিয়ে বসুন।”
-“আহা! বললামতো আজ রাতে আর কারেন্ট আসবেনা।”
-“আচ্ছা, এত বড় হোটেল শুধু কারেন্ট দিয়েই চলে? অন্যকোনো ব্যবস্থা নেই। আমাকে বোকা পেয়েছেন? কারেন্টের যা মতিগতি, এই যায় তো তিনঘন্টা পর আসে। তো হোটেলে বুঝি সারাদিন সার্ভিস দেয়? কারেন্ট কর্তৃপক্ষ হোটেল মালিকের দুলাভাই লাগে?”
তখনই আলো জ্বলে উঠলো। রাউফুন চুপসে গেলো। আজ বুঝি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে।
তবে সে মনে মনে পণ করে নিলো। তাড়াতে চাইলেও সে দূরে যাবেনা। ঘাপটি মেরে বসে থাকবে।
পুষ্প মুখ ঝামটা মে’রে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
বের হতেই রাউফুন বলল,
-“চলো খেয়ে আসি।”
পুষ্প যেনো শুনে ও শুনলোনা। আস্তে ধীরে সব করছে, পরনের জামাকাপড় ঠিক করছে, সাজগোছ নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছে।
হাত ঘড়িতে সময় দেখলো রাউফুন। কোনো কাজ ছাড়াই দশমিনিট লস করেছে। কিছু বললোনা। এমন করে আরও দশমিনিট সময় নষ্ট করার পর রাউফুন মুখ খুললো,
-“আর কতক্ষণ? আমার অনেক আগেই ক্ষুধা পেয়েছে। তোমার ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষায় ছিলাম।”
পুষ্প দরজা ঠে’লে বের হলো, পিছু পিছু রাউফুন রুম লক করে আসছে। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় দু’রুম পরের রুম থেকে একজন যুবক বের হলো। চলার পথে ছেলেটি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“এক্সকিউজ মি মিস! আপনাকে বোধহয় আজ একটা ছেলের সাথে রিসিপশনে দেখেছিলাম।”
পুষ্প ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
-“জি, আমার হাজবেন্ড এর সাথে এসেছি।”
ছেলেটি চওড়া হেসে বলল,
-“হানিমুন?”
-“সেরকমই বলতে পারেন।”
-“ডোন্ট মাইন্ড! আপনাদের নাম জানতে পারি?”
-“শিওর! আমি সামিহা জাহান পুষ্প, আমার হাজবেন্ড রাউফুন সপ্ত।”
-“ওহ নাইস নেইম। আমি তুষার। তা আপনারা কি ঘুরতে যাচ্ছেন?”
-“এখনো খাওয়া হয়নি, খেয়ে আশপাশ ঘুরে দেখবো।”
-“সেইম আমিও নিচে খেতেই যাচ্ছি।”
রাউফুন এসে পড়লো। পুষ্প আর কথা বাড়ালোনা। আগে তুষার নামলো, পেছনে পুষ্প আর রাউফুন।
রাউফুন ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভদ্রলোক তোমার পরিচিত নাকি?”
পুষ্প কিছু একটা ভেবে দুর্বোধ্য হাসলো। পরপরই জবাব দিলো,
-“পরিচিত না হলেও পরিচয় হতে কতক্ষণ? এনিওয়ে, হি ইজ আ নাইস পারসন।”
রাউফুন তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। কিন্তু মুখে কিছুই বললোনা। দুজনে খেয়ে আপাতত হোটেলের কাছাকাছি জায়গা গুলো ঘুরতে বেরিয়েছে। কিছুদূর যেতেই সেই তুষারের সাথে দেখা। দূর থেকে দেখে ছেলেটা হাই জানালো, কিন্তু এগিয়ে আসলোনা। সে বোধহয় বুঝে গিয়েছে কাপলদের মাঝখানে হাড্ডি হওয়া উচিত নয়। পুষ্প মিটিমিটি হেসে নিজ থেকেই এগিয়ে গেলো। পেছন ফিরে বলল,
-“আপনি কি তুষারের সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড? ভালো না লাগলে আসতে হবেনা। আমিই গিয়ে কথা বলি।”
রাউফুন দাঁড়িয়ে রইলো। সে মজা নিচ্ছে। যেনো পুষ্প তার কথাবার্তা দ্বারা রাউফুনকে ভীষণ বিনোদন দিচ্ছে।
তুষারের সাথে কথা বলে ফিরে আসলো পুষ্প। চোখেমুখে উৎফুল্লভাব ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“এত ভালো করে মানুষ কিভাবে কথা বলতে পারে? তারউপর ছেলেটা নাকি সিঙ্গেল। ভাবা যায়? বিয়ের আগে এই ছেলের সাথে দেখা হলে কি হতো?”
রাউফুন একটুও রাগ করলোনা। এসব জেলাসি-ফেলাসি খেলা খেলে কোনো লাভ নেই। সে আগেই বউয়ের মতিগতি বুঝে নিয়েছে। অন্ধকারে ভয় দেখিয়েছে বলে এখন প্রতি’শোধ নিতে চাচ্ছে। তুষার ছেলেটাকে দেখে সুযোগ পেয়ে ফায়দা লুটতে চাইছে। রাউফুন মুচকি হেসে বলল,
-“এখন যেতে চাও? ডাকবো ছেলেটাকে?”
অতঃপর দূর থেকে হাত বাড়িয়ে তুষারকে ডাকার চেষ্টা করে বলল,
-“এই যে ভাই, নিয়ে যান। ইন্টারেস্টেড আপনার প্রতি। একঘন্টা হাঁচি সহ্য করতে না পারলে আবার আমাকে ফেরত দিয়ে যাবেন।”
তুষার দূর থেকে বুঝলোনা রাউফুনের কথা। সে এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো। পুষ্প রেগে বোম হয়ে রইলো। পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার। এই লোকের মধ্যে জেলাসির কোনো ‘জ’ ও নেই। উল্টো তাকে হাঁচি নিয়ে অপমান করলো। ভীষণ রকম অসভ্য খেতাবে ভূষিত করলো রাউফুনকে। পেছন থেকে তুষারকে আসতে দেখে পুষ্প দপদপ পা ফেলে হোটেলের দিকে চলল।
তুষারের সাথে পরিচিত হয়ে পুষ্পর পেছনে ছুটলো রাউফুন। লম্বা কদম ফেলে পুষ্পর পাশাপাশি হেঁটে বলল,
-“চলে যাচ্ছো যে? তুমি না ইন্টারেস্টেড?”
পুষ্পর রাগে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো রাউফুনের একটি বাক্য। এই মুহূর্তে কিছু একটার উপর এই রাগ ঝাড়তে হবে। পুষ্প কোনো কিছু বাচবিচার না করে এক খাবলা বালি তুলে ছুঁড়ে মারলো রাউফুনের শার্টে।
রাউফুন নিজের শার্টের দিকে লক্ষ করে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর সে এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। এক খাবলা বালি নিয়ে পুষ্পর জামায় ছুঁড়ে মারলো।
পুষ্প হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিস্ময়ে মুখ হা করে একবার নিজের জামায় একবার রাউফুনের দিকে তাকালো। মানে কী? রাউফুন তার উপর এভাবে প্রতিশোধ নিলো? সে যে এভাবে বালি ছুঁড়বে এটা ছিলো পুষ্পর ভাবনার বাহিরে। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতেই আস্তে আস্তে ঠোঁট প্রসারিত হলো, অতঃপর খিলখিল শব্দ হেসে ফেললো পুষ্প। ধপ করে বালিতে বসে পড়লো। রাউফুন ধীর পায়ে হেঁটে নিজেও পুষ্পর গা ঘেষে বসলো।
হাসি থামিয়ে রাউফুনের কাঁধে মাথা রাখলো পুষ্প।
-“মনে হচ্ছে সদ্য কিশোরী জীবনে পা দিয়েছি।”
রাউফুন সন্তর্পণে এক হাত গলিয়ে বাহু বন্ধনে বেঁধে নিয়ে বলল,
-“প্রয়োজনে কিশোরী হতে হয়, প্রয়োজন ম্যাচিউর হতে হয়। যখন যেমন প্রয়োজন, তেমন হতে হয়। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার ভেতরকার বাচ্চামো গুলো হারিয়ে যায়না, মানুষ প্রকাশ ঘটানো কমিয়ে দেয়। নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখাতে গিয়ে প্রানবন্ত নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কখনো সুযোগ পেলেই নিজেকে উজাড় করে, ভেতরকার ‘আমি’কে’ প্রকাশ করে।”
পুষ্পর ভীষণ ভালোলাগলো পাশের মানুষটার কথাগুলো শুনতে। অথচ এই বাক্যগুলোতে রস নেই, প্রেম নেই। তবুও একরাশ ভালোলাগা ছুঁয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা, সময়ের সাথে সাথে কি আমাদের ভালোবাসা ও কমে যাবে? অনেকেই তো বাচ্চা হওয়ার পর দেখি আগের মতো দুজন দুজনকে সময় দেয়না।”
নিঃশব্দে হাসলো রাউফুন।
-“এই যে আমাদের ধারণা সন্তান হলেই ভালোবাসা কমে যায়, দুজনের মাঝে দূরত্ব বেড়ে যায়। এটা ভুল। দূরত্ব বাড়লেও গুরুত্ব কমেনা, ভালোবাসা কমেনা। যে ভালোবাসতে জানে, সে সারাজীবন আঁকড়ে ধরে রাখতে জানে।
সন্তান সুখের স্বাদ ভিন্ন। তখন দেখা যায় আমাদের নিজেদের থেকে সন্তানকে অনেকটা সময় দিতে হয়। জন্ম দিলেই মা বাবা হওয়া যায়না। সন্তানকে সময় দিলে স্বামী-স্ত্রীর হয়তো নিজেদের আগের মতো সময় দেওয়ার সুযোগ থাকেনা। কিন্তু ভালোবাসা কমেনা। এই যে দুজন থেকে তিনজন, চারজন হওয়া? এতেও কিন্তু সুখ রয়েছে, অন্যরকম ভালোবাসা রয়েছে। জীবনে কিছু ভিন্নতা দরকার। এইযে, কয়েকবছর দুজনে এভাবে সময় কাটানোর পর একঘেয়ে চলে আসবে। তখন মনে হবে এবার জীবনে ভিন্নতা আসা উচিত। আর সেই ভিন্নতা, জীবনকে মধুময় করতেই রহমত হিসেবে সন্তান আসে।”
পুষ্প ভেবে পেলোনা এত কেনো ভালোলাগছে? তার কপালটা কি পরিমাণের তুলনায় একটু বেশিই বড়? চুপিচুপি কপালে চার আঙ্গুল রেখে মেপে দেখলো। সত্যিই তার কপাল বড়।
পুষ্পর কান্ড দেখে রাউফুন মৃদু হাসলো। যখন পাশের সঙ্গী আপনাকে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করে? তখন কিন্তু ভালোই লাগে।
দূরের আবছা আলোয় সমুদ্রের তীর ঘেষে একজোড়া মানব-মানবী। সমুদ্রের জলে, বালিতে বালিতে, দুটি মনের অনুভূতি একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার। তাদের ভালোবাসার শান্ত রূপে বিঘ্ন ঘটাতেই বোধহয় মুঠোফোনের তীব্র শব্দ হলো।
#চলবে……..