#কল্পপ্রেমিক (উফঃ শুভ্র),প্রথমাংশ
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
আমার কল্পনায় বিভোর হয়ে আছেন বুঝি!
মধ্যদুপুর। আকাশে উত্তপ্ত রোদ। মাথার উপর বড় একটা বট গাছ। ঢালের ফাঁকা ফাঁকা জায়গা দিয়ে সূর্যের কিছুটা তীর্যক রশ্মি এসে পরছে এই অচেনা মানুষটার মুখশ্রীতে। চেনা নেই জানা নেই হুট করে কোথা থেকে আসলেন। আর এসেই এমন উদ্ভট একটা কথা বললেন! অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। আমি ভড়কে উঠলাম। বিস্মিত হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
মানে! কি বলতে চাচ্ছেন আপনি! আর কে আপনি? কখন আসলেন এখানে?
লোকটা আমার পাশেই বসে আছেন। আমাদের মাঝখানে দু এক ফিট জায়গা ফাঁকা। বেঞ্চিটাতে গাঁ ঘেঁষে বড়জোড় চারজন বসতে পারবে। সেখানে আমি আর অচেনা লোকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি। লোকটা মুখে হাল্কা হাসি রেখে অতি মধুর গলায় বললেন-
যখন তুমি আমাকে নিয়ে কল্পনার জগতে বিভোর ছিলে তখনই এসেছি। দু এক মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু তুমি খুব মনোযোগ দিয়েই উপন্যাসের বই পড়ছিলে তাই আমার উপস্থিতি টের পাওনি। খুব ক্লান্তবোধ করছিলাম তাই বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে বসে পরলাম। তোমার কাছে অনুমতি না নেওয়ার জন্য সরি।
লোকটার কথার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমি তার পূর্বপরিচিত কেউ। কত সুন্দর নিঃসংকোচে তুমি সম্মোধন করে কথা বলছেন! তবে আমি তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমি বেঞ্চির উপর দিকে আরেকটু চেপে বসলাম।আশেপাশে তেমন কোনো মানুষ নেই। এই ভরদুপুরে এখানে কোনো মানুষ থাকার কথাও না। জায়গাটা অবশ্য সামনের ঐ রেস্টুরেন্টের সাথে সংযুক্ত। নীল টিনের উঁচু কোণের চাল। কিছুটা ত্রিভুজ আকৃতির। রেস্টুরেন্টের দেয়াল গুলো কাঠ আর বাঁশের তৈরিতে করা হয়েছে। দেখতে অসম্ভব আকর্ষণীয়। জায়গাটাতে আমার প্রায়শই আসা হয়। খুব প্রিয় জায়গা তাই ঘনঘন আসি এখানে। কিন্তু আগে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি। আমি লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ঝাঁঝালো কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম তাকে-
আপনাকে নিয়ে বিভোর ছিলাম মানে কি! কি বলতে চাচ্ছেন সোজাসাপ্টা বলুন। এতো বিনীতা করা আমি মোটেও পছন্দ করিনা।
আমার কথায় লোকটার আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সে আগের মতোই মুখে হাসি টেনে রেখেছেন। অগোছালো চুল গুলো হাতের আঙুলের সাহায্যে ঠিক করতে করতে বললেন-
আমি শুভ্র। আমার নামের উপন্যাস পড়ছ আর আমাকেই চিনতে পারছ না! অদ্ভুত! খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।
আমি হকচকিয়ে উঠলাম। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত হাতের বইটার দিকে তাকালাম। হুমায়ূন আহমেদের বই। এখানে আসার পথেই বইটা কিনেছি। বইটা কেনার পেছনে দুটো কারণ আছে। প্রধান কারণ হলো বই পড়ে এই অপেক্ষাকৃত সময়টুকু কাটানো, যাকে সহজ ভাষায় বলা হয় টাইমপাস। আর দ্বিতীয় কারণ হলো শুভ্র সিরিজের উপন্যাস গুলো আমার খুব বেশিই ভালো লাগে। “এই শুভ্র! এই” উপন্যাসের এই নামটা আমার কাছে চুম্বকের মতো মনে হয়। “এই শুভ্র! এই” নামটার মধ্যেই কেমন যেন অদ্ভুত রকমের এক অনুভূতি কাজ করে। হুমায়ূন আহমেদের আবিষ্কৃত চরিত্র গুলোর মধ্যে হয়তো বেশিরভাগ মানুষ-ই হইলদা হিমু আর মিসির আলি এই দুটো চরিত্রের প্রতি আকর্ষিত হয়েছে। তবে আমি একটু বেশিই আকর্ষিত হয়েছি শুভ্র নামের চরিত্রে। আমি অনেকের কাছেই হিমু আর মিসির আলির কথা শুনেছি কিন্তু কখনো কাউকে শুভ্র নামের চরিত্রটা নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। তাই আরও বেশি জোঁক এসেছে এই চরিত্রটার প্রতি। উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি নিজের অজান্তেই এই চরিত্রটা-কে আমার কল্পনার জগতে খুব বড়সড় একটা জায়গা দিয়ে ফেলেছি।
আবারও আমার ভাবনায় ডুবে গেলে! কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসো। শুভ্র তোমার সামনেই বসে আছে তার সাথেও একটু কথা বলো।
লোকটার শীতল কন্ঠে আমার হুশ ফিরলো। রাগ হচ্ছে খুব। কিন্তু কেন বুঝতে পারছি না। শুভ্রকে নিয়ে মজা করছেন তাই! নাকি অচেনা লোক এভাবে যেচে কথা বলছেন তাই! আমি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কটমটিয়ে বললাম-
অযথা মিথ্যে কথা বলবেন না। সত্যি করে বলুন তো আপনার পরিচয় কি?
লোকটা হাসলেন। ওনার হাসিটাকে মনকাড়া হাসি বলে গণ্য করা যাবে বিনা সন্দেহে। নিমিষেই সকল রাগ মিইয়ে গেল। চেষ্টা করেও রাগটা ঠিক ধরে রাখতে পারলাম না।
আমাকে দেখেও কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি শুভ্র! তোমার কল্পনা জগতের শুভ্রর সাথে কি আমার কোনো মিল নেই?
উনি কিছুটা এগিয়ে এসে সোজা হয়ে বসলেন। যার মানে উনি চাচ্ছেন আমি যেন তাকে নিখুঁতভাবে দেখে শনাক্ত করতে পারি। আমি সরু চোখে ওনার দিকে তাকালাম৷ ধবধবে ফর্সা ত্বকে জড়ানো শুভ্র সাদা রঙের শার্ট। শার্টটা ইস্ত্রি করা হয়নি। ভাজ পরা কিছুটা কুচকে যাওয়া শার্ট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সেভ করেনি কয়েদিন অথবা দাড়ি রাখতে চাচ্ছেন ব্যাপারটা এমনই মনে হচ্ছে। ঠোঁট গুলো হাল্কা লালচে রঙের৷ বড় বড় দুটো মায়াবী চোখ আর কপালে আছড়ে পরে আছে একগুচ্ছ রেশমি চুল। একদম রাজপুত্রের মতো লাগছে। হুমায়ূন আহমেদের আবিষ্কৃত শুভ্র চরিত্রটাও একদম রাজপুত্রের মতো দেখতে। সব কিছুই মিলে গেছে৷ তবুও কেন যেন তাকে শুভ্র মনে হচ্ছে না। শুভ্রর কিছু একটা যেন তার মধ্যে নেই৷ আমি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ক্ষীণ গলায় বললাম-
নাহ.. আপনার সাথে শুভ্রর মিল পাচ্ছি না।
লোকটা আবারও হাসলেন। বেঞ্চি থেকে উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কিছুটা ঝুঁকে আমার চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে নিজে পরে নিলেন। আমি সাধারণত চশমা পরিনা। মাঝে মাঝে বই পড়ার সময় আর মাথা ব্যথার সময়েই চশমাটা পরা হয়। আজ মাথা ব্যথা ছিলো তাই চশমা পরেই বই পড়ছিলাম।আমি হতভম্ব হয়ে বসে আছি। লোকটা কিছু না বলেই আমার চশমা খুলে নিলেন!
এবার নিশ্চয়ই আমাকে শুভ্র মানতে দ্বিধাবোধ করবে না! এই যে দেখো এবার শুভ্রর কাছে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাও আছে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। নাহ এবার আর কোনো অমিল পাওয়া যাচ্ছে না। নিখুঁতভাবে খুটে খুটে দেখলেও কোনো অমিল খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। একদমই হুমায়ুন আহমেদের “এই শুভ্র! এই” উপন্যাসের শুভ্রর মতো লাগছে। আমি হতাশ হলাম। মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-
কি চাচ্ছেন আপনি শুভ্র সাহেব?
তেমন কিছুই চাচ্ছি না। আপাতত শুধু তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।
ওনার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এমন কথা শুনে আমার কিছুটা রাগ হলো। তীরের মতো আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। রাগ নিয়ে তেজি কন্ঠে বললাম-
আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন মানে কি? কোনো কারণ আছে বলতে চাওয়ার? না-কি একা মেয়ে পেয়ে ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে!
শুভ্র নামের মানুষটা তার মুখে হাসি রেখেই আবারও আমার পাশে এসে বসে পরলেন। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছেন। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই বাঁকা হয়ে আমার দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললেন-
কারণ তো অবশ্যই আছে। এই মুহুর্তে তোমার অপেক্ষাকৃত সময়টাকে কথা বলার মাধ্যমে পাড় করা খুব প্রয়োজন। তাই আমি চাচ্ছি আমার সাথে আড্ডা দিয়েই তোমার অপেক্ষাকৃত সময়টুকু কাটুক। সহজ ভাবে বললে যাকে বলে টাইমপাস করা।
আমি হকচকিয়ে উঠলাম। এই লোকটা জানে কিভাবে আমি এখানে বসে অপেক্ষা করছি! আমি বিস্মিত হয়ে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-
আপনি কি করে জানলেন আমি এখানে বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছি?
এই ভরদুপুরে এখানে একা একা বসে আছো দেখেই মনে হলো কারও জন্য অপেক্ষা করছো। তবে আমার মনে হচ্ছে না তোমার ফ্রেন্ডরা তোমার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে আজ এখানে উপস্থিত হবে।
শুভ্র সাহেব স্বাভাবিকভাবেই কথা গুলো বললেন। কিন্তু আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। মাথার মধ্যে প্রশ্নের ছড়াছড়ি খেলা শুরু হয়ে গেল। আমি ফ্রেন্ডদের জন্য অপেক্ষা করছি সেটা তো আমি তাকে বলিনি তাহলে কি করে বুঝলেন? এটাও কি কাকতালীয়! আমি ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস-
আমি ফ্রেন্ডদের জন্যই অপেক্ষা করছি আর তারা আজ আসবে এসব আপনি এতোটা শিউর হয়ে কিভাবে বলছেন?
উনি হাল্কা হাসলেন। সোজা হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসলেন। আমার চশমাটা এখনো ওনার চোখেই আছে। উনি চশমাটা আঙুল দিয়ে ঢেলে ভাবলেশহীন ভাবে বললেন-
অনেকটা সময় ধরেই তো অপেক্ষা করছো কিন্তু তারা কেউ-ই আসছে না। হয়তো একটু পরেই ফোন করে জানিয়ে দিবে তারা কেউ আসতে পারবে না। আর সেই সাথে অনেক গুলো সরি বলবে।
আমার ফ্রেন্ডরা কখনো এমন করেনি আর আজও কবে না। আমি….
পুরো কথা শেষ করতে পারলাম না, তার আগেই আমার ফোন বেজে উঠলো। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে এলে আমার। সাইড ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলাম অর্পিতা কল করেছে। অর্পিতার নাম দেখে আমি বিস্ময়ে শুভ্র নামক অদ্ভুত লোকটার দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক হাসি। আমি ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলাম। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলাম-
কিরে তোরা কোথায়? আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে তোদের জন্য?
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অর্পিতা অপরাধীর গলায় মিনমিনিয়ে বললো-
সরি দোস্ত। আসার সময় আচমকাই একটা ট্রাক রাস্তার সব কাঁদা আমাদের উপর ছিটিয়ে দিলো তাই বাধ্য হয়ে আমরা যে যার বাসায় চলে এলাম। তুই আর অপেক্ষা করিস না অনি। বাসায় চলে যা।
আমি তৎক্ষনাৎ কল কেটে দিলাম। ভয়ংকর রকমের কৌতুহল নিয়ে চেয়ে আছি শুভ্র সাহেবের দিকে।
আপনি কিভাবে আগে থেকেই সব বলে দিলেন? আমার ফ্রেন্ডরা আসবে না তা আপনি কি করে জানলেন শুভ্র সাহেব?
যদি বলি টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তাহলে কি বিশ্বাস করবেন?
ওনার ভ্রুক্ষেপহীন কথায় রাগে আমার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম-
এসব ফালতু কথা না বলে সত্যি করে বলুন তো আপনি কে?
শুভ্র সাহেব আমার দিকে চেয়ে হাল্কা হেসে বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন-
বললাম তো আমি শুভ্র। তোমার হাতে যেই বইটা সেই উপন্যাস তো আমার নামেই লেখা।
আমি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললাম-
উফফ শুভ্র সাহেব!! আপনি কিন্তু এবার বেশ….
আমার কথা থামিয়ে দিয়ে শুভ্র সাহেব তার অমায়িক হাসি মাখা মুখে বললেন-
ভুল বললে অনন্য। ‘উফফ শুভ্র সাহেব’ হবে না। ‘এই শুভ্র! এই’ হবে। তবে সমস্যা নেই আপাতত ‘উফফ শুভ্র সাহেব’ ডাকটাই তোমার মুখে বেশ মধুর লাগছে। মিষ্টি কন্ঠের কেউ রেগে গেলে তার কন্ঠের মিষ্টতা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তোমার বেলাও তাই হচ্ছে।
আমি যেন এবার আরেক দফা চমকে গেলাম। উনি আমার নামটাও জানেন!! কিন্তু কিভাবে? মনের মধ্যে কিছুটা ভয় এসে উঁকি দিলো। লোকটা কী ভূত! না-কি আমার হ্যালুসিনেশন! পর পর কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপটালাম। কিন্তু লাভ হলো না লোকটা এখনো হাসিমুখেই বসে আছে আমার পাশে। উনি এবার শব্দ করে হাসলেন। হাসতে হাসতে রসিকতার সাথে বললেন-
এই যুগের মেয়ে হয়ে ভূতে বিশ্বাস করা ব্যাপারটা কি তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে না অনন্যময়ি!!
চলবে….?