#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব সংখ্যা-১১)
———————–
অনিলা খানের হঠাৎ চিৎকার আঁতকে ওঠে নিঝুম। মুহূর্তে পরিবেশ কেমন পাল্টে জানি যায়।
নিঝুমের বারংবার একই প্রশ্নে অনিলা খান বিচলিত হয়ে ‘চুপ কর’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। নিঝুম বুঝে উঠতে পারে না এই সহজ প্রশ্নে এমন রিয়েক্ট করার কারণ। যখন অনিলা খানের পায়ের সম্পর্কে নিঝুম জানতে চায় তখনও তিনি চুপ ছিলেন কিন্তু যখন নিঝুম তার মৃ’ত শ্বশুরের মৃ’ত্যু’র কারণ জানতে চায় তখনই কেঁপে ওঠে অনিলা খানের অন্তরিক্ষ। মনে পড়ে যায় ছয় বছর আগেকার সেই দুর্বিষহ স্মৃতি। অন্তঃকরণে সুক্ষ্ম যন্ত্রণার আঁচড় পড়ে। সেই এক্সিডেন্ট, সেই ম’র্মা’ন্তি’ক ঘটনা। নাহ নাহ! তিনি আর ভাবতে পারছেন না। দু-হাতে কান চেপে ধরে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো জড়োসড়ো হয়ে কেঁদে ওঠেন। নিঝুম হতবাক। একজন কঠিন, শক্ত সামর্থ্য মহিলাকে হঠাৎ নিজ চক্ষু সম্মুখে এমন ভেঙে পড়তে দেখে সেও প্রচন্ড শকট। আনমনেই তার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে নানান প্রশ্ন,
– ‘মা কেন এমন করছে? আমি কী ভুল কিছু বলে ফেলেছি? ক্ষতটা খুব গভীর কিন্তু কী সেই ক্ষত? জানতে হবে আমায়। সবকিছু জানতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কে বলবে আমায়?’
নিঝুম ধীর পায়ে হেঁটে যায় অনিলা খানের নিকট। ভয়ে ভয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
– ‘ প্লিজ কেঁদোনা মা। অজান্তেই তোমার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে প্লিজ মাফ করে দাও। আমি আর কখনো এসব প্রশ্ন করব না। কক্ষনো না। তবু তুমি শান্ত হও।’
– ‘যদি আমাকে ভালো রাখতে চাস তবে আর কখনোই এসব প্রশ্ন করিস না।’
-‘করব না মা। কখনোই করব না।’
অনিলা খানের চোখের পানি মুছে দিয়ে নিঝুম দৌড়ে চলে যায় সেখান থেকে। অনিলা খান সেদিকে তাকিয়ে নিন্মস্বরে বলেন,
– ‘এসব কথা যে আমি কখনোই তোকে বলতে পারব না নিঝুম। কিছু কিছু সত্য জানতে নেই। সেগুলোর গোপনীয় প্রখর। যত অজানা থাকে ততই মঙ্গল।’
——————-
‘ইরা আছিস?’
-‘হ্যাঁ ভাইয়া আছি। ভেতরে এসো।’
-‘কী করছিস?’
-‘কলেজ যাবো তাই নোট’স গুলো চেক করে নিচ্ছি।’
-‘একটা কথা ছিল।’
-‘হুম বলো না।’
– ‘তুই আজকে হসপিটালে নিঝুমকে আমার সম্পর্কে যে সত্য জানাতে চাইছিলি সেটা যেন এখনই ও জানাতে না পারে। সময় হলে আমি নিজেই নিজেকে এক্সপোজ করব।’
– ‘আচ্ছা ভাইয়া ঠিক আছে।’
– ‘কখনো ভুল করেও যেন সত্যি টা ওর সামনে না আসে ইরা।’
– ‘হুম, তাই হবে। আমি সতর্ক থাকব।’
-‘ এই তো গুড গার্ল। আর একটা কথা…’
ইহান আমতা আমতা করছে। তা দেখে ইরা বলল,
– ‘ বলো না ভাইয়া। হ্যাজিটেড করছ কেন?’
ইহান একটা লম্বা শ্বাস নেয়। অতঃপর বলে,
-‘নিহান তোকে এখনো ডিস্টার্ব করে তাই না?’
ইরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এমন প্রশ্নে। সেই সাথে চমকায়, থমকায়। কিছু বলতে চেয়েও পারে না। কথা গুলো যেন সব কন্ঠনালীতে এসে দলা পাকিয়ে আসছে। ইরাকে অপ্রস্তুত হতে দেখে ইহান ফের বলল,
-‘দেখ ইরা তুই আমার একমাত্র আদরের বোন। তোর সুখ-ই আমার কাছে বড় সুখ। তোর সুখের জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে পারি। এখন তুই যদি চাস তবে আমি নিহানের…….. ‘
ইহানকে কথা শেষ করতে দেয় না ইরা। নিজেকে স্ট্রং করে উত্তর দেয়,
-‘ নাহ ভাইয়া। আমি এসবের কিছুই চাই না। তোমার কাছে যেমন আমি, আমার সুখ আগে তেমনই আমার কাছেও তুমি, তোমার সুখ আগে। যে পরিবার আমার ভাইয়ের জন্য ক্ষতিকর সেটা নিসন্দেহে আমার জন্যও ক্ষতিকর। আমি কখনোই চাই না ওদের ওই নোংরা পরিবারে পা রাখতে। ওরা শুধুই আমাদের দু’শ’ম’ন। আমি কখনোই এসব কিছু চাই না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আর নিহানের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। সামলে নেবো।’
ইহানের বুক থেকে যেন পাথর নেমে যায়। সে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। অতঃপর চোখ খুলে ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে বেসামাল পায়ে প্রস্থান করে।
ইহান চলে যায়। ইরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথার আভাস পায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সিক্ত গলায় বারকয়েক ঢোক গিলে। যেন চক্ষু বৃষ্টি আটকানোর প্রবল প্রচেষ্টা। যতই আটকাতে চাক চক্ষু কী আর বাঁধ মানে। অযথাই বেপরোয়া ভাবে গাল বেয়ে টুক করে মেঝেতে পড়ে। ইরা ধপ করে বসে পরে ফ্লোরে নেত্রযুগল আলগোছে বন্ধ করে নেয়।
কবে শেষ হবে এই লুকোচুরি খেলা? কবে শান্তি নামবে ধরনীর বুকে? কবে শা’স্তি পাবে অ’প’রা’ধী’র দল?
——————-
সেদিন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নিঝুম অসুস্থ থাকায় এখনো একদিনও ক্লাস এটেন্ড করতে পারে নি। এখন যেহেতু সে সুস্থ তাই ঠিক করেছে আজ কলেজে যাবে। ঠিক মতো ক্লাস এটেন্ড না করলে এক্সাম কীভাবে দিবে। ইশান আর নিঝুম তো একই ক্লাসে। তাই নিঝুম সকাল সকাল ইশানের রুমে এসে হাজির। উদ্দেশ্য ইশানের সঙ্গে ক্লাস বিষয়ক কথা বলা।
নিঝুম ইশানের ঘরের সামনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে কারণ আগের দিন যা দেখেছে। আজও যদি বাঁদর টা তার ইতিহাসিক বাঁদর ডান্স দিতে থাকে তো আজকে ওকে খুব করে জব্দ করবে। ঘটনা টা হলোই তাই। ইশান ঠিকই মিউজিক বাজিয়ে ডান্সিং করছে। নিঝুম আলগোছে দরজার আড়াল থেকে সেই দৃশ্য কিছুটা ভিডিও করে নেয়। অতঃপর দাঁত কেলাতে কেলাতে ভেতরে প্রবেশ করে। ইশান নিঝুমকে এখনো খেয়াল করে নি। হঠাৎ মিউজিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইশান থেমে যায়। পাশ ফিরে দেখে নিঝুম ঠোঁট টিপে হাসছে। ইশান কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। দৌড়ে ওয়াশরুম চলে যায়। ইশানের কান্ড দেখে নিঝুম এবার খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। অতঃপর হাসতে হাসতেই ইশানের বুকশেলফের কাছে যায়। সেখান থেকে বই নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে।
ইশান বেশ সময় নিয়ে বের হয়। মূলত সে নিঝুমের সামনে আর পড়তে চাইছে না। কিন্তু বের হয়ে এখনো নিঝুমকে তার রুমে দেখে কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হয় সে। বুঝতে পারে নিঝুমের এখানে আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ইশান এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে নিঝুমের কাছে গিয়ে বলে,
-‘বউমনি তুমি কী কিছু বলতে চাও।’
নিঝুম মাথা নাড়ে যার অর্থ হ্যাঁ। ইশান ভ্রু উচিয়ে বলে,
– ‘কী? তাহলে বলে ফেলো।’
– ‘আসলে আমি আজ থেকে নিয়মিত কলেজে যেতে চাইছি। তোমার আর আমার ক্লাস তো একই তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে যাই এ বিষয়ে আলাপ করে নেই।আমরা কী একসঙ্গে যেতে পারি।’
– ‘ওহ সিওর। এটা তো আরও ভালো হয়। তুমি রেডি হয়ে নাও একসঙ্গে বেড়চ্ছি আমরা।’
– ‘আর একটা কথা। তুমি আর আমি যেহেতু সেইম ইয়ার তখন তুমি আর আমাকে এসব বউমনি – টউমনি বলে ডেকো না।’
– ‘তবে কী বলতাম। সম্পর্কে তো তুমি আমার একমাত্র সুইট,কিউট বউমনি হও।’
– ‘তাতে কী আমরা তো একই বয়সী। তার ওপর কলেজে গিয়ে তুমি আমাকে বউমনি,বউমনি করলে ব্যাপারটা কেমন দেখায় না? আর আজকাল জেনারেশনে কেউ এতো নেম কল্ড’ এ গুরুত্ব দেয় নাকি। বন্ধুক্তই আসল।’
– ‘ হুম তা অবশ্য ঠিক। তবে আমি তোমায় কী বলে ডাকব?’
– ‘অবশ্যই নিঝুম বলে। উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস?’
– ‘সিওর।’
নিঝুম আর ইশান একে অপরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে নেয়। যার তবে বাড়িতেই নিঝুমের একটা বন্ধু হয়ে গেল।
———————-
ইরা, ইশান, নিঝুম আজ একসঙ্গে কলেজে এসেছে। ইরা নিজের মতো তার ক্লাসে চলে গেছে। ইশান ও নিঝুম একসঙ্গে এগোচ্ছে। ক্লাসে ঢুকতেই ইশানের সঙ্গে সুন্দরী মেয়েকে দেখে ইশানের জুলিয়েট গুলো সাময়িক আহত হয়। ইশান তো আগে কখনো এমন করে নি তাহলে এই মেয়ে কে? সকলেরই এক প্রশ্ন। তখন ইশান বলে নিঝুম তার বেস্ট ফ্রেন্ড। যেটা শুনে নিঝুম মনে মনে বেশ খুশি হয়। ওরা দু’জনে আজ পাশাপাশিই বসে। ইশান নিত্যদিনের মতো আজকে আর কোনো জুলিয়েট নিয়ে ছুকছুক করছে না বরং নিঝুমের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে পাশাপাশি মন দিয়ে ক্লাস করছে। নিঝুম নতুন তাই তার এই মুহুর্তে কোনো সঠিক সঙ্গ প্রয়োজন এটা ভেবেই ইশান তাকে এভাবে গাইড করছে।
আজকের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। রোদের ছিটে ফোঁটাও নেই। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে আকাশের বুক চিড়ে নেমে আসবে ঘন মেঘের বর্ষন। ইশান কিছু একটা জরুরি কাজে গেছে। ইরা আর নিঝুম নিজেরাই বাড়িতে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। নিঝুম ইরাকে আজকের সকল ঘটনা গুছিয়ে গুছিয়ে বলছে। ইরাও মিষ্টি হেসে উপভোগ করছে। তারা যখন কলেজের গেটের প্রায় কাছাকাছি ঠিক তখনই ধরনীর বুকে ঝমঝম করে বৃষ্টির আবির্ভাব। ইরা, নিঝুম মাথায় কোনো রকমে হাত দিয়ে দৌড় লাগায়। নিঝুম আগে আগেই গাড়িতে উঠে বসে কিন্তু ইরা যখনই উঠতে নেয় কেউ তার হাত খুব শক্ত করে টেনে ধরে। হঠাৎ হয়ে যাওয়া ঘটনায় ইরা ঘাবড়ে গিয়ে পেছনে তাকায়। পরক্ষণেই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখশ্রী থমকে দেয় তার দুনিয়া। সেই হাসি,সেই চোখ, সেই নেশা ধরা চাহনি। উফহ! ইরার হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়।
——————
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি