#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব-২)
————-
গাড়ি এসে থেমেছে বিরাট বড় একটি আলিশান মঞ্জিলের সম্মুখে। নিঝুমের হুঁশ ফিরে গাড়ির ব্রেকের ধাক্কায়। ভাবনা ছেদ হতেই সে সিক্ত নয়ন জোড়া হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা মুছে নিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি ভেড়ায়। তাদের গাড়িটি থামতেই পর পর কয়েকটি গাড়ি এসে পেছনে সারি বদ্ধ ভাবে জায়গা দখল করে নেয়। ওগুলোতে বর পক্ষের লোকজন আছে। নিঝুম বুঝতে পারে এটাই তার অনাকাঙ্খিত ভাবে তৈরি হওয়া শ্বশুর বাড়ি। পেছনের গাড়িগুলো থেকে একে একে সকলে বেড়িয়ে আসছে। তাদের মধ্য থেকে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে নিঝুমের কাছে আসে। ছেলেটি হাসোজ্জল মুখে দাড়িয়ে আছে আর মেয়েটি তখন নিঝুমের পানে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“এসো বউ-মনি।”
নিঝুম একটু টাসকি খায়। এ নামে প্রথম কেউ তাকে ডাকছে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। সে কী করবে,কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজেকে কেমন জানি অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে। নিঝুমকে নিশ্চুপ দেখে মেয়েটি নিজে থেকেই নিঝুমের হাত টেনে ধরে ওকে গাড়ি থেকে বাহিরে বের করে নিয়ে এলো। অতঃপর পাশের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল,
“এ হলো ইশান। আমার ছোট ভাইয়া। আর আমি হচ্ছি ইরা। আমরা কে বলতো? আমি হলাম তোমার একমাত্র ননদ আর ও হলো তোমার একমাত্র দেবর। পেয়ে গেলে পরিচয় বাকিটা ধীরে ধীরে জেনে যাবে। তাহলে এবার ভেতরে চলো আমাদের মিষ্টি বউ-মনি।”
নিঝুম হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইল ইরার পানে। ইরা ফের মিষ্টি হেসে নিঝুমের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। ওদের পেছনে পেছন সকলে আসছে। ইহান আগেই চলে গেছে ভেতরে এটা এখনো টের পায়নি নিঝুম। কী করে টের পাবে তার তো কোনো কিছুতেই মন নেই। নিজেকে একটি যান্ত্রিক রোবট ধারণা হচ্ছে তার।
গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই ওদের ওপর ফুলের বর্ষা শুরু হয়ে গেল যেন। বাগানের রাস্তা ধরে দু’পাশে সারিবদ্ধ ভাবে মেয়েরা ফুলের পাপড়িতে পরিপূর্ণ থালা হাতে দাড়িয়ে আছে। ওরা ভেতরে পা রাখতেই সেই মেয়েগুলো থালা থেকে ফুল নিয়ে ওদের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে স্বাগতম বার্তা সম্পন্ন করল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিঝুম বাড়িটার আশেপাশে চোখ বুলালো। বাড়িটির বর্তমান সাজসজ্জা খুবই মনোমুগ্ধকর। ঝলমলে মরিচবাতির সঙ্গে গোলাপ, গাঁধা ফুলের নিদারুণ কম্বিনেশন। এই মুহুর্তে চোখ ফেরানো দ্বায়। আনমনে এসব অবলোকন করতে করতে বাগানের রাস্তা পেড়িয়ে ওরা এসে পৌঁছল বাড়ির সদর দরজার সম্মুখে। নিঝুম মাথা নিচু করে আছে দাড়িয়ে আছে। তখনই ইরা তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“বউমনি এই হলো আমাদের মা মিসেস অনিলা খান। মানে তোমার শ্বাশুড়ি। ঝটপট সালাম করে নাও তো।”
নিঝুম চোখ তুলে তাকালো। দরজার ভেতরে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা হুইলচেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলার চোখে মুখে গাম্ভীর্যতার ছাপ স্পষ্ট। নিঝুম বুঝতে পারল পছন্দের পাত্রীর জায়গায় অন্য কাউকে হয়তো সে মেনে নিতে পারছে না। নিঝুম ভয়ে ভয়ে তাকে সালাম করল। অদ্ভুত ভাবে অনিলা খান নিঝুমের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“ভালো থেকো। ভালো রেখো। সংসারটাকে এক সুতোয় মালা গেঁথে রেখো কখনো ছিঁড়ে যেতে দিও না।”
নিঝুম বেশ অবাক হলো। এতো সহজে কী করে মেনে নিলো? বিষ্ময়ের রেশ কাটিয়ে নিঝুম মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। অনিলা চৌধুরী ওদের ভেতরে আসতে বলে নিজেও ভেতরে চলে গেলেন।
নিঝুমকে নিয়ে বসানো হয়েছে একেবারে ইহানের কক্ষে। কক্ষটি বর্তমানে ফুলে ফুলে সজ্জিত। সেই রয়েছে নানারকম ডেকোরেশন। খান বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা সবকিছুতেই এক্সট্রা মশলাদার আয়োজন। নিয়ম মাফিক আজ নিঝুম, ইহানের বাসর রাত। এই কক্ষে নিঝুমকে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মনের মধ্যে অসম্ভব তু’ফা’নে’র সৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছে এখনই এখান থেকে ছুট্টে পালাতে। কিন্তু উপায় নেই। লোকজনে চারদিক গমগম করছে। নিঝুমকে ঘিরে আছে অল্প বয়সী মেয়ে, বউরা। নিঝুম বিছানার মধ্যে গোল হয়ে বসে আছে। তারপাশ থেকে তার ননদ, জা-য়েরা নানা রকম হাসিঠাট্টা করছে কিন্তু তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে আতঙ্কিত হয়ে আছে সেই আগত প্র’ল’য়ে’র অপেক্ষায়। এ প্র’ল’য় যে সে প্র’ল’য় নই নিশ্চিত এই প্রলয়ে নিঝুমকে বলি দিতে হবে অনেক কিছু। হয়তো নিজের পরিবার নয়তো সম্মান। ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বাজতেই নিঝুমের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। কত-শত খাবার তার সম্মুখে উপস্থিত কিন্তু সে কিছুই খেতে পারছে না। টেনশনে গলা দিয়ে খাবার নামছে না। নিঝুমকে সকলে জোর করছে খাওয়ার জন্য কিন্তু ও কিছুতেই খেতে পারছে না। দেখা যায় এক পর্যায়ে অনিলা খান সেখানে উপস্থিত হন। তিনি সকলকে ঘরটা ফাঁকা করে দিতে বলেন। সকলে চলে যায় শুধু ইরা থাকে। তিনি ইশারায় ইরাকেও চলে যেতে বলেন। ইরাও চলে যায়। এখন শুধু নিঝুম আর তিনি আছেন। নিঝুম সো মাচ নার্ভাস। মৃদু কাঁপছে তার অন্তর। সে দু’হাতে আঙুল কচলাতে ব্যস্ত। অনিলা খান ওকে একবার পর্যবেক্ষণ করে হুইলচেয়ারটি টেনে নিয়ে একদম ওর কাছে চলে আসলেন। অতঃপর খাবারের প্লেটটি হাতে নিয়ে খাবার মাখতে মাখতে বললেন,
” তোমার কষ্ট টা বুঝতে পারছি। আমিও একজন মেয়ে এমন একটি দিন আমার জীবনেও এসেছিল। শুধু পার্থক্য একটাই আমার বিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি ছিল কিন্তু তোমার টা হলো অনাকাঙ্খিত ভাবে। জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর হাতে। সময় হলে এই তিনটি জিনিস হবেই। কিন্তু কীভাবে হবে সেটা তিনি ছাড়া কারোরই জানা নেই। তার ইচ্ছে হয়েছে তিনি তোমার বিয়েটা এভাবে লিখেছেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে তার বড় কোনো উদ্দেশ্যে আছে। এখন কথা হচ্ছে তোমার পরিবার নিয়ে। তুমি কোন পরিবারের, কোথা থেকে এসেছো, কোথায় থাকো এসবের কিছুই আমার জানা নেই। তবে আমি চেষ্টা করবো তোমার পরিবারকে ম্যানেজ করার বাকিটা আল্লাহ ভরসা। মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়। জানি তোমার হয়তো অনেক স্বপ্ন ছিল নিজের জীবন নিয়ে। আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমার সব স্বপ্ন নিজ দ্বায়িত্বে পূরণ করবো। বাকি রইল আমার ছেলে ও একটু ব’দ’মে’জা’জী কিন্তু মনটা ভীষণ ভালো। ধীরে ধীরে সব বুঝে যাবে। আমি একজন মা। আমি চাইলেই পারতাম এই বিয়েটা অস্বীকার করতে কিন্তু না আমি সেটা করিনি। কেন জানো? এই সমাজে একবার বিয়ে হয়ে গেলে সেই নারীর শ্বশুর বাড়িটিই তার আসল পরিচয় বহন করে। যদি কোনো কারণে এই পরিচয় থেকে মেয়েটিকে বিতারিত হতে হয় তখন এই নোং’রা সমাজ তাকে ছেড়ে কথা বলে না। তার ললাটে লিপে দেয় অলক্ষীর নামক তকমা। আমি চাই নি তুমি সে সকল পরিস্থিতির স্বীকার হও। এখন তুমিই ঠিক করে নাও তুমি কী করতে চাও। মুক্তি চাও নাকি সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাও। ডিসিশন এখনই চাইছি না তুমি ভাবো, সারারাত ভাবো, কাল আমাকে উত্তর টা দিও। এখন মুখটা খোলো তো ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।”
নিঝুম হতবাক। চক্ষে জল টলমল। এত সুন্দর করে কেউ ওকে এর আগে কখনো কোনো কিছুতে বোঝায় নি। সকলে শুধু ধমকে,শাসন করে এসেছে। ভালবাসেনি তা নয় ভালোবাসাতেও কেমন জানি দাম্ভির্য্য লুকিয়ে ছিল। নিঝুমকে চুপ থাকতে দেখে অনিলা খান ওর মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে বললেন,
“উহুম কান্না নয় এখন থেকে শুধু আনন্দ। এই মায়ের কাছে তুমি ভীষণ ভালো থাকবে। কথা দিলাম।”
নিঝুম চোখ মুছে কিঞ্চিৎ হেসে খাবার মুখে তুলে নিলো। অনিলা খান মনে মনে প্রশান্তির হাসি হাসলেন। অতঃপর পুরোটা খাবার তিনি নিঝুমকে খাইয়ে দিয়ে হুইলচেয়ার টেনে টেনে চলে যেতে লাগলেন। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে থাকল অপলক। এই মানুষটিকে নিঝুমের ভীষণ পছন্দ হলো। মনে মনে মায়ের স্থানে বসিয়ে নিলো। অনিলা খান দরজা অব্দি দিয়ে আবার কাঁধ বাকিয়ে নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“একটা কথা বলা হয়নি, তুমি কিন্তু ভীষণ মিষ্টি। আমার তোমাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। আমার পছন্দ করা পাত্রীর থেকেও বেটার।”
অতঃপর তিনি হুইলচেয়ার টেনে চলে গেলেন। নিঝুম ফের হতভম্ব হয়ে বসে রইল। সত্যিই এতটা আশা করে নি সে। সবকিছুই একটু এক্সট্রা পাচ্ছে যেন।
এ কক্ষে আর কারো প্রবেশ নিষেধ করে দেয় অনিলা খান। নিঝুম একা একা বেশ বোরিং ফিল করছে। সেই সঙ্গে বাড়ির জন্য টেনশনও বাড়ছে। কী হচ্ছে এখন ওখানে কে জানে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সকলে জানতে পেরে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। মায়ের ওপর কী ঝ’ড়’টাই না আসতে চলেছে এটা ভেবে শিউরে ওঠে নিঝুম। ততক্ষণাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়। নিঝুম চমকে ওঠে। দরজা সামনে ইহান দাড়িয়ে। তার দৃষ্টি শান্ত। ইহান দরজা লক করে দিয়ে এক পা এক পা করে এগোতে থাকে। নিঝুম শুকনো ডোক গিলে। দু-হাতে শক্ত করে বিছানার চাদর খামচে ধরে।
———————-
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি