কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১
লেখা :সাবিকুন নাহার নিপা
আজ তানির বিয়ে হবার কথা ছিলো। আড়ম্বরহীন বিয়ে। বরপক্ষের কয়েকজন লোক আসবে, বিয়ে পড়িয়ে খেয়েদেয়ে চলে যাবে। সেইমত সব আয়োজন করা হয়েছিল। তানির বাবা ফরহাদ সাহেব ত্রিশ জন মানুষের খাবারের আয়োজন করেছেন। এই পাড়ায় তার বেশ মান্যিগন্যি আছে ভালো ই। তবুও বেছে বেছে লোক দাওয়াত করেছে। সবাই এলেও বরপক্ষের কেউ আসেনি। তাদের আসার কথা ছিলো সকালে। ঢাকা থেকে আসবেন। বিয়ে হবার পর আবারও ফিরতি গাড়িতে রওনা হবেন। কিন্তু কারও টিকিটিও দেখা যায় নি।
ফরহাদ সাহেব হিসেবি মানুষ। তার জন্য এটা অনেক বড় লোকসান। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই ঘটনা আজ নতুন নয়। এর আগেও দু’বার তানির বিয়ে ভেঙেছে। তবুও তিনি আশায় ছিলেন এবারের বিয়েটা হবে। ছেলের মা নিজে এসে তানিকে আংটি পরিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি গতকাল রাতেও কথা হয়েছে কিন্তু আজ ফোনে পর্যন্ত পাচ্ছেন না।
রাগে ফরহাদ সাহেবের মাথা কাজ করছে না। ইচ্ছে হচ্ছে মেয়ের গলা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। মেয়ের কেলেঙ্কারির জন্য এসব হচ্ছে। তানির এটা দ্বিতীয় বিয়ে। এর আগে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু টিকতে না পেরে আবার ফিরেও এসেছে। ফরহাদ সাহেব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন কিন্তু তিনি একবারও ভাবেন নি যে তানির এই একটা ভুল তাদের সকলের ঘুম হারাম করে দেবে। তানি ছাড়াও ফরহাদ সাহেবের আরও দুটি মেয়ে আছে। অ্যানি আর মনি। অ্যানির বিয়েটা আটকে আছে তানির জন্য। এদিকে মনিরও বিয়ের বয়স হতে চলেছে। তাই জরুরী ভিত্তিতে তানির বিয়েটা দেয়া জরুরী ছিলো। ফরহাদ সাহেব এতোকাল পাত্র খুঁজেছেন বয়স্ক, বৌ মারা গেছে এমন কিন্তু সেসব পাত্রও শেষ পর্যন্ত তানিকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। এর একটা কারণ হলো তানি সুন্দরী। সুন্দরী মেয়ে তার উপর প্রথম বিয়ে ভেঙেছে তাই সকলের ই ধারণা এসব মেয়ে সংসার করার মতো না। আবার আরেকদল ভাবে এসব মেয়েদের জন্ম হয়েছে অ্যাকুরিয়ামে থাকার জন্য, রান্নাঘরের হাতা খুন্তি এদের জন্য নয়। তবুও শেষমেস ভালো পাত্র পাওয়া গেছিলো। পাত্র একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির টিচার। তার বউ মারা গেছে। সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির ছেলে। পাত্রের মা তানিকে দেখেছে রাস্তায়। তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল তখন তানি তাকে সাহায্য করেছে। ভদ্রমহিলা নিজে এসে নতমস্তকে মেয়েটাকে ছেলের জন্য চেয়েছেন। ফরহাদ সাহেব ও খুশিমনে মেনে নিয়েছেন। এর আগে যেখানে বিয়ে হয়েছিল সেখানকার ছেলেটাও ভালো ছিলো। বয়স অল্প, বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী ছেলে কিন্তু তানি সেখানে সংসার করতে পারেনি। তার জন্য তিনি অনেক অপদস্ত হয়েছেন কিন্তু মেয়েকে ফেলতে পারেনি। কারণ তানির মা তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে তানিকে স্নেহ করেন বেশী। সেই অপত্য স্নেহের কাছে ফরহাদ সাহেব কেও হার মেনে নিতে হয়েছে।
*****
“আম্মা শুনেন, রোজ রোজ এইসব বিয়ের নাটক করে টাকা পয়সা খুইয়ে কোনো লাভ নাই। ওই মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না”।
তাসলিমা বেগম শুকনো গলায় বলল, তানি কই আছে এখন?
সাবিনা রুক্ষ গলায় বলল, কই আর থাকবে? ছাদে যাইয়া বইসা আছে।
“সাজগোজ ধুইয়া ফালাইছে?”
“হ্যাঁ। খালি খালি দুইটা হাজার টাকা পানিতে গেল। আপনাগো টাকা বেশী হইছে তা বোঝা যাইতেছে”।
তাসলিমা ছেলের বউকে কিছু বললেন না। মেয়েটার কাছে যাওয়া দরকার কিন্তু শরীরে কুলোচ্ছে না। কাল রাত থেকে রান্নাবান্নার যোগাড় যন্ত থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা কাজ করে গেছেন। তার উপর আসর হয়ে গেল কিন্তু বরপক্ষের খবর নেই।
মেয়েটার কপাল টা এতো খারাপ কেন সেটা ভেবেই তাসলিমার রাতে ঘুম হয় না। অথচ তার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আর শান্ত শিষ্ট এটি। অথচ তার কপালেই ভোগান্তি লেগে থাকে। প্রথম বার বিয়ে হলো ইউনিভার্সিটি তে পড়া অবস্থায়। সে বিয়ে টিকলো না। আর এখন বিয়ে ঠিক হবার পরও কোনো না কোনো বাহানায় বিয়ে ভেঙে যায়। তাসলিমা উঠে দাঁড়ালো। মেয়ের আজ দুঃখের দিন। এই দিনে তার পাশে থাকা অবশ্যই দরকার। এখন ছাদে গিয়ে মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন। তবে যদি মেয়েটা একটু হালকা হয়।
———————— ————————
তানি বসে আছে ছাদের এক কোনে। বাড়িতে এখন এটাই সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গা। একটু আগে হিম শীতল পানিতে গোসল করায় একটু শীত শীত লাগছে। তানি হাতের মেহেদীর রঙ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মেহেদীর রঙ ফুটে ওঠায় তানির খালা বলেছিল, জামাই সোহাগি হবি তুই। অথচ তানির বিয়েটাই আজ হলো না। এই বিয়ে নিয়ে তানির অনেক আশা ছিলো। যে মহিলা তানির শাশুড়ী হবে তাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছিল। এই মহিলা মাত্র এক দেখায় ই সবকিছু জেনেশুনে বলেছিল, আমার ছেলের বউ হবি মা? তোরে মাথায় করে রাখব। তানি মুগ্ধ হয়েছে ভদ্রমহিলার কথায়। নিজের মুখে কিছু না বললেও পরিবারের সম্মতিতে আপত্তি করে নি। তবে ইচ্ছে ছিলো হবু বরের সাথে একবার দেখা করে নিজের ব্যাপারে কথা বলবে। কিন্তু ভদ্রলোক দেখা করতে চাইলেন না। মায়ের পছন্দ ই নাকি তার পছন্দ।
তানির মনে হয়েছে ভদ্রলোকের আসলে বিয়েতে মত ছিলো না। মা’কে খুশি করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বিয়েটা করবে না সেটা জানিয়ে দেয়া ভালো ছিলো। এতে করে সবার ই সুবিধা হতো । তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর একটুও কান্না পাচ্ছে না। বিয়ে শব্দটা বরং ওর কাছে একটা আতংক। যে বিবাহিত জীবন একবার দেখে এসেছে তারপর বিয়ে করার ইচ্ছে মরে গেছে।
“এই তানি আপা কই তুই শিগগিরই নিচে আয়। বর আসছে।”
ছোট বোনের কথা শুনে তানির নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। কী বলছে! বর আসলো অথচ ও গাড়ির শব্দ পেল না!
তানি হেলেদুলে নিচে নামতে লাগলো। হাত, পা অনবরত কাঁপছে। তাসলিমা মেয়েকে দেখতেই বলল, ক্যান যে সাজগোজ ধুইয়া ফেললি! এখন জামাইর সামনে ক্যামনে যাবি।
সাবিনা চাপা গলায় বলল, আম্মা জামাই তো এখনই তানির সাথে দেখা করতে চায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় তানি হকচকিয়ে গেল। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটছে যে তানির বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেল। হবু বরের সামনে গেল উল্টো জামা পড়ে। বেখায়েলে যে তখন উল্টো জামা পরেছে সেটা তখন কেউ খেয়াল করে নি।
***
“তানি আমিই আহনাফ শুভ্র। আমার সাথেই আজ আপনার বিয়ে হবে “।
তানি মাথা নাড়লো।
“তানি আপনি কিছু মনে করবেন না। আসলে আমরা পথে একটা বড় দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সব খুইয়েছি তাই কোনোভাবে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। আপনি প্লিজ এর জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন। ”
তানির কানে কিছুই ঢুকলো না। সে বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। এই তো সেই লোক যাকে দেখে জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছিল। লাভ এট ফার্স্ট সাইট।
তানিকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্র বলল, তানি আপনি কী ক্ষমা করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে প্লিজ কিছু খাবার ব্যবস্থা করুন। নাহলে অভুক্ত অবস্থায় যাকে সামনে পাব তাকেই খেতে ইচ্ছে করবে।
চলবে……
(পুরোটা অনলাইনে শেষ করব ইনশাআল্লাহ)